হঠাৎ বিপদে শিশুকে সুস্থ করবেন কী করে? কখনই বা যেতে হবে ডাক্তারের কাছে!

হঠাৎ বিপদে শিশুকে সুস্থ করবেন কী করে? কখনই বা যেতে হবে ডাক্তারের কাছে!

বিরাট ধকল গেল মধুরিমার উপর দিয়ে। তবে ধকলটা একদম মানসিকও। বর দেবক আর ১১ মাসের কন্যা মউকে নিয়ে মধুরিমা গেছিল উত্তরবঙ্গে বেড়াতে। পাহাড়ের কোলে ছোট্ট গ্রাম। কিন্তু এরম নির্জন পরিবেশের আনন্দটা দ্বিতীয় দিনেই মাটি! খেলতে গিয়ে মাথায় চোট পেল মউ! কপালের একটু উপরে ফুলে আলু হয়ে গেল ১০ মিনিটেই। কী প্রচণ্ড কান্না! অনেক খুঁজেও চিকিৎসকের সন্ধান পাওয়া গেল না। এই পাণ্ডববর্জিত দেশে ছোট্ট মউয়ের মাথার চোট নিয়ে মধুরিমা রীতিমতো দুশ্চিন্তায়। যদি ভিতরে রক্তক্ষরণ বা হেমরেজ (hemorrhage) হয়, যদি স্কালে চোট লাগে! মধুরিমা ভেবেই অস্থির। ঠিক তখনই গ্রামেরই এক বয়স্ক ভদ্রমহিলা মধুরিমাকে বললেন, এত দুশ্চিন্তা না করতে। উনিই ব্যবস্থা করে দিলেন হালকা ঠান্ডা সেঁক দেওয়ার। মাথার আলু পরের দিনই হাওয়া! মউ-ও পরের দিনই সেই আগের মতো প্রাণোচ্ছ্বল। সেই থেকে মধুরিমা ঠিক করেছে, অল্পস্বল্প ফার্স্ট এইড-এর বিষয়টা জেনে রাখবে। ভাগ্যিস গ্রামে ওই ভদ্রমহিলা ছিলেন! (First Aid for your Baby’s Accident in Bengali, Bachchar durghatana hole kibhabe prathomik chikitsa korben, First Aid for your Baby’s Accident in Bangla.First Aid for your Baby’s Accident in Bengali.)

 

 

শিশুর চোট-আঘাতের ফার্স্ট এইড (First Aid for your Baby’s Accident)

 

মউ একা নয়,  হামাগুড়ি দিতে শেখার পর কোনও বাচ্চাকেই আর এক জায়গায় ধরে রাখা যায় না। সুযোগ পেলেই হাত ফসকে চলে যায় ঘরের এমাথা থেকে ওমাথা। বাবা-মা তো এই দৌড়ের চোটে হাঁফিয়ে ওঠেনই, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ে দুশ্চিন্তাও। কিন্তু তা বলে আপনার শিশুকে তো আর বকেঝকে একজায়গায় বসিয়ে রাখতে পারবেন না। তাকে ইচ্ছেমতো খেলতে দিতেই হবে। কিন্তু পড়ে গিয়ে যদি আঘাত পায় আপনার ছোট্ট সোনা? কোনওভাবে যদি কেটে ছড়ে যায় নরম তুলতুলে শরীরের কোনও জায়গা? তখন দিশেহারা না হয়ে কী করবেন? জেনে নিন এমন খারাপ পরিস্থিতিতে ঠিক কী ধরনের প্রাথমিক চিকিৎসা (First Aid)-র ব্যবস্থা করবেন ওর জন্য। (First Aid for your Baby’s Accident in Bengali, Bachchar durghatana hole kibhabe prathomik chikitsa korben.)

