মহিলাদের মধ্যে বন্ধ্যাত্ব কেন আসে বা এর কারণ কী? কীভাবেই বা হয় এর চিকিৎসা?

মহিলাদের মধ্যে বন্ধ্যাত্ব কেন আসে বা এর কারণ কী? কীভাবেই বা হয় এর চিকিৎসা?

মাতৃত্ব যে মেয়েদের জীবনে সবথেকে বড় আশীর্বাদ হিসেবে আসে, তা আলাদা করে বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু একটা প্রাণকে নিজের মধ্যে অনুভব করার রাস্তা বা পদ্ধতিটা কিন্তু সবসময় চকচকে পাকা রাস্তার মতো হয় না। থাকে নানা চড়াই উতরাই, থাকে প্রচুর খানা খন্দ। যাই হোক, হেঁয়ালি না করে আসল কথাতেই আসি। খুব ভাগ্যবতী যারা, তাদের ক্ষেত্রেই দেখা যায়, আজ চাইলেন আর দু’মাস পরেই কনসিভ করতে পারলেন। আবার কিছু দম্পতি বেশ কিছু মাস চেষ্টা করে সুসংবাদটি পেলেন। আর রইলেন বাকি সেই সব দম্পতিরা, যারা চেষ্টা করার একটা নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরও মা-বাবা হতে পারছেন না। মহিলা বা পুরুষ, যে কারও শারীরিক সমস্যার জন্য কনসিভ করতে অসুবিধা হয় বা কনসিভ হয় না। মহিলাদের শারীরিক অসুস্থতা বা সমস্যার কারণে যদি কনসিভ করতে সমস্যা হয়, তা হলে তাকে মহিলাদের বন্ধ্যাত্ব বলে। (Female infertility: Causes and treatment in Bangla, Female infertility)

দেখা গিয়েছে, প্রতি ১০ জন দম্পতির মধ্যে ১টি এই বন্ধ্যাত্বের সমস্যায় ভুগে থাকেন। তবে এখন আর এতে মুষড়ে পড়ার প্রয়োজন নেই। আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্র মহিলাদের বন্ধ্যাত্বের সঠিক চিকিৎসা করে মায়ের কোলে এনে দিতে পারে ফুটফুটে এক সন্তান। তবে এর জন্য প্রয়োজন সতর্কতা, সমস্যা সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান এবং মানসিক জোর। বন্ধ্যাত্ব সংক্রান্ত যে কোনও চিকিৎসা শুরু করার আগে, ৩৫ বছর বয়সের নীচে মহিলাদের ডাক্তাররা অন্তত ১ বছর কনসিভ করার চেষ্টা করতে বলেন; মহিলার বয়স ৩৫-৪০ হলে ৬ মাস চেষ্টা করতে বলেন এবং যদি আপনার বয়স ৪০ পেরিয়ে গিয়ে থাকে, তা হলে সত্বর চিকিৎসা শুরু করা উচিত। মহিলাদের মধ্যে এই বন্ধ্যাত্ব কেন আসে বা এর কারণ কী? কীভাবেই বা হয় এর চিকিৎসা, দেখে নিন একনজরে।

আরও পড়ুন: ধাপে ধাপে আইভিএফ পদ্ধতি

গর্ভবতী হওয়ার জন্য কী কী বিষয় জরুরি? (Necessary conditions to get pregnant)

  • মাসিক চক্র নিয়মিত হওয়া।
  • মাসের নির্দিষ্ট সময়ে ওভ্যুলেশন হওয়া।
  • ওভ্যুলেশনের সময় নিয়মিত সহবাস।
  • সুগঠিত ফ্যালোপিয়ান টিউব এবং সুস্থ জরায়ু।
  • পুরুষ সঙ্গীর থেকে উন্নতমানের স্পার্ম।

মহিলাদের বন্ধ্যাত্বের কারণগুলি কী কী? (Reasons behind female infertility)

