বাড়তি খাবার পেটে গেলে ঢেকুরের সঙ্গেই তা বেরিয়ে আসে। এটা কিন্তু বমি নয়, রইল প্রতিকারের উপায়!

বাড়তি খাবার পেটে গেলে ঢেকুরের সঙ্গেই তা বেরিয়ে আসে। এটা কিন্তু বমি নয়, রইল প্রতিকারের উপায়!

পাপার বয়স সবে তিন মাস। এর মধ্যেই দুষ্টুমির সব রকম চিহ্ন দেখা যাচ্ছে ওর মধ্যে। ওকে কোনও ভাবেই বসিয়ে রাখা যায় না। স্নান করানোর পর গা-মোছানো যায় না। কোলে নিয়ে বারান্দায় বা ছাদে যে একটু পায়চারি করা হবে, তার যো নেই। এমনকী খাওয়ানোর পর যে একটু বসিয়ে রেখে খাবার হজম করনো হবে, তারও উপায় নেই। হয় এটা-ওটা টানছে, নয় গড়াগড়ি খাচ্ছে। ওকে নিয়ে পারমিতার হয়েছে বিরাট জ্বালা (Newborns Spitting Up)!

পারমিতার প্রথম সন্তান পাপা। পাপাকে খাওয়ানো থেকে শুরু করে স্নান করানোর পদ্ধতি—টুকিটুকি সব বিষয়ে জানতেই পারমিতা দ্বারস্থ হয় নিজের মায়ের। মায়ের কাছে পারমিতা শুনেছে, খাওয়ানোর পর বাচ্চাদের কাঁধের ওপর নিয়ে ঢেকুর তোলানোটা দরকারি (Nabojatoker Doi Bomi)। ওদের পিঠে তখন যদি হালকা-হালকা চাপড় দেওয়া যায়, তা হলে খুব ভালো হয়। কিন্তু সেই উপায় আছে! পাপাকে কোলে তোলা হল কী হল না, ও কখনও পারমিতার চুল টানছে, কখনও কান টানছে। এছাড়া আরও একটা সমস্যা হল বমি (Sisur Bomi)।

যাই খাওয়ানো হোক না কেন, খানিকটাকে করে বমি করে বের করে দেবেই সে। এটার কথাও পারমিতা জিজ্ঞাসা করেছিল মাকে। মায়ের কাছে ও শুনেছে, এটাকে বমি বলে না। আগেকার যুগে একে বাচ্চাদের ‘দই তোলা’ বা ‘দুধ তোলা’ বলা হত। এটা মোটেই ক্ষতিকারক কিছু নয়। অতিরিক্ত খাবার পেটে গেলে, তা বাচ্চাদের ঢেকুরের সঙ্গে বেরিয়ে আসে (Why Babies Spit Up)। কিন্তু তা বলে প্রতিবার খাওয়ানোর সময়ই?

শেষ পর্যন্ত মায়ের কথায় ভরসা করতে না-পেরে পারমিতা হাজির ডাক্তারবাবুর কাছেই। বিষয়টা ওঁকে জানাতেই, উনিও বললেন, এটা একেবারেই ক্ষতিকারক কিছু না। তবে প্রত্যেক বার খাওয়ার পরেই এটা হলে, বিষয়টা স্বাভাবিকও নয়। তবে যাকে পারমিতা ‘বমি’ বলে ভাবছিল , ডাক্তারবাবুর জানালেন, সেটা বমি নয়। ইংরেজিতে একে বলে ‘স্পিট আপ’ (Spitting Up in Babies)। প্রচলিত কথায় সেটাকেই দুধ তোলা বলেন অনেকে।

পাপার প্রতিবার খাওযার পর এই ‘স্পিট আপ’ হওয়ার পিছনে তার দুরন্তপনার ভূমিকা রয়েছে বলেও মত ওঁর। সেক্ষেত্রে খাওয়ার পর অন্তত ৩০ মিনিট ওকে চুপ করে শুইয়ে রাখতে হবে বলে মত ডাক্তারবাবুর। আরও নানা কারণে এই ঘটনা ঘটতে পারে। উনি জানালেন, সেগুলো সামলানোর উপায়ও (Bangla Baby Care Tips)।

পারমিতার মতোই অন্য যে বাবা-মায়েরা তাঁদের সন্তানের এই ‘স্পিট আপ’ নিয়ে চিন্তিত,

বিষয়টাকে বমি বলে যাঁরা ভাবেন, তাঁদের জন্য খুব স্পষ্ট ভাষাতেই ডাক্তারবাবু বুঝিয়ে দিলেন, এই দুটোর মধ্যে পার্থক্য কী কী? (Difference between vomiting and spitting up)

