দিন মেনেই টিকা দিন বাচ্চাকে। শিশুর সুস্থতায় সতর্ক হোন আজ থেকেই!

দিন মেনেই টিকা দিন বাচ্চাকে। শিশুর সুস্থতায় সতর্ক হোন আজ থেকেই!

বিজয়া আর শমীকের লাগেজ গোছানো প্রায় শেষ। ছোট্ট রুকুর ব্যাগ গোছানো শুধু বাকি । দু’দিন পরেই তিনজনের এই পরিবার পাড়ি দেবে রাজস্থান। পুজোর ছুটিতে নিখাদ ছুটি কাটানো। রুকুর ব্যাগে ওর ওষুধ আর প্রেসক্রিপশন নিয়ে নেওয়া দরকার। প্রেসক্রিপশনগুলো গুছিয়ে নেওয়ার সময় বিজয়ার চোখে পড়ল, পরের সপ্তাহেই রুকুর একটা ভ্যাকসিন নেওয়ার কথা! (Delaying Vaccines Increases Risks)

চিকিৎসককে ফোন করতেই, তিনি বললেন, রুকুর এই ভ্যাকসিনটা খুব জরুরি। ওই তারিখটা মিস করা ঠিক হবে না। শমীক বাড়ি ফিরে ঘটনাটা শুনে হেসে উড়িয়ে দিল। ওর মতে, অত ভয় পাওয়ারও ব্যাপার নেই। শমীক কিছু হবে না বললেও, বিজয়ার মনটা খচখচ করছিল।

শমীক আর বিজয়ার মতোই আরও অনেক বাবা-মা ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা সম্পর্কে সন্দিহান। ছোট্ট সোনাকে ভ্যাকসিন দেওয়ানো একটা চ্যালেঞ্জ‌। অনেক শিশুর বাবা-মা ভ্যাকসিনের ব্যাপারে ভয়ও পান (Why Parents Delay Vaccine)। যদি খোকা বা খুকুর আঘাত লাগে বা ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়! চিকিৎসকরা বাবা-মায়ের এমন ভীতির পিছনে থাকা বেশ কিছু কারণের কথা বলেন।

 

টিকা বা ভ্যাকসিন নিয়ে বাবা-মায়ের ভীতির কিছু কারণ (Why Parents Delay Vaccine)

 

  • পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ভয়: ভ্যাকসিন বা টিকা দেওয়ার পর কখনও কখনও শিশুর অ্যালার্জির সমস্যা, হালকা জ্বর ইত্যাদি হয়। চিকিৎসকের কথায়, খুব কম সময়ের জন্য এগুলো স্থায়ী হয়। তা হলেও বাবা-মায়েরা এই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াতেই বেশি ভয় পান। টিকা দিতে গিয়ে বাচ্চা এমন সমস্যায় পড়তে পারে, এই ভেবে অনেকে টিকাকরণ এড়িয়ে চলেন।

 

  • কার্যকারিতা সম্পর্কে সন্দিহান: ওষুধের মতো করে টিকা রোগের ভাইরাসকে মেরে দেয় না‌। বরং এটি শরীরে রোগের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় অ্যান্টিবডি তৈরি করে। রোগের ওষুধ হিসেবে এর ব্যবহার নেই বলে অনেক বাবা-মায়ের মনে এর কার্যকারিতা সম্পর্কে সন্দেহ রয়েছে। (Parental Delay or Refusal of Vaccine Doses) অনেকের আবার মনে করেন টিকার থেকে ওষুধ বেশি কার্যকরী।

 

  • টিকা সম্পর্কে অজ্ঞতা: পোলিও ছাড়াও দু’-একটা টিকার কথা জানলেও, শিশুর প্রয়োজনীয় সব ক’টি টিকার কথা অনেক বাবা-মায়ের অজানা। যথাযথ সচেতনতার অভাবই এর মূল কারণ বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
    Vaccination Chart

বিজয়ার ছোটবেলার বন্ধু রমিতারও মুম্বাইয়ে ট্যুরপ্ল্যান ছিল। তবে চিকিৎসকের কথায় সে ট্যুর বাতিল করে দেয়। ওর ছেলে বান্টির ছ’দিন পরেই ভ্যাকসিন নেওয়ার কথা। বান্টির চিকিৎসকই রমিতাকে বুঝিয়ে দেন, ভ্যাকসিন সঠিক সময়ে নেওয়া কেন গুরুত্বপূর্ণ (Children’s Vaccinations: The Dangers of Delaying Them)।

 

সঠিক সময় টিকা দেওয়ানো কেন জরুরি? (Importance of Vaccination)

  • রোগ থেকে মুক্তি: বেশ কিছু রোগের জীবাণুর পক্ষে শিশুদের আক্রমণ করাটা সুবিধাজনক। কারণ শিশুদের প্রতিরোধ ক্ষমতা একেবারে কম। ভ্যাকসিন বা টিকা দেওয়ার প্রধান লক্ষ্য হল এই রোগগুলোকে শিশুর জীবন থেকে দূরে রাখা (Free from Disease)। টিকাকরণের মাধ্যমে শিশুর শরীর ভাইরাসগুলোর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষমতা অর্জন করে।

