রাত ১১টার সময় ঋজুকে বাইক নিয়ে ছুটতে হল বাজারে। কাল সকালে গেলে হত না? না, সকালে কখন দোকান খুলবে! ততক্ষণ কি বসে থাকব নাকি? এই বলে তড়িঘড়ি বেরিয়ে গেল ঋজু। আসলে বিষয়টা গুরুতরও। ঋজু আর কৌশিকীর ছেলে ঋক। ঋকের বয়স সবে আট মাস। ঋজু চাকরিসূত্রে দিল্লির বাসিন্দা। এক সপ্তাহ আগে কলকাতা থেকে কৌশিকী আর ঋককে সে দিল্লিতে নিয়ে এসেছে। দিল্লিতে আসার পর থেকেই ঋকের কোষ্ঠকাঠিন্য শুরু হয়েছে। কিছুতেই ‘পটি’ করতে চাইছে না সে। করতে চাইছেও না, এবং তার মুখে দেখেই বোঝা যাচ্ছে সারাক্ষণ রীতিমতো কষ্ট হচ্ছে। দিল্লির এই জায়গায় ডাক্তারবদ্যি পাওয়াটাও বেশ ঝামেলার। তাই কৌশিকী খুব চিন্তা নিয়েই ফোন ঘুরিয়েছিল ঋজুর মা’কে। ওঁর পরামর্শ মতোই এখন ঋজুকে বাজারে ছুটতে হচ্ছে। কারণ ঋজুর মা বলেছেন, এসব সময় পানের বোঁটা খুব কাজে দেয়। বাচ্চার মলদ্বারে পানের বোঁটা দিয়ে অল্প সুড়সুড়ি দেওয়া গেলে নাকি সমস্যা সুরাহা হয়। (Foods that Cause and Relieve Constipation in Babies in Bengali.)
বাজারে গিয়ে ঋজু অনেক কষ্টে পানপাতা জোগাড় করেছে। কিন্তু কোষ্ঠকাঠিন্য সারানোর জন্য পানপাতার ব্যবহার ঠিক কেমন ভাবে হবে, তা ফোনে-ফোনে ঋজু বা কৌশিকীর কেউ-ই বুঝে উঠতে পারেনি ঋজুর মায়ের থেকে। তাই অবশেষে দ্বারস্থ হতেই হল চিকিৎসকের। পরদিন সকালেই এক বন্ধুর সূত্রে পাওয়া গেল শিশু-চিকিৎসকের সন্ধান। তিনিই বললেন, এই বয়সের বাচ্চাদের জন্য কোষ্ঠকাঠিন্যটা মোটেই অস্বাভাবিক কিছু নয়। এবং পানবোঁটার ব্যবহার সম্পর্কেও দিল্লির চিকিৎসক মশাই অবগত। তবে তাঁর মতে, এত জটিলতায় না গিয়ে শিশুর খাবারের বিষয় সচেতন হলেই সমস্যাটা অনেকাংশে মেটানো যায়। আর একেবারে যদি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তা হলে তো চিকিৎসকরা রয়েইছেন। সমাধান জানার আগে অবশ্য বুঝতে হবে বাচ্চাদের কোষ্ঠকাঠিন্য ঠিক কাকে বলে। কারণ এক বা দু’দিন বাচ্চা পায়খানা না করলেই অনেক বাবা-মা ভেবে ফেলেন, তাঁদের সন্তানের বুঝি কোষ্ঠের সমস্যা হচ্ছে। আসলে বিষয়টা ততটাও ভয়ের না।
অনেক বাচ্চার ক্ষেত্রেই পায়খানা নিয়ে এমন নানা জটিলতা খুবই সাধারণ। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, তারা সবাই কোষ্ঠকাঠিন্যে ভুগছে। কারণ যে সমস্ত বাচ্চা মায়ের দুধ পান করে, তাদের অনেকের ক্ষেত্রেই অনিয়মিত মলত্যাগ লক্ষ্য করা যায়। কারণ মায়ের দুধের পুষ্টিগুণ প্রচণ্ড বেশি। ফলত, সেই দুধের অনেকটাই বাচ্চার শরীরে পুষ্টি জোগানোর কাজে লেগে যায়। তাই অনেক সময়ই খুব বেশি পরিমাণে মল তৈরি হয় না বাচ্চার শরীরে। যে সব বাচ্চাদের কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা হচ্ছে বলে মনে হয়, তাদের বাবা-মায়েদের জন্য চিকিৎসকের কতগুলো সহজ পরামর্শ রয়েছে।
