ঘরোয়া টোটকার প্রতি শান্তনুর ভালো মতোই আস্থা আছে। কোন টোটকার কী কাজ, পিছনের বিজ্ঞানটাই বা কী, সেটা হয়তো সে ভালো ভাবে জানে না, কিন্তু মানুষ যুগের পর যুগ পরীক্ষার মাধ্যমেই যে এই সব টোটকার জ্ঞান লাভ করেছে, সে বিষয়ে তার কোনও সন্দেহ নেই। সে যখন ছোট ছিল, গরম কেটে বর্ষা নামল কী নামল না—তার বাবা বাজার থেকে এক কোয়া রসুন এনে তাকে খাওয়াতে শুরু করতেন। সত্যি বলতে, তার বিশেষ জ্বর-টরও হত না কখনও। হলেও একদিনের বেশি স্থায়ী হত না।(Foods To Tackle Cold and Cough in Toddlers.)
অনেক পরে শান্তনু জেনেছে, রসুনের মধ্যে এক ধরনের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান থাকে, যা শরীর থেকে টক্সিন বের করে দিয়ে শরীরকে ভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করার ক্ষমতা দেয়। শরীরে জন্মানো ভাইরাসের জীবনকালও কমিয়ে দেয় এই উপাদান (Super Foods to Tackle Cold and Cough)। কিন্তু এখন এক কোয়া রসুন সে পাবে কোথায়? কলকাতা হলে না-হয় কথা ছিল, এখন তো আর বাবাকে ফোন করে বলতে পারে না, এক কোয়া রসুন কিনে বেঙ্গালুরুতে পাঠিয়ে দিতে! (Thanda-Shordi Dure Rakhar Janyo Shishuder Ki Khawaben.)
আসলে তার চিন্তাটা হয়েছে ছেলে পাপাকে নিয়ে। পাপা দু’বছরে পড়েছে। সামনের বছর ওকে প্রি-স্কুলে দেওয়ার কথাও ভেবে রেখেছে শান্তনু আর অনিন্দিতা। কিন্তু পাপা খুবই ভোগে। জ্বরজারি লেগেই আছে। বিশেষ করে সিজন পাল্টানোর সময়। গরম থেকে বর্ষাকাল আসা বা শীতের গোড়ায় ওর জ্বর হবেই হবে। আর চিকিৎসকও বলেছেন, এর সব ক’টাই ভাইরাল ফিভার।আগামী বছরও যদি এমনটা চলতে থাকে, তা হলেই তো চিত্তির! পাপা স্কুলে যাবে, নাকি শরীর খারাপ (Sisur Sordi-Kashi) নিয়ে বাড়িতে শুয়ে থাকবে! এই নিয়েই ওরা কথা বলতে গেল চিকিৎসকের সঙ্গে।
তবে ডাক্তারবাবু আশ্বাস দিয়েছেন, এক কোয়া রসুন পাওয়া না-গেলেও এমন বহু খাবারই রয়েছে, যা পাপার বয়সি শিশুদের খাওয়ালে, তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে (Shishuder Sadharon Shordi-Kashite Koroniyo)। এক বছর থেকে তিন বছর বয়সি শিশুদের সেই খাবারের তালিকা রইল তাদের বাবা-মায়েদের জন্য। মরসুম বদলের সময় এই সব খাবার কাজে লেগে যাওয়ার সম্ভাবনা বিরাট।
#1. হালকা গরম জল ও মধু: ঠান্ডা লাগার হাত থেকে বাঁচার জন্য মধুর কোনও তুলনা হয় না। গলা ব্যথার সময় তো বড়রাও মধু খেতে পারেন। খাদ্যনালীর কোথাও প্রদাহ হলে, সেখানকার মিউকাসের পরিমাণ কমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এই মিউকাসকে ফিরিয়ে আনতেও মধুর জুড়ি নেই।
তাই আপনার সোনাকে বছরের এই সময় হালকা গরম জলে অল্প পরিমাণে মধু মিশিয়ে খাওয়াতে পারেন। শুধু দুটো কথা মনে রাখবেন। এক, বেশি পরিমাণে মধু দেবেন না। কারণ তাতে অনেকেরই পেটের গোলমাল হয়। দুই, শিশুর বয়স এক বছরের কম হলে তাকে মধু দেওয়া যাবে না।
