পর্দায় প্রথম মুখ দেখানো সেই ’৯৪ সালে! নীতীশ মুখোপাধ্যায়ের ধারাবাহিক ‘হে মহাজীবন’-এর হাত ধরে টেলি-দুনিয়ায় পা। ২০০১ থেকে ধারাবাহিক ভাবে ধারাবাহিক-জগতে। বাবা জয়ন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখেই অভিনয়ের প্রতি অনুরাগ তাঁর। বাবার কাছ থেকেই শিখেছেন কাজের প্রতি ডেডিকেশন! কাজ শিখেছেন কিংবদন্তি পরিচালক যিশু দাশগুপ্ত, রাজা দাশগুপ্ত, মিলন রায়চৌধুরী, অনিন্দ্য সরকারের কাছে। ‘টেলিভিশনের সন্তান’, সেই জয়জিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ই (Jayjit Banerjee) আজ হাত ধরলেন আমাদের। জীবনের সবচেয়ে সেরা ‘চরিত্র’, আদরের ছেলে ‘পিন্দি’র (ভালো নাম যশোজিৎ হলেও জয়জিৎ তাকে এই নামেই ডাকেন!) বাবা হয়ে ওঠার গপ্পো শোনালেন তিনি! (Exclusive interview of tollywood actor Jayjit Banerjee in Bengali.)
‘ফাদারস ডে’-র সকালে এক পেয়ালা চায়ের সাথে আড্ডা জমলো অভিনেতার কলকাতার বাড়িতেই। উল্টো দিকে বেবি ডেস্টিনেশন বাংলার সম্পাদক ঋত্বিকা ভট্টাচার্য। দেখতে দেখতে পিতৃত্বের ১২টা বছর পার করেছেন জয়জিৎ। সেই রেশ টেনেই হবু বাবা, নতুন বাবা, একটু পুরনো বাবা বা বয়স্ক বাবা-সব্বাইকে কুর্নিশ জানিয়ে আড্ডার শুরু করলেন। হলফ করে বললেন, ‘মা হওয়া শুধু নয়, বাবার মতো বাবা হওয়াও চাট্টিখানি কথা নয়!’
উত্তর: (এক গাল হেসে) কোনও ডাউটই নেই এখানে! সার্টিফিকেট দিয়েছে স্বয়ং আমার বউ! বলেছে, স্বামী হিসেবে আমি যদি একশোয় দশ পাই, বাবা হিসেবে ২০০ পাবো! এর চেয়ে বড় শংসাপত্র আর কী হয় বলুন!
উত্তর: রোজের কাজ মেটার পর যতটুকু সময় থাকে, ততটুকু কোয়ালিটি টাইমই ছেলেকে দিই আমি। আমার কাজ, কাজের পিছনে ছুটে বেড়ানো এ সবই তো আমার ভালোবাসার মানুষগুলোকে, আমার পরিবারকে একটু ভালো রাখতে, আনন্দে রাখতে। রোজের শ্যুটিংকেও দশটা-পাঁচটার ডিউটির মতোই দেখি আমি। তাতে যা রোজগার হয়, সেই দিয়েই আমার সংসার চলে, আমার গাড়ির ইএমআই আসে। কাজের ব্যস্ততা, কাজের প্রতি কমিটেমন্ট কাজের জায়গাতেই ছেড়ে আসি আমি। বাকি যেটুকু সময় থাকে হাতে, তার পুরোটাই শুধুই আমার ছেলের!
ওর জন্মের পর জীবনের মানেটাই যেন পাল্টে গিয়েছিল পুরো। শ্যুটিং শেষে বাড়ি ফেরার তাড়া, ছেলেটার সাথে একটু সময় কাটানোর প্রচণ্ড তাগিদ, ওর বড় হয়ে ওঠার প্রতিটা মুহূর্ত চেটেপুটে উপভোগ করা- এসব কিছুই তারিয়ে তারিয়ে এনজয় করেছি আমি। ছেলে এখন সাড়ে বারো, ছেলে এখন আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু!
ওর সাথেই ক্রিকেট খেলি আমি, ফুটবল খেলি, ভিডিও গেমে লড়াই করি। আমার ছেলেই আমার মুভি-পার্টনার!
(একটু মজা করে) আসলে শহরের সবচেয়ে এলিজেবল ব্যাচেলরকে নিয়ে বুকফুলিয়ে শপিং মলে বেড়াই আমি। দেখে জ্বলে-পুড়ে যায় সুন্দরী মেয়েগুলো (হেসে গড়িয়েই গেলেন অভিনেতা)!
