ডায়রিয়া ও তার লেজুড় দোস্ত ডিহাইড্রেশন; কারণ ও ঘরোয়া ভাবে প্রতিকারের উপায়!

ডায়রিয়া ও তার লেজুড় দোস্ত ডিহাইড্রেশন; কারণ ও ঘরোয়া ভাবে প্রতিকারের উপায়!

আমাদের সব্বার অতি পরিচিত এক আতঙ্কের নাম হল ডায়রিয়া। নিজেদের কথাই ভাবুন, ঘন ঘন বাথরুমে যাচ্ছেন আর আসছেন, জ্বর, বমি, গলা শুকনো, সব মিলিয়ে যেন বিতিকিচ্ছিরি এক অবস্থা। আর উপরি ফাউ হিসেবে আসতেই পারে ডিহাইড্রেশন। তখন আর কী, ডাক্তার বাবু গটমট করে এসে কটমট করে তাকিয়ে দেবেন হাতে স্যালাইনের সূঁচ ফুটিয়ে। ভেবেই ভয়ে ঘেমে গেলেন তো? এবার আসি, বাড়ির ওই ছোট্ট সদস্যটার কথায়। এই গরমে, ডায়রিয়ার রক্তচক্ষু কিন্তু যে কোনও দিন ওর ওপর পড়তে পারে। শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম হওয়ার কারণে, এমনিতেই যে কোনও রোগ-অসুখ বড্ড জলদি কব্জা করে ফেলে ওদের, তাই ডায়রিয়াও প্রায়ই হামলা করতে পারে বাচ্চাদের ওপর। কচি শরীরের কষ্টের কথা বলে আর না হয় কষ্ট দিলাম না। তার থেকেও বড় কথা, যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে ডায়রিয়া ও ডিহাইড্রেশন ডেকে আনতে পারে বাচ্চাটির মৃত্যু। (Dehydration and diarrhea in children In Bangla: Prevention and treatment)

গোদা বাংলায় ডায়রিয়া হচ্ছে ঘন ঘন মলত্যাগ। ডায়রিয়া সাধারণত ৩-৭ দিন থাকে। মলে জলের পরিমাণ স্বাভাবিকের থেকে অনেকটাই বেশি থাকে বা বলতে পারেন জলের মতো মল বার হয়। ২৪ ঘণ্টায় যদি ৩-৪ বারের বেশি এরকম জলের মতো মল হয়, তা হলে ডায়রিয়া হয়েছে বলা হয়। আর মল এবং আরও আনুসঙ্গিক উপসর্গের মাধ্যমে শরীর থেকে ক্রমাগত জল বেরিয়ে গিয়ে দেখা দেয় ডিহাইড্রেশন। এই ডায়রিয়া আর ডিহাইড্রেশন কেন হয়, ছড়ায় কীভাবে বা এদের হাত থেকে বাচ্চাটিকে বাঁচানোর উপায়ই বা কী? দেখে নিন এক নজরে।

ডায়রিয়ার কারণ (Reasons behind diarrhea)

প্রথমেই বলে রাখি, একদম ছোট্ট শিশু যারা শুধু মায়ের দুধ খায়; তারা মাঝে মাঝে দিনে প্রায় ৮-১০ বার পর্যন্ত মলত্যাগ করতে পারে। এই ধরনের মল কিছুটা পেস্টের মতো হয়। শিশু যদি চনমনে থাকে বা স্বাভাবিক থাকে, তা হলে কিন্তু এই ৮-১০ বার মলত্যাগ করাকে ডায়রিয়া বলে ভুল করবেন না।
এবার আসি ডায়রিয়ার কারণ কী, তা জানতে। শিশুদের ডায়রিয়া হওয়ার পিছনে প্রধান আসামী বলা যায় রোটা ভাইরাসকে। এছাড়াও, নোরো ভাইরাস বা অ্যাডেনো ভাইরাসের প্রভাবেও ডায়রিয়া হয়ে থাকে। আবার ব্যাকটেরিয়া জনিত ইনফেকশন থেকেও ডায়রিয়া হতে পারে। সাধারণত, সংক্রমিত খাবার বা পানীয় থেকে এই ব্যাকটেরিয়া জনিত ডায়রিয়া হয়ে থাকে। এছাড়া,এর জন্য ই- কোলাই, সিগেলা, সালমনেল্লা ইত্যাদি ব্যাকটেরিয়া ছাড়াও জিয়ারডিয়া ল্যাম্বলিয়া, এন্টামিবা হিসটোলাইটিকা ইত্যাদির মতো পরজীবীরা দায়ী। এইসব রোগজীবাণুরা মানুষের খাদ্যনালীতে হামলা করে ডায়রিয়ার মতো রোগ সৃষ্টি করে।

