সন্তান নিয়ে আসা নিয়ে কৌস্তুভ আর তানিয়া বেশ কিছুদিন ধরেই আলোচনা করছিল। তানিয়ার কথায়, গর্ভধারণের আগে কী কী প্রস্তুতি নেওয়া উচিত, সে সব বিস্তারিত জেনেই এই ব্যাপারে এগোনো উচিত। কৌস্তুভ সেই মতো একজন স্ত্রী-রোগ বিশেষজ্ঞের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেয়। আগামী দু’-এক মাসের মধ্যেই তানিয়া গর্ভধারণ করতে চায় শুনে, চিকিৎসক তানিয়াকে কয়েকটি দরকারি পরামর্শ দিলেন। বললেন, গর্ভধারণের আগের পর্যায়ে ব্রেকফাস্টে তানিয়ার বিভিন্ন ফর্টিফায়েড খাদ্যশস্য খাওয়া উচিত। এছাড়াও ফর্টিফায়েড ডাল জাতীয় শস্য, পালং শাকও যেন লাঞ্চ বা ডিনারের প্লেটে থাকে। এই নির্দিষ্ট খাবারগুলো মায়ের শরীরে ফলিক অ্যাসিডের জোগান দেয়। ফলিক অ্যাসিড গর্ভধারণের জন্য প্রয়োজনীয় অন্যতম পুষ্টি উপাদান! (Folic Acid Benefits in Pregnancy)
ফলিক অ্যাসিড হল এক রকমের ভিটামিন-বি। চিকিৎসকের কথায়, প্রাকৃতিকভাবে এই ভিটামিনটি বিশেষ পাওয়া না, শরীরকে তৈরি করে নিতে হয়। ফোলেটের সিন্থেটিক রূপ (Form) হল ফলিক অ্যাসিড। মানুষের শরীরে নতুন কোষ উৎপাদনে সহায়তা করে ফলিক অ্যাসিড। ডিএনএ তৈরির ক্ষেত্রে এটিই মুখ্য ভূমিকা পালন করে। (Folic Acid During Pregnancy) প্রিন্যাটাল অর্থাৎ গর্ভধারণের আগের পর্যায়ে ফলিক অ্যাসিড নারীশরীরকে গর্ভধারণের উপযুক্ত করে তোলে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভ্রুণের নিউরাল টিউব গঠন ও তার বেড়ে ওঠার জন্যও ফলিক অ্যাসিড প্রয়োজন। ভ্রুণের মস্তিষ্কের গঠনেও এর ভূমিকা রয়েছে। (Folic Acid Benefits in Pregnancy)
অনেকেই ফলিক অ্যাসিড ও ফোলেটকে একই উপাদান বলে মনে করেন। প্রকৃতপক্ষে এই দু’টি সম্পূর্ণ আলাদা । ফোলেট গোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে বেশ কয়েকটি ভিটামিন-বি । এর মধ্যে ফলিক অ্যাসিড হল প্রধানতম। এছাড়াও ফোলেট গোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে ডাইহাইড্রোফোলেট, টেট্রাহাইড্রোফোলেট নামের আরও কিছু ভিটামিন-বি।
তানিয়ার কখন ফলিক অ্যাসিড খাওয়া উচিত? চিকিৎসকের কাছে কৌস্তুভ জানতে চাইল। চিকিৎসক জানালেন, মেয়েদের সন্তানধারণের বয়স হওয়ার পর থেকেই ফলিক অ্যাসিড খাওয়া শুরু করা উচিত। এতে বেশি বয়সেও মেয়েরা শারীরিকভাবে ভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে না।
সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) সংস্থার মতে, ফলিক আ্যাসিড গর্ভধারণের অন্তত একমাস আগে থেকে প্রতিদিন খাওয়া উচিত। প্রেগন্যান্সি চলাকালীন ও সন্তান জন্ম নেওয়ার পরেও ফলিক অ্যাসিড খাওয়া চালিয়ে যেতে হবে। (Does Taking Folic Acid Help Getting Pregnant) গর্ভধারণের প্রথম কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই ভ্রুণের সুষুম্নাকান্ড তৈরি হয়। এই সময় ভ্রুণের জন্য ফলিক অ্যাসিড অত্যন্ত জরুরি। একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, যেসব মায়েরা গর্ভধারণের একবছর আগে থেকে ফলিক অ্যাসিড খান, তাদের ক্ষেত্রে প্রিম্যাচিউর বার্থের আশঙ্কা অনেকটাই কমে যায়।