তবে হ্যাঁ, বলতে দ্বিধা নেই যশোজিতের (সাক্ষাৎকার হচ্ছে বলেই ছেলেকে বোধহয় জীবনে প্রথম ভালো নামে ডাকলেন জয়জিৎ) বড় হয়ে ওঠা, ওকে মানুষের মতো করার পিছনে তেমন কোনও কনট্রিবিউশন নেই আমার। পুরো ক্রেডিটটাই আমার বাবা-মা আর ওর মায়ের। আমার বাবা-মা-ই আগলে রাখে ওকে।
(একটু অভিমানের সুরে) আমাকে কিন্তু কোনওদিন এত প্যামপার করেনি ওরা! কথায় বলে না, আসলের চেয়ে সুদের দর বেশি!
উত্তর: একটা কথা বললে হয়তো বিশ্বাসই করবেন না। আমার ছেলের তো ১২ বছর হয়ে গেল, আজ অবধি আমি বা আমার স্ত্রী ওর গায়ে হাত তুলিনি। মারধর করাকে শাসন করার মাধ্যম হিসেবে বিবেচনার মধ্যেও আনি না আমরা। দরকার পড়লে বকেছি, বুঝিয়েছি। কিন্তু আমাদের ভয় পেতে শেখায়নি কখনও। আমি আর আমার স্ত্রী একটা বিষয়ের ওপরই জোর দিয়েছি বরাবর, ছেলে যাতে মিথ্যের আশ্রয় না নেয় কোনও দিন! মিথ্যে থেকে দূরে থাকলেই ওর ভিতর কোনও কিছু লুকনোর প্রবণতা তৈরি হবে না। না লুকালে ভুল করার আশঙ্কা কমে যায় অনেকখানি। আর ভুল না করলে বকাবকির প্রশ্ন আসে কোথা থেকে?
বাবা বলে নয়, একজন সাধারণ মানুষ হিসেবেই বলছি। আশপাশের বাচ্চাগুলোকে দেখি তো, সে তুলনায় সত্যি বলতে আমাদের ছেলেটা কিন্তু বড্ড ভালো। (প্রসঙ্গত, এমন পিতৃ-গর্বের যথেষ্ট কারণও তৈরি হয়েছে ইতিমধ্যে। বছর বারোর যশোজিৎ বা জোজো বা পিন্দি বা প্যাঁও বা ননাই বা কুটুস (সবকটাই বাড়ির নাম) রীতিমতো স্টার এখন! ডন বসকোর (পার্ক সার্কাস) উজ্জ্বল, মেধাবী ছাত্রটি টানা তিনটি বার ‘দাদাগিরি’ চ্যাম্পিয়ন। সেই সঙ্গে স-গৌরবে পা রেখেছে অভিনয়-জগতেও।)
উত্তর: আলাদা করে চাহিদা মেটানোর আসলে দরকারই পড়ে না। আমি আর আমার স্ত্রী ওর সাথে বন্ধুর মতো মিশি। ওর সিদ্ধান্তগুলো ওকে নিজেই নিতে দিই। কোনও কিছুই চাপিয়ে দিই না। ও কী খাবে, কোথায় যাবে, কী পরবে- এসব ডিসিশন আমরা ওকেই নিতে দিই। আমার মনে হয়, মোটামুটি বোঝদার হলেই যদি বাচ্চাকে তার নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে দেওয়া যায় তা হলে আগামী জীবনের চ্যালেঞ্জগুলো ওর কাছে অনেক সহজ হয়ে যায়।
বাচ্চার বেড়ে ওঠার সময় বলে তাকে মোবাইল থেকে, ইন্টারনেট থেকে, টিভি থেকে দূরে রাখব, এ কাজ আমরা কোনওদিন করিনি। করবও না। দূরে দূরে রাখতে গিয়ে হিতে বিপরীত হয়। যুগটা এমন, যে আপনি না চাইলেও অনেক সত্য, অনেক কিছুরই মুখোমুখি হবে আপনার বাচ্চা। বিপত্তি এড়াতে তাই সব কিছু নিয়েই তার সাথে খোলাখুলি কথা বলা ভালো। তাকে গোড়াতেই ধরিয়ে দেওয়া ভালো, কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল!
(আলোচনা খানিক গম্ভীর হয়ে যাচ্ছে দেখে নিজেই রাশ টানলেন জয়জিৎ (Jayjit Banerjee) । মুড পাল্টে হঠাৎ বললেন) আরে, আমি তো অপেক্ষায় আছি কবে ওর একটা গার্লফ্রেন্ড হবে! ওর বয়সে দুটো প্রেম করে ফেলেছি আমি।
(মুখটা কাঁচুমাচু করে) আসলে পিন্দিকেও দোষ দেওয়া যায় না। বেচারাকে বয়েজ স্কুলে ভর্তি করিয়েছি যে আমরা!
উত্তর: এই উত্তরটা জানলে যশোজিৎ বেজায় এমব্যারেসড হবে! যখন ওর ছ’মাস বয়স, একবাট্টি একা ছিল আমার সাথে। ঘুমের ভিতরই পটি করে সে একসার কাণ্ড! এমনিতে এসবে বড্ড ঘেন্না আমার। কিন্তু ছেলের ন্যাপি পাল্টাতে গিয়ে গন্ধ, ঘেন্না কিছু মালুমই হলো না!
