সোনামণির ঘুম আসে না! স্তন্যদায়ী মায়ের ডায়েটে এই সব খাবার নেই তো?

সোনামণির ঘুম আসে না! স্তন্যদায়ী মায়ের ডায়েটে এই সব খাবার নেই তো?

কয়েক দিন থেকেই খুদে বিতান রাতে ঠিক মতো ঘুমোচ্ছে না। তিন মাস বয়সে ওর প্রায় সারাদিনই ঘুমিয়ে থাকা উচিত। অথচ দুধ খাওয়ানোর পর ওকে কিছুতেই ঘুম পাড়ানো যায় না। তা ছাড়া প্রচন্ড কান্নাকাটিও করে। শেষে পারমিতা নিজে সামলাতে না-পেরে বিতানের চিকিৎসকের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিল। (Foods To Avoid While Breastfeeding)

চিকিৎসক সবটা শুনে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি প্রতিদিন কফি জাতীয় কিছু পান করেন? পারমিতা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বোঝাতেই চিকিৎসক বললেন, কফিতে থাকা ক্যাফিনই প্রভাব ফেলছে ছোট্ট খোকার শরীরে। ওর মেজাজ বিগড়ে দিচ্ছে, ঘুম কেড়ে নিচ্ছে। ও যেহেতু এখনও মায়ের দুধ খায়, তাই মায়ের ডায়েট ওর উপর প্রভাব ফেলবেই। যতদিন না ও শক্ত খাবার খাচ্ছে, ততদিন মায়ের নিয়ম মেনে খাওয়াদাওয়া করা উচিত।

পারমিতা জিজ্ঞাসা করল, কোন কোন খাবারগুলো এই সময় এড়িয়ে চলা উচিত? চিকিৎসক ওর প্রশ্নের উত্তরে প্রেসক্রিপশনে কতগুলো খাবারের নাম লিখে সেগুলোর পাশে কাটা চিহ্ন দিয়ে দিলেন। অর্থাৎ এগুলো খাওয়া যাবে না। পাশাপাশি এও বলে দিলেন, কেন ওই খাবারগুলো খাওয়া উচিত নয়।

 

যা যা খাবার খেতে মানা স্তন্যদায়ী মায়ের (Foods to Avoid While Breastfeeding)

#1. কফি (Coffee): বিশেষজ্ঞদের মতে, স্তন্যপান যতদিন চলবে, ততদিন মায়ের ডায়েটে কফি না-থাকাই উচিত। কফিতে থাকে ক্যাফিন নামক প্রাকৃতিক উত্তেজক। কফি পান করলে তা মায়ের দুধে প্রভাব ফেলতে পারে। শিশুরা প্রাপ্তবয়স্কদের মতো ক্যাফিন হজম করতে পারে না। ফলে এই উত্তেজক ছোট্ট সোনার মেজাজ বিগড়ে দেয়, চোখ থেকে কেড়ে নেয় ঘুম। ক্যাফিনের পরিমাণ বেশি হয়ে গেলে স্তন্যদুগ্ধে আয়রনের পরিমাণ কমে যায়। এতে শিশুর রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমে যায়।

#2. চকোলেট (Chocolate): চকোলেট অনেকেরই প্রিয় একটি খাবার। তবে স্তন্যপানের সময় এটি মোটেও মা ও শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়। চকোলেটের মধ্যে রয়েছে থিওব্রোমিন নামক পদার্থ। স্তন্যদুগ্ধে এর প্রভাব ক্যাফিনের মতোই। থিওব্রোমিন শিশুর মেজাজ বিগড়ে দেয়, ছোট্ট খুদে খাওয়াদাওয়ার পর অশান্ত হয়ে পড়ে, কান্নাকাটি করে।
চিকিৎসকদের কথায়, চকোলেট খাওয়া যেতেই পারে, তবে কতটা পরিমাণে তা নির্ভর করবে খুদের মেজাজের উপর। যতটা খেলে খুদের মেজাজে কোনও প্রভাব পড়ে না, তার বেশি না-খাওয়াই ভালো। দিনে ৭০০ মিলিগ্ৰামের বেশি থিওব্রোমিন শরীরে গেলে সোনামণির ঘুম কমে যেতে পারে।

#3. অ্যালকোহল (Alcohol): অ্যালকোহল ছোট্ট সোনার স্নায়ুকোষের বৃদ্ধি আটকে দেয়। স্তন্যপান করানোর সময় মা অ্যালকোহল পান করলে স্তন্যদুগ্ধের মাধ্যমে তা শিশুর শরীরে প্রভাব ফেলে। তাই ওর সুরক্ষার কথা ভেবে এই সময় অ্যালকোহল পান বন্ধ রাখা উচিত।

