কচি বয়সটাই সোনার মস্তিষ্কের বিকাশে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। কীভাবে সাহায্য করবেন আপনি?

কচি বয়সটাই সোনার মস্তিষ্কের বিকাশে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। কীভাবে সাহায্য করবেন আপনি?

গত বছর কাশফুলের গন্ধে যখন পুজোর আমেজ আসতে শুরু করেছে, তখনই নম্রতার কোলে ছোট্ট তিতলির জন্ম‌। নম্রতা আর রণজয়ের পরিবারে সে যেন মা দুর্গা হয়ে এসেছে। ছয় মাসের মাথায় ও হামা দেওয়া শুরু করে। সেই থেকে ওর দুরন্তপনায় কোনও কমতি নেই। এই ছুঁড়ছে, ওই ভাঙছে, হামা দিয়ে ঘুরছে সারা বাড়ি। (Encouraging Brain Development in Children)

তবে এত আনন্দের মধ্যেও একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। ১৩ মাস বয়স হলেও তিতলি কোনও কথা বা শব্দ বলতে পারে না। নম্রতা কতবার বাবা-মা বলতে শিখিয়েছে, কিন্তু কোনও সাড়াই দেয় না। (Early Brain Development and Health) এই নিয়ে নম্রতা-রনজয় এখন দুশ্চিন্তায়। যে দুশ্চিন্তা শেষ পর্যন্ত ওদের টেনে নিয়ে যায় চিকিৎসকের চেম্বারে।

তিনি সবটা মন দিয়ে শুনে বললেন, ওকে নিয়ে এখনই চিন্তার কোনও কারণ নেই। বরং এখন ওর মস্তিষ্কের বিকাশের দিকে মন দেওয়া দরকার (Brain Development Activities)। মস্তিষ্কের বিকাশের ব্যাপারটা ওরা বুঝতে পারল না। তখন চিকিৎসকই বুঝিয়ে দিলেন মস্তিষ্কের বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য যা শিশুর মন ও শরীরকে গড়ে তোলে।

মস্তিষ্ক হল শরীরের কন্ট্রোল রুম। সেই বলে দেয়, এভাবে হাসো, এভাবে কাঁদো বা এভাবে কথা বলো। চিকিৎসক ছোট্ট তিতলির এই কন্ট্রোল রুম নিয়ে নম্রতা-রণজয়কে কী কী বোঝালেন? চলুন সেগুলোই একে একে দেখে নেওয়া যাক।

 

 

শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশ নিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য (Interesting and Surprising Facts About Child’s Brain Development)

 

#1. বুলি ফোটার আগেই মস্তিষ্ক তৈরি: মানুষের মস্তিষ্কে রয়েছে সেরেবেলাম আর ব্রোকাস এরিয়া নামে দু’টি অংশ। এরাই ছোট্ট সোনাকে কথা বলার সময় ঠোঁট, জিভ কীভাবে নাড়াতে হয়, তা শিখিয়ে দেয়। (Brain Development in Children) বিশেষজ্ঞদের মতে, মস্তিষ্কের এই অংশ দু’টি শিশুর বুলি ফোটার আগেই নিজেদের তৈরি করে নেয়।

 

#2. ছোঁয়া পেলে শিশুর সাইন্যাপস পরিণত হয়: মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করে নিউরোন। এই নিউরোনগুলোর মধ্যে অনুভূতির বিভিন্ন খবর আদানপ্রদান হয় সাইন্যাপসের (synapses) মাধ্যমে। বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, যে শিশুরা মায়ের‌ সংস্পর্শে বেশি সময় কাটায় তাদের সাইন্যাপস অন্য শিশুদের তুলনায় বেশি সক্রিয় ও তাড়াতাড়ি কাজ করে।

 

#3. একাধিক ভাষা জানলে মস্তিষ্কের ভালো: জন্মের সময় ছোট্ট সোনাকে যে ভাষাই শেখান ও সেই ভাষাই শিখে নেয়। তবে মস্তিষ্ক একাধিক ভাষা শেখারও ক্ষমতা রাখে (Amazing Facts About the Infant Brain)। একাধিক ভাষা শিখলে ওর মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বাড়ে। এর ফলে খুব তাড়াতাড়ি কাজ করার পাশাপাশি কোনও কিছুতে মনঃসংযোগ করাটাও মস্তিষ্কের জন্য সহজ হয়।

 

#4. মস্তিষ্কেরই বেশিরভাগ শক্তি লাগে: মস্তিষ্কের সম্পূর্ণ বিকাশের জন্য এর কোষগুলো শরীরের থেকে শক্তি সংগ্ৰহ করে। বিশেষজ্ঞদের কথায়, শিশুদের শরীর মস্তিষ্ক বিকাশের জন্যই সবচেয়ে বেশি শক্তি খরচ করে । একটি শিশুর শরীরের ৬০ শতাংশ শক্তিই মস্তিষ্কের বিকাশে লাগে।

 

