নীলার এখন ৭ মাস চলছে। বাড়ির সব্বার আদরের বউমাটি তার স্বামী, শ্বশুরবাড়ি, বাপেরবাড়ি সব্বার যত্নে গর্ভাবস্থার কষ্ট অনেকটাই যেন ভুলে আছে। লালিত্যে ফেটে পড়ছে চোখ-মুখ, কালো একগোছা চুল যেন আরও দীঘল হয়ে নেমেছে। একটু বয়স্করা বা যারা এখনও একটু পুরনো ভাবধারায় বিশ্বাসী, তারা নীলাকে দেখলেই একবাক্যে বলছে, “তোর ছেলেই হবে। মেয়ে হলে এতো রূপ খুলতো না তোর।” (Facts and Myths About Predicting the Sex of Your Baby)
শুধু নীলা নয়, হবু মাকে দেখে, তার পেটের গড়ন বা রূপের বাহার দেখে অনেকেই কিন্তু গর্ভস্থ বাচ্চার লিঙ্গ নির্ধারণ করে বসে থাকেন। শুধু পেটের গড়ন বা রূপ নয়; আরও এমন অনেক কিছু আছে, যা দেখে গর্ভস্থ সন্তান ছেলে হবে না মেয়ে; এই নিয়ে মন্তব্য করেন অনেকে।
বলাই বাহুল্য, এইগুলির পিছনে বিজ্ঞানসম্মত কোনও যুক্তি কাজ করে না বা এগুলি মিলে গেলে তা নেহাতই কাকতালীয় (Gender-Guessing Myths and Facts)। প্রত্যেক মা’ই একটি সুস্থ, স্বাভাবিক সন্তান চায়। তা সে ছেলে হোক বা মেয়ে হোক; তা নিয়ে মায়ের মাথাব্যথা থাকে না একবিন্দুও। তাও, পুরনো সময় থেকে চলে আসা কিছু তথ্য বা মন্তব্য এখনও শোনা যায় কান পাতলেই।
বাইরের দেশে ডাক্তারই সঠিক সময়ে জানিয়ে দেন গর্ভস্থ বাচ্চার লিঙ্গ। কিন্তু আমাদের দেশে সেটা করা আইনবিরুদ্ধ এবং অত্যন্ত গর্হিত অপরাধ। তাই, গর্ভবতী মায়েদের দেখেই তাদের বাচ্চার লিঙ্গ ঠিক করতে বসেন আমাদের প্রবীণ প্রজন্ম। তাদের কথা কী আদৌ মেলে?
কী কী গুজব বা ভুল তথ্য ঘোরে আমাদের আশেপাশে? (Facts and Myths About Predicting the Sex of Your Baby) কথাগুলির কতটা কুসংস্কার আর কতটা যুক্তি ঠাসা? সত্যিই কী বাইরে থেকে গর্ভস্থ বাচ্চার লিঙ্গ নির্ধারণ করা সম্ভব? এই হরেক প্রশ্নের জবাব নিয়েই সাজিয়ে দিলাম আজকের প্রতিবেদন।
#1. হবু মায়ের পেটের আকার (The Shape of Your Bump): হবু মায়ের পেটের আকার দেখে নাকি বলে দেওয়া যায় সন্তান ছেলে হবে না মেয়ে! গর্ভবতী মায়ের পেট যদি একটু নীচের দিকে হয়ে গোল একটা বলের আকারে ফুলে থাকে, তা হলে ভাবী সন্তান ছেলে হয়। আবার, যদি হবু মায়ের পেট যদি বেশ ছড়িয়ে প্রায় পেটের পুরো অংশ নিয়েই ফুলে ওঠে; তা হলে গর্ভস্থ সন্তান মেয়ে হয়।
সত্যিটা কী? হবু মায়ের পেট কীভাবে বেড়ে উঠবে তা নির্ভর করে মায়ের পেটের পেশী, পেশীর দৃঢ়তা বা মায়ের পেটের আকারের ওপর। যারা আগে “মা” হয়ে গিয়েছেন, তাদের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, পেট নীচের দিকে এসেই ফুলে ওঠে। এর কারণ, তাদের পেটের পেশী আগে থেকেই শিথিল হয়ে থাকে। গর্ভস্থ সন্তান ছেলে না মেয়ে; এর ওপর নির্ভর করে হবু মায়ের পেটের আকারে কোনও পরিবর্তন হয় না।