 

#1. কাটাছেঁড়া (cut and scrapes): দুরন্ত একরত্তির অল্পতেই ছোটখাটো কাটাছেঁড়া হতেই পারে। এই সময় ওর হাত থেকে রক্ত বেরোচ্ছে দেখে ভয় পাবেন না। বরং কয়েকটি পদ্ধতি জানা থাকলে সহজেই ওকে সামলাতে পারবেন।

 

  • ফার্স্ট এইড (first aid for cuts and scrapes): প্রথমে নিজের হাত সাবান দিয়ে ভালো করে ধুয়ে নিন। এরপর শিশুর কেটে বা ছড়ে যাওয়া জায়গাটা হালকা গরম জল (lukewarm water) দিয়ে ভালোভাবে পরিষ্কার করে ফেলুন। এরপর পরিষ্কার কাপড় বা গজ দিয়ে ওই জায়গাটা চেপে ধরুন। কিছুক্ষণ পর রক্ত বন্ধ হয়ে যাবে। তখন অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল মলম লাগিয়ে দিতে পারেন‌। এতে বাইরের হাওয়া লেগে ওখানে কোনও ইনফেকশন হবে না। মলম লাগানোর পর অবশ্যই তুলো দিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিন।

 

  • কখন চিকিৎসকের পরামর্শ জরুরি (when to visit doctor): হালকা গরম জলে তো ক্ষতস্থান ধুয়ে দিলেন। এরপর গজ বা পরিষ্কার কাপড় দিয়ে কাটা জায়গাটা চেপেও রাখলেন। কিন্তু পাঁচ মিনিট পেরিয়ে গেলেও রক্ত যদি না থামে, তবে আর সময় নষ্ট করবেন না। বাচ্চাকে নিয়ে তাড়াতাড়ি যান কোনও এক পেডিয়াট্রিশিয়ান বা শিশু চিকিৎসকের কাছে। হতে পারে এটা কোনও গুরুতর আঘাত। যদি দেখেই বুঝতে পারেন গভীরভাবে কেটে গিয়েছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ডাক্তারের কাছে পৌঁছনোই ভালো।

 

 

#2. মাথায় চোট (head bumps): সবেমাত্র কয়েকদিন হল আপনার ছোট্ট চ্যাম্প দাঁড়াতে শিখেছে। কিন্তু দুরন্তপনায় তো তার জুড়ি মেলা ভার। ফলে চলাফেরা করতে গিয়ে অসাবধানেই পড়ে গেল মাটিতে। লাগল তো লাগল, একেবারে মাথাতেই চোট লাগল। ঘাবড়াবেন‌ না। জেনে নিন, কীভাবে ফার্স্ট এইড দেবেন আপনার শিশুকে।

 

  • ফার্স্ট এইড (first aid for head bumps): পড়ে গিয়ে মাথায় চোট পেলে ছোট্ট সোনা কাঁদবেই। তাকে কোলে তুলে আগে দেখে নিন মাথার কোথাও ফেটে গিয়েছে বা ফুলে গিয়েছে কি না। ফেটে না গেলে নিশ্চিন্তি। তবে অল্প ফুলে যেতে পারে আঘাত পাওয়া অংশে। তার মাথার ফোলা অংশে ঠান্ডা সেঁক দিন। দেখবেন বাচ্চা কিছুক্ষণেই কান্না থামিয়ে আবার দুরন্তপনায় মেতে উঠেছে।

 

  • কখন চিকিৎসকের পরামর্শ জরুরি (when to visit doctor): পড়ে গিয়ে মাথা ফেটে গলগল করে রক্ত বেরোলে এক মুহূর্ত দেরি করবেন না। চিকিৎসক ছাড়া এর চিকিৎসা সম্ভব নয়। আঘাত পেয়ে বাচ্চার হাবেভাবে কোনও পরিবর্তন এলে চিকিৎসকের কাছে যান যত তাড়াতাড়ি। আঘাত পাওয়ার পর বাচ্চা যদি বমি করে বা অজ্ঞান হয়ে যায়, তখন ব্যাপারটা আরও সিরিয়াস। এছাড়া বাচ্চা যদি খাট বা কোনও উঁচু জায়গা থেকে পড়ে আঘাত পায়, তবে ঝুঁকি না নিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে নেওয়াই ভালো।