 

  • রোগপ্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধি: খুকু বা খোকার ছোট্ট শরীর বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে মানিয়ে নিতে সময় নেয়। তাই ওর রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলা দরকার। চিকিৎসকদের কথায়, টিকা বা ভ্যাকসিন এই কাজই করে (Building Immunity Power)। জন্মের পর শিশুর শরীরে প্রথম কয়েক বছর অনেক অ্যান্টিবডিই তৈরি হয় না। এতে বেশ কিছু রোগের ভাইরাস সহজেই আক্রমণের সুযোগ পায়। টিকা শিশুর শরীরে প্রয়োজনীয় অ্যান্টিবডি তৈরি করতে সাহায্য করে (Important Reasons to Vaccinate Your Child)।

 

  • রুটিনে ব্যাঘাত: ছোট্ট খুকু রোজ স্কুল যায় মায়ের হাত ধরে‌। স্কুলেই একদিন সে অসুস্থ হয়ে পড়ল। জানা গেল, ঠিক সময়ে ওই রোগের ভ্যাকসিন নেওয়া হয়নি বলেই এই অবস্থা। পড়াশোনা বন্ধ করে দু’মাস শয্যাশায়ী অবস্থায় কাটলো। একটা টিকা বাদ পড়লে এ ভাবেই নষ্ট হয় বহুমূল্য সময়।

 

  • পরিবার ও সমাজের সুরক্ষা: বেশ কিছু রোগের ভাইরাস সহজেই একজনের থেকে আশেপাশের পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে। এতে একাধিক মানুষের শরীরে রোগটি সংক্রামিত হয়। অথচ এমন কিছু রোগ টিকাকরণের মাধ্যমে সহজেই এড়িয়ে চলা যায়। তাই শিশুর টিকাকরণ সমাজের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।

 

  • টিকা নিরাপদ ও কার্যকরী: টিকাকরণের ফলে ব্যক্তিবিশেষে কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়। অনেক শিশু আবার সিরিঞ্জ দেখলেই কেঁদে ওঠে। কিন্তু এই ভয় বা ব্যথা খুব কম সময়ের জন্য স্থায়ী হয়। বরং টিকা থেকে পাওয়া প্রতিরোধ ক্ষমতা সারাজীবন শিশুর শরীরকে রক্ষা করে (Vaccination are Safe and Effective)।

 

বিশেষজ্ঞদের মতে, ভ্যাকসিন বা টিকার কোনও কোর্স বাদ দেওয়া বা দিতে দেরি করা মোটেই শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়। এতে শিশুকে নানা রকম বিপদের সম্মুখীন হতে হয়। রমিতাকে সেই বিপদগুলোর কথাই বলছিলেন বান্টির চিকিৎসক।

 

আরও পড়ুন: টিকার ব্যথা আর নয়। ছোট্ট সোনার ভ্যাকসিনের ব্যথা কমানোর সহজ, ঘরোয়া রাস্তা!

 

টিকার দিন পেরিয়ে গেলে কী কী ঝুঁকির আশঙ্কা থাকে (Risk of Delaying Vaccination)

 

#1. রোগাক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা: বিশেষজ্ঞরা বলেন, কোনও টিকা বাদ পড়লে শিশুর শরীর সেই নির্দিষ্ট রোগটি প্রতিরোধের জন্য নিজেকে তৈরি করতে পারে না (Risk Of Getting Ill)। ফলে যে কোনও সময় ওই রোগের ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে ছোট্ট দেহ। অনেকক্ষেত্রে এমন অসুখে শিশুর স্থায়ী ক্ষতিও হতে পারে।

#2. রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার অভাব: শিশুর শরীর সব ধরনের রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলতে সক্ষম নয়। সে কারণেই টিকাকরণের প্রয়োজন। টিকা ঠিক সময়ে না-দিলে শিশুর শরীরে প্রয়োজনীয় অ্যান্টিবডি তৈরি হয় না (Risks of Delaying or Skipping Vaccines)। এতে ওর রোগাক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে।

#3. সংক্রমণের আশঙ্কা: মিসেলস্ বা হাম এমন একটি রোগ যা টিকার মাধ্যমে সহজেই সারিয়ে ফেলা সম্ভব। এই রোগটি সংক্রমণের মাধ্যমে ছড়ায়। ছোট্ট বাচ্চা বাইরের পরিবেশে বেরোনো শুরু করেছে। সঠিক সময়ে তাকে টিকা না-দেওয়া হলে সংক্রমণের মাধ্যমে সেও আক্রান্ত হতে পারে (Risk of Contamination)।

