বাচ্চাকে নিজে হাতে খাওয়া শেখাতেই প্রয়োজন ফিংগার ফুডের। রইল রেসিপি!

বাচ্চাকে নিজে হাতে খাওয়া শেখাতেই প্রয়োজন ফিংগার ফুডের। রইল রেসিপি!

ফিংগারফুড ব্যাপারটা হাতিঘোড়া কিছু নয়। আপনার খুদে বড় হচ্ছে, এবার ওকে নিজে নিজে খাওয়ার অভ্যেস তৈরি করাতে হবে। নিজে নিজে খাবার নিয়ে খেলে খাবারের ওপর ওর আগ্রহও জন্মাবে। বাচ্চাগুলো তো আর বড়দের মতো জুত করে খাবার ধরে মুখে পুরতে পারে না। (Finger Foods for Baby – Tips and Ideas)

তাই, বাচ্চাদের জন্য নরম কিছু খাবার বানিয়ে দেওয়া উচিত যাতে ওরা নিজেরা প্লেট থেকে তুলে খেতে পারবে (Baby Self-Feeding: Tips & Tricks)। বাচ্চা প্রথমেই হাত মুঠো করে খাবার ধরতে পারে না, তাই ওর জন্য খাবারের আকার হতে হবে একটু লম্বা, বলতে পারেন আমাদের আঙুলের মতোই খানিক। এর থেকেই লোকজন ভালোবেসে একে ফিংগারফুড (ফিঙ্গারফুড) বা আঙুল খাবার নাম দিয়েছে।

ছোট্ট কথায়, বাচ্চাকে নিজে নিজে খাওয়া শেখানোর প্রথম ধাপ হল নানাধরনের ফিংগারফুড বানিয়ে দেওয়া (The Ultimate Guide to Finger Foods for Baby Led Weaning)। যাতে বাচ্চার খাবারের প্রতি আকর্ষণ জন্মায়। আর কে না জানে, বাচ্চার খাবার রংচঙে হলে তার চাহিদা বহুগুণ বেড়ে যায় খুদেগুলোর কাছে।

আজ তাই কতগুলো ফিংগারফুড নিয়েই আলোচনা রইল প্রতিবেদনে। কী দেওয়া যায়, কখন থেকে দেওয়া যায় বা কীভাবে বাচ্চার খাবার করে তুলবেন রঙিন ( Best Finger Foods for Baby); রইলো তারই হদিস। দেখে নিন একনজরে।

 

বাচ্চাকে কখন থেকে ফিংগারফুড দেওয়া শুরু করবেন? (Introducing Finger Foods to Your Baby)

বাচ্চা ভালো করে বসতে শেখার পরেই ওকে নিজে নিজে খেতে দেবেন। মাথা সোজা রেখে সোজা হয়ে বসতে পারবে, তবেই বানিয়ে দেবেন ফিংগারফুড। দাঁত যদি ৪-৫টিও হয়, তাও সমস্যা নেই, খুদের মাড়ির জোর কম নয়।
তবে মাড়িতে লাগতে পারে এরকম কোনও কিছু মেলাবেন না ওর খাবারে। ৯ মাস বয়সেই সাধারণত শিশু ভালোভাবে গ্যাঁট হয়ে বসতে শিখেই যায়। তারপরেই না হয় শুরু করুন ওকে ফিংগারফুড দেওয়া। নানারকম মজাদার রেসিপি তো আমরাই বলে দিচ্ছি এখানে।

 

ফিংগারফুড হিসেবে বাচ্চাকে যা যা খাবার দেওয়া যায়? (Finger Foods for Baby- Tips and Ideas)

 

#1. নানারকম ফলের ঝুড়ি: ফিংগারফুড হিসেবে বাচ্চাকে দিতে পারেন নানারকম ফল। এবার আর ফলের ভর্তা বা পিউরি নয়, গোটা ফলই দিতে পারেন ওকে, তবে কেটে কেটে। যে ফলই দিন, তা যেন নরম আর পাকা হয়।

  • কলা, আপেল, আম, কমলালেবু, পাকা পেঁপে, নাশপাতি, নরম পেয়ারা, তরমুজ, আঙুর, কিউয়ি, চেরি ইত্যাদি সব ধরনের ফল খেতে পারবে ও।
  • ফলের খোসা ও বীজ যেন অবশ্যই ছাড়ানো থাকে। আর ফলের টুকরোগুলো হবে একটু বড় বড়, আঙুলের মতো। এতে ও সহজেই হাত দিয়ে ধরতে পারবে ও মুখ পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারবে।

 

#2. সবজিপাতির মাতামাতি: সবজির মধ্যে শাক বাদ দিয়ে প্রায় সবকিছুই দিতে পারেন ফিংগারফুড হিসেবে। বাচ্চা যেসব সবজি খেয়ে অভ্যস্ত, সেগুলোই রান্না হওয়ার পরে পেস্ট না করে ওকে দিন ছোট টুকরোয় কেটে কেটে (Baby Finger Foods)। কীভাবে দেবেন?