এখানেই শেষ নয়, আরও করেছি। আমি এমনিই একটু কুঁড়ে প্রকৃতির। জল গড়িয়েও খাই না। কিন্তু ছেলের জন্য রান্নাও করেছি! ‘বিগ বস’-এ থাকতে রান্না শিখেছিলাম। ফিরে এসে নিজের মতো এক্সপেরিমেন্ট করে মুরগি রেঁধে খাইয়েছিলাম ছেলেকে।
(মুখের কথা কেড়ে নিয়ে) রেসিপি-টেসিপি জিজ্ঞেস করবেন না! ওটা পুরোটাই পরীক্ষামূলক। কীভাবে যে রান্নাটা করেছিলাম, আজও ভেবে পাই না। ছেলে খেয়ে সার্টিফিকেট দিয়েছিলো, ‘দারুণ হয়েছে বাবা!’
উত্তর: উঁহু, এসবে ভুলবেন না! ছেলে আমার বড্ড ডিপ্লোমেটিক! এখন বলে নয়, ছোট থেকেই কেউ যদি ওকে জিজ্ঞেস করত, কাকে বেশি ভালোবাসো? সিরিয়ালি আমাদের চারজনের নাম বলে দিত ও। তা-ও বয়স মেনে! দাদু, তারপর দিদা, তারপর বাবা, তারপর মা। সব্বাইকে ২৫ শতাংশ করে ভালোবাসে ও! কেউ বেশি না, কেউ কম না!
ছেলেটার কপালটা আসলে দারুণ ভালো। আমি আমার দাদু-দিদাকে পাইনি। ও পাচ্ছে। অর্ধেক সময় আমার বাবা-মা’র কাছেই থেকে যায় যশোজিৎ। বাবা-মা-ই মাথায় করে রেখেছে ওকে। আমরা বলি, ওর দু’জোড়া বাবা-মা!
উত্তর: আমার ছেলে আসলে এগুলোকে সে ভাবে গুরুত্বই দেয়নি কোনও দিন। বলা ভালো, রুপালি পর্দাটা যে একটু চকচকে দুনিয়া এটার আঁচই পায়নি ও। ছোট থেকেই টলিউডের তারকাদের চোখের সামনে দেখেছে। তাই বিষয়টি নিয়ে কোনও আকর্ষণই কাজ করে না ওর।
আর যদি অহংকার বা সেসব বলেন, তো বলবো এসবের ধারও ধারে না যশোজিৎ। আমার ছেলে বলে শুধু নয়, ধীরে ধীরে ওকেই লোকজন চিনতে শুরু করেছে।
ছেলে সেটা বুঝতে পারে, কিন্তু সেটাকে মাথার ভিতর আসতে দেয় না। যতটা পারি, আর পাঁচটা বাচ্চার মতোই ওকে মানুষ করার চেষ্টা করছি। ও নিজেও নিজের পা-দুটো মাটিতে রেখেই সামনের দিকে এগোচ্ছে।
উত্তর: দেখুন, এ সুবিধা তো আমাদের প্রাপ্য নয়! তো কী বলি বলুন তো। কাজ করেও অনেক সময় টাকা পাচ্ছি না, বসিয়ে বসিয়ে কোন প্রোডাকশন হাউজ টাকা দেবে শুনি?
তবে হ্যাঁ, এই পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। যাঁরা এই ছুটি পাচ্ছেন, সেই সব হবু-বাবাদের বলবো ছুটিটা কাজেও লাগান। মায়ের সঙ্গে রাতজাগা ভাগ করে নিন। ছোট্ট বাচ্চার দেখভালের সবটুকু আপনিও সমান ভাবে করুন। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, সন্তানের বড় হয়ে ওঠাটা পুরোপুরি উপভোগ করার চেয়ে ভালো অনুভূতি আর কিছুই হয় না!
উত্তর: আবারও সেই এক কথাই বলবো, ‘মা হওয়া শুধু নয়, বাবার মতো বাবা হওয়াও চাট্টিখানি কথা নয়!’ ছেলে-পরিবার সামলাতে গিয়ে কখনও যদি পকেটে টান পড়ে, আজও ‘উরি বাবা!’ বলে বাবার নামটাই সবার আগে স্মরণ করি আমি। বাবাই যে একমাত্র অবলম্বন আমার! যশোজিতের জীবনেও সেই ভূমিকায় উত্তীর্ণ হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। সফল কি না, বলবে ভবিষ্য়ৎ…
আরও পড়ুনঃ মায়েদের জন্য আর কী টিপস রইল সুদীপার? খোঁজ নিলাম আমরা!
null
null