জেনে নিন কোন কোন খাবার ১ বছরের নীচে দিলে স্বাস্থ্যের ক্ষতি হতে পারে আপনার বাচ্চার!

জেনে নিন কোন কোন খাবার ১ বছরের নীচে দিলে স্বাস্থ্যের ক্ষতি হতে পারে আপনার বাচ্চার!

নন্দিতা সেনের বয়স ৬০ ছুঁই ছুঁই। স্কুলে পড়ান, আগামী বছর চাকরি থেকে অবসর নেবেন। তাঁর নিজের বিষয় জীববিদ্যা। বিজ্ঞানের ছাত্রী এবং শিক্ষিকা হওয়ার সুবাদে নন্দিতা নিজের এবং চারপাশের প্রতিটা মানুষের সব কাজই রীতিমতো বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিতে সঠিক কি না, তা বিচার করে নেওয়ার চেষ্টা করেন। এহেন নন্দিতা সম্প্রতি ঠাকুমা হয়েছেন। সাত মাসের নাতিকে কোলে নিয়ে গান শোনাতে বড় ভালোবাসেন তিনি। আর নাতি যদি কেঁদে ওঠে, তার মুখে মধু ভেজানো চুসি ধরিয়ে দেওয়াটাও নন্দিতার কাছে বড় আদরের। কিন্তু এই আদরের কাজটাতেই বাধা পড়েছে। নন্দিতার বৌমা অর্পিতা বেঁকে বসেছে ঠাকুমার এই নাতিকে মধু খাওয়ানোর বিষয়ে। বৌমার দাবি, এটা একদম ঠিক কাজ নয়। সে নাকি কোথায় শুনেছে! (The five worst foods for babies in Bengali, Je khabargulo shishur swasthyer janyo khotikarok, Sishur jonyo khotikor khabar. Five worst foods for babies in Bengali.)

অর্পিতা বলে কী! একরত্তি বাচ্চা! তার মুখে মধু দেওয়া হবে না! নন্দিতা তাঁর মা-ঠাকুমার মুখে শুনেছেন, বাচ্চার মুখে মধু না-দিলে নাকি সে বিরাট ঝগড়ুটে হয়। এ সব অযৌক্তিক কথায় কোনও বিশ্বাস নেই নন্দিতার। কারণ এর পিছনে বিজ্ঞানের ন্যূনতম ভূমিকা নেই। কিন্তু নন্দিতা বিশ্বাস করেন, মধু খেলে রোগ প্রতিরোধ বাড়ে, জ্বরজারি কম হয়। সেই কারণেই আমরা শীতে মধু খাই। তাই তিনি নাতির মুখে মধু দেওয়ার একশো শতাংশ পক্ষে। কিন্তু বৌমা অর্পিতার বক্তব্য, এ সব নাকি একদম ভুল ধারণা। মধুর চোটে নাকি ক্ষতি হতে পারে বাচ্চার।নন্দিতা মোটেই একবগ্গা, ইস্পাত-কঠিন মানুষ নন। বিরুদ্ধ মত শুনতে তাঁর কোনও আপত্তিই নেই। তাই তাঁর নাতি শুভর পরের দিন ডাক্তার দেখানোর সময় অর্পিতার সঙ্গে তিনিও চলে গেলেন চেম্বারে। বৌমা যখন বলছেই, তখন বিষয়টা চিকিৎসকের থেকে ভালো করে জেনে নেওয়াই যাক না। মধু ভালো নাকি মন্দ, তা পরিষ্কার হয়ে যাবে বিশেষজ্ঞের কথা থেকেই।

চেম্বারে এসে দীর্ঘদিনের ধারণা ভেঙে গেল নন্দিতার। অর্পিতার কথা সমর্থন করে চিকিৎসকও বললেন, মধু এত ছোট শিশুর জন্য মোটেই ভালো নয়। অনেক পরিবারেই দীর্ঘদিনের রেওয়াজ বাচ্চাদের একদম ছোট থেকে মধু খাওয়ানোর। কিন্তু এটা নাকি মোটেই ঠিক কথা নয়। ডাক্তারবাবুর মতে, এ সব সেকেলে যুগের ধারণা। বর্তমান চিকিৎসা-বিজ্ঞান বলছে, মধু থেকে বাচ্চাদের ফুড পয়জন-এর মতো সমস্যাও হতে পারে। তবে শুধুমাত্র মধু নয়, এমন আরও অনেকগুলো খাবার রয়েছে, যা বাচ্চাদের অবলীলায় দিয়ে দেন তাদের বাবা-মা বা পরিবারের মানুষ। কিন্তু এগুলো চরম ক্ষতি করতে পারে বাচ্চার। বাচ্চাকে কখনওই দেওয়া যাবে না, এমন খাবারের একটা তালিকাও তৈরি করে দিলেন তিনি। তার থেকে বাছাই করা পাঁচটা রাখা হল এই তালিকায়। (The five worst foods for babies in Bengali, Je khabargulo shishur swasthyer janyo khotikarok, Sishur jonyo khotikor khabar)