#5. প্রথম তিন বছর মস্তিষ্কের জন্য গুরুত্বপূর্ণ: মস্তিষ্কের বিকাশ কোন বয়সে সবচেয়ে ভালো হয়? অনেক মা-বাবাই এই কথা জানতে চান তাঁদের চিকিৎসকের কাছে। বিজ্ঞান বলছে, জন্মের পর থেকে তিন বছর বয়স পর্যন্ত শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশ সবচেয়ে বেশি হয়। (Brain Facts) তিন বছরের মধ্যে একটি শিশুর এক হাজার ট্রিলিয়ন সাইন্যাপস তৈরি হয়। মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের মধ্যে সেরেবেলাম সবচেয়ে তাড়াতাড়ি আকারে বাড়ে। এই অংশটিই পরে শরীরের নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গের চলাফেরা নিয়ন্ত্রণ করে (Brain Development- 0-3 years)।

 

#6. সবচেয়ে বেশি নিউরোন নিয়ে জন্ম: বিজ্ঞান বলছে, ছোট্ট শিশু যখন মায়ের গর্ভ থেকে জন্ম নেয়, তার মস্তিষ্কে প্রায় দশ হাজার কোটি নিউরোন থাকে। যা থাকে না একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মস্তিষ্কেও। অথচ আকারের দিক থেকে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মস্তিষ্কের অর্ধেক হল সদ্যজাত শিশুর মস্তিষ্ক। এই বিশাল সংখ্যক নিউরোনই প্রথম একবছর বয়সের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই সময়েই ছোট্ট সোনা শিখে নেয় অনেক কিছু। (Facts About Your Toddler’s Developing Brain)
পাশপাশি চিনে নেয় তার বাবা-মা, বাড়ি ও অন্যান্য আত্মীয়দের। তার মানসিক গঠনও এই সময় সবচেয়ে তাড়াতাড়ি হয়।

 

#7. দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতি: ছোট্ট সোনা তার মাকে ছাড়া থাকতেই পারছে না। মা না-থাকলেই সে প্রচণ্ড কাঁদে। এমন ঘটনায় অনেক মায়েরাই বুঝে পান না কী করবেন। যদিও বিশেষজ্ঞরা বলেন এটি দীর্ঘমেয়াদি স্মৃতিশক্তির লক্ষণ। কারণ এমন কান্নাকাটির অর্থ হল ছোট্ট সোনা বুঝে গিয়েছে (Encouraging Brain Development in Children), বাবা-মা ওর সবচেয়ে কাছের লোক।
জন্মের পর থেকে বিভিন্ন ধাপের মধ্যে দিয়ে শিশুর পূর্ণ মস্তিষ্ক তৈরি হয়। মস্তিষ্কের বিকাশ সম্পর্কে এই তথ্যগুলোর পাশাপাশি তিতলির চিকিৎসক মস্তিষ্কের সম্পূর্ণ বিকাশের বিভিন্ন ধাপের কথাও বলেন। এবারে সেই ধাপগুলোই দেখে নেওয়া যাক।

 

আরও পড়ুন: বাড়ন্ত বাচ্চার জন্য ৬টি জরুরি খাবার

 

ধাপে ধাপে শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশ (Baby Brain Development Stages)

  • প্রথম ছয় মাস: জন্মের সময় কাঁদলেও জন্মের পরের কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই ছোট্ট সোনা হেসে ওঠে। আর তা মা-বাবার হাসি দেখেই। বাবা-মায়ের মুখের দিকে তাকানো আর তাদের চিনতে পারা শুরু হয় আর কয়েক দিন পর থেকে। ছয় মাসের মাথায় একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মতোই সে বিভিন্ন রং বুঝতে শেখে। এই সময় মস্তিষ্কে বাড়তে থাকে নিউরোনের সংখ্যা।

 

  • ছয় থেকে ১২ মাস: ছয় মাসের অন্নপ্রাশন শেষ। (Baby Brain Development Stages) এই সময় ধীরে ধীরে ও আপনার কম্যান্ডগুলো বুঝতে শুরু করবে। আপনি যদি বল ঠেলে দেন ওর দিকে, ও-ও উল্টে আপনার দিকে ঠেলে দেবে। এমনকী নাম ধরে ডাকলে আপনার মুখের দিকেও তাকাবে। একবছরের জন্মদিনে কেক কাটার সময় আধো-আধো গলায় মা, বাবা ডাকও শুনতে পারেন ওর মুখে।

 

  • এক থেকে দুই বছর: আধো আধো গলায় মা-বাবার পাশাপাশি আরও বেশ কিছু শব্দও শিখে নেবে আপনার ছোট্ট সোনা। আশেপাশের পরিবেশের প্রতি তার কৌতুহল অনেক বেড়ে যাবে। এই সময় শিশুর মস্তিষ্ক চারপাশের জিনিসগুলোর রং, আকার থেকে একটা ছবি বা ইম্প্রেশন নেওয়ার চেষ্টা করে। (Ages & Stages Of Child Development) আপনার নির্দেশগুলো ওর মস্তিষ্ককে আরও সক্রিয় করে তোলে।