গর্ভাবস্থার আগে ও গর্ভাবস্থায় ফলিক অ্যাসিড খাওয়া উচিত। তবে সব পর্যায়ে এর পরিমাণ এক নয়। চিকিৎসকের মতে, গর্ভধারণের আগে ফলিক অ্যাসিড দিনে ৪০০ মাইক্রোগ্ৰাম খাওয়া উচিত। (Folic Acid 5mg Before Pregnancy) গর্ভধারণের পর প্রথম তিনমাস প্রতিদিন ৫০০ মাইক্রোগ্ৰাম খেতে হবে। চতুর্থ মাস থেকে নবম মাস পর্যন্ত প্রতিদিন ৬০০ মাইক্রোগ্ৰাম ফলিক অ্যাসিড খাওয়া উচিত। (Folic Acid Dose in Pregnancy) চিকিৎসকের কথায়, এই সময় ভ্রুণের চাহিদা মেটাতেই ফলিক অ্যাসিড বেশি পরিমাণে প্রয়োজন হয়। সন্তান জন্মের পরে ব্রেষ্ট ফিডিং পর্যায়ে মায়ের প্রতিদিন ৫০০ মাইক্রোগ্ৰাম ফলিক অ্যাসিডের প্রয়োজন।
ফলিক অ্যাসিড সাপ্লিমেন্টের আকারে বাজারে পাওয়া যায়। যেসব মাল্টিভিটামিনে অন্তত ৪০০ মাইক্রোগ্ৰাম ফলিক অ্যাসিড থাকে, সেই মাল্টিভিটামিনই মায়ের জন্য উপযুক্ত। এছাড়া চাল, গম, ওটস্ ও ডালজাতীয় শস্য থেকে তৈরি ফর্টিফায়েড খাবারেও ফলিক অ্যাসিড থাকে।
কিছু নির্দিষ্ট ধরনের পাউরুটিতেও ফলিক অ্যাসিড থাকে। এছাড়া পালং শাকও ফলিক অ্যাসিডের উৎস।
আরও পড়ুন: থাইরয়েড গ্রন্থির খামখেয়ালীপনায় শরীরে কী কী অসুবিধা হতে পারে, প্রতিকার-সমেত জেনে নিন!
তানিয়া চিকিৎসকের কাছে ফলিক অ্যাসিডের উপকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চেয়েছিল। চিকিৎসক এবারে একে একে সেগুলো বললেন। (Benefits of Taking Folic Acid Before Pregnancy)
#1. নিউরাল টিউবে অস্বাভাবিকতা (Neural Tube Defect): নিউরাল টিউবের শেষ অংশ ঠিকমত বন্ধ না হলে এতে অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়। এর ফলে সন্তানের জন্মের পর নানারকম সমস্যাও দেখা দিতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ফলিক অ্যাসিড নিয়মিত খেলে ভ্রুণের নিউরাল টিউবের অস্বাভাবিকতা ৫০ শতাংশ কমে যায়। এছাড়াও প্রথম সন্তানের ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক নিউরাল টিউব থাকলে পরের সন্তানের ক্ষেত্রেও তা থাকার আশঙ্কা থাকে। তবে নিয়মিত ফলিক অ্যাসিড খেলে এই আশঙ্কা ৭০ শতাংশ পর্যন্ত কমানো সম্ভব। (Folic Acid for Pregnancy) এক্ষেত্রে ফলিক অ্যাসিডের ডোজ চিকিৎসক ৪০০ মাইক্রোগ্ৰাম থেকে বাড়িয়ে দেন। ডোজ কতটা হবে, সেটা চিকিৎসকই বলে দিতে পারবেন।
#2. স্পাইনা বিফিডা (Spina Bifida): গর্ভধারণের প্রথম মাসেই ভ্রুণের সুষুম্নাকান্ড তৈরি হয়। এই সুষুম্নাকান্ড বা ভার্টিব্রার গঠন সম্পূর্ণ না হলে স্পাইনা বিফিডার সমস্যাটি দেখা দেয়। এই সমস্যা সদ্যোজাতের শরীরে দেখা দিলে তার একাধিক অপারেশন করার প্রয়োজন পড়ে। এই সমস্যার ফলে সদ্যোজাত স্থায়ীভাবে পক্ষাঘাতেও আক্রান্ত হয়ে যেতে পারে। তাই গর্ভাবস্থায় যথেষ্ট পরিমাণে ফলিক অ্যাসিড ভ্রুণকে দেওয়া উচিত।
