বাড়ির ঘড়িতে সবে সকাল ৯ টা। আপনিও রীতিনীতি মেনে লক্ষ্মী মেয়েটির মতো ব্রেকফাস্ট সেরে চেয়ারে বসে পা দোলাচ্ছেন। হঠাৎ কী যেন হল আপনার! মন-প্রাণ যেন ছটফট করে উঠলো রান্নাঘরের রাখা আমের আচারের কথা ভেবে। ব্যাস, যেমন ভাবা অমনি কাজ। আধ বয়াম আচার আপনি একাই সাবড়ে দিলেন! (Cravings During Pregnancy)
আচার ছাড়ুন, ওতো ঘরেই ছিল, দুদিন আগে রাতে বেচারা বরকে ঘুম থেকে উঠিয়ে পাড়ার দোকানে পাঠিয়েছিলেন, আইসক্রিম কিনতে। শুধু কী আইসক্রিম বা আচারে ক্ষান্ত দিচ্ছেন? (Food Cravings During Pregnancy) ব্রাউনি, চকো লাভা, পিৎজা বা কোথাও কিছু মিষ্টি না পেলে মুঠো মুঠো নকুলদানাই উড়িয়ে দিচ্ছেন যখন তখন। আর যখন কিছু খাওয়ার ইচ্ছে হচ্ছে, সেটা যতক্ষণ না খাচ্ছেন মনে যেন কিছুতেই শান্তি হচ্ছে না।
আর বড্ড ভালোবাসেন, এই ভেবে আজ আপনার বরটি চিলি চিকেন কিনে নিয়ে এলো। আপনি প্রচণ্ড খুশি হয়ে খেতে বসলেন, দিয়ে এক কামড় দিয়েই নাক সিটকে “বমি পাচ্ছে” বলে উঠে গেলেন। আপনার ‘উনি’ মুখ কালো করে বসে রইলেন।
আহা, আবার লজ্জা পাওয়ার কী আছে এতে? আপনাকে মোটেই কথা শোনাচ্ছি না বা লজ্জা দিচ্ছি না। বেশ করবেন খাবেন, হাজার বার খাবেন। কিন্তু, আপনার যে কেন এমনটা হচ্ছে আপনি তো নিজেই বুঝতে পারছেন না! মাঝে মাঝে উদ্ভট সময়ে কিছু খেতে ইচ্ছে করছে, আবার প্রচণ্ড পছন্দের খাবারগুলো দেখলে গা গুলিয়ে উঠছে। (Pregnancy Te Ki Ki Khawa Jabe Na) খাবার ইচ্ছে বা অনিচ্ছে যেন পুরোটাই পেট থেকে মনের হাতে চলে গেছে।
বিশ্বাস করুন, এতে আপনার একফোঁটা দোষ নেই। আপনি যে মা হতে চলেছেন! সেই আনন্দে শরীরের ভিতরে এখন সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আর হরমোনের দল তুলকালাম কাণ্ড ঘটাচ্ছে, খামখেয়ালীপনার চূড়ান্ত অবস্থা যাকে বলে!