 

  • দুই থেকে তিন বছর: এই সময় আপনার চোখের মণি নিজের ব্যাপারে খুব সচেতন হয়ে ওঠে। পুতুল বা গাড়ি নিয়ে খেলার সময় নিজের মতো করে কল্পনা করার চেষ্টা করে। এই সময় একটি শিশুর মস্তিষ্কের আকার প্রাপ্তবয়স্ক মস্তিষ্কের প্রায় ৮০ ভাগ হয়ে যায়।

 

জন্ম থেকে তিন বছরের মধ্যে একটি শিশুর এক হাজার ট্রিলিয়ন সাইন্যাপস তৈরি হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, পৃথিবীতে আসার পর শিশুর মস্তিষ্ক চারপাশের যে আলো, হাওয়া, স্বাদ, গন্ধ পায়, তাদের জন্যই সাইন্যাপসগুলো সংখ্যায় বাড়তে থাকে। (Brain Development Stages: Newborn to Infant) যার অর্থ হল পৃথিবীর সঙ্গে মানিয়ে নিতে মস্তিষ্ক আরও সংবেদনশীল বা রেসপনসিভ (responsive) হয়ে ওঠে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি শিশুর মস্তিষ্ক প্রথম ৫ বছরেই ৯০ শতাংশ পরিণত হয়ে যায়। তাই এই সময়ের মধ্যে ওর মস্তিষ্ক যত সক্রিয় রাখা যায়, ততই ভালো। কীভাবে ওর মস্তিষ্ককে সক্রিয় রাখা সম্ভব? তিতলির চিকিৎসক এই নিয়েও নম্রতাদের বেশ কিছু এক্সারসাইজ-এর কথা বলেছেন। এবারে সেগুলোই জেনে নেওয়া যাক।

 

 

শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশে আপনার যা করণীয় (How to Encourage a Child’s Brain Development)

  • গল্প বলুন ও শুনতে চান: প্রতি রাতে একই গল্প ওকে শোনান। দুই-তিন বছর বয়সে বাচ্চা গল্প শুনে শুনে মনে রাখার চেষ্টা করে। কিছুদিন বাদে ওর কাছেই সেই গল্পটা শুনতে চান‌, অল্প ধরিয়ে দিন।

 

  • জিনিস ঘাঁটতে দিন: ছোট্ট সোনা খেলনা বাদে অন্যান্য জিনিসও ঘাঁটাঘাঁটি করছে। সেটা দেখে আপনার রেগে গেলে চলবে না। বরং ওকে জিনিসগুলো ঘাঁটতে দিন। শিশুর মস্তিষ্ক সব কিছুর মধ্যেই কিছু না কিছু আবিষ্কার করতে ভালোবাসে। কোনও জিনিসের উপর কৌতুহল ওকে ওর আশেপাশের পরিবেশকে চিনতে সাহায্য করে। (How to Encourage a Child’s Brain Development) একই সঙ্গে কোন জিনিসে বিপদ হতে পারে, কোন জিনিসটা ভালো, সে সম্পর্কে একটা ধারণা ওর মস্তিষ্কে স্থায়ী জায়গা পেয়ে যায়।

 

  • গান শোনান: অআকখ বা এবিসিডি দিয়ে আপনার বাচ্চাকে নিয়মিত গান শোনান। একই গান বারবার শোনার ফলে মনে রাখার অভ্যাস তৈরি হয়। পাশাপাশি একাধিক ভাষা শেখার প্রাথমিক ধাপটাও পূরণ হয়।
    জিনিস চেনান: যে সব জিনিসগুলো ঘরের চারপাশে ও প্রতিদিন দেখছে, সেগুলোর সঙ্গে এবার ওর পরিচয়ের পালা। দুই বছর বয়স পেরোলে আশেপাশের জিনিসের প্রতি এমনিই ওর আকর্ষণ জন্মায়। (Ways to Boost Your Baby’s Brain Power) সেই জিনিসগুলো দেখিয়েই তাদের নাম ওকে বারবার বলুন। এভাবেই জিনিসগুলোর নাম মনে রাখার অভ্যাস তৈরি হবে।

 

তিতলির সত্যি কোনও সমস্যা ছিল না কারণ একবছরের মধ্যেই ওর মুখে কথার ফোয়ারা! আর তা কোনও ওষুধ ছাড়াই। তবে চিকিৎসকের কাছে গিয়ে নম্রতা-রণজয় মস্তিষ্কের বিকাশ সম্পর্কে অনেক কিছু জেনেছে। যা পরে ওদের অনেক কাজে লেগেছে। আপনার জন্যও তাই সেই তথ্যগুলোই রইল এই প্রতিবেদনে (Encouraging Brain Development in Children)।

 

আরও পড়ুন: বাচ্চার বুদ্ধির বিকাশে পাঁচটি জরুরি খাবার

 

একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার  হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

 

null

null