 

আরও পড়ুনঃ ডায়রিয়া ও লেজুড় দোস্ত ডিহাইড্রেশন; কারণ ও প্রতিরোধের উপায়

 

#3. পুড়ে গেলে (burn): ছোট বয়সে নানা জিনিসে কৌতূহল কম হয় না। হাতের কাছে গরম চায়ের কাপ, গরম থালা বা গরম কিছু থাকলে ওর তো কোনও দোষ নেই! এগুলো নাড়াচাড়া করতে গিয়ে হাতে ছ্যাঁকা খাওয়া বা পুড়ে যাওয়া স্বাভাবিক।

 

  • ফার্স্ট এইড (first aid for burn): বাচ্চার যে অংশে ছ্যাঁকা লেগেছে বা পুড়েছে সে অংশ সাধারণ জলের ধারার নীচে ধরুন। তবে কখনওই বরফ জল, মাখন এসব দেবেন না ওই জায়গায়। শিশুর কষ্ট কমাতে পোড়া জায়গায় লাগান অ্যালোভেরার নির্যাস। পোড়াস্থানে ফোসকাও পড়ে যেতে পারে, সেটা গেলে দেবেন না যেন। না জেনে কোনও মলম ভুলেও ব্যবহার করবেন না পোড়া স্থান ঠিক করতে।

 

  • কখন চিকিৎসকের পরামর্শ জরুরি (when to visit doctor): বাড়িতে শুধু ফার্স্ট ডিগ্ৰি বার্নের চিকিৎসাই করা উচিত। যদি মুখ, বা অন্য কোনও সংবেদনশীল অঙ্গ পুড়ে যায় তবে সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারের নিয়ে যান। গভীরভাবে ভিতরের চামড়া পর্যন্ত পুড়ে গেলে তা সেকেন্ড ডিগ্ৰি বার্নের মধ্যে পড়ে। এরকম হলে বা অনেকটা জায়গা জুড়ে পুড়ে গেলে দেরি না করে ডাক্তারের কাছেই নিয়ে যাওয়া উচিত।

 

 

#4. শ্বাসনালীতে কিছু আটকে গেলে (choking): গিলে ফেলতে পারে এমন জিনিস শিশুর চারপাশ থেকে যত দূরে রাখা যায় ততই ভালো। কারণ কোনও জিনিস নাড়াচাড়া করতে করতে শিশুরা যদি তা মুখে পুরে দেয় এবং সেটা শ্বাসনালীতে আটকে যায়, তখন হয় বিপদ। এতে প্রাণ নিয়ে টানাটানি পড়ে যায় রীতিমতো। তাই এর ফার্স্ট এইড জেনে রাখা অবশ্যই দরকার।

 