  • বমি হল পাকস্থলীর মধ্যে থাকা খাবারের একটা বড় অংশ মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে। সেখানে ‘স্পিট আপ’ বা দুধ তোলার ক্ষেত্রে খুব অল্প পরিমাণে দুধ বা খাবার মুখে উঠে আসে।
  • বমির ক্ষেত্রে (Sisur Jotno) পেটের পেশির বড় পরিমাণে সংকোচন হয়। যা পেটের খাবারকে ঠেলা দিয়ে বের করে আনে। ‘স্পিট আপ’-এর ক্ষেত্রে কোনও পেশির ভূমিকা নেই। ঢেকুরের সঙ্গে অতি অল্প পরিমাণে খাবার মুখে আসে।
  • বমির ক্ষেত্রে শিশুর প্রচণ্ড কষ্ট হয়। কিন্তু ‘স্পিট আপ’-এর ক্ষেত্রে তেমন কোনও কষ্টই হয় না।

 

ডাক্তারবাবুর কথায়, অনেক বাবা-মা বাচ্চাদের ঘনঘন ‘স্পিট আপ’ দেখে ভয় পেয়ে যান। তাঁরা ভাবেন, এর ফলে বুঝি তাঁদের ছোট্ট সোনাদের বৃদ্ধির হার কমে যাবে। কিন্তু আসলে বিষয়টা একদমই তা নয়। ‘স্পিট আপ’-এর ফলে যে খাবারটা নবজাতকের মুখে উঠে আসে, সেটা পুরোপুরি উদ্বৃত্ত। ফলে, বাচ্চার পেট ঠিক মতো ভরল না—এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। কিন্তু এই ‘স্পিট আপ’ বা
দুধ তোলার কারণগুলো কী কী সেটাও জেনে রাখা দরকার। তা হলে কী করে এই দুধ তোলা আটকানো যাবে, সেটাও পরিষ্কার হবে। (what causes spit up in babies)

 

  • পেটে বাতাস চলে যাওয়া: স্তন্যপান করানো, দুধ বা অন্য খাবার খাওয়ানোর সময় শিশুর পেটে বাতাস চলে যায়, যা এই দুধ তোলার অন্যতম কারণ।
    গ্যাসট্রোএসোফেগাল রিফ্লাক্স: বাতাস যাচ্ছে না, কিন্তু অতিরিক্ত খাবার পেটে গেলেও, সেটা রিফ্লাক্স-এর মাধ্যমে মুখে উঠে আসতে পারে। এটাও ‘স্পিট আপ’-এর বড় কারণ।

 

  • অতিসক্রিয়তা: পারমিতা তার খোকার ক্ষেত্রে যা দেখেছে, এই ক্ষেত্রে বিষয়টা সে রকম। খাওয়ার পর অনেক শিশুই শান্ত হয়ে থাকতে চায় না। তাদের দুষ্টুমির কারণেই পেটে চাপ পড়ে। ফলত কিছুটা খাবার সেই চাপের চোটে মুখে চলে আসে।

 

  • পাইলোরিক স্টেনোসি: খুব কম শিশুর মধ্যে এই সমস্যাটি দেখা যায়। এক্ষেত্রে দুধ তোলা শুরু হওয়ার একটু পরেই বা তার সঙ্গে সঙ্গেই হালকা বমিও হতে পারে। এক্ষেত্রে বমির প্রবণতাটা ‘স্পিট আপ’-এর কারণ। এটি মোটেই ভালো কথা নয়। এক্ষেত্রে অতি দ্রুত চিকিৎসকের পারমর্শ নিতে হবে।

 

 

আরও পড়ুনঃ সদ্যোজাত শিশুর অ্যালার্জি; কারণ ও প্রতিকার

 

 

এ তো গেল ‘স্পিট আপ’-এর কারণ। যদিও এই ‘স্পিট আপ’ শিশুদের জন্য বিপজ্জনক কিছু নয়, তারপরেও বাবা-মায়েরা শিশুদের এই প্রবণতার পরিমাণ কমাতে পারেন। কারণ শারীরিক সমস্যা না-হলেও, ‘স্পিট আপ’-এর পর শিশুকে পরিষ্কার করানোর মতো কিছু ঝক্কি থেকেই যায়। ফলে এই প্রবণতা কমানো গেলে লাভই হবে। এক ঝলক দেখে নেওয়া যাক,

 

‘স্পিট আপ’ আটকানোর পদ্ধতিগুলো কী কী (How to prevent spitting up after feeding)

 

#1. বেশি খাওয়ানো নয়: বেশি খাওয়ানো হলেই শিশুদের মধ্যে দুধ তোলার প্রবণতা বেড়ে যায়। তাদের পাকস্থলী ভর্তি হয়ে গেলে, তারা অতিরিক্ত খাবার ধরে রাখতে পারে না। তখন তা উপরে উঠে আসে। তাই তাদের অল্প অল্প করে অনেক বেশি বার খাওয়ান। তাতে এই প্রবণতা কমবে।