#2. মর্নিং সিকনেস (Morning Sickness Madness): গর্ভবতী অবস্থায় সকালে উঠেই বমি, মাথা ঘোরা অর্থাৎ মর্নিং সিকনেসের মাত্রা যদি বেশি হয়, তা হলে মেয়ে হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
সত্যিটা কী? এর কিন্তু বিজ্ঞানসম্মত কোনও যুক্তি নেই। সাধারণ “মর্নিং সিকনেসের” সাথে এই বিশেষ মর্নিং সিকনেসের সেরকম পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যায়নি। আংশিক রূপে কখনও সখনও মিলে গেলেও এর ওপর ভিত্তি করে সঠিকভাবে বাচ্চার লিঙ্গ নির্ধারণ করা সম্ভব না।
#3. গর্ভস্থ সন্তানের হৃদস্পন্দন (Fetal Heart Rate Predictor): গর্ভস্থ সন্তানের হার্টরেট ১৪০ বিপিএম-এর বেশি হলে সে মেয়ে এবং এর কম হলে সে ছেলে।
সত্যিটা কী? গর্ভস্থ অবস্থায় একটি সুস্থ, স্বাভাবিক বাচ্চার হার্টরেট ১২০ থেকে ১৬০ বিপিএম-এর মধ্যেই থাকে। এর সাথে ছেলে বা মেয়ে হওয়ার কোনও যোগসূত্র নেই।
#4. নুন/ চিনির প্রতি হবু মায়ের আসক্তি (Food Cravings): হবু মায়ের যদি খুব মিষ্টি, চকলেট জাতীয় খাবার খেতে ইচ্ছে করে; তবে গর্ভস্থ সন্তান মেয়ে। যদি মায়ের নোনতা খাবারে আসক্তি বেশি হয়; তবে ভাবী সন্তান ছেলে।
সত্যিটা কী? গর্ভাবস্থায় একেকজনের খাবারে আসক্তি একেকরকম হয়; নোনতা বা মিঠে স্বাদের ওপর বিশেষ আসক্তি কোনও ভাবেই ভাবী বাচ্চার লিঙ্গ নির্ধারণ করতে পারে না।
#5. হবু মায়ের রূপ বা চেহারায় পরিবর্তন (Hair, Skin, and Your “Glow”): বলা হয়, ভাবী সন্তান যদি মেয়ে হয়; তা হলে সে নাকি মায়ের সব রূপ নিজের কাছে নিয়ে নেয়। ফলস্বরূপ, মায়ের ত্বক জেল্লাহীন হয়ে পড়ে, বেড়ে যায় ব্রণের উৎপাত। চুলের স্বাস্থ্যও খারাপ হয়ে যায়।
অন্যদিকে, গর্ভবতী থাকাকালীন মায়ের রূপ যদি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়, ত্বকের সাথে সাথে চুলের জেল্লা ও ঘনত্ব দারুণ বেড়ে যায়; তা হলে ভাবী সন্তান ছেলে হয়।
সত্যিটা কী? এই মন্তব্যটির পিছনে কোনও বিজ্ঞানসম্মত যুক্তি নেই। হবু মায়ের শরীরে হরমোনের মাত্রা ওঠাপড়ার কারণেই মায়ের বাহ্যিক রূপে যাবতীয় পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।
#6. মায়ের ওজন বৃদ্ধির হার (Extra Weight Measure): মায়ের চেহারার সামনের অংশ বেশি ভারী হয়ে গেলে মনে করা হয়, হবু সন্তান ছেলে। মায়ের নিতম্ব এবং নিম্নাঙ্গে চর্বি জমলে বলা হয় হবু সন্তান মেয়ে।
সত্যিটা কী? এই তথ্যটিরও কোনও বিজ্ঞানসম্মত যুক্তি নেই।
আরও পড়ুন: হবু মায়ের খাদ্যতালিকায় কী কী খাবার রাখতেই হবে, খসড়া ও ডায়েট চার্ট থাকল এখানে!
