সাত মাসের পরী সোহিনী আর সুপ্রভর একমাত্র আদুরে সন্তান। তাদের দু’জনের পরিবারে এত দিন আর কোনও সদস্য ছিল না। সোহিনী আর সুপ্রভ দু’জনের বাবা-মা-ই অনেকদিন আগে পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছেন। দু’জনেই মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির উঁচু পদে চাকরি করে। অফিসেই তাদের আলাপ, সেখান থেকে প্রেম ও তারপর বিয়ে। বিয়ের পর আড়াই বছর ধরে সোহিনীর কোনও ইস্যু হচ্ছিল না। এরপর গত বছর যখন প্রেগন্যান্সি টেস্টের রিপোর্ট সোহিনীর হাতে আসে, তখন বাড়িতে রীতিমতো উৎসবের তোড়জোড় শুরু হয়। (Foods to Encourage Baby’s Weight Gain)
আজ দেখতে দেখতে পরীকে নিয়ে কেটে গিয়েছে সাতটা মাস। সোহিনী আর সুপ্রভ দু’জনে মিলে তাদের ছোট্ট সোনার দেখভাল করে। কিন্তু এত আনন্দের মাঝেও চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াল পরীর কম ওজন। ওর শরীরে কোনও রোগবালাই নেই, অথচ গতমাস থেকে ওর ওজন স্বাভাবিকের থেকেও কম। (Bachhar Ojon) এই সমস্যা নিয়ে চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার পর তিনি সব বিস্তারিত শুনলেন।
পরী খাওয়া দাওয়া কেমন করে, ওর পায়খানার প্রকৃতি কীরকম, কান্নাকাটি করছে বা ঝিমিয়ে পড়ছে কি না ইত্যাদি ইত্যাদি। (List of Healthy Weight Gain Foods for Babies) সমস্ত শুনে তিনি ওর জন্য একটা নতুন ডায়েট করে দিলেন। বললেন, এই ডায়েট মেনে চললে কয়েক দিনেই ওর ওজন স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
শিশুর ওজন স্বাভাবিক না-হলে সব মায়েরাই দুশ্চিন্তায় থাকেন। আপনার সোনার কম ওজন নিয়ে আপনিও দুশ্চিন্তায় আছেন নিশ্চয়ই। শিশুর ওজন বাড়াতে চিকিৎসকরা সঠিক ডায়েটের উপরে ভরসা রাখেন। কোনও গুরুতর অসুখ না-থাকলে পুষ্টিগুণের অভাবেই শিশুর ওজন কমে যায়। তাই সঠিক পুষ্টিকর খাবারই শিশুকে স্বাভাবিক ওজন ফিরিয়ে দিতে পারে। আর সে কারণেই ওষুধের বদলে খাবারের উপরে বিশেষজ্ঞদের ভরসা বেশি। চলুন জেনে নেওয়া যাক, শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য কোন কোন পুষ্টিগুণ খাবারে থাকা উচিত। (Best Foods for Weight Gain in Babies & Toddlers)
বাড়ন্ত বাচ্চার ওজন বাড়াতে প্রয়োজনীয় পুষ্টিগুণ
(Proper Nutrition to Gain Babies Weight)
বাচ্চার ওজন বাড়াতে কোন কোন খাদ্যগুণ বা নিউট্রিশন প্রয়োজন, তা তো জেনে নেওয়া গেল। এবারে জেনে নিতে হবে, কোন কোন খাবার খেলে শিশু এই সব ক’টি উপকরণই পাবে। শিশুর ডায়েট যাই হোক না কেন, কিছু নির্দিষ্ট খাবার তাতে রাখা উচিত, এমনটাই বলেন শিশুস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। চলুন জেনে নেওয়া যাক সেই খাবারগুলো সম্পর্কে।
