কোন বয়স থেকে জল খেতে পারবে ছোট্ট সোনা? বয়স ভেদে পরিমাণই বা কতটা?

কোন বয়স থেকে জল খেতে পারবে ছোট্ট সোনা? বয়স ভেদে পরিমাণই বা কতটা?

অয়ন এইমাত্র অফিস থেকে ফিরল। ওর দু’মাসের ছেলে চিকুর তখন দুধ খাওয়া শেষ। অঙ্কিতা চিকুর জামা ঠিক করে দিচ্ছিল। অয়ন তা দেখে বলল, ‘কি গো চিকুকে জল খাওয়াবে না?’। তার কথা শুনে অঙ্কিতার তো চোখ বড় বড়। ‘কী বলছো! ছয় মাসের আগে চিকুর জল খাওয়া একদম নিষেধ’। (Guidelines for Offering Water to Babies)

অঙ্কিতার মনে থাকলেও কথাটা অয়নের একদম মাথায় ছিল না। অঙ্কিতা মনে করানোতে ওর একে একে সবই মনে পড়ল।‌ জল খাওয়ানোর ব্যাপারে দেড় মাস আগে চিকিৎসক একটা লম্বা তালিকা করে দিয়েছিলেন। তাতেই লেখা ছিল, শিশুকে কখন জল খাওয়ানো যায় (When can babies drink water?), কখন খাওয়ানো উচিত নয়, আবার জল খেলে ছোট্ট সোনার কী কী সমস্যা হতে পারে তাও বলে দিয়েছিলেন।

 

#1. ছয় মাসের আগে জল নয় (Don’t give water before six months): জন্মের পর থেকে মায়ের দুধই শিশুর জন্য আদর্শ। চিকিৎসকরা বলেন, এই সময় শিশুর জন্য দুধের কোনও বিকল্প নেই। দুধই শিশুর প্রয়োজনীয় পুষ্টির জোগান দেয়। তাই ছ’মাস বয়স না-হলে ছোট্ট সোনাকে জলও খাওয়ানো উচিত নয় (Why Babies Shouldn’t Drink Water Before 6 Months)।

  • খিদে নেই: ছ’মাসের কম বয়সি শিশুকে জল খাওয়ালে ওর খিদেই মরে (lost appetite) যেতে পারে। জল ছোট্ট সোনার পেট ভরিয়ে দেয়। তখন ও মায়ের দুধ খাওয়ার জন্য আর বায়না করে না। দুধ না-খেলে শিশুর শরীরে প্রয়োজনীয় পুষ্টিদ্রব্য ঢুকবেই না। তাই চিকিৎসকেরা জল খাওয়াতে নিষেধ করেন।

 

  • কিডনির সমস্যা: কিডনির কাজ শরীরের বর্জ্য পদার্থ ছেঁকে বার করে দেওয়া। শরীরে জলের পরিমাণ বাড়লে কিডনির কাজও বেড়ে যায়। ছোট্ট সোনার কিডনি (kidney malfunction) এত চাপ সহ্য করতে পারে না। ফলে কিডনিতে থাকা ইলেক্ট্রোলাইট শরীর থেকে বেরিয়ে যায়। যা থেকে ওর গুরুতর অসুখ হতে পারে।

 

  • ওয়াটার ইনটক্সিকেশন: জল শরীরের সোডিয়ামের ঘনত্বে হেরফের ঘটায়। বেশি পরিমাণ জল ছোট্ট সোনার ইলেক্ট্রোলাইটের (water intoxication) ভারসাম্য নষ্ট করে দিতে পারে। এর ফলে ওর খিঁচুনির মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে।

 

  • পুষ্টির অভাব: ছ’মাস না-হওয়ার আগেই জল খাওয়ালে ছোট্ট সোনার পুষ্টিতে ঘাটতি হতে পারে (nutrition lack)। দুধ নিজেই জলীয় খাবার। তার উপর শিশু যদি জল খায়, তা হলে দুধ থেকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি শুষে নেওয়ার মতো ক্ষমতা শরীরের আর থাকে না। এতে ওর বৃদ্ধির হার কমে যেতে পারে।

 

  • গরমেও দুধ: গরমকালে রোদের প্রচণ্ড তাপ। এই সময় ছোট্ট সোনার শরীরে কষ্ট হচ্ছে ভেবে জল খাওয়ানো কিন্তু ঠিক নয়। এক্ষেত্রেও ওর জন্য দুধই আদর্শ বলে মনে করেন শিশুস্বাস্থ্য-বিশেষজ্ঞরা।