#7. স্তনের আকার (The Biggest Breast): হবু মায়ের ডানদিকের স্তন আকারে বড় হয়ে গেলে গর্ভস্থ সন্তান ছেলে হয়। আবার বামদিকের স্তন বড় হয়ে গেলে গর্ভস্থ সন্তান মেয়ে হয়।
সত্যিটা কী? গর্ভকালে স্তনের আকারে পরিবর্তন খুব সাধারণ এবং কাঙ্খিত একটি ঘটনা। এর সাথে গর্ভস্থ সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারণের কোনও যোগসূত্র নেই।
#8. হবু মায়ের মুডের পরিবর্তন (Mood Swings): গর্ভকালে খুব বেশি মুড সুইংস হলে ভাবী সন্তান মেয়ে হয়।
সত্যিটা কী? বিজ্ঞানসম্মত কোনও যুক্তি নেই।
#9. প্রস্রাবের রং (Pee Colour): হবু মায়ের প্রস্রাবের রং স্বচ্ছ হলে ভাবী সন্তান ছেলে হয়। উজ্জ্বল হলুদ বর্ণের প্রস্রাবের অর্থ ভাবী সন্তান মেয়ে।
সত্যিটা কী? একেবারেই যুক্তিহীন। হবু মায়ের দৈনিক জল খাওয়ার পরিমাণের ওপরেই তার প্রস্রাবের রং নির্ভর করে, গর্ভের বাচ্চার লিঙ্গের ওপর নয়।
#10. গ্যাস-অম্বলের বাড়াবাড়ি: গর্ভকালে হবু মায়ের যদি খুব বেশি বুকজ্বালা, গ্যাস-অম্বল হতে থাকে; তা হলে মনে করা হয় সন্তানটি মেয়ে। বলা হয়, গর্ভস্থ বাচ্চার যদি প্রচুর চুল থাকে তা হলেও মায়ের এই ধরনের অস্বস্তি বেশি হয়।
সত্যিটা কী? অম্বল বা বুকজ্বালার সাথে গর্ভস্থ বাচ্চার লিঙ্গের কোনও যোগসূত্র নেই। তবে মজার ব্যাপার; বাচ্চার মাথায় চুলের পরিমাণের সাথে কিন্তু অম্বলের একটা যোগ আছে। গর্ভের সন্তান ছেলে হোক বা মেয়ে; তার মাথায় চুল গজানোর সাথে সাথে মায়ের বুকজ্বালা/অম্বল হওয়ার প্রবণতা বাড়ে। ছেলে বা মেয়ের লিঙ্গ নয়; হরমোনের ক্ষরণেই এমনটা ঘটে বলে মনে করা হয়।
#11. হবু মায়ের শোওয়ার ধরন (Your Sleeping Position): হবু মা যদি বামদিকে কাত হয়ে শুতে পছন্দ করেন, তা হলে ভাবী সন্তান হয়তো ছেলে। আবার, মায়ের যদি ডানদিকে পাশ ফিরে ঘুমোতে বেশি আরামবোধ হয়; তা হলে ভাবী সন্তান মেয়ে।
সত্যিটা কী? কোনও যুক্তি নেই। তবে, গর্ভকালে বাম পাশ হয়ে ঘুমনো ভালো। এতে প্লাসেনটায় রক্ত ও পরিপোষকের সংবহন ভালো হয়।
#12. মায়ের হাত: মায়ের হাত যদি ফাটা ও রুক্ষ হয়; তা হলে ভাবী সন্তান ছেলে। হাত যদি নরম থাকে; তবে গর্ভস্থ সন্তানটি মেয়ে।