আপনার ভিতরে বেড়ে উঠছে ছোট্ট একরত্তি প্রাণ, আর তার বসবাসের উপযোগী করতেই শরীর নিজেকে সাজাচ্ছে বড্ড যত্ন করে। এসবেরই প্রভাব দেখা দিচ্ছে বাহ্যিক নানা উপসর্গ হিসেবে। যার মধ্যে এই খাবার নিয়ে খামখেয়ালীপনা অন্যতম। হঠাৎ কিছু খাবার ভীষণ ইচ্ছে বা কিছু বিশেষ খাবারে অনীহা; গর্ভাবস্থায় খুব সাধারণ এক উপসর্গ। (Pregnancy Food Aversions) কেন হয় এমনটা, এর পিছনে কাদের কারসাজি বা কীভাবে সামলাবেন এই “উঠলো বাই, খাবার খাই” ব্যাপারটা? আজ এই নিয়েই আমাদের প্রতিবেদন। খেতে খেতে পড়ে ফেলুন।
যখন খুশি, যা খুশি খেতে ইচ্ছে করছে গর্ভকালে, কিন্তু কেন? (Food Cravings and What They Mean)
#1. হঠাৎ কিছু খাওয়ার ঝোঁক ওঠার কারণ: সময় মানার বালাই নেই, বা ভালো মন্দের বিচার নেই। যখন তখন কোনও কিছু খাওয়ার ইচ্ছে হতে পারে গর্ভবতী মহিলাদের। সে হতে পারে মিষ্টি কিছু বা নোনতা বা ঝালঝাল কোনও পদ বা বিশেষ কোনও খাবার। যতক্ষণ না সেই খাবারটা মুখে পড়ে, মনে যেন কেমন ছটফটানি চলতে থাকে হবু মায়ের। বিদেশী ভাষার পোশাক পরালে এই ব্যাপারটার নাম “ফুড ক্রেভিংস (Food Cravings)”। গর্ভবতী মায়েদের ক্ষেত্রে বড্ড কমন একটা ঘটনা। এর জন্য নির্দিষ্ট কাউকে দায়ী করা না গেলেও মোটামুটি একটা অনুমান করা যায় বই কি!
- হরমোনের নাচানাচি: গর্ভাবস্থায় হবু মায়ের শরীরে যে হরমোনের মাত্রার ওঠাপড়া হতে থাকে, এ আমরা সবাই জানি। আর এই যখন তখন খাওয়ার ইচ্ছে হওয়ার পিছনেও হরমোনের হাত থাকে। আমাদের শরীরে ঘ্রেলিন (ghrelin) নামের একটি হরমোন আছে; এই হরমোন আমাদের খাদ্যাভ্যাসে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে।
এই হরমোনকে “হাঙ্গার হরমোন (hunger hormone)”-ও বলা হয়ে থাকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ঘ্রেলিনের প্রভাব আমাদের খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলেও গর্ভাবস্থায় আসল হাসি হাসে নিউরোপেপটাইড ওয়াই (Neuropeptide Y/NPY) নামের একটি হরমোন। গর্ভবতী মহিলার শরীরে এই হরমোন বেশি মাত্রায় তৈরি হয়। তাই যখন তখন কোনও খাবার খাওয়ার ইচ্ছে হওয়া বা ফুড ক্রেভিং হয়ে থাকে। (Pregnancy Cravings Meaning)
- শরীরের চাহিদা জানানোর নিজস্ব পদ্ধতি: হতে পারে শরীর তার নিজের চাহিদার কথা জানানোর চেষ্টা করছে। গর্ভাবস্থায় শরীরে বেশি পরিপোষক , ক্যালোরি বা এনার্জির প্রয়োজন পড়ে। হবু মায়ের শরীরে আয়রন, ভিটামিন সি, ক্যালসিয়াম ইত্যাদি কোনও পরিপোষকের ঘাটতি হলে শরীর তার মতো করে জানানোর চেষ্টা করে। আর হবু মা, অন্য কিছু খেয়ে রসনা তৃপ্ত করে নেন। ধরুন, মায়ের শরীরে ক্যালসিয়ামের প্রয়োজন এবং শরীর ওই ‘ক্রেভিং’-এর মাধ্যমেই জানানোর চেষ্টা করছে। হবু মা সেটা না বুঝে এক গ্লাস দুধের জায়গায় দু বাটি ভ্যানিলা আইসক্রিম খেয়ে নিলেন। আবার অনেকেরই চা-কফির ভালোমতো অভ্যাস থাকে।