  • কুমড়ো, বিনস, পেঁপে বা গাজর, যা দিতে চান প্রথমে খোসা ছাড়িয়ে প্রমাণ সাইজের আঙুলের মতো আকারে লম্বা করে কেটে নিন। এবার জলে সামান্য নুন দিয়ে সবজি সেদ্ধ করে নিন। সেদ্ধ হয়ে গেলে প্যানে খাঁটি মাখন দিয়ে সেদ্ধ সবজির টুকরোগুলো একটু নাড়াচাড়া করে নিয়ে বাচ্চাকে খেতে দিন।
  • আলু এবং মিষ্টি আলু, বাচ্চাদের খুব প্রিয়। খোসা ছাড়িয়ে লম্বা করে কেটে নিন। সেদ্ধ করে দিন, বেকড দিন বা হাল্কা বাটারে ভেজে; বাচ্চা এমনিই খেয়ে নেবে।
  • ব্রকলি বা ফুলকপি যেন বাচ্চার খাবার থেকে বাদ না পড়ে। সবুজ সবুজ এই ফুলের মতো জিনিসগুলো কিন্তু বাচ্চা খুব আগ্রহ নিয়ে খাবে। ফুলকপি বা ব্রকলি আগে জলে সেদ্ধ করে নিন। তারপর সামান্য অলিভ অয়েলে ভেজে দিন দিন। স্বাদমতো নুন দিয়ে দিন। যদি আপনি মাইক্রোওয়েভ ওভেনে রোস্ট করতে চান, তাও পারেন (Finger Food Recipes for Your Baby or Toddler)। বাচ্চা হাতে ধরতে পারবে এমন ভাবেই কাটবেন কিন্তু।
  • ক্যাপসিকাম লম্বা লম্বা করে কেটে ঢাকা দিয়ে দিয়ে ভেজে নিন। মিলিয়ে দিন খাঁটি মাখন। বাচ্চা খাবে মহানন্দে।
  • মটরশুঁটি ও ভুট্টা; বাচ্চারা বেশ পছন্দ করে। মটরশুঁটি ও ভুট্টার দানা অল্প সেদ্ধ করে নরম করে নিন। সামান্য মাখনে একটু ঢাকা দিয়ে দিয়ে ভেজে নিন। তবে খেয়াল রাখবেন গলায় যেন না লাগায়।

 

আমরা সাধারণত যে সবজিগুলি খেয়ে থাকি, মোটামুটি সবই বললাম। তবে আপনি  বাচ্চাকে যা সবজি খাওয়াতে চান, শাক বাদ দিয়ে সবই ফিংগারফুড হিসেবে রান্না করে দিতে পারেন। সবজিগুলো যেন বাচ্চা হাতে ধরতে পারে, সেভাবে কাটবেন। সেদ্ধ করে অল্প বাটারে বা অলিভ অয়েলে ভেজে দেবেন। (Baby Food Recipes, Ideas & Nutrition Tips) আর রোস্ট করতে চাইলে অলিভ অয়েল আর অল্প নুন মাখিয়ে রোস্ট করে ছানাকে দেবেন।

 

#3. আমিষ খাবো মনের সুখে: ফল, সবজি এসব তো মোটামুটি হল, ডিম, মাছ, মাংস বাদ দিলে চলে নাকি? ৮ মাসের হয়ে গেলেই বাচ্চা ডিমের কুসুম খেতে পারে আর ৯ মাসের হয়ে গেলেই মাছ। তারপর ওর খাবারে ঢুকে পড়ে মুরগির মাংসও। বাচ্চা যেহেতু ১ বছরের হয়ে গেলে বেশ নিজেই বসে থাকতে পারে আর হাত দিয়ে ফিংগারফুড খেতে পারে, তাই ১ বছরের বাচ্চার পরিপ্রেক্ষিতেই আমিষ খাবারের উদাহরণ দিচ্ছি।

