সোনা কি আমাশয় বা ডিসেন্ট্রি-তে ভুগছে? ঘরোয়া পথেই রয়েছে সহজ সমাধান!

সোনা কি আমাশয় বা ডিসেন্ট্রি-তে ভুগছে? ঘরোয়া পথেই রয়েছে সহজ সমাধান!

পেটের গোলমাল তো কমবেশি সব শিশুরই হয়ে থাকে। এক-দু’দিন সেই সমস্যা চললেও কেউ বিশেষ মাথা ঘামান না, তা নিয়ে। ঠিক এমনটাই ভেবেছিল অহনা। অপারও বুঝি ওই সাধারণ পেট-খারাপের মতো কিছু হয়েছে! (Dysentery in Infancy; Causes & Home Remedies)

কিন্তু তৃতীয় দিনেও যখন পেটের গণ্ডগোল কমল না, বরং উল্টে তার সঙ্গে অল্প-অল্প রক্ত বেরোতে শুরু করল, তখন অহনার ধারণা হল, নিশ্চয়ই বড় কিছু হয়েছে। অপাকে ওদিন বিকেলে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতেই তিনি বললেন, অপার ডিসেন্ট্রি (Dysentery) বা আমাশয় হয়েছে (Dysentery: Treatment, Symptoms, and Causes)। এবং বিষয়টা রক্ত-আমাশয়ের দিকে যাচ্ছে।

অপার বয়স এখন চার বছরের একটু বেশি। এমন সমস্যা এর আগে হয়নি। তবে চিকিৎসক অভয় দিলেন, এখনও বিরাট দুশ্চিন্তার কিছু নেই। কয়েকটা ওষুধ নিয়ম করে খাওয়ালে এবং সেগুলোর কোর্স শেষ করলেই অপা এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাবে। তার পাশাপাশি তিনি বলে দিলেন, এই সমস্যার কয়েকটা ঘরোয়া সমাধানের কথাও (Home Remedies for Dysentery)।

তবে এ সবের আগে জেনে নেওয়া দরকার,

আমাশয়টা আসলে কী? (What is Dysentery?)

  • আমাশয় হল অন্ত্রের ইনফেকশন বা সংক্রমণ।
  • মূলত জীবাণুঘটিত রোগ।
  • আমাশয়ের কারণে প্রাথমিক ভাবে খুব কষ্ট হলেও এতে প্রাণহানীর কোনও আশঙ্কা থাকে না (Dysentery, Persistent Diarrhoea, and Diarrhoea)। কিন্তু আমাশয় দীর্ঘদিন নিরাময় না-হলে প্রাণহানীর আশঙ্কাও দেখা দেয়।

 

আমাশয়ের লক্ষণ (Symptoms of Dysentery):

  • পেটের ব্যাপক গণ্ডগোল। মারাত্মক ডায়ারিয়া (Diarrhea)।
  • পেটে, বিশেষ করে নাভির চারপাশের এলাকায় প্রচণ্ড ব্যথা।
  • অনেকের ক্ষেত্রে সংক্রমণ বাড়াবাড়ি হলে জ্বরও এসে যেতে পারে।
  • অনেক আমাশয় পেটের ভিতর এমন সংক্রমণের সৃষ্টি করে যে, সেখান থেকে রক্তপাতও হয়। ফলে মলের সঙ্গে রক্ত বেরোতে থাকে (Childhood Diarrhoea and Its Management)।
  • আমাশয়ের অন্যতম লক্ষণ, বারবার পেটে ব্যথা হলেও, বাথরুম যেতে হলেও— কখনও পেট পুরোপুরি পরিষ্কার হয় না।

 

তবে আমাশয়ের প্রকারভেদও আছে। মূলত দু’রকমের আমাশয় হয়। (Types of Dysentery):

  • তীব্র আমাশয় (Acute Dysentery): ১০ থেকে ১৪ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয় এই অসুখ। পেটব্যথা থেকে শুরু করে জ্বর পর্যন্ত হতে পারে। বাড়াবাড়ি হলে মলে রক্ত এবং মিউকাস দেখা যায়। চিকিৎসা না-করানো হলে পুঁজও বেরোতে পারে।

 

  • দীর্ঘস্থায়ী আমাশয় (Chronic Dysentery): আমাশয় দীর্ঘদিন চিকিৎসা না-করিয়ে ফেলে রাখলে এই সমস্যা হয়। শিশুদের তো বটেই বড়দেরও এই সমস্যা হতে পারে। সেক্ষেত্রে আমাশয় বহু মাসেও সারে না। আক্রান্তের শারীরিক অবস্থার দীর্ঘস্থায়ী অবণতি হয়।

অহনার কাছে পরিষ্কার, এই আমাশয় ব্যাপারটা কী? কিন্তু এখনও পরিষ্কার নয়, অপার এই অসুখটা হল কী করে? (Dysentery Causes) কারণ চার বছর পেরিয়ে গেলেও অপার খাওয়াদাওয়ার বিষয়ে অহনা প্রচণ্ড খুঁতখুঁতে। এখনও ওকে খুব ভালো করে পরিশুদ্ধ না-করে কোনও খাবার খাওয়ানো হয় না। তা হলে?

