বাচ্চার মাথার পিছনদিক চ্যাপ্টা হবে না আর; মেনে চলুন এই টিপসগুলো!

বাচ্চার মাথার পিছনদিক চ্যাপ্টা হবে না আর; মেনে চলুন এই টিপসগুলো!

ছোট্ট তুতানের বয়স ১ মাস। বড্ড ঘুমোয় সে; একেবারে চিতমাত দিয়ে হাত-পা তুলে ঘুমচ্ছে তো ঘুমচ্ছেই। তা বেশ, ভালো কথা; বাচ্চারা তো ঘুমবেই। এতে কোনও অসুবিধাই নেই! গতকাল তুতানের দিদা এসেছেন নাতির সাথে দেখা করতে। নাতিকে কোলে নিয়েই অভিজ্ঞ হাত বুঝে গেছে যে নাতির মাথার বামদিকটা আর নিটোল গোল নেই। কেমন যেন একটু চেপ্টে গেছে। তুতানের মা তরী এই প্রথম “মা” হয়েছে; আরও দশদিকে সামলাতে গিয়ে বাচ্চার মাথার আকার নিয়ে মাথা ঘামানোর সুযোগই পায়নি বেচারি। আজ মা বলতে তরী খেয়াল করে দেখলো যে, সত্যি তুতানের মাথার একপাশটা চেপ্টে যাচ্ছে। (Tips to Prevent a Flat Head in Babies)
ভয়ের কোনও কারণ না থাকলেও বড় হয়ে চ্যাপ্টা মাথা দেখে তুতান যে মোটেই খুশি হবে না! নাতির মাথা নিটোল গোল রাখতে দিদুন লেগে পড়লেন বালিশ বানাতে আর তরী একফাঁকে আলোচনা সেরে নিল তার ডাক্তার-বন্ধুনীর সাথে। সবকিছু জেনে আমরাও সাজিয়ে দিলাম প্রতিবেদন। ছোট্ট বাচ্চার গোল মাথাটির স্বার্থে পড়ে নাও এখনই। (Preventing Flat Heads in Babies Who Sleep on Their Backs)

 

#1. ছোট্ট বাচ্চার মাথা চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া বা ফ্ল্যাট হেড কী? (Understanding Flat Head Syndrome)

একদম ছোট্ট বাচ্চাদের মাথার পিছনের দিকটা বা পিছনের দিকের একটা পাশ চ্যাপ্টা হয়ে যায়। খুব বেশি হয়ে গেলে এই চ্যাপ্টা আকার কিন্তু পরবর্তীতে আর ঠিক হয় না। বড় বয়সে চুলে বোঝাই হয়ে সেরকম বোঝা না গেলেও মাথার পিছনের অংশের আসল আকার কিন্তু চ্যাপ্টাই থেকে যায়। এই ঘটনাটিকেই মাথা চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া বা ফ্ল্যাট হেড সমস্যা বলা হয়।

#2. বাচ্চার মাথা চ্যাপ্টা কেন হয়ে যায়? (Why Do Some Babies Develop Flat Spots on Their Heads?)

বাচ্চার জন্মের পর প্রথম ৬ মাস বাচ্চাকে চিত করে শোওয়ানোই উচিত। এভাবে ঘুমলে বাচ্চার অকালমৃত্যু বা সাডেন ডেথ সিন্ড্রোমে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও অনেকটাই কমে যায়।
এবারে, নবজাতকের স্কাল বা মাথার খুলি খুব নরম হয়। এতটাই নরম হাড় দিয়ে মাথার খুলির কাঠামো তৈরি থাকে, যে ক্রমাগত চাপ পড়লে তা নিজের আকারই বদলে ফেলতে পারে। (Why Do Some Babies Develop Flat Spots on Their Heads?) বাচ্চার ঘাড় পুরোপুরি শক্ত হতেও প্রায় ৫-৬ মাস সময় লেগে যায়। তাই, বাচ্চা যখন ঘুমোয় নিজের চাহিদামতো ঘাড় ঘোরাতে পারে না ফলে যে কোনও একদিকে ঘাড় কাত করে ঘুমনোর প্রবণতা তার মধ্যে দেখা যায়।
একটা উদাহরণ দিয়ে বোঝাই? ধরুন, আপনার বাচ্চা সারাক্ষণ বাঁদিকে ঘাড় কাত করেই ঘুমোয়। এর ফলে মাথার বাঁদিকের স্কালের হাড়ে একটানা চাপ পড়তে থাকে এবং বাচ্চার মাথা বাঁদিকে চেপ্টে যায়। ডাক্তারি পরিভাষায় এরই নাম পজিশনাল প্ল্যাজিওসেফালি (Positional plagiocephaly)।
যেসব বাচ্চার মাথা একটু আধটু চ্যাপ্টা হয়, সেটা পরে বড় হলে ঠিকও হয়ে যায়।

#3. বাচ্চার মাথা চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া কী খুব ভয়ের কিছু? (Do You Need to Worry if Your Baby Has a Flat Head?)