  • ফার্স্ট এইড (first aid for choking): এই সময় শিশুর মুখ নীল হয়ে যেতে থাকে, কান্না আসলেও কাঁদতে পারে না। প্রথমেই দেখুন গলায় জিনিসটা আটকানোর পর শিশু কাশছে কি না বা মুখ দিয়ে সোঁসোঁ আওয়াজ হচ্ছে কি না। যদি সে কাঁদে ও জোরে কেশে ওঠে, তবে কঠিন জিনিসটা নিজে থেকেই বেরিয়ে আসতে পারে। যদি দেখেন শ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে, তবে বুঝতে হবে শ্বাসনালীতে পুরোপুরি আটকায়নি জিনিসটা। এই সময় হেমলিখ ম্যানিউভার (Heimlich Manuever) পদ্ধতির প্রয়োগ করুন। এক্ষেত্রে শিশুকে আপনার বাঁহাতের উপর উপুড় করে রাখুন। শিশুর পা যেন মাথার থেকে উঁচু লেভেলে থাকে। এবার ঘাড়ের হাড় দুটোর মাঝে ডানহাতের তালু দিয়ে পাঁচ বার তাড়াতাড়ি চাপ দিন বা রগড়ে দিন। যদি জিনিসটা বেরিয়ে না আসে, তবে শিশুকে সোজা করে বাঁহাতের উপর একই ভাবে শুইয়ে দিন। এক্ষেত্রে বুকের পাজরের যে হাড় তার উপর নীচের দিকে পাঁচবার চাপ দিতে হবে। বাচ্চার বয়স এক বছরের বেশি হলে হেমলিখ ম্যানুয়েভারের পদ্ধতি অন্যরকম। এক্ষেত্রে বাচ্চাকে পিছন থেকে জড়িয়ে নিজের এক হাত মুঠো করে তার পেটের উপর রাখুন। আরেক হাত অন্যপাশ দিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে গিয়ে ওই মুঠোটা চেপে ধরুন। এবার খুব কম সময়ে পেট বরাবর উপরের দিকে কয়েকবার চাপ দিন। যতক্ষণ না জিনিসটা বেরিয়ে আসছে, ততক্ষণ এটা করুন। যদি শিশু যদি অজ্ঞান হয়ে যায়, এই পদ্ধতি খাটবে না। সেক্ষেত্রে সাহায্য নিতে হবে সিপিআর পদ্ধতির। প্রশিক্ষণ না থাকলে কোনওভাবেই সিপিআর পদ্ধতি প্রয়োগ করে বসবেন না!

 

  • কখন চিকিৎসকের পরামর্শ জরুরি (when to visit doctor): একাধিকবার হেমলিখ ম্যানিউভার করেও যদি জিনিসটা না বেরিয়ে আসে, তবে একেবারেই দেরি করা ঠিক নয়। বাচ্চা অজ্ঞান হয়ে গেলে পরিস্থিতি আরও কঠিন। এক্ষেত্রে আপনি যদি সিপিআর পদ্ধতি না জানেন, তবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান। মনে রাখুন, এটি কিন্তু বাচ্চার জীবনমরণ সমস্যা।

 

#5. পোকার কামড় (insect bites): এমনিতে  মশা  বা সাধারণ কিছু পোকার কামড়ে শিশুর তেমন কিছু হয় না। কামড়ানো অংশটা ফুলে যায়। কিন্তু বোলতা, মৌমাছি, বিছে এসবের কামড় তীব্র বিষাক্ত যা শরীরকে রীতিমত দুর্বল করে দেয়। এমনকী বড় বিপদও হতে পারে।

 

  • ফার্স্ট এইড (first aid for insect bites): কামড়ানো জায়গাটায় খোঁটাখুটি করবেন না। সাবান দিয়ে ভালো করে ধুইয়ে দিন জায়গাটা। যদি হুল ফুটে থাকে, হাত দিয়ে তুলবেন না। ডেবিট কার্ডের মতো কিছু দিয়ে ত্বক উপর রগড়ে দিন। এতে হুলটা উঠে আসতে পারে। কামড়ানো জায়গায় অ্যান্টিহিস্টামিন জাতীয় লোশন লাগাতে পারেন যাতে ব্যথা কমে যায়।

 

  • কখন চিকিৎসকের পরামর্শ জরুরি (when to visit doctor): বোলতা মৌমাছির কামড়ে যদি বমি জ্বর, অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটে, তবে সময় নষ্ট না করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়াই সবচেয়ে ভালো।

 

মনে রাখবেন, ফার্স্ট এইড বা প্রাথমিক চিকিৎসার পুরোটাই তাৎক্ষণিক বিপদ সামলানোর জন্য। শিশুর ছোট-বড় সব সমস্যার জন্যই চিকিৎসকের সঙ্গে সময়মতো যোগাযোগ করতেই হবে।

 

আরও পড়ুনঃ শিশুর কানে ব্যথার উপশমে ১০টি ঘরোয়া টোটকা

 

একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার  হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

null

null