আরও পড়ুনঃ কলিক খুবই স্বাভাবিক এক সমস্যা, আপনার পুঁচকের জন্য সমাধানও বাড়িতেই আছে
ডাক্তারবাবু এরপর তালিকা তৈরি করে দিলেন, কোষ্ঠের সমস্যার হাত থেকে বাঁচার জন্য বাচ্চাকে কী কী খাবার বেশি খাওয়াবেন, আর কোন কোন খাবার তুলনায় এড়িয়ে চলবেন। প্রথমে দেখে নেওয়া যাক, যা যা খেলে আপনার খোকা বা খুকুর কোষ্ঠের সমস্যা অনেকটা কমবে।
#1. খেজুর (Dates): খেজুরে যেমন প্রচুর পরিমাণে ফাইবার থাকে, তেমনই একই সঙ্গে থাকে প্রচুর মাল্টিভিটামিন। রাতে খেজুর ভিজিয়ে রেখে সকালে সেই ভেজা খজুর বাচ্চাকে দিতে পারেন. এতে পেট পরিষ্কার হয়। অনেকে বাচ্চাদের খেজুরের জুস-ও খাওয়ান। বিদেশে বাবা-মায়েরা বাচ্চাদের প্রুন খাওয়ান। সেক্ষেত্রেও একই রকম কাজ হয়। এদেশে প্রুনের তুলনায় খেজুর সহজলোভ্য। তবে এতে আপনার সোনার অ্যালার্জি জাতীয় কোনও সমস্যা হবে কি না, তা চিকিৎসকের কাছ থেকে জেনে নিন।
#2. কড়াইশুঁটি (Green Peas): ফাইবারে ভর্তি এই সবজিটি। আপনি কাঁচাও খেতে পারেন। কিন্তু আপনার সোনামণিকে সিদ্ধ করে খাওয়ান এই কড়াইশুঁটি। শীতকালে পেট পরিষ্কার হবে সহজেই।
#3. রাঙা আলু (Sweet potatoes): অধিকাংশ কন্দ-জাতীয় খাবারই কোষ্ঠকাঠিন্য বাড়ায়। আলু, মুলো—এই সব সবজি খেলে সামান্য মাত্রায় হলেও কোষ্ঠর সমস্যা হতে পারে। কিন্তু রাঙা আলু এর ঠিক বিপরীত। এই আলুর মধ্যে শিশুর প্রয়োজনীয় কার্বোহাইড্রেট থাকে বিপুল মাত্রায়।
#4. নাশপাতি (Pears): প্রচুর ফাইবার তো থাকেই, পাশাপাশি এই ফলে থাকে বিপুল পরিমাণে ভিটামিন সি। এই ভিটামিন বাচ্চার রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। আর ফাইবার পেট পরিষ্কার করতে সাহায্য করে।
#5. বিনস (Beans): বিনস খুবই উপকারী একটি সবজি। কারণ এর মধ্যে একই সঙ্গে জলে দ্রবীভূত হওয়ার মতো বা ওয়াটার সলিউবল (water soluble) ফাইবার থাকে, আবার জলে দ্রবীভূত হয় না বা ইনসলিউবল (water insoluble), এমন ফাইবারও থাকে। দুটোই শিশুর জন্য খুব উপকারি। কোষ্ঠের সমস্যার ক্ষেত্রে এটি বড় সমাধান।
#6. অ্যাপ্রিকট (Apricots): কাশ্মীর বেড়াতে গেলে সেখান থেকে অ্যাপ্রিকট নিয়ে আসাটা একটা রেওয়াজ। কিন্তু সেই অ্যাপ্রিকট আপনার সোনার পেটের জন্য এতটাই ভালো যে তাকে এই ফলটি খাওয়ানোটাকেও একটা রেওয়াজে পরিণত করে ফেলতে পারেন। এখন যে কোনও বড় শহরেই সারা বছর এই ফল কিনতে পাওয়া যায়। কোষ্ঠ পরিষ্কার করতে এর জুড়ি নেই। তা ছাড়া এই ফল এতটাই সুস্বাদু, ভালো লাগবে শিশুদের।