সত্যিটা কী? একেবারেই যুক্তিহীন। হাতে ক্রিম না লাগালে, যত্ন না করলে হাত ফেটে যায়, রুক্ষ হয়ে যায়। গর্ভের সন্তান ছেলে না মেয়ে, এর সাথে কোনও সম্পর্ক নেই।
#13. পা ঠান্ডা হয়ে যাওয়া: গর্ভকালে হবু মায়ের পা যদি সবসময় ঠাণ্ডা থাকে, তা হলে ভাবী সন্তান ছেলে। আর যদি পা স্বাভাবিক গরম থাকে তবে ভাবী সন্তান মেয়ে।
সত্যিটা কী? বিজ্ঞানসম্মত যুক্তি নেই।
#14. প্রসবযন্ত্রণার স্থায়িত্ব: মনে করা হয়; মায়ের প্রসবযন্ত্রণা দীর্ঘক্ষণ স্থায়ী থাকলে সন্তানটি ছেলেই হবে।
সত্যিটা কী? ভাবী সন্তানের লিঙ্গ এবং প্রসবপীড়ার স্থায়িত্ব সরাসরি সম্পর্কযুক্ত না হলেও আংশিক রূপে এই তথ্যকে অস্বীকার করা যায় না। দেখা যায়, যেসব মহিলা পুত্র সন্তানের জন্ম দেন, অনেক ক্ষেত্রেই তাদের বেশি ব্যথা ও জটিলতা সহ্য করতে হয়। যেহেতু, ছেলে সন্তানের মাথার আকার ও ওজন মেয়ের থেকে তুলনামূলক বেশি থাকে; তাই মাকে বেশি কষ্ট সহ্য করতে হয়।
#15. পেটের ওপর দাগ ও নিপলের রং (Linea Nigra and the Colour of the Nipples:): গর্ভবতী মায়ের পেটের ওপরে একটা গাঢ় রঙের লাইন দেখা যায়। একে লিনিয়া নিগ্রা (Linea Nigra) বলে। পিউবিক হাড় থেকে নাভি পর্যন্ত এই দাগ লাইন দেখা গেলে ভাবী সন্তান মেয়ে হয়। আর যদি এই লাইন পাঁজরের কাছ থেকে পিউবিক হাড় পর্যন্ত নেমে আসে; তবে ভাবী সন্তান ছেলে হয়। আবার নিপলের রং গাঢ় হতে থাকলে ভাবী সন্তান ছেলে হয়।
সত্যিটা কী? গাঢ় রঙের লাইন বা নিপল বা এরিওলার রঙে পরিবর্তন, সবই নির্ভর করে হবু মায়ের শরীরে হরমোনের মাত্রার ওঠাপড়ার ওপরে। গর্ভস্থ বাচ্চার লিঙ্গের সাথে এর কোনও যোগসূত্র নেই।
যে আপনার কোলে আসতে চলেছে, সে যেন সুস্থ এবং স্বাভাবিক হয়। ছেলে বা মেয়ে যাই হোক, সে আপনার অতি আদরের নাড়ি ছেঁড়া ধন। তাই ভেসে আসা গুজবে কান দিয়ে মনে মনে কিছু নিশ্চিত বলে ধরে নেবেন না। যুক্তি দিয়ে, বিচারবুদ্ধি দিয়ে বিশ্লেষণ করে তবেই কোনও তথ্য বিশ্বাস করুন। ভালো থাকুন, আনন্দে থাকুন আর তাকে কোলে নেওয়ার জন্য দিন গুণতে থাকুন। (Facts and Myths About Predicting the Sex of Your Baby)
আরও পড়ুন: কীভাবে ঠিক রাখবেন শরীর, কীভাবে বাড়বে কনসিভ করার সম্ভাবনা; দেখে নিন একনজরে!
একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।
null
null