কিছু বিশেষজ্ঞদের মতে, স্তন্যপান করানোর সময় সপ্তাহে দু’বার একেবারে অল্প পরিমাণে অ্যালকোহল পান করলে শিশুর স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয় না। এক্ষেত্রে খুদেকে দুধ খাওয়ানোর অন্তত দু’ঘন্টা আগে অ্যালকোহল পান করে নেওয়া উচিত। তবে অতিরিক্ত পরিমাণে অ্যালকোহল পান করলে স্তন্যদুগ্ধের ক্ষরণ কমে যেতে পারে।

#4. বাঁধাকপি, ফুলকপি ও ব্রকোলি (Cabbage, Cauliflower And Broccoli): বাঁধাকপি, ফুলকপি বা ব্রকলি জাতীয় সবজি খেলে খাদ্যতন্ত্রে যথেষ্ট অ্যাসিডিটি হয়। এছাড়াও লেনটিল, পেঁয়াজ, বিনস্ও অ্যাসিডিটির কারণ। মায়ের অ্যাসিডিটি হলে পরদিন শিশুরও অ্যাসিডিটি হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। কারণ বিশেষজ্ঞদের মতে, মায়ের দুধের মধ্যে দিয়েই এই অ্যাসিডিক উপাদান ওর ছোট্ট দেহে যায়। তাই অ্যাসিড উৎপাদনকারী খাবার স্তন্যপান করানোর পর্বে এড়িয়ে চলা উচিত।

#5. হাই মার্কারি মাছ (High-mercury Fish): বেশি পরিমাণে পারদ বা মার্কারি রয়েছে এমন মাছ স্তন্যপান করানোর পর্বে না-খাওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসক। মার্কারি মায়ের দুধের মাধ্যমে খুদের শরীরে যায়। এতে তার নার্ভের গঠনে বাধা তৈরি হয়। বরং বাজার থেকে জ্যান্ত মাছ কিনে তা রান্না করে খাওয়াটা এই সময় মা ও শিশুর স্বাস্থ্যের পক্ষে নিরাপদ।

#6. টক ফল (Citrus Fruit): টকজাতীয় ফল যেমন কমলালেবু, আনারস, সরবতিলেবু ,আম, পেঁপে ইত্যাদিতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি (Acidic Foods to Avoid While Breastfeeding)। মা হওয়ার পর ভিটামিন সি মায়ের শরীরের জন্য ভালো। তবে টক জাতীয় ফল খেলে অ্যাসিডিটি হতে পারে। যা মায়ের দুধের মাধ্যমে খুদের শরীরে প্রভাব ফেলে।
ছোট্ট সোনার খাদ্যতন্ত্র অপরিণত হয়। অপরিণত খাদ্যতন্ত্রে অ্যাসিডিটি হলে ওর জন্য সেটি খুবই কষ্টকর। তাই বিশেষজ্ঞরা খুদেকে শক্ত খাবার খাওয়ানোর আগে পর্যন্ত মাকে টকজাতীয় ফল না-খাওয়ার পরামর্শ দেন।

#7. পিনাট (Peanut): পিনাট খাবার হিসেবে বেশ সুস্বাদু। কিন্তু এতে রয়েছে অ্যালার্জিক প্রোটিন। মা পিনাট খেলে এই অ্যালার্জিক প্রোটিন ব্রেস্টমিল্কে মিশে যায়। যা শিশুর দেহে গিয়েও অ্যালার্জি ছড়িয়ে দিতে পারে। এতে খুদের গায়ে চুলকানি হতে পারে। এমনকী ওর নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হতে পারে। এছাড়া ভবিষ্যতে শিশুর পিনাটে অ্যালার্জি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই স্তন্যপানের পর্বে পিনাট বা পিনাট দিয়ে তৈরি কোনও খাবার খাওয়া উচিত নয়।

 

আরও পড়ুন: কিছুতেই ল্যাচ করতে পারছে না সদ্যোজাত; ব্রেস্টফিডিং সংক্রান্ত সব সমস্যার সমাধানে রইল টিপস!


#8. মশলাদার খাবার (Spicy Foods): ঝাল-মশলা বাচ্চার অপরিণত খাদ্যতন্ত্র মোটেই সহ্য করতে পারে না। তাই মায়ের খাবারে মশলা থাকলে তা ছোট্ট সোনার জন্য মোটেই ভালো নয়। সামান্য গরম মশলা গুঁড়োও মায়ের খাবারে থাকলে তা খুদের খাদ্যতন্ত্রের ক্ষতি করতে পারে (What Not to Eat When Breastfeeding to Avoid Gas)। বাচ্চাকে শক্ত খাবার খাওয়ানোর আগে পর্যন্ত তাই মায়ের খাবারের রেসিপিতে মশলা না-রাখাই উচিত।