একটু খোঁজখবর করতেই বেরিয়ে এল তথ্য। হালে অপাকে সাঁতারে ভর্তি করা হয়েছে। ডাক্তারবাবু জানালেন, অনেক সময়ই পুলের জলে এমন জীবাণু থাকে। সেখান থেকেই ছড়াতে পারে এই অসুখ।

 

এর বাইরেও আমাশয় ছড়ানোর পিছনে রয়েছে বেশ কয়েকটা কারণ (Cause of Dysentery):

  • সংক্রামিত খাবার।
  • সংক্রামিত জল বা অন্যান্য পানীয়।
  • নোংরায় হাত দিয়ে, সেই হাত ভালো করে না-ধোওয়া।
  • যে কথা আগেই বলা হয়েছে, সাঁতার কাটার সময় পুলের বা পুকুরের সংক্রামিত জল পেটে যাওয়া।
  • সংক্রামিত ব্যক্তির স্পর্শ।
  • চিকিৎসকের কথায়, আমাশয় সংক্রমণের পিছনে জলের ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি। তাই ওই বিষয়টায় নজর দিতে হবে সর্বাধিক। শুধুমাত্র শিশুদের নয়, বড়দের ক্ষেত্রেও এই নিয়ম মেনে চলতে হবে। তা হলেই এড়ানো যাবে আমাশয়ের সমস্যা। (How to prevent Dysentery)
  • এর বাইরেও অহনা চিকিৎসকের থেকে জেনে নিল, কোন কোন ঘরোয়া পদ্ধতিতে আমাশয়ের (Home Remedies for Diarrhea in Babies) প্রাথমিক চিকিৎসাটুকু করা যায়। বাড়াবাড়ি হলে তো ডাক্তাররা রয়েছেনই। কিন্তু ঘরোয়া পদ্ধতিতে যদি এই রোগের নিরাময় করা যায়, তা হলে তো কথা নেই।

 

আরও পড়ুন: বাচ্চার পটির রং থেকেই বোঝা যায় সে সুস্থ আছে না নেই, মিলিয়ে নিন প্রতিবেদনের সাথে!

 

ঘরোয়া টোটকায় আমাশয়ের প্রতিকার (Home Remedies of Dysentery):

 

#1. বেলের সরবত (Bael Fruit drink): এক বা দু’চামচ বেলের শাঁস নিয়ে, তা দিয়ে শরবত বানিয়ে ফেলুন। সকালে এই শরবত খাওয়ান আপনার খোকা বা খুকুকে। দিনে দু’বারও খাওয়াতে পারেন। আয়ুর্বেদেও আমাশয়ের নিরাময়ে অন্যতম রাস্তা হিসেবে বেলের শরবতের কথা বলা হয়েছে। তবে মারাত্মক বেশি পরিমাণে খাওয়াবেন না (Home Remedies for Loose Motion in Kids)। কোনও সংশয় থাকলে, চিকিৎসকের থেকে জেনে নিন।

#2. ঘোলের শরবত (Buttermilk): ঘোলের শরবতও আপনার সোনার আমাশয় সারাতে খুব কার্যকরী। এক গ্লাস ঘোলের মধ্যে এক চিমটে বিটনুন, সামান্য গোলমরিচ গুঁড়ো, সামান্য জিরে গুঁড়ো মিশিয়ে নিয়ে এই শরবত বানান (Acute Bacterial Dysentery in Children)। দিনে দু’বার অন্য খাবার খাওয়ার পর এই শরবত খাওয়াতে পারেন।

#3. আদা দিয়ে ঘোলের শরবত (Ginger Buttermilk drink): আদা শুকনো করে তার পাউডার বানিয়ে নিন। তার সঙ্গে সম পরিমাণ জিরে গুঁড়ো, জায়ফল গুঁড়ো এবং গোলমরিচ গুঁড়ো মেশান। এই মিশ্রণের এক চামচ ঘোলের সঙ্গে মিশিয়ে নিন। এতে এক চিমটে বিটনুনও দিতে পারেন। সকালে এই শরবত খাওয়ান আপনার সোনাকে (Home Remedies for Dysentery in Children)। জলখাবারের পরেই খাওয়াবেন। বিকেলে খাওয়াতে হলে ঘোল বাদ দিয়ে এক চামচ মিশ্রণ মিশিয়ে নেবেন হালকা গরম জলের সঙ্গে।

