আপনার ছোট্ট সোনার কি মাঝে মধ্যে খিঁচুনি হচ্ছে? তারপর কিছুক্ষণের জন্য সে অজ্ঞান হয়ে থাকছে? আপনার পরিবারের সদস্যরা বা পাড়ার অন্য লোকজন বলছেন, এটা মৃগী বা ওই জাতীয় সমস্যা? এবং তার জন্য নানা রকম টোটকা বাতলাচ্ছেন আপনাকে? (Epilepsy in Children Diagnosis & Treatment)
তা হলে আপনাকে সুতপার ঘটনাটা বলা যাক। সুতপার ছেলে সুতীর্থ জন্মানোর কয়েক মাসের মধ্যেই এই সমস্যা দেখা যায়। সুতপা তখন যাকে বলে যারপরনাই ভয় পেয়েছিল (Diagnosing Seizures in Children)। তার সবে ধন নীলমণির যদি এখনই এমন কঠিন অসুখ হয়, তা হলে বড় হয়ে কী হবে!
কিন্তু চিকিৎসকের কাছে একবার গিয়েই সুতপার ধারণাটা আমূল বদলে গেল। ডাক্তার ম্যাডাম পরিষ্কার জানালেন, শৈশবে এই জাতীয় সমস্যা (Epilepsy in Childhood) মোটেই অস্বাভাবিক নয়। অহরহ বাচ্চাদের মধ্যে এই সমস্যা দেখা যায়। টিনএজ পার করার আগেই এই সমস্যা আপনাআপনি সেরেও যায়।
হ্যাঁ, এক কথায় এর নাম মৃগীই (Mrigi Rog) বটে। ইংরেজিতে যাকে বলা হয় এপিলেপসি (Epilepsy)। মানুষের এবং সব প্রাণীরই মস্তিষ্কের সচলতার পিছনে কাজ করছে নানা ধরনের ইলেকট্রিক্যাল তরঙ্গ।
শিশুর মস্তিষ্কে এই তরঙ্গের রকমফের হলেই এপিলেপসির মতো সমস্যা দেখা যায়। বারবার খিঁচুনি (Seizure) ফিরে আসতে পারে এই সমস্যা হলে। হঠাৎ করে শিশু অসুস্থ হয়ে পড়ে। মিনিট খানেক এই অবস্থায় থাকার পর আবার আস্তে আস্তে সে সুস্থ হয়ে ওঠে (Signs and Symptoms of Seizures)। ক্রমাগত এই সমস্যা হতে থাকলে চিকিৎসকের সঙ্গে দ্রুত কথা বলতে হবে।
সুতপার ছেলের মতোই প্রার্থনার মেয়ে তিন্নির ক্ষেত্রেও একই সমস্যা হয়েছিল। প্রার্থনার দ্বিতীয় সন্তান তিন্নি। বড় মেয়ের ক্ষেত্রে এমন সমস্যা না-থাকায়, প্রার্থনার বুঝতে পারছিল না, এপিলেপসির পিছনের কারণটা ঠিক কী (What Can Cause a Seizure in a Child?)?
জিনগত কারণ হলে তো তিন্নির দিদি তানিরও একই সমস্যা হত। চিকিৎসককে তা জিজ্ঞেস করতে, তিনি জানালেন জিনগত বা বংশগত কারণ এপিলেপসির (Mrigi Rog) পিছনে থাকতেই পারে। কিন্তু সেটাই একমাত্র কারণ নয়। এছাড়াও রয়েছে আরও কয়েকটি কারণ। যেমন:
মৃগী বা এপিলেপসি কেন হয় (Cause of Epilepsy):
কোনও কারণ ছাড়াই শিশুর মাঝে মধ্যেই খিঁচুনি হলে, সাধারণত চিকিৎসকরা এপিলেপসি বলে সন্দেহ করেন (Types of Seizures in Children)। অনেক ক্ষেত্রে জ্বর বা আঘাতের কারণে শিশুর খিঁচুনি বা কাঁপুনি হয়। এগুলো ছাড়া এমনি-এমনি খিঁচুনি হওয়া এপিলেপসির প্রধান লক্ষণ। কিন্তু তাও নিশ্চিত হওয়ার জন্য চিকিৎসকরা বেশ কয়েকটি পদ্ধতির সাহায্য নেন। এক ঝলকে দেখে নেওয়া যাক সেগুলো।
মৃগী রোগ শনাক্ত করার উপায় (How is Epilepsy Diagnosed?)