 

আরও পড়ুন: সময় বিশেষে ব্রেস্ট মিল্ক ও ফর্মুলার যুগলবন্দীতেই বাচ্চার সম্পূর্ণ পুষ্টি 

 

#2. বিভিন্ন বয়সে জলের প্রয়োজন কেমন (Requirement of water at different ages)

ছ’মাস বয়সে পেরোলে ছোট্ট সোনাকে সাধারণ খাবার-দাবারের সঙ্গে পরিচয় করানো যেতে পারে। চিকিৎসকদের পরামর্শ, এই সময় সাধারণ খাবারের সঙ্গে ওকে জলও খাওয়ানো শুরু করুন (When Can My Baby Start Drinking Water?)। তবে জলের পরিমাণ নিয়ে সতর্ক থাকতে হবে। বয়স অনুযায়ী ছোট্ট শরীরটার জলের প্রয়োজন বিভিন্ন রকম (When Can Babies Start Drinking Water & How Much to Feed)। কোন বয়সে কতটা জল খাওয়াবেন, সে নিয়ে চিকিৎসকদের পরামর্শ জেনে নেওয়া জরুরি।

  • ছয় থেকে বারো মাস: ছ’মাস কেটে যাওয়ার পর তরল খাবারের সঙ্গে ওর পরিচয় শুরু হোক। এই সময় ওর দুধ খাওয়ার পরিমাণ কমে যাবে। সেই জায়গা পূরণ করবে তরল খাবার আর জল। এই বয়সে শিশুর প্রতিদিন ৬০ থেকে ১০০ এমএল (Quantity of Water for 6 Month Baby) জল পান করা উচিত। এই জলই খাবার হজমে সাহায্য করবে। তবে তরল খাবারে কতটা জল মেশানো হচ্ছে, সেদিকেও নজর রাখুন।

 

  • বারোর কোঠা পেরোলে: বারোর কোঠা পেরোলে এক এক করে ওর সব দুষ্টুমি শুরু। ফলে এই সময় দৌড়ঝাঁপ শুরু হবে। তাই ১২ মাস বয়স হয়ে গেলে শরীরে জলের প্রয়োজন বেড়ে যায়। দুধ খাওয়ার পরিমাণও এই সময় অনেকটা কমে যায়। এই ঘাটতি মেটাতেই চিকিৎসকরা শিশুকে দিনে ৫০০ এমএল (How Much Water Can a 12 Month Old Drink) মতো জল খাওয়ানোর পরামর্শ দেন।
    গরমকাল হলে এই জলের পরিমাণ ওর চাহিদা মতো বাড়তে পারে। জলই ওদের শরীরকে হাইড্রেটেড রাখে আর খাবার হজমে সাহায্য করে।

 

#3. ছোট্ট শরীর হাইড্রেটেড রাখার উপায় (Tips to Keep Baby Hydrated): শিশু নিজের প্রয়োজন সব সময় বুঝতে পারে না। ওকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি জোগানোর পাশাপাশি শরীর হাইড্রেটেড রাখাও মায়ের কাছে চ্যালেঞ্জ।

  • অল্প অল্প কিন্তু বারে বারে: অল্প অল্প করে কিন্তু বারে বারে জল খাওয়ানোর পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা। একবারে অনেকটা জল খেয়ে নিলে পেট ভার হয়ে যায়। ওর অন্য খাবার খাওয়ার ইচ্ছেও চলে যায়। অল্প অল্প করে খেলে, পেট ভার হয় না আবার ছোট্ট কিডনিতেও অত্যাধিক চাপ পড়ে না।

 

  • আবহাওয়ার খেয়াল রাখুন: আবহাওয়া অনুযায়ী শিশুর জলের চাহিদা বাড়ে-কমে। তাই কখন কতটা জল খাওয়ানো প্রয়োজন, সে বিষয়ে সতর্ক থাকুন। অনেক সময় ও নিজেই জলের দিকে এগিয়ে যায়। বাধা না-দিয়ে ওকে উৎসাহ দিন। গরমকালে কতটা জল খাওয়ানো উচিত, সে নিয়ে কথা বলুন চিকিৎসকের সঙ্গে।

 