একেবারেই না, বাচ্চার মাথা চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়ার মধ্যে ভয়ের কিছুই নেই। বাচ্চার মস্তিষ্কের সঠিক বিকাশে কোনও ভাবেই বাধা সৃষ্টি করে না। আর চ্যাপ্টা তো ঠিক নয়; মাথার পিছনের দিকের অংশ একটু যেন টাল খেয়ে যায়। বামদিক বা ডানদিক বা মাথার পিছনে সোজাভাবেই মাথার আকার গোল থাকে না। খুদের যখন চুল কম থাকবে, তখন এরকম হয়ে গেলে চোখে পড়বে। ভবিষ্যতে চুলের গোছা এসে ঢেকে দেবে ছানার চ্যাপ্টা মাথা।
আসলে, মাথা চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া দেখতেই খারাপ লাগে। অল্প হল, ঠিক আছে; কিন্তু খুব বেশি হয়ে গেলে পরে চুলের গোছাও কিন্তু ঢেকে দিতে পারে না তাকে। (Do You Need to Worry if Your Baby Has a Flat Head?) তাই ছোট বয়স থেকেই তার যত্ন নেওয়াটা একান্ত দরকার।

 

আরও পড়ুন: বাচ্চাকে দেদার সাজাচ্ছেন চোখে কাজল টেনে; অজান্তে ওর ক্ষতি করছেন না তো?

 

#4. বাচ্চার মাথার আকার ঠিক রাখতে কী কী করতে পারেন? (Tips to Prevent a Flat Head in Babies)

  • পজিশন পাল্টাতে থাকুন নিয়মিত: একই দিকে রোজ শোওয়াবেন না বাচ্চাকে। চিত করে শোওয়াবেন অবশ্যই, তবে মাথা যেন কোনও নির্দিষ্ট একদিকে না থাকে। (How to Prevent Infant Flat Head)
  • ঘুমের মধ্যেও সাইড বদল: ছোট্ট বাচ্চারা এমনিই অনেকক্ষণ ঘুমোয়। সেরকম হলে ঘুমের মধ্যেই বাচ্চার মাথা আলতো হাতে অন্য পাশে কাত করে দিন। অনেকক্ষণ টানা ঘুমলেই এমনটা করবেন। না হলে বাচ্চার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটতে পারে।
  • টামি টাইম হোক নিয়মিত: নিয়ম মেনে বাচ্চাকে করান টামি টাইম। টামি টাইম নাম শুনে ঘাবড়ে যাবেন না। বাচ্চাকে তার পেটের ওপর উপুড় করে শুইয়ে খেলানোকেই ভালোবেসে টামি টাইম বলে।
    বাচ্চা যখন জেগে থাকবে, চনমনে থাকবে এবং ক্লান্ত থাকবে না; সেইসময়টাই বাচ্চাকে টামি টাইম করানোর উপযুক্ত সময়। বাচ্চাকে নিজের পেটের ওপর শুইয়ে নিন উপুড় করে। বাচ্চার পেট লেগে থাকবে আপনার পেটে। এবার বাচ্চার সাথে কথা বলুন, ওকে ডাকুন, ওর সাথে খেলুন। এসবের প্রভাবেই বাচ্চা ঘাড় তুলে তাকাতে চেষ্টা করবে ও ঘাড় নাড়াতে চেষ্টা করবে। আস্তে আস্তে শক্ত হতে শুরু করবে ওর নরম ঘাড়। ঘাড় একটু শক্ত হয়ে গেলেই বাচ্চা মাথার ভারে আর একপেশে হয়ে শুয়ে থাকবে না। (How to Prevent Flat Head)
  • জেগে থাকলেও নজর রাখুন: বাচ্চা যদি শুয়ে শুয়ে খেলছে বা স্ট্রলারে চেপে বাইরে ঘুরতে বেরিয়েছে, নজর দিন মাঝে মাঝে। একইদিকে মাথা পেতে রাখলে তা সরিয়ে দিন অন্যদিকে। অবশ্যই খুব সাবধানে।
  • ঘাড় শক্ত হতে সাহায্য করুন: বাচ্চার সাথে কথা বলুন, ওকে ডাকুন, ২ মাস বয়স হলেই ওকে বেড়াতে নিয়ে যান; তা হলে বাচ্চাও ঘাড় ঘুরিয়ে শব্দের উৎস খোঁজার চেষ্টা করবে, নতুন জিনিস দেখতে পেলে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখবে। ঘাড়ের পেশি শক্ত হতে এসবই সাহায্য করবে ওকে। ঘুমনোর সময় ছোট্ট মাথাটিকে নিজে নিজেই ঘোরানোর শক্তি পাবে খুদে। (How to Help Babies Avoid Getting a Flat Head)
  • আলতো হাতে ম্যাসাজ: অনেক বাচ্চার ঘাড়ের পেশি বা হাড় নমনীয় হয় না। ডাক্তারবাবুর পরামর্শ নিয়ে একদম আলতোহাতে আস্তে আস্তে ঘাড়ে ম্যাসাজ করে দিন। কীভাবে ম্যাসাজ করবেন, দেখিয়ে দেবেন আপনার ডাক্তারবাবুই। এই ম্যাসাজ ঠিকভাবে করা হলে বাচ্চার ঘাড় নমনীয় হয়।