বাচ্চার ওজন বাড়াতে খাদ্য তালিকায় রাখুন এই ৯টি খাবার
(9 Best Foods for Weight Gain in Babies and Kids)
#1. কলা: পর্যাপ্ত পরিমাণে খেলেও ছোট্ট সোনার খাবার ঠিক মতো হজম হচ্ছে না। তাই কমে যাচ্ছে ওজন। এসব ক্ষেত্রে সমাধান একটাই— কলা। কলা এমন একটি ফল যা খাবার হজম করানোর পাশাপাশি পৌষ্টিকতন্ত্রের অন্যান্য সমস্যাও সারিয়ে দিতে পারে। কলায় রয়েছে ভিটামিন বি-৬, ভিটামিন সি-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ উপাদান যা শিশুকে বিভিন্ন অসুখের থেকেও দূরে রাখে। (Baby Care Tips) কলায় থাকা পটাশিয়াম শিশুর হৃদযন্ত্র ভালো রাখে। তাই সোনামণির ব্রেকফাস্টে এবার থেকে কলা মাস্ট।
#2. অলিভ অয়েল: ছোট্ট সোনার প্যাংক্রিয়াস থেকে নিঃসৃত উৎসেচকই ওকে খাবার হজম করতে সাহায্য করে। এই প্যাংক্রিয়াসকে ভালো রাখে অলিভ অয়েলে থাকা মনোআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট। (Bachhar Ojon Baranor Upay) শিশুর বয়স ছ’মাস পেরিয়ে গেলে চিকিৎসকরা খাবারে অল্প অলিভ অয়েল মিশিয়ে খাওয়ানোর পরামর্শ দেন। অলিভ অয়েলে থাকা উদ্ভিজ্জ ফ্যাট বাচ্চার ওজন বাড়াতে সাহায্য করে। তবে একশো গ্ৰাম খাবারে এক চা-চামচ অলিভ অয়েল যথেষ্ট। এর থেকে বেশি দিলে বাচ্চার ডায়রিয়া হতে পারে। এবং অলিভ অয়েল দেওয়ার সময় শুধুমাত্র একস্ট্রা ভার্জিন তেলই দেবেন। (How Children Can Gain Weight Healthily) এটাই কাঁচা খাওয়ানো যায়। যদি রান্নায় দিতে হয়, সেক্ষেত্রে পিওর অলিভ অয়েল ব্যবহার করবেন।
#3. স্তন্যপান: শিশুর ওজন কম হওয়ায় দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, বাচ্চার ওজন বাড়াতে মায়ের দুধের বিকল্প খাদ্য আর কিছু নেই। সব চিকিৎসকই বাচ্চাকে প্রথম একবছর টানা দুধ খাওয়ানোর পরামর্শ দেন। শক্ত খাবার খাওয়া শুরু করলেও এই দুধ খাওয়া যেন বন্ধ না-হয়। কারণ মায়ের দুধে থাকা ফ্যাট বাচ্চার শরীরে প্রয়োজনীয় ক্যালোরি জোগায়। দুধের মধ্যে থাকা ক্যালসিয়াম বাচ্চার হাড় শক্ত করে। (Sisur Ojon Baranor Upai)
#4. ওটস্: বাচ্চা দৌড়ঝাঁপ আর দুষ্টুমি করতে ওস্তাদ। অত্যাধিক ক্যালোরি বার্নের ফলেই কমে যাচ্ছে ওজন। এমন অবস্থায় ওটস খুবই কার্যকরী। ওটস-এ রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার । তাই এটি সহজে হজম হয়। আর কে না জানে, ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার শিশুকে অফুরন্ত এনার্জি দেয়। তাই এবার থেকে লাঞ্চে রাখুন ওটস্-এর পরিজ।
দেখবেন ওজন নিয়ে দুশ্চিন্তা কিছু দিনেই ভ্যানিশ। (The Best Foods to Help Your Baby Gain Weight)
আরও পড়ুন:আর দুশ্চিন্তা নয়, নিয়ম মানলেই নাদুসনুদুস হবে কোলের ছানা!