#9. রসুন (Garlic): রসুনের গন্ধে অনেক খুদের যেমন অসুবিধা হয় না, তেমনই অনেকেই আবার সহ্য করতে পারে না। মায়ের খাবারে রসুন থাকলে তার প্রভাব বুকের দুধেও পড়ে। তাই রসুন খাওয়ার পর নজর রাখুন সোনামণি দুধ খাওয়ার সময় অস্বস্তিবোধ করছে কি না। তেমনটা হলে মায়ের ডায়েটে রসুন ছাড়া রান্নাই থাকা ভালো।

#10. ডেয়ারি দ্রব্য (Dairy Products): স্তন্যপানের পর্বে মা গরুর দুধ থেকে তৈরি কোনও খাবার খেলে মায়ের দুধের মধ্য দিয়ে তা সন্তানের দেহে যায়। অনেক শিশুর খাদ্যনালীই গরুর দুধ সহ্য করতে পারে না (Foods to Avoid During Breastfeeding to Prevent Colic)। তাই মা ডেয়ারি দ্রব্য খাওয়ার পর স্তন্যপান করালে শিশু কলিক হতে পারে, দুধ বমি করে দিতে পারে। আসলে, দুধের অ্যালার্জেন খুদের খাদ্যনালীতে গন্ডগোল পাকিয়ে দেয়। তাই এমনটা হলে চিকিৎসকরা মায়ের ডায়েট থেকে ডেয়ারি দ্রব্য বাদ দেওয়ার পরামর্শ দেন।

 

 

এতগুলো খাবার সম্পর্কে শোনার পর পারমিতা স্বাভাবিক ভাবেই একটু হকচকিয়ে গেল। চিকিৎসককে জিজ্ঞেস করল, কোন খাবারটা ওর জন্য ভালো আর কোনটা ভালো নয় (Foods to Avoid While Breastfeeding), তা কী করে বুঝব? চিকিৎসক বললেন, কয়েকটি বিষয় মনে রাখলে আপনি নিজেই আপনার ডায়েট কেমন হওয়া উচিত তা বুঝতে পারবেন।

  • নজর রাখুন (Keep An Eye): দুধ খাওয়ানোর সময় ছোট্ট সোনার উপর নজর রাখা এখন অত্যন্ত জরুরি। প্রতিদিন দুধ খাওয়ার পর ও কেমন আচরণ করছে তা লক্ষ্য রাখুন। ওর যদি কান্নাকাটি, বমি, ঘুম না-আসা বা ডায়রিয়ার লক্ষণ দেখা যায়, তা হলে বোঝা যাবে মায়ের খাবারে কী কী পরিবর্তন আনা উচিত।
  • প্রসেস করা খাবার নয় (No Processed Food): প্রসেসড বা প্রক্রিয়াজাত খাবার স্তন্যপানের পর্বে একেবারেই খাওয়ানো উচিত নয়। এই ধরনের খাবারে মেশানো থাকে নানারকমের প্রিজারভেটিভস্। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই প্রিজারভেটিভস্-এ থাকা রাসায়নিক পদার্থ যেমন ব্রেস্ট মিল্কে প্রভাব ফেলে, তেমনই শিশুর শরীরেরও ক্ষতি করতে পারে।
  • খাবারের ডায়েরি (Food Diary): স্তন্যপানের পর্বে একটি খাবারের ডায়েরি লেখা সব মায়েদেরই উচিত। এই ডায়েরিতে লিখে রাখুন কোন খাবার খাওয়া যাবে, কোন খাবার খাওয়া যাবে না। যে খাবারগুলো খেলে ছোট্ট সোনার সমস্যা হচ্ছে, সেগুলোর নামও লিখে রাখুন। এমনকী কোন খাবার কতটা খেলে বা কখন খেলে খুদের দুধ খাওয়ার পর কোনও অসুবিধা হচ্ছে না, সমস্তই লিখে রাখতে পারেন আপনার ডায়েরিতে।

 

ডাক্তারের পরামর্শ মেনে পারমিতা কফি খাওয়া একদম বন্ধ করে দিয়েছিল। এর ফলও ও হাতেনাতে পেল। দু’-একদিনের মধ্যেই বিতান একদম শান্ত ছেলে, চুপচাপ দুধ খেয়ে নেয়, ঘুম পাড়ালে কয়েক মিনিটেই ঘুমিয়ে পড়ে। কে বলবে দুদিন আগে এই ছেলেটা দুধ বমি করে ফেলত, কাঁদত আর রাত্রিবেলা জেগে থাকত! (Foods To Avoid While Breastfeeding)

 

আরও পড়ুন: প্রসবের পর কী করলে আপনি ঝটপট চনমনে হয়ে উঠবেন? সহজ উপায় থাকল এখানে!


 

একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার  হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

 

 

null

null