Also read: বাচ্চার কোষ্ঠকাঠিন্য; কারণ, লক্ষণ ও প্রতিকার

কীভাবে ছড়ায় এই ডায়রিয়া (How does diarrhea spread)

  • খাওয়ার আগে হাত ঠিক করে না ধুলে বা মলত্যাগের পর হাত ভালো ভাবে না ধুলে।
  • বাইরে সংক্রমিত মলে বসে থাকা মাছি খাবারে এসে বসলে সেই খাবার থেকে।
  • সংক্রমিত খাবার এবং পানীয় জল থেকে।
  • খাবার খাওয়ার বাসন অপরিষ্কার হলে।
  • বাতাসেও অনেক সময়ে ডায়রিয়ার ভাইরাস ছড়ায়। গরমকালে এর প্রকোপ বেশি বাড়ে।
  • এছাড়া, যেসব বাচ্চারা ঠিক করে টয়লেট ব্যবহার করতে শেখেনি, তাদের ডায়রিয়া হলে বাড়ির অন্য শিশুরও ডায়রিয়া হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। টয়লেট ঠিক মতো পরিষ্কার না হলে ডায়রিয়ার জীবাণু ছড়ায়।

ডায়রিয়ার উপসর্গ (Symptoms of diarrhea)

  • ঘন ঘন পাতলা জলের মতো মলত্যাগ।
  • বমি।
  • জ্বর।
  • শিশু ঝিমিয়ে পড়ে।
  • শরীরে জলের অভাবে দেখা দেয় ডিহাইড্রেশন।

বাচ্চার ডায়রিয়া হলে কী করবেন (What to do if your baby has diarrhea)

  • যদি বাচ্চা ব্রেস্ট মিল্ক খায়, তা হলে তাকে বারবার ব্রেস্ট মিল্ক দেওয়ার চেষ্টা করুন। বাচ্চা যদি ফর্মুলা খেয়ে অভ্যস্ত, তা হলে তাকে ফর্মুলা খাওয়ান। ৬ মাস বেশি বয়সি বাচ্চা যা খেয়ে অভ্যস্ত তাকে তাই খাওয়াতে চেষ্টা করুন। শিশুর খাবার যে তেলমশলা ছাড়া হয়, এতো বলাই বাহুল্য। তাই ও যে রকম খাবার খায় সেই খাবারই দিন, না হলে শিশু দুর্বল হয়ে পড়বে। শিশু যদি একটু বড় হয়েছে, তা হলে তার জন্য রান্না করুন সয়াবিন তেল দিয়ে। এসময় বাসি খাবার খাওয়াবেন না এবং ফ্রিজে রাখা খাবারও দেবেন না।
  • প্রচুর পরিমাণে জল খাওয়ান বাচ্চাকে। জল বা অন্য যে কোনও তরল এই সময় খাওয়াতেই হবে।
  • কাঁচকলা সেদ্ধ করে নরম ভাতে সেটা চটকে মেখে দিন। সঙ্গে দিতে পারেন ডালের জল। কাঁচকলা সেদ্ধ ডায়রিয়া কমাতে সাহায্য করে।
  • প্রত্যেকবার মলত্যাগের পর বাচ্চাকে স্যালাইন ওয়াটার খাওয়ান। এতে ডিহাইড্রেশন হওয়ার ভয় অনেকটাই কমে যাবে। স্যালাইন ওয়াটার খাওয়ান ধীরে ধীরে সময় নিয়ে। না হলে শিশু বমি করে ফেলবে এবং আবার মলত্যাগের বেগ অনুভব করবে।

ডায়েরিয়ার লেজুড় ডিহাইড্রেশন; কিন্তু কেন? (What is dehydration?)

ডায়রিয়া হলে শরীর থেকে মলের মাধ্যমে ক্রমাগত জল ও নুন বেরিয়ে যেতে থাকে। অনেক সময় বাচ্চা বমিও করে এবং এর ফলেও শরীরের জল বেরিয়ে যায়। ক্রমাগত জল ও নুন বেরিয়ে যাওয়ার ফলে দেখা দেয় ডিহাইড্রেশন। ডিহাইড্রেশন বাচ্চা ও বাড়ন্ত বাচ্চাদের জন্য মারাত্মক। এতে মৃত্যুও হতে পারে।

ডিহাইড্রেশনের উপসর্গগুলি কী কী? (Symptoms of dehydration)

  • তেষ্টা বেড়ে যায়।
  • শিশু কাঁদলেও চোখে জল আসে না।
  • ত্বক, গলা, জিভ শুকিয়ে যায়।
  • চোখ গর্তে ঢুকে যায়।
  • শিশু ঝিমিয়ে যায়।
  • খাওয়া বন্ধ করে দেয়।
  • প্রস্রাব কমে যায় বা বন্ধ হয়ে যায়।
  • চোখ মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়।

বাচ্চার যাতে ডিহাইড্রেশন না হয়, তার জন্য কী করবেন? (How to prevent dehydration?)