#4. বেড়ানোর ক্ষেত্রেও বাধা: টিকা এড়িয়ে চললে কোথাও ঘুরতে যাওয়ার ক্ষেত্রেও বিধিনিষেধ তৈরি হবে‌। বিশেষজ্ঞদের কথায়, যেসব অঞ্চলে নির্দিষ্ট রোগটি অনেকটা জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে , সেসব এলাকায় ঘুরতে না-যাওয়াই ভালো। ওসব জায়গায় ঘুরতে গেলে ছোট্ট সোনা সহজেই ওই রোগে আক্রান্ত হতে পারে।

টিকা সব সময় চিকিৎসক-নির্দেশিত সময়েই দেওয়া উচিত। (Risk Factors for Delayed Immunization) দেশ অনুযায়ী এর একটি তালিকাও আছে। তবে কিছুক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম হয়। শিশুর কোনও সমস্যা দেখা দিলে চিকিৎসকরা টিকার দিনক্ষণে পরিবর্তন আনেন।

 

কোন ক্ষেত্রে টিকা দেওয়ায় দেরি করা যেতে পারে (When Delaying Vaccination is Suggested)

  • প্রচন্ড জ্বর: প্রচন্ড জ্বর থাকাকালীন চিকিৎসকরা ভ্যাকসিন দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা দেরি করেন। টিকা দেওয়ার পর অনেকেরই হালকা জ্বর হয়। এই জ্বর শিশুকে আরও দুর্বল করে দিতে পারে বলেই এমন সিদ্ধান্ত।

 

  • এলার্জি: অ্যালার্জির সমস্যা চলাকালীন শিশুর পক্ষে টিকা নেওয়া অসুবিধার। বেশ কিছু টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে অ্যালার্জি দেখা দেয়। এই অ্যালার্জি ও আগের অ্যালার্জি দুইয়ে মিলে বাচ্চার শরীরে স্ট্রেস হয়। এই সময় চিকিৎসক টিকা দেরি করে নেওয়ার পরামর্শ দেন (Reasons to Delay Vaccines for Kids)।

 

  • হাই ডোজ স্টেরয়েড: শিশুকে যদি কোনও কারণে হাই ডোজের স্টেরয়েড নিতে হয়, তবে কিছু ভ্যাকসিন তার শরীরের পক্ষে ভালো নয়। রোটাভাইরাস, মিসেলস, মাম্পস, রুবেলা ইত্যাদি রোগের টিকা সে সময় এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা।

 

শমীক বলা সত্ত্বেও বিজয়া নিজেই ঘোরার টিকিট বাতিল করল। আগে টিকা, তারপর সব। সেই যাত্রায় রুকুসোনার টিকা দেওয়া হল। কিন্তু তারপরই ওর গায়ে জ্বর। চিকিৎসক অবশ্য বলেই দিয়েছিলেন, এমন কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক ব্যাপার। টিকা দিলে কী কী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে দেখে নেওয়া যাক।

 

টিকা দেওয়ার পর কী কী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে (Side Effects of Vaccination)

  • হালকা জ্বর: টিকা নেওয়ার পর অনেক শিশুরই হালকা জ্বর হয়। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ফরেন এলিমেন্ট (Foreign Element) শরীরে প্রবেশ করার ফলে শরীরের মানিয়ে নিতে প্রাথমিকভাবে সমস্যা হয়। এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে হালকা জ্বর আসে। তবে তা দু’-তিন দিনের মধ্যেই কমে যায়।

 

  • ব্যথা ও ফুলে যাওয়া: টিকা দেওয়ার পরেই ইনজেকশন ফোটানো অংশে ব্যথা হতে পারে। ব্যথার পাশাপাশি ওই অংশ ফুলেও যেতে পারে। অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়াও দেখা দিতে পারে। তবে এই ব্যথা আর ফোলাভাব দু’-তিন দিনের বেশি স্থায়ী হয় না। অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়াও কয়েকদিনের মধ্যেই সেরে যায়।

 

  • পেশিতে ব্যথা: টিকার সিরিঞ্জ ফোটানো অংশে ব্যথা বা ফোলা না-হলেও তার আশেপাশের পেশিতে অনেক সময় ব্যথা হতে থাকে (Vaccine Side Effects)। এটাও ক্ষণস্থায়ী।

 

ট্যুর বাতিল হওয়ায় শমীক ক্ষুণ্ণ হয়েছিল। তবে পরে ইন্টারনেট ঘেঁটে ও বিষয়টা বুঝতে পারে। টিকা না নিয়ে ওখানে নিয়ে যাওয়া মোটেই উচিত হত না। বরং রুকু নিরাপদ হওয়াই শমীকের এখন স্বস্তির নিঃশ্বাস। (Delaying Vaccines Increases Risks)

 

আরও পড়ুন: জটিল ও মারণ নানা রোগের হাত থেকে রক্ষা পেতে সময় মেনে টিকা দিন আপনার শিশুকে!

 

একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার  হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

null

null