  • ডিম ভালো করে সেদ্ধ করে সেটা লম্বা লম্বা টুকরোয় ভেঙে দিন।
  • অলিভ অয়েলে একখানা ডিমের ওমলেটও বানিয়ে দিতে পারেন খুদেকে।
  • কাঁটা বিহীন মাছ ছাড়িয়ে বাচ্চাকে দিন। ও নিজে নিজেই খাওয়ার চেষ্টা করবে। ওর জন্য ভেটকি, মাগুর বা শিঙ্গি; যে মাছেরই ঝোল বানান, মাছের কিছুটা অংশ ছাড়িয়ে (Baby Self-Feeding: Tips, Tricks and Finger Foods to Try) ওকে একটা প্লেটে খেতে দিন। এতে মাছ খাওয়ার ওপর ওর আগ্রহ বাড়বে।
  • এবার আসি মুরগির মাংসে। ওর জন্য যে চিকেন স্যুপটা বানালেন, তার থেকে মাংসটা তুলে নিয়ে ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে প্লেটে সাজিয়ে দিন। মাংসের পিস বাটার ও নুন মাখিয়ে বেক করেও দিতে পারেন। তারিয়ে তারিয়ে আমিষ খাবে

 

আরও পড়ুন: প্যাকেটজাত আর নয়, ১-৩ বছরের খুদের জন্য বাড়িতেই বানিয়ে ফেলুন পুষ্টিকর, সুস্বাদু মুসলি!

 

ফিংগারফুডের কিছু রংবেরঙের রেসিপি (Baby Finger Food Recipes)

 

#1. ভাতের লাড্ডু: কিছুটা সেদ্ধ ভাত নিয়ে জল ঝরিয়ে নিন। এবার ওই সেদ্ধ ভাত, একটু শক্ত করে সেদ্ধ করা আলু, বাড়িতে তৈরি খাঁটি ঘি ও অল্প নুন দিয়ে চটকে মেখে নিন। মাখাটা কিন্তু একটু টাইট হবে, সেভাবেই আলু ও চাল সেদ্ধ করবেন। এবার মাখাটা গোল গোল করে বা ল্যাংচার আকারে গড়ে নিন। বাচ্চাকে খেতে দিন।

 

#2. রঙিন ওমলেট: খাবার যদি রংচঙে হয়, তা হলে খাবারের প্রতি আগ্রহ বাড়ে বাচ্চার। ১ বছর হয়ে গেলে বাচ্চাকে গোটা ডিম দেওয়া শুরু করতে পারেন। বানিয়ে দিতে পারেন এই রংচঙে ওমলেট (Finger Foods For Baby)।

  • ক্যাপসিকাম, লাল, হলুদ বেলপেপার, গাজর, বিন্স খুব ছোট ছোট করে কেটে নিন।
  • ওমলেট বানানোর মতো অল্প পেঁয়াজ কুচিয়ে নিন।
  • এবার বাটিতে ডিম, সব কুচনো সবজি, পেঁয়াজ, নুন এবং কিছুটা চিজ ছড়িয়ে ভালো করে ফেটিয়ে নিন।
  • প্যানে তেল গরম করে এপিঠ ওপিঠ পাল্টে ঢাকা দিয়ে ভেজে নিন রঙিন ওমলেট।
  • লম্বা লম্বা করে কেটে বাচ্চাকে খেতে দিন।

 

#3. রামধনু পকোড়া: এই খাবারটিও কিন্তু বেশ বাহারি দেখতে হবে। আর বাচ্চা কামড়ে কামড়ে খেতেও পারবে (Baby’s First Finger Foods)। স্বাদে তো দারুণ।

  • গ্রেট করে নেওয়া গাজর ও আলু হাতে চিপে জলটা বের করে দিন।
  • সবুজ ও লাল ক্যাপসিকাম কুচিয়ে কেটে নিন।
  • পেঁয়াজ কুচি নিন সামান্য।
  • একটা পাত্রে গাজর, আলু, ক্যাপ্সিকাম, পেঁয়াজ নিয়ে একটা ডিম ও নুন দিয়ে ভালো করে মেশান।
  • এবার ওতে বেসন দিয়ে মাখাটা টাইট করে নিন।
  • অল্প তেলে চ্যাপ্টা চ্যাপ্টা করে ভেজে নিন।

 

#4. বাহারি ডিম-সবজি: এই খাবারটি খুবই পুষ্টিকর। ব্রেকফাস্টে অনায়াসে দিতে পারেন বাচ্চাকে (Finger Foods for Baby with No Teeth)।