ডিহাইড্রেশন হয়ে গেলে অর্থাৎ উপরোক্ত কোনও একটি উপসর্গও যদি শিশুর মধ্যে দেখা যায়, তা হলে তাকে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দিতে হবে। তবে, বাচ্চার ডায়রিয়া হলে যদি কিছু নিয়ম মেনে চলেন, তা হলে এই ডিহাইড্রেশন হওয়ার সম্ভাবনা বহু গুণে কমে যায়। ডিহাইড্রেশনের আক্রমণ ঠেকাতে যা যা করবেন, সেগুলি হল;

  • পর্যাপ্ত পরিমাণে জল খেতে দিন বাচ্চাকে। বাড়িতে তৈরি নুন চিনির শরবতও খুব উপকারী বাচ্চার জন্য।
  • বাড়িতে স্যালাইন ওয়াটার এনে রাখুন এবং নিয়ম অনুসারে তা শিশুকে খাওয়ান।
  • জল ছাড়াও অন্য তরল খাবার শিশুকে খাওয়াতে পারেন।
  • ডাবের জল, সাবুর জল, ঘোল, ভাতের মাড়, গাজরের স্যুপ, টক দই, নুন ও গুড়ের শরবত খেতে দিন বাচ্চাটিকে।
  • বাচ্চা যদি মায়ের দুধ খায়, তা হলে তাকে বারবার দুধ খাওয়ান।
  • বাচ্চা যদি জল বা অন্য কোনও তরল খাবার খেতে না চায়, তা হলে ওকে ORS (oral rehydration solution) দেওয়া শুরু করুন। এতে শরীর থেকে বেরিয়ে যাওয়া নুন, চিনি ও জলের ঘাটতি ভালোভাবে পূরণ হয়ে যায়। ডাক্তারের নির্দেশ মতো খাওয়াতে থাকুন ORS.

Also read: বমি, পেট খারাপ? বাচ্চার জন্য ঘরোয়া প্রতিকার

কয়েকটি গুরুত্ত্বপূর্ণ তথ্য (Points to remember)

  • শিশুর জন্মের পর শালদুধ খাওয়ালে তার ডায়রিয়া হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কম থাকে বা হলেও বাড়াবাড়ি পর্যায়ে যায় না।
  • সাধারণত ডায়রিয়া নিজে নিজেই ঠিক হয়ে যায়। প্রয়োজন শুধু শিশু সঠিক পুষ্টি আর জল পাচ্ছে কি না সেটা দেখা। স্যালাইন ওয়াটারই এর প্রধান ওষুধ। খুব বাড়াবাড়ি হলে তখন শিশুকে ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা করা হয়।
  • শিশুর ডায়রিয়া যদি নির্দিষ্ট সময়ের পরেও না কমে, মলের সাথে রক্ত বেরোয়, প্রচণ্ড জ্বর আসে, শিশু স্যালাইন ওয়াটার বা খাবার কিছুই খেতে পারে না, খুব বমি করলে এবং ডিহাইড্রেশনের কোনও লক্ষণ দেখা দিলে সত্ত্বর চিকিৎসকের পরামর্শ নিন এবং প্রয়োজনে হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা করান।
  • নিজেও পরিষ্কার থাকুন এবং বাচ্চাকেও পরিষ্কার রাখুন। খাবার আগে ভালো করে হাত ধোয়ার অভ্যাস তৈরি করান। শিশু মলত্যাগ করার পর তার হাত জীবাণুনাশক সাবান দিয়ে ভালো করে ধুইয়ে দিন ও টয়লেটও নিয়মিত পরিষ্কার রাখুন।
  • খাবার বা পানীয় আঢাকা রাখবেন না। ফ্রিজের খাবার ভালো করে না ফুটিয়ে বাচ্চাকে দেবেন না।
  • বাইরের কেনা খাবার খাওয়াবেন না বাচ্চাকে।
  • বাচ্চার খাবার জল ও ব্যবহারের জল ফুটিয়ে রাখুন।
  • কেটে রাখা ফল বাচ্চাকে খাওয়াবেন না।
  • শিশুর ডায়রিয়া হলে ডাক্তারের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখুন। তথাকথিত ওষুধ খাওয়াতে না হলেও দরকার বিচক্ষণ পর্যবেক্ষণের। ডায়রিয়া ও ডিহাইড্রেশন সম্পর্কে সচেতন থাকুন। সামান্য ভুলের জন্য শিশু ভবিষ্যতে নানা শারীরিক অসুবিধায় পড়তে পারে এবং তার মৃত্যুও হতে পারে।
  • বাচ্চাকে সঠিক সময় রোটা ভাইরাসের টিকা দিন।

একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার  হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

null

null