মহিলাদের মধ্যে বন্ধ্যাত্বের কারণ হিসেবে মুখ্য বলা যায়, জননতন্ত্রের জটিলতা। ওভ্যুলেশন প্রক্রিয়া নিয়মিত না হলে বা ফ্যালোপিয়ান টিউবে ব্লক থাকলে কনসিভ করতে অসুবিধা দেখা দেয়। ওভারিতে ফাইব্রয়েড থাকার কারণে হতে পারে বার বার গর্ভপাতও। এছাড়া কিছু মহিলার জননতন্ত্রে জন্মগত ত্রুটি থাকে, সেক্ষেত্রেও গর্ভবতী হতে পারেন না ওই মহিলা। ওভ্যুলেশন প্রক্রিয়া যে যে কারণে ব্যাহত হয় এবং ফ্যালোপিয়ান টিউব যে সব কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে এই বন্ধ্যাত্ব সৃষ্টি করে, সেগুলি হল; (Female infertility: Causes and treatment in Bangla)

  • পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম (Polycystic ovary syndrome) –এর কারণে শরীরে হরমোনের তারতম্য ঘটে এবং ওভারিতে ছোট ছোট সিস্ট থাকার কারণে কনসিভ করতে সমস্যা হয়।
  • ওভারিতে টিউমার থাকলে।
  • শরীরে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি প্রোল্যাকটিন হরমোন তৈরি হলে তা ইস্ট্রোজেন হরমোনের স্বাভাবিক মাত্রা কমিয়ে দেয়। এর ফলেও গর্ভে ভ্রূণ আসতে সমস্যা হয়।
  • কোনও অসুস্থতার কারণে বা জিনগত বৈশিষ্ট্যের কারণে ৪০ বছরের আগেই ওভারি থেকে আর ওভাম বা ডিম তৈরি হয় না। এর পোশাকি নাম প্রিম্যাচিওর ওভারিয়ান ফেলিওর(Premature ovarian failure)।
  • শরীরে থাইরয়েড গ্রন্থির অস্বাভাবিকতা।
  • অত্যধিক ওজন, অ্যালকোহল সেবন, ধূমপান এছাড়া নিজের ইচ্ছে মতো ওষুধ খাওয়াও বন্ধ্যাত্বের পরোক্ষ কারণ হিসেবে কাজ করে।
  • যৌন সংক্রমণের কারণে জরায়ু ও ফ্যালোপিয়ান টিউবে ইনফেকশন হয়ে থাকে। ডাক্তারি ভাষায় যার নাম পেলভিক ইনফ্লাম্যাটরি ডিজিস (Pelvic inflammatory disease)। এর কারণে আসতে পারে বন্ধ্যাত্ব।
  • এক্টোপিক প্রেগন্যান্সির কারণে যদি ফ্যালোপিয়ান টিউব ক্ষতিগ্রস্ত হয়, বা অন্য কোনও অপারেশনের ফলে ফ্যালোপিয়ান টিউব বাদ চলে যায়, তা হলেও গর্ভে ভ্রূণ আসতে সমস্যা হয়।
  • জরায়ুতে ফাইব্রয়েড এবং পলিপ থাকলে কনসিভ করতে সমস্যা হয়।
  • এছাড়াও, অনেকের ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক সারভিকাল মিউকাসও বন্ধ্যাত্বের জন্য দায়ী। এই ধরনের মিউকাস স্পার্মকে ওভামের কাছে পৌঁছতে দেয় না এবং নিষেকে বাধা দেয়।
  • পূর্বে কোনও জটিল অসুখে ভুগে থাকলে কনসিভ করার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি হতে পারে।
  • কোনও কোনও ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ সুস্থ দুই সঙ্গীর বাচ্চা হতেও সমস্যা দেখা দেয়। যার সঠিক কোনও কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না।

বন্ধ্যাত্ব কীভাবে শনাক্ত করা হয়? (How to diagnose female infertility?)

আল্ট্রাসাউন্ড, ল্যাপারস্কপি, রক্ত ও মূত্র পরীক্ষা, ব্রেস্ট পরীক্ষা, Hysterosalpingography বা HSG, Sonohystogram, Hysteroscopy ইত্যাদি পরীক্ষার মাধ্যমে মহিলার শরীরে কোনও জটিলতা থাকলে তা নির্ধারণ করা যায় এবং প্রয়োজন অনুসারে চিকিৎসা করা যায়।

আরও পড়ুনদ্রুত গর্ভধারণের ৭টি সহজ টিপস!