প্রেগন্যান্ট হওয়ার পরে সেই অভ্যাস অনেকটাই ছেড়ে দিতে হয়। সেই অভ্যাসের বশবর্তী হয়ে শরীর পরিপূরক অন্য খাবারের সন্ধান করে। এবং তখনই মায়ের নানা রকম খাবার খেতে ইচ্ছে হতে পারে।
- ঘ্রাণেন্দ্রিয় ও স্বাদেন্দ্রিয়র অতিসক্রিয়তা: গর্ভাবস্থায় এই দুই ইন্দ্রিয় যেন বেশি সক্রিয় হয়ে যায়। গন্ধ ও স্বাদের বাছ-বিচার বেড়ে যায় ভীষণভাবে। বিশেষ গন্ধ বা ফ্লেভারযুক্ত খাবার অথবা অন্যরকম বিশেষ স্বাদ হবু মায়ের বিশেষ পছন্দের হয়ে থাকে। তবে এই স্বাদ ও গন্ধের প্রভাব সবার ক্ষেত্রে আলাদা। কেউ প্যাকেট প্যাকেট চিপস উড়িয়ে দিতে চান আবার কেউ হাঁড়ি ভর্তি রসগোল্লা। (Causes and Common Cravings During Pregnancy)
- খাবারের প্রতি ভালোবাসা: আমাদের মধ্যে অনেকেই কিন্তু ভোজনরসিক এবং খেতে বেশ ভালোবাসেন। অনেকেরই ভালো ভালো খাবার খেলে মন ভালো হয়ে যায়। এই ব্যাপারটা গর্ভবতী মায়েদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যাদের কাছে মন ভালো রাখার রাস্তাটা পেট হয়ে যায়, অর্থাৎ যারা আমার মতোই খেতে ভালোবাসেন, তাদের ক্ষেত্রে প্রেগন্যান্সিতেও ফুড ক্রেভিংস বেশি হয়।
আরও পড়ুন: গর্ভাবস্থায় আনারস খাওয়া; কিছু সত্যি, কিছু রটনা
#2. খাবারে অনিচ্ছা বা কোনও খাবারে অনীহার কারণ: শুধু যে খাবার খেতেই ইচ্ছে হয়,এমনটা তো না। অনেকের ক্ষেত্রেই ব্যাপারটা উল্টেও যায়। খাবারে রুচি থাকে না বা খাবার দেখলেই বিরক্তি লাগে। এক্ষেত্রে হরমোনের ভূমিকাকেই প্রধানত দায়ী করা হয়।
- আবারও হরমোন: গর্ভাবস্থায় হিউম্যান কোরিওনিক গোনাডোট্রপিন হরমোন (Human Chorionic Gonadotropin (hCG))-এর মাত্রা দ্রুতহারে বাড়তে থাকে। এর পরোক্ষ প্রভাব হিসেবে দেখা দেয় গা বমি ভাব, মাথা ঘোরা, ক্লান্তি এবং খাবারে অরুচির মতো উপসর্গ।
- নাকের গন্ধকাতর মনোভাব: নাক এসময় যেন বেশিই গন্ধ পায়। যে মাছ, মাংসের রান্নায় আপনার জীবনে গন্ধ লাগেনি, গর্ভাবস্থায় তার সামনেই হয়তো আপনি মুখে আঁচল চাপা দিলেন। খাবারের থেকে আসা গন্ধ আমাদের খাবার খাওয়ার ইচ্ছে বাড়াতে বা কমাতে পারে। খাবার থেকে বাজে গন্ধ আসছে মনে হওয়ার কারণে, হবু মায়ের সেই খাবারে অরুচি চলে আসে। (Funny Pregnancy Cravings)
- শারীরিক অস্বস্তি: প্রেগন্যান্সির প্রথম দিকে শরীরে হওয়া নানারকম অস্বস্তি এবং মানসিক উদ্বেগও খাবারে অরুচি হওয়ার অন্যতম কারণ।
#3. গর্ভাবস্থার কখন এই ধরনের ‘খাবারে খামখেয়ালীপনা’ হয়?