 

 

যে পাঁচটি খাবার কখনওই শিশুকে দেওয়া যাবে না (Five Worst Foods for Babies)

 

#1. মধু: মধুর কথা দিয়ে যখন বিষয়টা শুরু হল, তখন প্রথমেই বলে নেওয়া যাক, কেন এটা শিশুর জন্য ক্ষতিকারক। চিকিৎসকদের মতে বহু পরিবারেই শিশুদের ছোটবেলায় মধু খাওয়ানোর রেওয়াজ আছে। কিন্তু এটা একেবারেই বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি না। এবং এতে শিশুর ক্ষতি হতে পারে।

 

কেন ক্ষতির: মধুতে একটি বিশেষ উপাদান থাকে, যার নাম ক্লসট্রিডিয়াম বোটুলিনাম (Clostridium botulinum)। যা একটি ব্যাকটেরিয়ার জন্ম দেয়। সেই ব্যাকটেরিয়া শিশুর শরীরে বোটুলিজম নামক রোগের সৃষ্টি করতে পারে। তবে শিশুর বয়স এক বছর পেরিয়ে গেলে এই রোগের আশঙ্কা কমতে থাকে। তখন তাকে অল্প অল্প করে মধু দেওয়া যেতে পারে।

 

কী করতে হবে: বাচ্চাকে চুসির মধ্যে দেওয়ার জন্য মধুর কোনও বিকল্প নেই। কিন্তু বাচ্চার মুখ মিষ্টি রাখতে তাকে সামান্য কলা চটকে দেওয়া যেতে পারে। তবে তার আগেও চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে নেওয়া ভালো।

 

 

#2. লজেন্স এবং চকোলেট: লজেন্স, টফি বা চকোলেট বাচ্চার জন্য খুবই ক্ষতিকারক। বিশেষ করে জেলি জাতীয় লজেন্স। ললিপপ গোছের লজেন্সও শিশুদের না-দেওয়াই ভালো।

 

কেন ক্ষতির: লজেন্স, টফি বা চকোলেটে থাকা চিনি মুখের মধ্যে এক ধরনের অ্যাসিড উৎপাদন করে, যা দাঁতের অ্যানামেলের খুব ক্ষতি করে। যে ধরনের লজেন্স মুখের মধ্যে অনেক ক্ষণ ধরে থাকে, তাতে ক্ষতির পরিমাণ আরও বেশি।

 

কী করতে হবে: শিশুর দাঁতের এবং মুখের যত্ন নিতে এসব লজেন্স থেকে তাকে দূরে রাখুন। যদি একান্তই না পারেন, তা হলে অন্য খাবার খাওয়ানো হচ্ছে, এমন সময় বা খাওয়ানোর শেষে তাকে এই জাতীয় লজেন্স বা টফি দিন। মনে রাখবেন, সে যেন জমিয়ে রেখে-রেখে এই লজেন্স না-খায়। তাকে বোঝান, খুব দ্রুত খেয়ে শেষ করে নিতে হবে এই টফি। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা, লজেন্স, টফি, চকোলেট বা অন্য কোনও ধরনের মিষ্টি খাওয়ার পর অবশ্যই যেন তার দাঁত মাজানো হয়। ব্রাশ করলে মুখে এই চিনির পরিমাণ অনেকটাই কমে যায়।

 

আরও পড়ুনঃ শিশুর সুরক্ষায় কোন বয়সে কোন টিকা!

 

#3. চিপস এবং তেলেভাজা: এক বছরের কম বয়সি শিশুদের জন্য চিপস বা তেলেভাজা ভয়ানক ক্ষতিকারক। এই ধরনের খাবারে স্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকে এবং নুনের মাত্রার বিপুল হয়। যা শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকারক।

 

কেন ক্ষতির: চিপস বা প্যাকেটের স্ন্যাকস-এ বিপুল পরিমাণে লবণ থাকে। আর কড়া ভাজা খাবার, যেমন সিঙাড়া বা চপে থাকে স্যাচুরেটেড ফ্যাট। একই কথা জিলিপি বা অন্য ভাজা মিষ্টির জন্যও প্রযোজ্য। এই দুটো জিনিসই শিশুর পক্ষে হজম করা কঠিন। তা ছাড়া এই ধরনের খাবার পেটের মধ্যে অনেক জায়গা দখল করে ফেলে। ফলত পুষ্টিকর খাবার ধারণ করার মতো জায়গা কমে যেতে পারে আপনার সোনার পেটে। তার খিদে কমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।

