পুষ্টিগুণে ভরপুর পদ্মের বীজ মাখানা! জেনে নিন উপকারিতা ও রেসিপি

পুষ্টিগুণে ভরপুর পদ্মের বীজ মাখানা! জেনে নিন উপকারিতা ও রেসিপি

দিশারি তার ছোট্ট অন্তুকে নিয়ে গতকাল শপিং মলে গিয়েছিল। অন্তুর বয়স এখন ১১ মাস। শপিং মলে যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল ওর বেবিফুড কেনা। বেবিফুডের সেকশন থেকে খাবারগুলো ট্রলিতে নিতে নিতেই ওর চোখে পড়ল কতগুলো বাক্স। বাক্সের মধ্যে শোলার বলের মতো কতগুলো জিনিস রাখা। পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা শপিং অ্যাসিস্ট্যান্টকে জিজ্ঞেস করতে ছেলেটি বলল এটির নাম মাখানা, পদ্মফুলের বীজ! (Makhana (Lotus Seeds) for Babies, Benefits & Recipes)

বাচ্চাদের খাবার হিসেবে এটি বেশ জনপ্রিয়। দিশারি ইতিপূর্বে এই জিনিসটা দেখেনি। তাই এক বাক্স কিনেই নিল। এটা অন্তুকে খাওয়ানো যায় কি না তা জানতে যোগাযোগ করল চিকিৎসকের সঙ্গে। নতুন কিছু খাওয়ানোর আগে দিশারি সবসময় ওঁর পরামর্শ নেয়। মাখানার কথা বলতেই চিকিৎসক বললেন, ওটা বাচ্চাদের জন্য খুবই ভালো খাবার (Bacchader Pustikor Khabar)। অন্তু যেহেতু ছয় মাস বয়স পেরিয়ে গিয়েছে, তাই ওকে নিশ্চিন্তে খাওয়ানো যেতে পারে।

খুদে অন্তু এখনও ভালো করে চিবোতে পারে না। মাখানা ওর জন্য উপকারী হলেও কী ভাবে এটা খাওয়ানো যায়, সে সম্পর্কে কিছুই জানতো না দিশারি। চিকিৎসককে এই নিয়ে জিজ্ঞেস করতে তিনি কয়েকটি  সুস্বাদু রেসিপি (Shishur Khabar Recipe) বলে দিলেন।

 

খুদে স্পেশাল মাখানা রেসিপি (Makhana Recipes for Babies)

 

#1. মাখানা পোরিজ (Makhana Porridge): শুকনো খাবারের তুলনায় জলীয় খাবার বাচ্চাদের জন্য বেশি ভালো। কারণ এটি শরীরে জলের ভারসাম্য ঠিক রাখতে সাহায্য করে।
খুদের পোরিজ রান্নার (Phool Makhana Porridge for Babies) জন্য প্রয়োজন কয়েকটি অর্ধেক করে কেটে রাখা মাখানা, এক চামচ ঘি আর অল্প চিনি। প্রথমে কড়াইতে ঘি দিয়ে কেটে রাখা মাখানাগুলো অল্প ভেজে নিন। মাখানাগুলো সোনালি রঙের হয়ে এলে জল ঢেলে দিন। মাখানা নরম হওয়া পর্যন্ত সময় দিন। নরম হয়ে এলে মিশ্রণটি মিক্সারে ঢেলে মিহি করে পেস্ট করে নিন। খুদেকে দুপুরে বা বিকেলে এই পোরিজ পরিবেশন করুন।

 

#2. মাখানা পাউডার (Makhana Powder): মাখানা পাউডার সিরিয়াল পাউডারের মতোই উৎকৃষ্ট বেবিফুড।
এক্ষেত্রে মাখানাগুলো প্রথমে অর্ধেক আকারে কেটে নিন। এছাড়া উপকরণ হিসেবে লাগবে কয়েকটি কাজুবাদাম। প্রথমে মাখানাগুলো কড়াই বা প্যানে রোস্ট করে নিন। মুচমুচে (Crispy) হওয়া পর্যন্ত রোস্ট করতে হবে। একইভাবে কাজুবাদামও রোস্ট করে নিতে হবে। এরপর দু’টিকে একসঙ্গে মিক্সারে ঢেলে মিহি করে নিলেই তৈরি মাখানা পাউডার। এই পাউডারটি একটি ছাঁকনিতে ভালো করে ছেঁকে নিন, যাতে কোনও দলা না-থাকে। নয়তো শিশুর গলায় আটকে যেতে পারে।

 