#4. ক্যামোমাইল চা (Camomile tea): ক্যামোমাইল চায়ের মধ্যে থাকা উপাদান অন্ত্রে ব্যাকটেরিয়া-জাত সমস্যার সহজ সমাধান। যে ভাবে চা বানানো হয়, সে ভাবেই এক কাপ গরম জলের জন্য এক চা-চামচ ক্যামোমাইল পাতার গুঁড়ো ব্যবহার করুন। যদি পাতা না-পান তা হলে এক কাপ গরম জলে ক্যামোমাইল চায়ের একটা টি-ব্যাগও দিতে পারেন। দিনের মাথায় এমন দু’-তিন কাপ চা খাওয়াতে পারেন আপনার খোকা-খুকুকে। ওর আমাশয়ের সমস্যা কমতে পারে (Treating Diarrhea in Children)।

#5. গাজরের রস (Carrot juice): গাজরের মধ্যে থাকা ফাইবার এবং অন্যান্য উপাদানও একই ভাবে পেটের বিভিন্ন সংক্রমণের বিরুদ্ধে শরীরকে লড়তে সাহায্য করে। দুই থেকে তিনটে গাজরের রস বানিয়ে আপনার সোনামণিকে খাওয়াতে পারেন। তবে একেক শিশুর গাজর হজম করার ক্ষমতা একেক রকম। তাই ওকে কতটা গাজরের রস খাওয়াবেন, তা আগে থেকে চিকিৎসকের কাছে জেনে নিন (Dysentery Treatment – Natural Ayurvedic Home Remedies)। ও যদি একান্তই গাজরের রস খেতে না-চায়, তা হলে গাজর সিদ্ধ করে স্যুপও খাওয়াতে পারেন।

#6. লেবুর রস (Lemon juice): লেবুর রসও ব্যাকটেরিয়ার সঙ্গে লড়াই করার ক্ষেত্রে খুবই কার্যকরী। দুটো লেবুকে চাকা-চাকা করে কেটে নিন। তারপর একগ্লাস জলে সেই লেবুর চাকাগুলো ডুবিয়ে ফোটাতে থাকুন। ঠান্ডা করে এই মিশ্রণ আপনার সোনাকে খাওয়ান। পারলে সারা দিন ধরে একটু-একটু করে খাওয়াতে থাকুন (Stomach Pain and Loose Motion Home Remedies)। তাতে বিষয়টা আরও কাজে দেবে। তবে এই পদ্ধতি প্রয়োগের আগেও একবার চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে নেওয়া দরকার।

#7. পাকা পেঁপের রস (Raw papaya): কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে আমাশয়— পেটের হরেক সমস্যার সমাধান রয়েছে পেঁপের কাছে। একটা গোটা পাকা পেঁপে টুকরো-টুকরো করে কেটে নিন। এবার তিন-চার কাপ জলে সেটা ফোটান। ১০-১৫ মিনিট ফোটানোর পর হাল্কা গরম থাকতে থাকতেই আপনার সোনামণিকে ওই জুস খাইয়ে দিন (Dysentery Ayurvedic Treatment)। তবে কোনও ভাবেই অতিরিক্তি পরিমাণে খাওয়াবেন না। সেক্ষেত্রে পেটের সমস্যা বেড়ে যেতে পারে।

#8. কমলা লেবুর রস (Orange juice): কমলা লেবুর রসের মধ্যেও এমন উপাদান রয়েছে, যা শিশুদের পেটের জন্য খুব ভালো। সারা দিন ধরে ওকে তিন থেকে চার গ্লাস পর্যন্ত কমলা লেবুর রস খাওয়াতে পারেন। এই লেবুর রস ওর শরীর হাইড্রেটেড রাখতেও সাহায্য করবে।

 

ঘরোয়া পদ্ধতিতে আমাশয়ের নিরাময়ের অনেকগুলো রাস্তাই রয়েছে। (Home Remedies for Dysentery for Babies) কিন্তু মনে রাখবেন, এর অনেকগুলোই কোনও কোনও শিশুর জন্য সমস্যারও হয়ে যেতে পারে। তাই আগে চিকিৎসকের বা শিশুস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া দরকার। আর যদি সমস্যা বাড়াবাড়ির আকার নেয়, তখন ঘরোয়া পদ্ধতি ছেড়ে চিকিৎসকের পরামর্শ মতো ওষুধের দ্বারস্থ হতেই হবে। (Dysentery in Infancy; Causes & Home Remedies)

 

আরও পড়ুন: ডায়রিয়া ও লেজুড় দোস্ত ডিহাইড্রেশন; কারণ ও প্রতিরোধের উপায়

 

একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার  হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

 

null

null