  • গাজর, বিন্স, ক্যাপসিকাম, ব্রকলি,আলু ইত্যাদি সবজি নিয়ে লম্বা লম্বা টুকরোয় কেটে সেদ্ধ করে জল ঝরিয়ে নিন।
  • প্যান গরম করে ওতে মাখন দিয়ে সেদ্ধ সবজিগুলো নাড়াচাড়া করুন। সামান্য নুন দিয়ে দিন।
  • এবার সবজিগুলো রান্না হয়ে গেলে একটা প্লেটে সবজিগুলো সাজিয়ে দিন।
  • একটা ডিম সেদ্ধ লম্বা লম্বা করে কেটে সবজির ওপর এদিক ওদিক করে সাজিয়ে দিন।
  • যদি মনে হয় ডিম হাতে ভেঙে বা গ্রেট করে দেবেন, তাও দিতে পারেন।
  • প্লেটটা কতটা রঙিন হবে বোধ করি বুঝতে পারছেন। বাচ্চা এমনিই খেয়ে নেবে।

 

#5. বাচ্চাদের চিকেন ফিংগার: এবার একটু মাংস দিয়ে শেষ করি আজ।

  • মুরগির মাংস লম্বা লম্বা আঙুলের মতো আকারে কেটে নিন।
  • সামান্য পেঁয়াজের রস, রসুন থেঁতো, অল্প পাতিলেবুর রস ও নুন মাখিয়ে আধঘণ্টা ম্যারিনেড হতে দিন।
  • বেক করতে চাইলে মাংসের পিসগুলোয় বাটার মাখিয়ে মাইক্রোওয়েভ ওভেনে বেক করে দিন।
  • সাধারণ ওভেনে করতে হলে, পাত্রে একটু বাটার গরম করে নিন। পিস গুলো ওতে দিয়ে প্যান ঢাকা দিয়ে দিন। আবার একটু পরে অন্যপিঠ উল্টে ঢাকা দিন (Baby Finger Food Recipes)।
  • সেদ্ধ হয়ে গেলে ও একটু পোড়া পোড়া ভাব এলে নামিয়ে নিন।
  • শসা সরু সরু করে কেটে দিন স্যালাডের মতো খাওয়ার জন্য।
  • চিকেনটা চাইলে ছাড়িয়েও দিতে পারেন বাচ্চাকে।

 

কোন কোন খাবার ফিংগারফুড হিসেবে কখনই দেবেন না? (Foods to Avoid)

  • শক্ত বাদাম জাতীয় খাবার।
  • বড় শক্ত কোনও খাবার যা গলায় আটকে যেতে পারে।
  • যে খাবার বাচ্চা মুখে ভাঙতেই পারবে না সেটা দেবেন না।
  • লিচুর মতো ফল গলায় আটকে যেতে পারে। এই জাতীয় ফল দিলে বাচ্চার সামনে থাকুন এবং বেশ ছোট করে কেটে দিন যাতে বাচ্চা বেকায়দায় গিলে নিলেও গলায় না খেত্রেও। বিশেষ লক্ষ্য রাখুন আঙুর, মটরশুঁটি, বেদানা, ভুট্টা ইত্যাদির ক্ষেত্রেও।
  • কাঁটা যুক্ত মাছ একেবারেই দেবেন না। তাও যদি কোনও ভাবে অসাবধানবশত মাছের কাঁটা গলায় লেগে যায়, সঙ্গে সঙ্গে কী করবেন সেটা দেখে নিন এইখানে-> চটজলদি গলার কাঁটা নামাবেন কী করে? ঘরোয়া পদ্ধতির চেকলিস্ট হাতে আছে তো!

 

বিশেষ কিছু টিপস:

  • বাচ্চার বয়স অনুযায়ী ওকে ফিংগারফুড বানিয়ে দিন।
  • বাচ্চাকে খেতে বসিয়ে একা ছেড়ে দেবেন না কখনই। বাচ্চা মানুষ, নরম খাবারও কিন্তু গলায় আটকে যেতে পারে বেকায়দায়। তাই সাবধান থাকুন। বাচ্চা যখন খাবে তখন সামনে কেউ বড় যেন অবশ্যই থাকে।
  • বাচ্চাকে খেতে দেবেন হাল্কা প্লেটে। কোনও ধারালো চামচ, কাঁটা চামচ বাচ্চাকে দেবেন না। আঘাত লেগে যেতে পারে।
  • বাচ্চার কোনও খাবারে এলারজি আছে কি না, সেটা লক্ষ্য রাখবেন। বিশেষ করে নতুন কোনও খাবার শুরু করলে। (Finger Foods for Baby – Tips and Ideas)

 

আরও পড়ুন: ছোট্ট ছানার জন্য সহজ-স্বাস্থ্যকর ১০ ধারার খিচুড়ির রেসিপি!

 

একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার  হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

 

null

null