#3. মাখানার মিষ্টি (Sweet Makhana): ছোট্ট সোনার দাঁত গজালে তবেই এই খাবার তাকে দিন। এটি একবার রান্না করে মুখবন্ধ জারে স্টোর করতে পারেন। ওর মুখরোচক কিছু খেতে ইচ্ছে করলে ওকে দিন।
প্রয়োজনীয় উপকরণগুলো হল এক কাপ গোটা মাখানা, এক চামচ ঘি, গুঁড়ো করা আখের গুড়। প্রথম কড়াইতে ঘি দিয়ে মাখানাগুলো ভালো করে রোস্ট করে নিন। রোস্ট হওয়ার পর সহজেই ওগুলো আঙুল দিয়ে ভাঙা যায়। এরপর আলাদা প্যানে আখের গুড় সামান্য জল মিশিয়ে ফোটান। ফুটতে শুরু করলেই আগুন নিভিয়ে মাখানাগুলো মিশ্রণে দিয়ে ভালো করে নেড়ে নিতে হবে। এরপর বাচ্চার প্লেটে সাজিয়ে দিন মিষ্টি মিষ্টি মাখানা (Baby Food Recipes)।

 

#4. মাখানার ক্ষীর (Makhana Kheer): মাখানার ক্ষীর খেতে খুবই সুস্বাদু আর বাচ্চাদেরও প্রিয়।
এর প্রয়োজনীয় উপকরণগুলো হল এক কাপ কেটে রাখা মাখানা, চার-পাঁচটা কাজু, এক কাপ দুধ, দুই চামচ আখের গুড় আর এক চামচ ঘি। কড়াইতে প্রথমে মাখানাগুলো ভালো করে রোস্ট করে নিন। অর্ধেক পরিমাণ কাজুবাদাম একইভাবে রোস্ট করুন। এবারে অর্ধেক পরিমাণ রোস্টেড মাখানা ও রোস্ট করা কাজুবাদাম মিক্সারে মিহি করে পাউডার করে নিন। এরপর কড়াইয়ে ঘি দিয়ে বাকি কাজুগুলো ভেজে নিন।

এই সময় পাশে একটি কড়াইতে হালকা আঁচে দুধ গরম করতে বসিয়ে দিন।‌ অল্প গরম হলে ওতে মিশিয়ে দিন আখের গুড়। দশ মিনিট গরম করার পর দুধের পরিমাণটা কমে আসবে। তখন এতে অল্প অল্প করে মাখানা ও কাজুবাদামের পাউডার মেশান। খেয়াল রাখুন যাতে কোনও দলা না তৈরি হয়‌‌। এরপর রোস্টেড মাখানা ও কাজুগুলো ঢেলে অল্প নেড়ে নিন‌। বিকেলে বা রাতে খুদের প্লেটে পরিবেশন করুন মাখানার ক্ষীর।
খাবারের পুষ্টিগুণ নিয়ে সব মায়েরাই চিন্তায় থাকেন। সন্তানকে যা দেওয়া হচ্ছে তাতে শুধু পেট ভরলে হবে না, বরং পুষ্টিগুণও থাকা চাই। বিশেষজ্ঞদের কথায়, মাখানায় থাকা পুষ্টিদ্রব্য শিশুর বিকাশের জন্য অত্যন্ত কার্যকরী।

 

আরও পড়ুন: প্যাকেটজাত আর নয়, ১-৩ বছরের খুদের জন্য বাড়িতেই বানিয়ে ফেলুন পুষ্টিকর, সুস্বাদু মুসলি!

 

মাখানা বা পদ্মবীজের পুষ্টিগুণ (Health Benefits Of Makhanas)

 

  • ফাইবার-সমৃদ্ধ: একশো গ্ৰাম মাখানায় থাকে ৭.৫ গ্ৰাম ফাইবার (Fiber Rich)। ফাইবারে সমৃদ্ধ খাবার হওয়ায় এটি শিশুদের পেট অনেকটা সময়ের জন্য ভর্তি রাখে। তা ছাড়া খাবার হজম করতে ফাইবার সাহায্য করে। এতে বাচ্চার কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যাও কমে যায়।

 

  • প্রোটিন-সমৃদ্ধ: প্রোটিন শিশুর শরীরের কোষ গঠন, হরমোন উৎপাদন ও বৃদ্ধিতে মুখ্য ভূমিকা নেয়। ১০০ গ্রাম মাখানায় থাকে প্রায় দশ গ্রাম প্রোটিন (Protein Rich)। বিশেষজ্ঞরা সে কারণেই একে শিশুর উপযোগী খাবার মনে করেন‌।

 

  • ক্যালসিয়াম-সমৃদ্ধ: ছোট্ট সোনার শরীরের হাড়, দাঁত ইত্যাদি মজবুত করতে ক্যালসিয়ামই ভরসা। বিশেষজ্ঞদের মতে, ১০০ গ্ৰাম মাখানায় রয়েছে ৬০ মিলিগ্ৰাম ক্যালসিয়াম (Calcium Rich)। যা শিশুদের জন্য একদম আদর্শ (Benefits of Makhana for Babies)।

 

  • কার্বোহাইড্রেটে ভরপুর: খুদে হাঁটতে চলতে শেখার পর তার দুষ্টুমির অন্ত থাকে না। তার এই অফুরান দুষ্টুমির জন্য ভরপুর এনার্জির প্রয়োজন। মাখানায় থাকা কার্বোহাইড্রেট সেই এনার্জিই দেয় খুদেকে (Carbohydrate Rich)। ১০০ গ্ৰাম মাখানায় থাকা ৭৭ গ্ৰাম কার্বোহাইড্রেট শিশুর দুষ্টুমির জন্য যথেষ্ট পরিমাণে এনার্জি জোগায়।