#2. আদা, রসুন দিয়ে খিচুড়ি: খিচুড়ি তো সব শিশুকেই খাওয়ানো হয়। বিশেষ করে তাদের বয়স নয়-দশ মাস হয়ে গেলে তো বেশি মশলাপাতি ছাড়া খিচুড়ি তাদের জন্য খুবই উপাদেয় এবং পুষ্টিকর খাবার। কিন্তু এই খিচুড়ি যে রোগ প্রতিরোধেও কাজে লাগতে পারে, তা ভেবে দেখেছেন কি কখনও? সাধারণ খিচুড়ি রাঁধার সময় তার মধ্যে মিশিয়ে দিন কিছুটা রসুন আর কিছুটা আদা। দেখবেন, খিচুড়ির স্বাদ বদলে গিয়েছে। তার পাশাপাশি আপনার সোনাও মরুসুম বদলের সময় ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়ার সঙ্গে লড়াই (Sisur Sordi-Kashi) করতে প্রস্তুত।
#3. গাজরের সুপ: গাজরেরর মধ্যে থাকা পুষ্টিগুণ শিশুর জন্য খুবই ভালো। তা ছাড়া এর মধ্যে থাকা অন্য উপাদান শিশুকে ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করার শক্তি জোগায়। তবে ছয় মাসের কম বয়সি শিশুদের গাজর না-খেতে দেওয়াই ভালো। গাজর সিদ্ধ করে, পেস্ট করে ওকে খেতে দিতে পারেন। সবচেয়ে ভালো হল, গাজরের সুপ বানিয়ে দেওয়া। কোন বয়সে ওকে কতটা গাজর দেওয়া যাবে, তা চিকিৎসকের থেকে ভালো করে জেনে নিয়েই এই সুপ ওকে দিন।
আরও পড়ুনঃ টিকার ব্যথা আর নয়। ছোট্ট সোনার ভ্যাকসিনের ব্যথা কমানোর সহজ, ঘরোয়া রাস্তা!
#4. টমেটোর সুপ: সুপের কথা যখন উঠলই, তখন সবচেয়ে উপকারী এবং উপাদেয় সুপটার কথা না-বললেই নয়। অবশ্যই এটা টমেটো সুপ। টমেটোর গুণের কথা বলে শেষ করা যাবে না। প্রথমত, এর মধ্যে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট শিশুর বৃদ্ধির সহায়ক এবং রোগ প্রতিরোধে খুবই কার্যকরী। দ্বিতীয়ত, টমেটো ভিটামিন সি-এ ঠাসা। ফলে ঠান্ডা লাগার মতো সমস্যার হাত থেকে শিশুকে রক্ষা করার জন্য টমেটোর জুড়ি মেলা ভার। তৃতীয়ত, টমেটোর মধ্যে থাকা আয়রন। যে আয়রন শিশুর শরীরে রক্ত বা লোহিত কণিকার পরিমাণ বাড়াতে ব্যাপক ভাবে সাহায্য করে। এরপরেও কী আপনার মনে সন্দেহ থাকতে পারে, টমেটো সুপ আপনার সোনাকে ঠান্ডা লাগার হাত থেকে কি না, তা নিয়ে!
#5. আদা-চা: আদা-চা শিশুদের জন্যও খুব ভালো। অনেকেই ছোট বাচ্চাদের চা খাওয়াতে ভয় পান। তার কারণ চা-এর মধ্যে থাকা ট্যানিন। কিন্তু পরিমিত পরিমাণে চা শিশুদের জন্য ক্ষতিকারক তো নয়ই, বরং আসলে তা শিশুর উপকারই করতে পারে। তবে এক বছর বয়সের আগে এই চা দেওয়া উচিত নয়। এই চায়ে আদা মিশিয়ে আপনার সোনাকে দিন।
আদার মধ্যে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করার শক্তি বাড়াবে ওর মধ্যে। আর যদি চা দিতে একান্তই মন না-চায়? সেক্ষেত্রেও অসুবিধার কিছু নেই। শুকনো আদা ওকে দিন। সেটা মুখের মধ্যে কিছুক্ষণ রাখলে সেই রসেও ওর যথেষ্ট উপকার হবে। বিশেষ করে ঠান্ডা লাগা গলার ব্যথায় এই রসের কোনও তুলনা নেই।