এই সব পরীক্ষার পর চিকিৎসক যদি নিশ্চিত হন শিশুর এপিলেপসি বা মৃগীই হয়েছে, তা হলে তিনিই বাতলে দেবেন এরপর চিকিৎসার পদ্ধতি কী হবে (Treatment of Convulsion in Child)। যেহেতু এই সমস্যায় আক্রান্ত বেশির ভাগ শিশুই টিনএজ-এ পড়তে না-পড়তেই অসুখটি একদম সেরে যায়, তাই এ নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই।
তবে চিকিৎসকের কথা মতো নিয়মমাফিক চিকিৎসা চালিয়া যেতে হবে। একটা কথা মনে রাখা দরকার। এপিলেপসি খুব উদ্বেগ করার মতো সমস্যা না-হলেও এটা মস্তিষ্কের খুব জটিল সমস্যা। তাই ওষুধ দিয়ে দ্রুত নিরাময় করে ফেলার আশা রাখবেন না (Treatment for Epilepsy)। সময়ের উপর ভরসা রাখাটাই এক্ষেত্রে সবচেয়ে কাজের কথা।
খিঁচুনি বা মৃগী রোগের চিকিৎসা পদ্ধতি (Treatment for Epilepsy)
#1. এপিলেপসির ওষুধ বা অ্যান্টি-এপিলেপসি ড্রাগ: একে অ্যান্টিকনভালস্যান্ট ড্রাগ (anticonvulsant drugs)-ও বলে। এই ধরনের ওষুধ সম্প্রতি বাজারে এসেছে। খুবই উন্নত মানের ওষুধ এগুলি। কিন্তু কোন ওষুধ কোন শিশুর উপর কাজ করবে, তা একমাত্র বলতে পারবেন চিকিৎসকই। তবে এই ধরনের ওষুধ (Medications for Children’s Epilepsy) এপিলেপসি পুরোপুরি সারিয়ে ফেলতে পারে না। কিন্তু খিঁচুনির সংখ্যা অনেকটা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে এনে দিতে পারে।
#2. কেটোজেনিক ডায়েট: যে সমস্ত শিশুর ক্ষেত্রে খিঁচুনির ওষুধ খুব ভালো কাজ করে না, তাদের কেটোজেনিক ডায়েট (Ketogenic Diet) চার্ট মেনে খাবার খাওয়ানোর কথা বলেন চিকিৎসকরা। এটি মূলত হাই-ফ্যাট, লো-কার্বহাইড্রেট ডায়েট চার্ট। শিশুকে প্রতি এক গ্রাম কার্বোহাইড্রেট বা প্রোটিনের জন্য তিন থেকে চার গ্রাম ফ্যাট জাতীয় খাবার দিতে হয়।
পরিসংখ্যান বলছে, এই ধরনের ডায়েটে থাকলে শিশুর খিঁচুনির পরিমাণ অনেকটাই কমে আসে (Natural Treatments for Epilepsy)। তবে এক্ষেত্রে চিকিৎসক এবং ডায়েটেশিয়ানের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে শিশুর খাবার নির্বাচন করতে হবে। ঘি, মাখন, মেয়োনিজ বা অলিভ ওয়েলের পরিমাণ এই ডায়েট চার্টে বেশি প্রাধান্য পায় (Best Epilepsy Home Treatments)।
#3. মডিফায়েট অ্যাটকিনস ডায়েট: কেটোজেনিক ডায়েটেরই একটু পরবর্তিত রূপ এই ডায়েট চার্ট। দিনের মাথায় কী পরিমাণ ক্যালোরি শিশুর শরীরে যাবে, কেটোজেনিকে তার নির্দিষ্ট মাত্রা বেঁধে দেওয়া থাকে। মডিফায়েড অ্যাটকিনস (Modified Atkin’s diet) -এ সেই বিধিনিষেধটা থাকে না। দিনের মাথায় শরীরে কতটা ফ্লুইড যাবে, তারও কোনও বিধিনিষেধ নেই এই ডায়েট চার্টে। বহু শিশুর ক্ষেত্রেই এই দ্বিতীয় শ্রেণির ডায়েট চার্ট বেশি কার্যকরী হয়েছে (Natural and Effective Remedies for Epilepsy)।