কীভাবে চিকিৎসা করা হয় বন্ধ্যাত্বের? (Treatment of female infertility)

  • শরীরে হরমোনের তারতম্যকে স্বাভাবিক করার জন্য বিভিন্ন ওষুধ ও ইনজেকশন দেওয়া হয়।
  • ফাইব্রয়েড ও পলিসিস্ট দূর করার জন্য হরমোনাল ওষুধ দেওয়া হয়।
  • ফ্যালোপিয়ান টিউব, জরায়ু বা পেলভিক অংশে কোনও ব্লকেজ বা অসুবিধা থাকলে তা অপারেশনের মাধ্যমে দূর করে দেওয়া হয়।
  • ওভ্যুলেশন যাতে নিয়মিত হয় তার জন্য ওষুধ দেওয়া হয় এবং ওভাম নিঃসরণ প্রক্রিয়াকে উত্তেজিত করে একের বেশি ওভাম তৈরি করতে সাহায্য করা হয়।
  • কোনও ভাবেই যদি মহিলার শরীর চিকিৎসায় সাড়া না দেয়, তা হলে আই ভি এফ পদ্ধতির সাহায্য নেওয়া হয় বা টেস্ট টিউব বেবি করানো হয়। যদিও এই দুই প্রক্রিয়াই বেশ খরচসাপেক্ষ।

কী কী বিষয়ে সতর্ক থাকবেন আপনি? (Some points to remember)

  • বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসায় অনেক ক্ষেত্রেই একটা নির্দিষ্ট সময় প্রয়োজন হয়। ধৈর্য না হারিয়ে ডাক্তারের কথা মতো চিকিৎসা গ্রহণ করুন।
  • কেন বাচ্চা আসছে না বা কেন কনসিভ করতে পারছি না, এই ভেবে সারাক্ষণ দুশ্চিন্তা করলে তা কনসিভ করার ক্ষেত্রে হানিকারক।
  • নিজের BMI স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করুন। উচ্চতা অনুযায়ী নিজের ওজন ঠিক রাখুন। অত্যধিক ওজন কনসিভ করতে বাধা সৃষ্টি করে।
  • বয়সের সাথে সাথে মহিলাদের ওভামের গুণগত মান এবং পরিমাণ দুইই কমতে শুরু করে। ৩৪-৩৫ বছরের পর এই সমস্যা প্রকট হতে শুরু করে। তাই কনসিভ করার প্ল্যানিং-এ খুব বেশি দেরি করবেন না।
  • অ্যালকোহল সেবন এবং ধূমপান থেকে শত হস্ত দূরে থাকুন।
  • নিজের ইচ্ছে মতো বা চটকদার বিজ্ঞাপনে বিভ্রান্ত হয়ে কোনও গর্ভনিরোধক ওষুধ, হরমোনাল পিল বা সাপ্লিমেনট খাবেন না। নিজের কোনও অসুবিধা হলে সরাসরি ডাক্তারের সাথে কথা বলুন। প্রয়োজন অনুসারে উনিই আপনাকে ওষুধ দেবেন।
  • সহবাসের সময় ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখুন।
  • মাত্রাতিরিক্ত ক্যাফেইন শরীরে যেতে দেবেন না। দিনে ২০০ মিলিগ্রামের কম ক্যাফেইন গ্রহণ করার চেষ্টা করুন।
  • মাসিক অনিয়মত হলে বা শরীরে কোনও অসুবিধা হলে সেটা লুকিয়ে যাবেন না। আজ কোনও সমস্যা লুকিয়ে বা চেপে রাখলে ভবিষ্যতে তা আরও ভয়ানক আকার নিতে পারে। তাই সময় থাকতে থাকতে চিকিৎসা করান।
  • মনে পজিটিভ চিন্তা ভাবনা রাখুন। প্রয়োজনে সঙ্গীর সাথে খোলাখুলি কথা বলুন। আনন্দে থাকুন, চিন্তামুক্ত থাকুন। (Female infertility: Causes and treatment in Bangla)

একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার  হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

null

null