প্রেগন্যান্সি শুরুর পর থেকে ৯ টা মাস তার দেখা নেই, ক্যালেন্ডারে দাগ দেওয়া দিনগুলো মায়েরা ভুলতে বসেছে বলে! না হে, অত শান্তি নেই মেয়েদের কপালে। সে আবার ঘুরে আসবে! এবং, অবশ্যই তার ঘুরে আসাটাই কাম্য। কাকে নিয়ে কথা বলছি? হ্যাঁ, পিরিয়ড বা মাসিক। হাজার অস্বস্তি, ব্যথা সহ্য করিয়েও মেয়েদের চরম কাঙ্খিত শারীরিক প্রক্রিয়া এই মাসিক বা পিরিয়ড। হবে না আবার, এর মধ্যেই যে মাতৃত্বের বীজ বোনা থাকে! (First Period After Pregnancy: What to Expect)
এই পিরিয়ড বা মাসিক ডেলিভারির কতদিন পরে শুরু হয়? ডেলিভারির পরেই যে রক্তপাত শুরু হয়, সেটা কী আদৌ পিরিয়ড? ব্রেস্টমিল্ক তৈরির ওপর পিরিয়ড হওয়া বা না হওয়ার কী প্রভাব? বা, ডেলিভারির পরে কতটা বদলে যায় আমাদের অতি পরিচিত মাসিক (First Period After Having a Baby)? সতর্কই বা হবেন কখন? এরকম হাজারো প্রশ্ন নিয়ে মায়েরা ব্যতিব্যস্ত হয়ে যান, প্রাণ খুলে কাউকে বলতেও তাদের মহা আপত্তি। তাই, আজকের প্রতিবেদনে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে সাজিয়ে দেওয়া হল সবকিছু।
সবার শরীর সমান নয়, কিছু ক্ষেত্রে সময়ের বা উপসর্গের এদিকওদিক হতেই পারে; তবু সাধারণ একটা খসড়া জানা থাকলে সুবিধে হবে মায়েদের, সব পরিস্থিতি সামলে নিতে পারবে তারা। (First Period after Baby Heavy) জানতে হলে পড়ে নিন!
যেসব মায়েরা বাচ্চাকে এক্সক্লুসিভ ব্রেস্টফিডিং করান না, ডেলিভারি হওয়ার ৬-৮ সপ্তাহ পরে তাদের পিরিয়ড বা মাসিক শুরু হয়ে যায়। তবে, যদি বাচ্চা এক্সক্লুসিভ ব্রেস্টফিড করে, সেক্ষেত্রে সময়টা বদলে যায়। বাচ্চা যতদিন শুধুমাত্র বুকের দুধ খায়, ততদিন মায়ের পিরিয়ডই হল না এমনটাও কিন্তু হয়েই থাকে।
বাচ্চা তার পুরো পুষ্টি যদি শুধুমাত্র বুকের দুধ থেকেই পায়, তা হলে সেই মায়ের পিরিয়ড শুরু হতে ভালোই দেরি হয়। (First Menstrual Period after Birth) আর অন্যদের ক্ষেত্রে (যারা বাচ্চাকে বুকের দুধ ও অন্য খাবার মিলিয়ে মিশিয়ে খাওয়ান বা যার বাচ্চা শুধুই ফর্মুলা খায়) ডেলিভারির পরে মোটামুটি কয়েকমাস পরেই পিরিয়ড শুরু হয়ে যায় (Postpartum Period)।
ছোট্ট কথায়; না, দুটি সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস। ডেলিভারির পরে পরেই মায়েদের ব্লিডিং হয়। তা সে ডেলিভারি সি সেকশন করেই হোক বা ভ্যাজাইনাল; দুই ক্ষেত্রেই মায়েদের ভ্যাজাইনাল ডিসচার্জ হয়। এটা কিন্তু আমাদের চিরাচরিত মাসিক বা পিরিয়ড নয় মোটেই। (Your First Period After Pregnancy)
সোজা বাংলায় বললে, বাচ্চা হওয়ার পুরো প্রসেসটা ভীষণ ঝকমারির এবং মায়ের শরীরের সবকিছু ওলট-পালট করে দেয়। ডেলিভারির পরে শরীর চেষ্টা করে আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসতে।
শরীরের এই ভালো হওয়ার চেষ্টায় “লোচিয়া” একটা সিগন্যাল হিসেবে উপস্থিত হয়। গর্ভাবস্থায় জরায়ুতে লাইনিং মোটা হয়, তবেই সে সন্তানকে ধরে রাখতে পারে। ডেলিভারির পরে জরায়ুর দেওয়াল থেকে এই অতিরিক্ত লাইনিং খসে পড়তে থাকে। এই লাইনিং-ই রক্তের সাথে ভ্যাজাইনা দিয়ে শরীরের বাইরে বেরিয়ে আসে। (Do Your Periods Change After Pregnancy) এজন্য এই লোচিয়া বেশি রক্তের-এর সাথে সাথে অনেক ক্লটও নিয়ে বেরোয় এবং রং গাঢ় হয়।