 

  • অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট: শিশুদেরও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট প্রয়োজন। মাখানা অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের সমৃদ্ধ উৎস। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট (Antioxidant) শিশুর শরীরকে টক্সিন মুক্ত রাখে । পাশাপাশি ভয়ানক রোগের সঙ্গে ভবিষ্যতে লড়াই করার শক্তি জোগায়।

 

  • গ্লুটেন-মুক্ত: অনেক সময়ই দেখা যায় কোনও নির্দিষ্ট খাবার খাওয়ার ফলে বাচ্চার অ্যালার্জি হয়ে গিয়েছে। এই কারণে নতুন খাবার নিয়ে মায়েরা ভয়ে থাকেন‌। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাখানা সম্পূর্ণ গ্লুটেন-মুক্ত খাবার (Gluten Free)। আর অ্যালার্জি মূলত গ্লুটেন রয়েছে এমন খাবার থেকেই হয়। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে অ্যালার্জির আশঙ্কা থেকে মায়েরা মুক্ত।

 

  • সুস্থ কিডনি: কিডনি সুস্থ না-থাকলে বাচ্চার অনেকরকম সমস্যাই হতে পারে। কিডনি সুস্থ রাখতে প্রয়োজন পটাশিয়াম, ফসফরাস ও সোডিয়ামের মতো যৌগ। ১০০ গ্ৰাম মাখানায় রয়েছে ৫০০ মিলিগ্ৰাম পটাশিয়াম, ৯০ মিলিগ্ৰাম ফসফরাস ও প্রায় ২০০ গ্ৰাম সোডিয়াম (Makhana Benefits)। সঠিক পরিমাণে এই যৌগগুলো উপস্থিত থাকায় মাখানা খুদের কিডনিকে সুস্থ রাখে।

 

মাখানার উপকারিতা ও রেসিপি সম্পর্কে তো জানা গেল। তবে এসবের পাশাপাশি মায়েদের মনে রাখতে হবে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা। প্রত্যেক বিশেষজ্ঞই মাখানা খাওয়ানোর আগে এগুলো মায়েদের মনে করিয়ে দেন।

 

বাচ্চাকে খাওয়ানোর আগে মাথায় রাখুন ক’টি কথা (Things to Keep in Mind)

 

  • পাউডারই ভালো: এক বছরের কমবয়সি বাচ্চাদের সব ক’টি দাঁত থাকে না। তাই গোটা বা অর্ধেক মাখানা কখনওই তাদের দেওয়া উচিত নয়। এতে গলায় আটকে বড়সড় বিপদ হতে পারে। বরং দাঁত না-হওয়া পর্যন্ত, ও ঠিক মতো চিবোতে না-শেখা পর্যন্ত মাখানার পাউডার বা পরিজই ওর জন্য উপযুক্ত।

 

  • পোকা আছে কি না দেখে নিন: মাখানা পদ্মের বীজ হওয়ায় অনেক সময় এর ভিতরে পোকা থাকে। তাই মাখানা কাটার পর ভালো করে দেখে নিন ভিতরে পোকা রয়েছে কি না। রান্নার আগে মাখানা ভালো করে পরিষ্কার করে নিন।

 

  • চিকিৎসকের পরামর্শ নিন: ছ’মাস বয়সের আগে মাখানা শিশুর জন্য উপযুক্ত কি না তা নিয়ে পরামর্শ নিন চিকিৎসকের। তিনি আশ্বাস দিলে তবেই ওকে মাখানা খাওয়ান।

 

  • ঘি ও চিনি: মাখানার কয়েকটি রেসিপিতে ঘি ও চিনি ব্যবহার রয়েছে। তবে শিশুর স্বাস্থ্যের কথা ভেবে অনেক চিকিৎসক এগুলো এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেন। আপনার শিশুর ক্ষেত্রে কী করা উচিত, সে বিষয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে ভুলবেন না।

অন্তুর দ্বিতীয় জন্মদিন আসছে‌। একবছর আগে দিশারি ওকে মাখানা খাওয়ানো শুরু করে (Healthy Baby Food)। আর তারপর থেকে ওটাই ওর ফেভারিট খাবার। মাখানার পুষ্টিগুণে ওর বাড়বৃদ্ধি দেখে দিশারি নিশ্চিন্ত। মাঝে মাঝে ছেলে যখন মাকেও এক-আধটা মাখানা খাইয়ে দেয়, তখন দু’জনের আনন্দ দেখার মতো। (Makhana (Lotus Seeds) for Babies, Benefits & Recipes)

 

আরও পড়ুন: সেরেলাক না-পসন্দ? খুদেকে তবে বানিয়ে দিন ওরই মন-পসন্দ খাবার। রেসিপি থাকল এখানে!

 

একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার  হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

null

null