 

#5. পুরনো দিনের ঠাকুমা-দিদুনের কার্যকরী টোটকা (Home Remedies to Prevent Flat Head in Babies)

  • সর্ষের বালিশ: সরষের বালিশের কথা কে না জানে? বাড়িতে একটা বাচ্চা এলো মানেই তার জন্য সরষের বালিশ তৈরি হয়ে গেলো। সরষের বালিশ মাথায় দিয়ে শোওয়ালে বাচ্চার মাথার আকার চ্যাপ্টা হয় না বা এতটাই কম হয় যা বড় হলে ঠিক হয়ে যায়।

কীভাবে বানাবেন সর্ষের বালিশ?

  • ছোট্ট একটা বালিশ বানানোর মতো পরিমাণে গোটা কালো সর্ষে নিয়ে ভালো করে ধুয়ে জল ঝরিয়ে শুকিয়ে নিন।
  • বালিশের খোল বানিয়ে নিয়ে সর্ষেগুলো ওতে ভরে দিন এবং খোলা মুখ ভালো করে সেলাই করে দিন।
  • পাতলা কটনের বালিশের ওয়াড় পরিয়ে দিন। (Flat Head Baby Pillow)

 

  • শিমুল তুলোর বিড়া বালিশ: বিড়ার মতো দেখতে হয় বলে এই বালিশকে বিড়া বালিশ বলা হয়। বাচ্চার মাথার আকার ঠিক রাখার জন্য এই ধরনের বালিশ খুবই উপকারী। নরম হওয়ার জন্য বাচ্চা খুব আরাম পায় এতে; ওর ঘাড়ও সাপোর্ট পায়। (Tips to Prevent Your Baby from Having a Flat Head)

কীভাবে বানাবেন শিমুলের বিড়া বালিশ?

  • বিড়া তৈরি করার জন্য লম্বা পাইপের আকারে একটা কাপড়ের খোল বানিয়ে নিন। একমুখ বন্ধ লম্বা পাইপের মতো দেখতে হবে এই কাপড়ের খোলটি।
  • খোল তৈরি করার জন্য নরম, পুরনো সুতির কাপড় ব্যবহার করুন।
  • এবার খোলের ভিতর ভালো মানের শিমুল তুলো ভরে নিয়ে খোলা মুখটা সেলাই করে দিন। এবার পাইপের মতো বালিশটা পেঁচিয়ে নিয়ে বিড়ার আকারে আনুন এবং সেলাই করে দিন।
  • বালিশ যেন খুব বেশি শক্ত না হয়; সেদিকে খেয়াল রাখুন। খুব বেশি তুলো ভরবেন না একবারে। (How to Treat Flat Head in Babies)

মনে রাখুন, বাচ্চা মানুষ; তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলোও বড্ড বাচ্চা এবং কাঁচা। টানাহেঁচড়া করতে গিয়ে সে যেন কোনও ভাবেই আঘাত না পায়। (How to Fix Baby Flat Head) ঘাড়ের ব্যায়াম হোক বা মালিশ, বা ঘুমের মাঝে জায়গা বদল; সবটাই করুন অতি সাবধানে। সামান্য সতর্কতা নিলেই বাচ্চার মাথা চ্যাপ্টা আকার নেবে না; নিলেও সেটা সেরে যাবে বয়সের সাথে। মাথা চ্যাপ্টা নিয়ে ভয়ের কোনও কারণ নেই; তবে যদি দেখেন বাচ্চার ঘাড় নমনীয় নয় একেবারেই বা ঘাড় ঘোরাতে গেলে বাচ্চার অস্বাভাবিক কষ্ট হচ্ছে বা লক হয়ে যাচ্ছে; ডাক্তারবাবুকে দেখাতে দেরি করবেন না। ঘাড় শক্ত হলেই তো ছোট্ট নিটোল গোল মাথাটি ‘মাথা তুলে’ দাঁড়াবে। (Tips to Prevent a Flat Head in Babies)

 

আরও পড়ুন: ছোট্ট ছানাকে কীভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখবেন? রইল সহজ গাইডলাইন!

 

একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার  হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব। 

null

null