উল্টোদিকে এমন কিছু খাবার রয়েছে, যা খেলে শিশুর কোষ্ঠকাঠিন্য বাড়তে পারে। এমনকী সেই সমস্ত শিশু, যাদের কোষ্ঠের সমস্যা নেই, তাদেরও এই সমস্যা শুরু হতে পারে। তাই এই সব খাবার থেকে আপনার সোনাকে দূরে রাখাই ভালো।
#1. কৌটোর দুধ (Formula milk): ফর্মুলা মিল্ক-এ থাকা প্রোটিনের কারণে অনেক সময় বাচ্চাদের কোষ্ঠের সমস্যা হয়। দুধ ছাড়াও বাচ্চাদের জন্য যে বিশেষ ধরনের কৌটোর খাবার পাওয়া যায়, সেগুলোও কোষ্ঠের সমস্যা ডেকে আনতে পারে। কিন্তু এর সঙ্গে মায়ের দুধের কোনও সম্পর্ক নেই। তাই কোনও অবস্থাতেই মায়ের দুধ বন্ধ করা চলবে না।
#2. আপেল (Apples): শিশুদের পেটের গণ্ডগোল হলে, পেট খারাপ হলে তাদের আপেল সেদ্ধ করে খাওয়ানো হয়। কারণ ডায়েরিয়া আটকাতে আপেলের জুড়ি নেই। ফলে বোঝাই যায়, স্বাভাবিক অবস্থায় আপেল কোষ্ঠকাঠিন্যের মতো সমস্যা ডেকে আনতে পারে।
#3. গাজর (Carrots): পুষ্টিগুণে ভরা এই সবজিটি শিশুর জন্য খুবই উপকারি। কিন্তু যদি আপনি আপনার সোনাকে গাজর সেদ্ধ করে খাওয়ান, তবে ওর কোষ্ঠের সমস্যা হতে পারে। চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়েই বাচ্চাদের গাজর খাওয়ানো উচিত।
#4. চিজ (Cheese): মিনারেলে ভরা চিজ বাচ্চাদের জন্য খুব মুখোরোচক। কিন্তু এতে ফাইবারের পরিমাণ অত্যন্ত কম। তাই এটি শিশুদের মল শক্ত করে দিতে পারে।
#5. পাউরুটি (White bread): সাদা পাউরুটি বাচ্চাদের খাওয়ানোর আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। কারণ পাউরুটিতে থাকা ময়দা কোষ্ঠকাঠিন্যের বড় কারণ। তবে আটার পাউরুটিতে এই সমস্যা তুলনায় অনেকটাই কম হয়।
#6. ভাত (Rice): শিশু শক্ত খাবার খেতে শুরু করার পর, বেশির ভাগ মা তাদের ভাত খাওয়ান। কিন্তু এই ভাতও কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা ডেকে আনতে পারে। তবে এটা সকলের ক্ষেত্রে হয় না। কারও কারও ক্ষেত্রে হয়।
কোষ্ঠের সমস্যা শিশুদের ক্ষেত্রে একেবারেই অস্বাভাবিক কিছু নয়। প্রচুর খাবার, কিছু ঘরোয়া টোটকা রয়েছে, যাতে সহজেই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। কিন্তু বাড়াবাড়ি হলে চিকিৎসকের কাছে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনও রাস্তা খোলা থাকবে না। আর যদি ঘরোয়া খাবার দিয়ে শিশুর এই সমস্যা করতে চান, তা হলেও চিকিৎসককে জানিয়েই সেই পথে এগোন ভালো।
একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।
null
null