 

#2. সোজা করে রাখুন: খাওয়ানোর পর ওকে পেটের উপর শুতে দেবেন না। পারলে কোলে নিয়ে সোজা করে রাখুন। তাতে খাবার তাড়াতাড়ি হজম হবে। ‘স্পিট আপ’-এর (Spitting Up in Babies) প্রবণতা কমবে।

 

#3. শান্ত রাখুন: খাওয়াদাওয়ার পর ওকে খুব বেশি দুষ্টুমি করতে দেবেন না। অন্তত ৩০ মিনিট যাতে ও শান্ত থাকে, সেদিকে নজর দিন।

 

#4. সোজা করে শোওয়ান: নবজাতকরা খাওয়ার পরে-পরেই উপুর হয়ে শুলে, তাদের মধ্যে দুধ তোলার প্রবণতা বাড়ে। তা ছাড়া অন্য একটা ঝুঁকিও থাকে। উপুর হয়ে শোওয়া অবস্থা দুধ তুললে, তা নাক এবং মুখ বন্ধ করে শিশুর শ্বাস নেওয়ার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। তাই খাওয়ার পর ও শুতে চাইলে ওকে অবশ্যই সোজা করে শোওয়ান, তাতে দুধ তোলার প্রবণতা কমবে।

 

#5. বারবার ঢেকুর তোলান: ও যাতে বারবার ঢেকুর তোলে সেদিকে নজর দিন। এতে পেটের মধ্যে বাতাস চলে গেলে বা পেটে গ্যাস হলে, তা বেরিয়ে আসবে। শুধুমাত্র খাবার খাওয়ানোর শেষে ঢেকুর তোলাবেন না। খাবার খেতে খেতেও যাতে ও ঢেকুর তুলতে পারে, সেদিকে নজর রাখুন। এতে দুধ তোলার প্রবণতা কমবে। খাবার অনেক ভালো ভাবে হজমও হবে।

 

#6. নিজের ডায়েটে নজর: আপনার ছোট্ট সোনার খাবারে তো নজর দিচ্ছেন। কিন্তু জানেন কি, ওর পেটে অতিরিক্ত গ্যাস হওয়ার পিছনে আপনার খাবারেরও ভূমিকা থাকতে পারে? যে মায়েরা স্তন্যপান করাচ্ছেন, তাঁরা নিজেদের ডায়েট থেকে ডেয়ারি প্রোডাক্ট বা অন্য কিছু খাবার বাদ দিতে পারেন। এতে শিশুর পেটে গ্যাস উৎপাদনের মাত্রা কমবে। তবে কোন কোন খাবার বাদ দেবেন, তা চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলেই ঠিক করবেন।

 

এ তো গেল, ‘স্পিট আপ’-এর কারণ। শিশুদের এই প্রবণতা মোটেই ভয়ের কিছু নয়, বা বিপজ্জনক কিছু নয়—এই কথাটা বারবার বলা হয়েছে এই প্রতিবেদনে। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে এই ‘স্পিট আপ’ ভয়ের হতেও পারে। কারণ তার পিছনে থাকে বড় কোনও সমস্যার পূর্বাভাস।

 

 

তেমনই বড় কোনও সমস্যা আছে কি না, তা বোঝার লক্ষণগুলো জেনে নিন। (Can spitting up be a sign of a problem)

  • শিশুর ওজন বাড়ছে না।
  • সবুজ বা হলুদ তরল পদার্থ উঠে আসছে দুধের সঙ্গে।
  • দুধ তুললে, তার সঙ্গে রক্ত বেরোচ্ছে।
  • শিশু একেবারেই খেতে চাইছে না।
  • দুধ তোলার প্রবণতা একদম ছোটবেলায় ছিল না। ছয় মাস বয়সের পরে হঠাৎ এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
  • শিশুর শ্বাসের সমস্যা হচ্ছে।

 

উপরের সমস্যাগুলো থাকলে অবশ্যই চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলতে হবে। না-হলে শিশুর এই দুধ তোলা, দই তোলা বা ‘স্পিট আপ’ নিয়ে ভয় পাওয়ার কারণ নেই বাবা-মায়েদের। সাধারণত এক বছর বয়সের আশেপাশে এসে এই প্রবণতা ধীরে ধীরে কমে যায়। তার আগে ছোট্ট সোনার মুখে লেগে থাকা বাড়তি খাবারটুকু মুছিয়ে দেওয়াই যা আপনার অতিরিক্ত কাজ।

 

 

আরও পড়ুনঃ কীভাবে পরিষ্কার করবেন গুবলে ছানার লাল জিভ?

 

একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার  হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

 

null

null