#5. অ্যাভোকাডো: ছোট্ট সোনা পর্যাপ্ত পরিমাণ পুষ্টিদ্রব্য না পেলে ওজনে কমতে বাধ্য। তাই চিকিৎসকরা পরামর্শ দেন বাচ্চার প্রধান খাবারের সঙ্গে অ্যাভোকাডো রাখতে। কারণ অ্যাভোকাডোয় রয়েছে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন, ফাইবার, রাইফ্লাভিন, থিয়ামিন, ফোলিক অ্যাসিড ও জিঙ্কের মতো গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টিদ্রব্য। (Baby Weight Gain Food Chart) এই উপাদানগুলো শিশুর কোষের গঠন থেকে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি— সবেতেই ভূমিকা নেয়। পাশপাশি বাচ্চাকে জোগায় পর্যাপ্ত পরিমাণে এনার্জি। তাই বাচ্চার ওজন কম নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকলে ওর লাঞ্চ বা ব্রেকফাস্টে রাখুন অ্যাভোকাডো।
#6. বাদাম: খনিজ পদার্থের অভাবে শিশুর শরীরের বিভিন্ন জৈবিক ক্রিয়াবিক্রিয়া থমকে থাকে। যার প্রভাবে ওজন কমে যাওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার। (Bangla Baby Care) শিশুস্বাস্থ্য-বিশেষজ্ঞরা তাই বাচ্চাকে বাদাম খাওয়ানোর পরামর্শ দেন। কাজুবাদাম, পিনাট বাটারে আছে ক্যালসিয়াম, আয়রন, ম্যাগনেশিয়াম, পটাশিয়ামের মতো গুরুত্বপূর্ণ খনিজ পদার্থ। তাই বাচ্চাকে এবার থেকে লাঞ্চ বা ব্রেকফাস্টে পেস্ট করা বাদাম খাওয়াতে ভুলবেন না। (Safe Weight Gain Tips for Underweight Kids)
#7. চিজ: বিশেষজ্ঞদের মতে, বাচ্চার ওজন বাড়াতে ফ্যাট সমৃদ্ধ খাবার খুবই প্রয়োজন। আর সেদিক থেকে চিজের বিকল্প খুব কম। কারণ চিজে রয়েছে যথেষ্ট পরিমাণ ফ্যাট ও ক্যালসিয়াম। তবে বাচ্চাদের খাওয়ার জন্য ক্রিম চিজ ও কটেজ চিজই সবচেয়ে নিরাপদ। (How to Gain Weight) চিজ প্রায় সব বাচ্চারই পছন্দের খাবার। তাই খাওয়ানো নিয়ে মায়েদের বেশি ঝামেলা নেই। তবে দুই বছরের কমবয়সি শিশুদের গ্ৰেট করা চিজ খাবারে মিশিয়ে দিন। নয়তো গলায় আটকে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
#8. সবজি: ভিটামিন আর খনিজ পদার্থের অভাবে শিশুর শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। যার ফলে ওজন কমে যাওয়া স্বাভাবিক। শিশুর ওজন বাড়াতে ভিটামিন আর খনিজ পদার্থ সমৃদ্ধ খাবার ডায়েটে রাখা মাস্ট। বিশেষজ্ঞদের মতে, ছোট্ট সোনা যখন থেকে শক্ত খাবার খাওয়া শুরু করছে, তখন থেকেই পাতাযুক্ত শাকসবজিও ওর প্লেটে রাখা উচিত। (How to Make Baby Gain Weight Fast) যেমন গাজর আর বিনসে রয়েছে ভিটামিন এ, কে, বি-৬, পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, ম্যাঙ্গানিজের মতো খনিজ পদার্থ। তাই ডিনার বা লাঞ্চ— যে কোনও সময়েই একটি সবজি ওর প্লেটে থাকুক।
#9. ডিম: ছোট্ট সোনার কোনও অসুখ হলে তার প্রভাব ওজনে পড়তে বাধ্য। ডিমে রয়েছে এমন কয়েকটি প্রোটিন, যা শিশুর রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা আরও বাড়িয়ে তোলে। এই প্রোটিনগুলো শিশুর শরীর নিজে তৈরি করতে পারে না। (Sisur Ojon) অথচ এগুলোই ওর শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি করতে প্রয়োজন। তাই আট মাস বয়সের পর থেকে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী শিশুকে নিয়মিত ডিম খাওয়ান। শুরু করুন ডিমের কুসুম দিয়ে। দেখবেন, ওজন নিয়ে দুশ্চিন্তা কিছুদিনের মধ্যেই দূর হয়েছে।
কোনও গুরুতর অসুখ না হলেও ছোট্ট পরীর ডায়েটে ছিল খনিজ পদার্থের ঘাটতি। তাই ওর ওজন নেমে যায় স্বাভবিক মাত্রার নীচে। সোহিনী ডাক্তারের চেম্বার থেকে ফিরে সেদিন থেকেই নতুন ডায়েট ফলো করতে শুরু করে।
সবাইকে চমকে দিয়ে মাত্র ১৪ দিনের মাথায় পরীর ওজন আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে যায়। অর্থাৎ আর সব দুশ্চিন্তার ইতি। আপনিও সোহিনীর মতো আপনার বাচ্চার ওজন এভাবেই স্বাভাবিক করে ফেলতে পারেন। আপনার সাহায্যের জন্য তো রইলই এই চেকলিস্ট। (Foods to Encourage Baby’s Weight Gain)
আরও পড়ুন: বাড়ন্ত বাচ্চার ওজন বাড়াতে ৫টি খাবার
একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।
null
null