 

কী করতে হবে: শিশুর প্রতিদিন এক গ্রামের মতো লবণ দরকার। ফলে এই জাতীয় স্ন্যাক্স দেওয়ার কোনও অর্থই হয় না। বরং শিশুর স্বাদবদলের জন্য টাটকা ফল টুকরো করে কেটে তাকে স্ন্যাক হিসেবে দিন। তার বয়স এক বছরের বেশি হয়ে গেলেও চেষ্টা করুন, তাকে এই সব খাবার থেকে দূরে রাখতে।

 

 

#4. সোডা পানীয় এবং ফ্রুট জুস: সোডা ড্রিংক এবং প্যাকেটের ফ্রুট জুস আপনার সোনামণির জন্য খুবই ক্ষতিকারক। অতিরিক্ত পরিমাণে অ্যাসিড এবং চিনি শিশুকে রীতিমতো অসুস্থ করে ফেলতে পারে।

 

কেন ক্ষতির: সোডা পানীয় বা প্যাকেটের ফ্রুট জুসে অতিরিক্ত পরিমাণে চিনি এবং অ্যাসিড থাকে। যা আপনার খোকা বা খুকুর দাঁতের মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে। তবে সেটাই একমাত্র কারণ নয়, এই ধরনের পানীয় অতিরিক্ত পরিমাণে ক্যালোরি-সমৃদ্ধ হয়। ফলে এই ছোট বয়সেই আপনার সোনার শরীরে জমতে পারে বিপুল পরিমাণে মেদ। যা পরবর্তী কালে তার হৃদযন্ত্রের সমস্যা ডেকে আনতে পারে।

 

কী করতে হবে: এই জাতীয় পানীয় থেকে আপনার সোনাকে দূরে রাখুন। ফলের রস খাওয়াতে চাইলে, তাজা ফল থেকে রস বের করে নিন। সেটাও বেশিক্ষণ রেখে দেবেন না। রস বের করার পরেই ওকে খাইয়ে দিন। কোন কোন ফলের রস ওকে দেওয়া যাবে, সেটা চিকিৎসকের কাছ থেকে জেনে নিন। আর সোডা জাতীয় পানীয় কখনওই নয়।

 

 

#5. গোরুর দুধ: সবাই জানেন, শিশুদের জন্য মায়ের দুধের কোনও বিকল্প হয় না। কিন্তু বাচ্চা একটু বড় হওয়ার পরে অনেকেই তাঁদের গোরুর দুধ দিতে চান। এটা মোটেও সঠিক সিদ্ধান্ত নয়।

 

কেন ক্ষতির: মায়ের দুধে পুষ্টিগুণের পাশাপাশি নানা ধরনের এনজাইম থাকে, যা শিশুর বড় হয়ে ওঠার জন্য খুবই দরকারি। এই জন্যই চিকিৎসকরা বলেন, বাচ্চার জন্য মায়ের দুধ সুষম খাবার। সেখানে গোরুর দুধে অতিরিক্ত পরিমাণে ল্যাকটোজ থাকে, শিশুদের জন্য যা একেবারেই ভালো নয়। এই অতিরিক্ত ল্যাকটোজ পেটের সমস্যা ডেকে আনতে পারে। তার চেয়েও বড় কথা, এই দুধ বাচ্চার কিডনির ক্ষতি করতে পারে। শরীরে আয়রনের ঘাটতি হওযার আশঙ্কাও থাকে এ সব ক্ষেত্রে।

 

কী করতে হবে: চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে আপনার সোনার দুধ বাছুন। কতদিন পর্যন্ত সে মায়ের দুধ খাবে, কখন থেকে অন্য খাবার খাবে, সেটা বলতে পারবেন বিশেষজ্ঞরাই। আপনার সোনা কতটা বড় হলে, তাকে অন্য দুধ দেওয়া যাবে, সেটাও জেনে নিন চিকিৎসকের থেকেই।
অনেক সময়ই পরিস্থিতির কারণে নিয়ম মেনে শিশুদের খাওয়ানো যায় না। কখনও কখনও ছোটখাটো ভুলভ্রান্তি হয়ে যায়। বা এমন কোনও খাবার শিশুরা খেয়ে ফেলে, যেগুলো তাদের খাওয়ার কথা না। এ সব ক্ষেত্রে দেরি না করে, সত্বর চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে নেওয়া দরকার।

 

আরও পড়ুনঃ মোবাইল ফোন খেলনা নয়; দূরে রাখুন বাচ্চাকে!

 

একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার  হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

null

null