#6. হলুদ মেশানো দুধ: নিজের ছোটবেলার কথা মনে আছে আপনার? আখের গুড় দিয়ে কাঁচা হলুদ আপনাকে খেতে দিতেন আপনার ঠাকুমা বা দিদিমা। সকালে খালি পেটে এই হলুদ খাওয়া দারুণ উপকারী। বিশেষ করে এই মরসুম বদলের সময়। কারণ হলুদের মধ্যে থাকা বিশেষ উপাদান ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করার ক্ষমতা বাড়ায়। সেই হলুদই আপনার সোনার কাছে ফিরিয়ে আনুন। দুধের মধ্যে মিশিয়ে খাওয়ান এই হলুদ। এক বছরের বেশি বয়সি বাচ্চাদের জন্য এই হলুদ-দুধের তুলনা হয় না। বিশেষ করে শুকনো কাশি বা বুকে কফ জমে গেলে, তার উপশম করতে এই পথ্যের তুলনা নেই।
#7. সবজি আর মুগ ডালের সুপ: মুগ ডালে এক বিশেষ ধরনের অ্যামিনো অ্যাসিড থাকে। যে অ্যাসিড শিশুদের কেন বড়দের শরীরও নিজে থেকে উৎপাদন করতে পারে না। অথচ এই অ্যামিনো অ্যাসিড রোগ প্রতিরোধের জন্য খুবই দরকারি।(Domestic Treatment To Tackle Cold And Cough) ফলে সুপ হিসেবে এই মুগ ডাল আপনার সোনাকে খাওয়াতে পারেন। আর শুধু মুগডাল কেন, তার সঙ্গে মিশিয়ে নিন বেশ কিছু সবজিও। তা থেকে আপনার একরত্তি পেয়ে যাবে বহু ধরনের ভিটামিনও।
#8. রাঙা আলু মাখা: রাঙা আলু বাচ্চাদের জন্য খুবই ভালো খাবার। তবে ছয় মাসের কম বয়সি শিশুদের রাঙা আলু না-দেওয়াই ভালো। সবচেয়ে ভালো হল এক বছর বয়স পেরিয়ে গেলে তবেই দেওয়া। রাঙা আলুর মধ্যে থাকা বিটা ক্যারোটিন শিশুদের শরীরের জন্য খুবই কাজের। কারণ এটি শরীরে ভিটামিন এ-র মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে।
এই ভিটামিন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। রাঙা আলুতে থাকা আর একটি যৌগ— স্পোরামিনস শিশুদের শরীরে অক্সিডেটিভ কোষের নষ্ট হওয়া রোধ করে এবং এই জাতীয় কোষগুলি যাতে দ্রুত আগের অবস্থায় ফিরে আসতে পারে, সেই পথ মসৃণ করে।
#9. মাশরুম সুপ: এক বছরের বেশি বয়সের শিশুদের জন্য মাশরুম খুবই উপকারি। বিশেষ করে মরসুম বদলের সময় এই মাশরুমের সুপ আপনার সোনাকে খুব ভালো রাখতে পারে। এবং খুব সহজেই এই সুপ আপনি উপাদেয়ও করে তুলতে পারেন। এই সুপে অনেকেই সাদা ক্রিম মেশান। একমাত্র এই বিশেষ উপকরণটি বাদ দিতে পারেন। তাতেও সুপের স্বাদ বিন্দুমাত্র কমবে না।
#10. সাবুর খিচুড়ি: সাবু এমন একটি খাবার, যা শিশুর বৃদ্ধিতে খুবই সাহায্য করে। এমনকী যে সময় তার শরীরটা একটু খারাপ (Sordi-Kashi Saranor Ghoroya Upay), সে একটু দুর্বল, তখনও তার বৃদ্ধি যাতে সমান তালে চলতে থাকে, সেদিকেও নজর রাখতে পারে সাবু। তবে এক বছরের আগে এই খাবার ওকে না-দেওয়াই ভালো। দরকার হলে এর সঙ্গে কিছু সবজিও মিশিয়ে নিতে পারেন। আরও সুস্বাদু হবে।
সর্দি-কাশি বা সাধারণ ঠান্ডা লাগায় শিশু খুবই দুর্বল হয়ে পড়ে। এই অবস্থা থেকে ওকে বের করে আনতে অনেক চিকিৎসকই নানা ধরনের মাল্টি-ভিটামিন বা অন্য ধরনের সাপ্লিমেন্ট খাওয়াতে বলেন। কিন্তু তার বাইরেও আমাদের ঘরোয়া খাবারেই রয়েছে এমন অনেক কিছু, যা আপনার সোনাকে বের করে আনতে পারে এই সমস্যা থেকে। তবে কোন বয়সে কোন খাবারটা খাওয়াবেন, তা আগে থেকে চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে ঠিক করে নিলেই ভালো হয়।
আরও পড়ুনঃ মশা-মাছি থেকে শিশু থাকুক দূরে
একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।
null
null