বেশ কিছুদিন বা অনেকের ক্ষেত্রে কিছু সপ্তাহ এই লোচিয়া স্থায়ী থাকে। দিনের পর দিন ব্লিডিং-এর পরিমাণ কমতে থাকে এবং রং হাল্কা হতে থাকে। ঘন লাল বা কালচে লাল রং-এর ডিসচার্জ ধীরে ধীরে গোলাপি এবং শেষ পর্যায়ে সাদাটে, স্বচ্ছ হয়ে যায়। এইসময় তলপেটে পিরিয়ডের মতোই ব্যথা হতে পারে কারণ জরায়ুর সংকোচন শুরু করে যায়। শরীরের ওপর ভিত্তি করে এই লোচিয়া ২৪-৩৬ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। কারও কারও ক্ষেত্রে, এই স্থায়িত্বের কম বেশি হতেই পারে।
বুঝেই গেলেন যে, ডেলিভারির পরে হওয়া ভ্যাজাইনাল ব্লিডিং কোনও ভাবেই আমাদের স্বাভাবিক মাসিক বা পিরিয়ড নয়। লোচিয়া ও মাসিক সম্পূর্ণ আলাদা।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, যে মায়েরা বাচ্চাদের শুধুমাত্র বুকের দুধই খাওয়ান; তাদের মাসিক খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসে না। এর জন্য দায়ী অবশ্যই হরমোন। প্রোল্যাকটিন নামের যে হরমোন ব্রেস্টমিল্ক তৈরি করে; সেইটি জননে জড়িত হরমোন বা রিপ্রোডাট্কিভ হরমোনগুলিকে দাবিয়ে রাখে। ফলস্বরূপ মায়ের শরীরে পুনরায় অভ্যুলেশন বা ডিম্বস্ফোটন শুরু হয় না। আর এর ফলেই স্বাভাবিকভাবেই পিরিয়ড হয় না।
না, একেবারে কমিয়ে দেয় এটা বলা ঠিক হবে না। তবে, কিছুটা প্রভাব অবশ্যই ফেলে। ডেলিভারির পরে যখন পুনরায় মাসিক বা পিরিয়ড শুরু হয়; তখন ব্রেস্ট মিল্কের পরিমাণে বা তার প্রতি বাচ্চার আচরণে কিছুটা পরিবর্তন হলেও হতে পারে।
হরমোনের কার্যকারিতার জন্যই হতে পারে, ব্রেস্ট মিল্কের পরিমাণ একটু কমে গেল বা ব্রেস্ট মিল্ক গঠনগতভাবে কিছুটা বদলে গেল। বদলাতে পারে এর স্বাদও। বাচ্চা সেই স্বাদবদলটাই হয়তো বুঝে ফেলে কিছুদিন একটু অদ্ভুত আচরণ করল। খেতে চাইল না বেশি বা কম খেলো। (First Period after Stopping Breastfeeding)
তবে, যে পরিবর্তনই হয় তা নেহাতই নগণ্য। সব বাচ্চা এই স্বাদবদল বুঝতেও পারে না আর যারা পারে, তারা দু’দিন পরেই আবার নিজের খাওয়ার ছন্দে ফিরে আসে। কাজেই, এই পরিবর্তনে ঘাবড়ে যাওয়ার একেবারেই কোনও প্রয়োজন নেই।
ডেলিভারির পরে লোচিয়া স্থায়ী হতে পারে প্রায় ৫-৬ সপ্তাহ। এবার সেই সময়ের পরেই বা কারও যদি ৩ সপ্তাহ পরে লোচিয়া বন্ধ হয়ে পিরিয়ড শুরু হয়ে যায়; তা হলে সত্যি দুই ডিসচার্জের মধ্যে মায়েরা গুলিয়ে ফেলতে পারেন। তবে, ডিসচার্জের প্রকৃতি ও ধরন জানা থাকলে এই অসুবিধা এড়ানো যায় অনেকটাই।
লোচিয়া যত দিন যায়, হাল্কা রঙের হতে থাকে ও পরিমাণেও কমে যায়। আর পিরিয়ডের ব্লাড কিন্তু শুরুর দিনের পর থেকে গাঢ় হতে থাকে। কাজেই, গুলিয়ে ফেললে লক্ষ্য রাখুন ডিসচার্জের রং এবং পরিমাণের ওপর।
আরও পড়ুন: উঁহু, আপনি গর্ভবতী নন! শরীরের খামখেয়ালিপনায় মাসিকে দেরি হতেই পারে। জেনে নিন বিশদে!