সাধারণত গর্ভাবস্থার প্রথম দিকেই এই ধরনের খাবার ইচ্ছে বা খাবারে অনীহা ব্যাপারটা দেখা দেয়। ফার্স্ট ট্রাইমেসটারের শেষের দিকে এই খামখেয়ালীপনা বেড়ে যায়, সেকেন্ড ট্রাইমেসটারের পুরোটা জুড়ে দাপাদাপি করে। তারপর এর শেষের দিকে আস্তে আস্তে কমতে শুরু করে। বাচ্চা হওয়ার পরে এই খাবারে আসক্তি ও বিরক্তি, দুটোই কোথায় যেন ভ্যানিশ হয়ে যায়। আবার অনেকের ক্ষেত্রে প্রেগন্যান্সিতে এরকম কোনও ঘটনাই ঘটে না।
#4. কীভাবে সামলাবেন খাবার নিয়ে মনের এই খেয়ালীপনা? (What to Do About Pregnancy Cravings)
- খেতে ইচ্ছে হলে হাজারবার খাবেন। তবে একটু সময় আর পরিমাণ বুঝে। যদি সকাল ৭ টায় লেবুর আচার খেতে ইচ্ছে হয়, সেটা খাওয়া তো যুক্তিযুক্ত নয়। আবার রাতের বেলা আইসক্রিম খাওয়ার ইচ্ছে হলে সেটাও তিন চার বাটি খাওয়া ঠিক নয়। প্রেগন্যান্সি চলাকালীন শরীরের নির্দেশ শুনুন, কিন্তু তাতে যেন আপনার শরীর খারাপ না হয়।
- যেসব খাবারে পুষ্টিগুণ কম, সেইসব খাবার খান অল্প পরিমাণে। চকোলেট খাওয়ার ইচ্ছে হলে পুরো বারটা না খেয়ে কতগুলো কিউব ভেঙে খান।
- অসময়ে ভুলভাল খেতে ইচ্ছে হলে মন অন্যদিকে করার চেষ্টা করুন, নিজেকে অন্য কোনও কাজে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করুন। মনে রাখবেন, আপনার খাদ্যাভ্যাসের ওপরেই কিন্তু আপনার বাচ্চা এবং আপনার স্বাস্থ্য নির্ভরশীল। (Weird Pregnancy Cravings)ইচ্ছে হবে জানি। কিন্তু পুষ্টিগুণ যেন মাথায় থাকে। স্বাদ ও স্বাস্থ্যের সমন্বয় ঘটাতে নিজেই নাহয় মিক্স ম্যাচ করে রেসিপি বানান।
- খাবারে অরুচির ক্ষেত্রে বলব, ডাক্তারের সাহায্য নিন। এসময় যথাযথ পুষ্টিটা কিন্তু আপনার ও বাচ্চার জন্য আবশ্যক।
- ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে মাল্টি-ভিটামিন ক্যাপসুল ও সাপ্লিমেনট নিতে থাকুন। খবরদার, নিজে নিজে কোনও ভাবেই কিছু ওষুধ খাবেন না।বাচ্চার ক্ষতি হতে পারে।
- খুব গরম খাবার খাবেন না। ঠান্ডা খাবার খান। গরম খাবারে নাকে বেশি গন্ধ লাগবে। খাবার ঠান্ডা হয়ে গেলে এই গন্ধ আপনাকে সমস্যায় ফেলতে পারবে না।
- খুব বেশি খাওয়াও ভালো না, আবার একেবারেই না খেতে পারলেও মহা বিপদ। তাই, নিজের শরীর সম্পর্কে সচেতন থাকুন। যে কোনও অসুবিধায় ডাক্তারের পরামর্শ নিন। (Cravings During Pregnancy)
আরও পড়ুন : কৎবেল মানেই জিভে জল! গর্ভাবস্থায় খাওয়া কি নিরাপদ?
একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।
null
null