#3. অ্যানেনসেফালি (Anencephaly): ফলিক অ্যাসিডের অভাবে নানারকম সমস্যা দেখা যায়। বিশেষজ্ঞদের কথায়, এদের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ সমস্যা হল অ্যানেনসেফালি। অনেক সময় দেখা যায়, গর্ভে থাকাকালীন ভ্রুণের মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ সম্পূর্ণ তৈরি হয়নি। বিজ্ঞানের পরিভাষায় একেই অ্যানেনসেফালি বলা হয়। এসব ক্ষেত্রে সদ্যোজাত শিশুটির আয়ুও কমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, গর্ভধারণের আগে থেকে ফলিক অ্যাসিড নিয়মিত খেলে ভ্রুণের এই সমস্যা এড়ানো সম্ভব।
#4. জন্মগত অস্বাভাবিক হৃৎপিণ্ড (Congenital Heart Defect): অনেক সময় ভ্রুণের হৃৎপিণ্ড ও হৃৎপিণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকা রক্তনালী সঠিকভাবে গড়ে ওঠে না। এতে হৃৎপিণ্ডের ভিতরের দেওয়াল ও ভালভগুলি ক্ষতিগ্ৰস্ত হয়। এছাড়াও হৃৎপিণ্ড থেকে নির্গত ধমনীগুলিও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা একেই কনজেনিটাল হার্ট ডিফেক্ট বলেন। গর্ভাবস্থায় ফলিক অ্যাসিড সাপ্লিমেন্ট নিয়মিত খেলে ভ্রুণের শরীরে এই সমস্যা দেখা দেয় না।
#5. ক্লেফ্ট লিপ ও ক্লেফ্ট প্যালেট (Cleft Lip & Cleft Palate): গর্ভাবস্থায় ফলিক অ্যাসিড না খেলে ভ্রুণের এমন সমস্যাও দেখা দিতে পারে। এক্ষেত্রে জন্মের সময় শিশুর নাকের নীচে থাকা উপরের ঠোঁটটির অংশ মাঝখান থেকে চেরা হয়। চেরা অংশটি নাকের সঙ্গে গিয়ে মিলিত হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, ফলিক অ্যাসিডের অভাবেই শিশুর ঠোঁটের এমন অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়।
#6. প্রিম্যাচিউর বার্থ (Premature Barth): ফলিক অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাবার বা সাপ্লিমেন্ট নিয়মিত খেলে শিশুর প্রিম্যাচিউর বার্থও সহজে এড়ানো যায়। প্রিম্যাচিউর বার্থে শিশুর শরীর বাইরের পরিবেশের সঙ্গে মানাতে পারে না। এছাড়াও প্রিম্যাচিউর শিশুর ওজনও স্বাভাবিক ওজনের থেকে কম হয়। ফলিক অ্যাসিড গর্ভাবস্থায় ভ্রুণের কোষ বিভাজনে সাহায্য করে। ডিএনএ গঠনে সাহায্য করায় এটি ভ্রুণের প্রিম্যাচিউর বার্থও প্রতিরোধ করে।
#7. মিসক্যারেজ (Miscarriage): গর্ভপাত বা মিসক্যারেজ যে কোনও মায়ের জন্যই অত্যন্ত দুঃখের। গবেষণায় দেখা গিয়েছে এর পিছনে নানা কারণ থাকতে পারে। যার মধ্যে অন্যতম কারণ হল ফলিক অ্যাসিডের অভাব। ফলিক অ্যাসিডের অভাবের ফলে জরায়ু থেকে ভ্রুণের শরীরে সঠিক পরিমাণে পুষ্টি সরবরাহ হয় না। চিকিৎসকরা তাই পরামর্শ দেন, গর্ভধারণের অনেক আগে থেকেই ফলিক অ্যাসিড খাওয়া উচিত। এতে মায়ের জরায়ুও সন্তানধারণের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি সংগ্ৰহ করতে পারে।
চিকিৎসকের পরামর্শ পেয়ে সেদিন তানিয়া সত্যিই খুব উপকৃত হয়। ফলিক অ্যাসিড সাপ্লিমেন্ট নিয়মিত খাওয়ার ফলে তানিয়া গর্ভধারণের পর থেকে প্রসবের সময় পর্যন্ত কোনও সমস্যাই হয়নি। ছোট্ট ঈশান জন্মানোর পর চিকিৎসকও জানান, ঈশান সম্পূর্ণ সুস্থ ও স্বাভাবিক। (Folic Acid Benefits in Pregnancy)
আরও পড়ুন: গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিসের প্রভাব ও কীভাবে সুস্থ রাখবেন নিজেকে, জেনে নিন বিশদে!
একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।
null
null