আরও পড়ুন: অটিজম কী, কেন? লক্ষণ ও প্রতিরোধের উপায়
#4. লো গ্লাইসেমিক ইনডেক্স ট্রিটমেন্ট: এটা আরেক ধরনের ডায়েট চার্ট। এখানে আবার দিনের মাথায় শিশু কতটা কার্বোহাইড্রেট খাবে, তার উপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। এবং সেই কার্বোহাইড্রেটে কতটা কম গ্লাইসেমিক ইনডেক্স রাখা যাবে তার দিকেই নজর দেন ডায়েটেশিয়ানরা। এই ডায়েট (Low Glycemic Index Treatment)) মেনে শিশুকে খাওয়ালে তার শরীরে ভিটামিন বা মিনারেলের ঘাটতি হতে পারে। সেক্ষেত্রে চিকিৎসকরা সাপ্লিমেন্ট দেওয়ার কথাও বলেন।
#5. মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার: যে সব শিশুর ক্ষেত্রে সমস্যা খুব গুরুতর আকার নেয়, এবং কোনও পদ্ধতিতেই খিঁচুনি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয় না, তাদের ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচারই (Treating Children with Epilepsy) একমাত্র পথ বলে মনে করেন চিকিৎসকরা।
শিশুর এপিলেপসি ধরার পড়ার পর, তার বাবা-মায়ের উপর কিছু দায়িত্ব এসে পড়ে। মনে রাখবেন, আপনার সোনা যদি এই সমস্যায় আক্রান্ত হয়, তা হলেও ভয় পাওয়ার কিছু নেই। স্বাভাবিক জীবন কাটানোটা তার জন্য মোটেই কঠিন কিছু নয়। কিন্তু সামান্য কয়েকটি বিষয়ে আপনাকে সচেতন থাকবে হবে।
শিশুর খিঁচুনি শুরু হলে আপনার কী করণীয়?
(What Do You Do If a Child is Having a Seizure?)
সাধারণত এ ধরনের খিঁচুনি তখনই হয় যখন বাচ্চার শরীরের তাপমাত্রা হুট করে বেড়ে যায়। একবার খিঁচুনি শুরু হয়ে গেলে তা থামানোর জন্য আসলে তাৎক্ষণিকভাবে কিছুই করার থাকে না। তবে শিশুকে নিরাপদ রাখতে কিছু কিছু কাজ করতে পারেন আপনি ও আপনার সঙ্গী (Seizure First Aid)। যেমন-
খিঁচুনির সময় যে কাজগুলো কখনওই করবেন না (Things to Avoid When Your Child is Having a Seizure)
খিঁচুনি হলে কখন যাবেন চিকিৎসকের কাছে? (When to Call a Doctor?)
আপনার ছোট্ট সোনা এই সমস্যায় আক্রান্ত হলে যা যা আপনার করার আছে তার একটা গাইডলাইন তো পেয়েই গেলেন এখানে। কিন্তু এর বাইরে একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জিনিস পড়ে থাকে। এখনও আমাদের সমাজের বহু জায়গায় এপিলেপসি বা মৃগী নিয়ে রীতিমতো কুসংস্কার রয়েছে (Myths and Superstition About Epilepsy)।
সেগুলোয় একদম কান দেবেন না। কোনও টোটকা চিকিৎসার রাস্তায় যাবেন না। মনে রাখবেন, একমাত্র চিকিৎসকই আপনার সোনাকে ঠিক করার সঠিক রাস্তাটা বলে দিতে পারেন (Epilepsy in Children Diagnosis & Treatment)।
আরও পড়ুন: খাবার দেখলেই বাচ্চার আতঙ্ক? দেখে নিন কারণ ও প্রতিকার
একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।
null
null