ডেলিভারির পরে যখন আবার নতুন করে পিরিয়ড শুরু হয়, প্রথমদিকে তা একটু বদলে যায় বই কি! মায়ের শরীর আবার নতুন করে মাসিকচক্রের জন্য প্রস্তুত হয়; মাসিকের নিয়মিত ছন্দে ফিরে আসার জন্য তৈরি করে নিজেকে (First Period After Baby How Long Does It Last)। ডেলিভারির পরে প্রথম হওয়া পিরিয়ড তাই অনেকটাই আলাদা অনুভূতি নিয়ে আসে। যেমন;
জরায়ুর দেওয়াল আগের থেকে মোটা হয়ে যায় বলেই তা খসে পড়ার সময় তলপেটে মাসল ক্র্যাম্প বেশি হয়। আস্তে আস্তে, এই ব্যথা কম হতে থাকে এবং পরবর্তী কয়েক মাসের মধ্যেই আবার আগের মতোই পিরিয়ড হতে শুরু করে।
আবার দেখা যায়, গর্ভবতী হওয়ার আগে যেসব মহিলার এন্ডমেটরিওসিস (endometriosis)-এর মতো সমস্যা ছিল, ডেলিভারির পরে তাদের ক্ষেত্রে ব্লিডিং-এর পরিমাণ কমে যায়। শারীরিক কোনও সমস্যা বা পিটুইটারি গ্রন্থি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও এই পিরিয়ডে প্রভাব পড়ে। সেক্ষেত্রে, চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া একান্ত জরুরি।
কিছু গর্ভনিরোধক ট্যাবলেট একেবারেই নিরাপদ। ডেলিভারির পর থেকেই অনেকে খেতে শুরু করেন। কিন্তু, চিকিৎসকেরা বলেন, ডেলিভারির পরে বেশ কয়েক সপ্তাহ এই গর্ভনিরোধক ট্যাবলেট না খাওয়াই ভালো বা খেলেও চিকিৎসকের অনুমতি নিয়ে তবেই।
আসলে, গর্ভনিরোধক ট্যাবলেটে ইস্ট্রোজেন ও প্রজেসটিন বা শুধু প্রজেসটিন থাকে মূল উপাদান হিসেবে। কিছু ট্যাবলেট পিরিয়ড নিয়মিত ছন্দে ফিরিয়ে আনতে পারে (Irregular Periods after Pregnancy) আবার কিছু পিরিয়ড বন্ধ রাখতে পারে। সবথেকে বড় কথা, বাচ্চা যদি বুকের দুধ খায়, গর্ভনিরোধক ট্যাবলেট প্রভাব ফেলতে পারে বুকের দুধের গঠন ও তৈরিতেও। তাই, এক্ষেত্রে একমাত্র ভরসা চিকিৎসক। মায়ের শরীরের অবস্থা এবং পরিস্থিতি বুঝে চিকিৎসকই সিদ্ধান্ত নেবেন। (First Period After Pregnancy: What to Expect)
এই ব্যাপারটা একদিকে মজার আবার আতঙ্কেরও। অনেকে ভাবতেই পারেন যে, পিরিয়ড শুরু হয়নি মানে এখন গর্ভবতী হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কথাটা কিন্তু আংশিক সত্যি। (No Period after Giving Birth Can I Get Pregnant)
উপরোক্ত একটি লক্ষণও দেখলে দেরি না করে ডাক্তারের কাছে যান এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা করান।
সতর্ক থাকুন এবং নিজের শরীরে ঘটে চলা পরিবর্তনগুলো নিয়ে ওয়াকিবহাল থাকুন। দেখবেন, কোনও পরিস্থিতিতেই ঘাবড়ে যাবেন না। আর, চিকিৎসকের কাছে মন খুলে আলোচনা করুন নিজের যে কোনও সমস্যা নিয়ে। আর বন্ধুর কাছে মন খুলতে হলে, আমরা তো আছিই। (First Period After Pregnancy: What to Expect)
আরও পড়ুন: গর্ভকালীন দিনগুলোয় আপনার গোপনাঙ্গের যত্ন নেওয়ার গোপন কথা
একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।
null
null