  • চলাফেরায় নজর রাখুন: দৌড়ঝাঁপ করলে শিশুর ঘাম হয়। এতে ওর শরীরে জলের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। একইসঙ্গে, খনিজ পদার্থের ভারসাম্যও নষ্ট হয়। তাই এই সময় ওর জলের প্রয়োজন বেশি। দৌড়ঝাঁপের ফলে শরীরের তাপমাত্রাও বাড়তে থাকে। পর্যাপ্ত জলই ছোট্ট শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক রাখতে পারে।

 

  • ফলের রস: অনেক শিশুই শুধু জল পান করতে চায় না। প্রয়োজন অনুযায়ী জল খাওয়াতে গেলে তাদের মেজাজ বিগড়ে যায়। এমন করলে তো শরীর মানবে না! তাই ওদের জন্য বাড়িতে তৈরি ফলের রস অনেক কার্যকরী। এতে শরীরে জলের ভারসাম্য ঠিক থাকে। তবে হ্যাঁ, এ কথাও মনে রাখা প্রয়োজন যে ফলের রস দেওয়া যায় ১ বছরের পরই!

 

#4. জল খাওয়াবেন কীভাবে (How to feed them water): খাবারের মতো না হলেও জল খাওয়ানোর সময় মায়েদের কম ঝক্কি পোহাতে হয় না। তাই মনে রাখুন কয়েকটি টিপস।

  • কাপ ধরতে শেখান: এই বয়স থেকে কোনও কিছু ধরা বা ছোঁয়ার ক্ষেত্রে ওর হাত ও চোখের মধ্যে সমন্বয় সাধন হয়। তাই এই সময় ওকে জলের কাপ ধরতে শেখান (When Can Babies Drink Water And How To Feed It To Them)। ওকে জল খাওয়ানোর জন্য কিনতে পারেন রংবেরঙের সিপিং কাপ।

 

  • অল্প করে খাওয়ান: প্রথমবার জল খাওয়ানোর সময় একদম অল্প করে খাওয়ান। খাওয়ানোর পরে লক্ষ রাখুন এই নতুন পানীয়টা ও কেমন ভাবে নিচ্ছে। প্রথম প্রথম খাওয়ানোর সময় অল্প করে বারে বারে খাওয়ান। এতে জল খাওয়া নিয়ে সমস্যা হবে না‌। পরে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ওর জল পানের অভ্যাস তৈরি হয়ে যাবে।

 

  • সময়ে সময়ে এগিয়ে দিন: এক বছরের জন্মদিন পেরিয়ে গেলে ওর জল খাওয়ার অভ্যাস অনেকটাই তৈরি হয়ে যাবে। এই সময় ও নিজেই কাপ ধরে জল খেতে পারবে। তবে প্রয়োজন অনুযায়ী সময়ে সময়ে জল খাওয়ার ব্যাপারটা আপনাকেই সামলাতে হবে। তখন ওর কাছে এগিয়ে দিন জলের কাপ।

 

#5. মাথায় রাখুন (keep in mind): চিকুকে জল খাওয়ানো শুরু করার আগে অঙ্কিতাকেও চিকিৎসক এই কথাগুলো মনে করিয়ে দিয়েছিলেন।

  • ফোটানো জল খাওয়ান: ছোট্ট সোনাকে যখনই জল খাওয়াবেন, ফোটানো জলই খাওয়ান (always offer boiled water)। ফোটানো জলে ব্যাক্টেরিয়া থাকে না। পরে চিকিৎসকের পরামর্শ মতো ফিল্টার করা বা পরিশুদ্ধ জল পান করাবেন।

 

  • প্যাকেটের জল নয়: বাজার থেকে কেনা প্যাকেট বা বোতলের জল (no bottled water) ছোট্ট সোনার জন্য এই বয়সে মোটেই ভালো নয়।

 

  • মিল সাপ্লিমেন্ট নয়: জল কিন্তু কোনও খাবারেরই পরিবর্তে খাওয়ানো যায় না। তাই পেট ভার হবে না এমন পরিমাণেই জল খাওয়াতে হবে শিশুকে।

 

ছ’মাসের আগে যেমন জল একদম নয়, ছ’মাসের পরেও তেমনই জল খাওয়ানোর পরিমাণ সম্বন্ধে সতর্ক থাকতে হবে। (Guidelines for Offering Water to Babies) তাই জলের উপরেই রইলো এই গাইডলাইন, যা চিকুর চিকিৎসক দিয়েছিলেন অঙ্কিতাকে।

 

আরও পড়ুন: বাচ্চাকে গোরুর দুধ খাওয়ানো শুরু করবেন কখন থেকে?

 

একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার  হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

null

null