ন্যাপি ছাড়িয়ে পটিতে বসানোর সাধারণ সমস্যা ও তার সহজ সমাধান

ন্যাপি ছাড়িয়ে পটিতে বসানোর সাধারণ সমস্যা ও তার সহজ সমাধান

একটি ছোট্ট বাচ্চাকে মানুষ করা তো যে সে কথা নয়, ঠিক সময়ে খাইয়ে আর ঘুম পাড়িয়েই মায়ের কাজ শেষ হয় না। ভবিষ্যতের সঠিক সহবত ও সুঅভ্যাসের বীজ পুঁতে দিতে হয় ছোট্ট বয়সেই। শিশুর পটি ট্রেনিং ঠিক এরকমই একটা সহবত যা সঠিক সময়ে শিশুকে শেখাতেই হয়। সাধারণত ১৮-৩০ মাস বয়স, বাচ্চাদের পটি ট্রেনিং দেওয়ার আদর্শ সময়। চঞ্চল দস্যিটার মধ্যে এই সুঅভ্যাস গড়ে তুলতে প্রয়োজন প্রচুর ধৈর্য এবং ঠান্ডা মাথা। এবারে যে জন্ম থেকে ডায়াপারেই হিসু, পটি সব করে অভ্যস্ত, সে হঠাৎ করে টয়লেট সিটে বসে পটি করতে আগ্রহী হবেই বা কেন! ব্যাস, কিছুতেই টয়লেট সিটে বসে পটি করছে না সে। আপনার হয়তো মনে হতে পারে, আপনার ছানাটি ভীষণ অলস, শুয়ে শুয়ে পটি করে আর বিছানা ভিজিয়ে বড্ড মজা পেয়ে গেছে; আর ফলস্বরূপ, পটি ট্রেনিং করাতে গিয়ে মাথার ঘাম পায়ে পড়ছে আপনার। মাঝে মাঝে বড্ড রাগ হয়ে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে বাচ্চার ওপরই আচ্ছা করে চেঁচাই। সেটা করতে না পেরে বাড়ির অন্যদের অকারণেই মেজাজ দেখিয়ে ফেলছেন হুটহাট। (Common potty training problems and solutions in Bangla.Common potty training problems and solutions in Bengali.)

 

বাচ্চার পটি ট্রেনিং বা টয়লেট ট্রেনিং-এর কিছু সমস্যা (How Parents Can Solve the Worst Potty Training Problems)

আসলে কী জানেন, ব্যাপারটা মোটেও আপনি যেমন ভাবছেন তেমন নয়। আপনার বাচ্চা আলস্যও করছে না আর আপনার চেষ্টাতেও কোনও ত্রুটি নেই। আসল সমস্যা বাচ্চাটির মনের গোড়ায়। একটা নতুন অভ্যাস নিজের করে নেওয়ার আগে তার মনে দেখা দিয়েছে হাজারো সংশয়, জন্ম নিয়েছে অকারণ উদ্বেগ আর গেড়ে বসেছে পটি ট্রেনিং নিয়ে অমূলক কিছু ভয়। এসবেরই বহিঃপ্রকাশ হিসেবে বাচ্চা পটি ট্রেনিং করতেই চাইছে না বা চেষ্টাও করছে না। সমস্যার গোড়া বুঝতে পারলে অনেক ক্ষেত্রেই তার সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব। সেজন্যই আজকের প্রতিবেদনের আলোচ্য বিষয়, বাচ্চাকে পটি ট্রেনিং করাতে কী কী সমস্যা আসে এবং তার সমাধানই বা কী? পড়ে দেখুন, আশা করি কাজে লাগবে আপনার।

 

#1.শিশু মনে অকারণ ভয় (Anxiety in babies)

অনেক বাচ্চার মনেই পটি ট্রেনিং-এর পদ্ধতি বা টয়লেট সিটে বসা নিয়ে একটা ভয় কাজ করে। সেই ভয়ের উৎস কিন্তু বড়দের সত্যি অজানা। মনে করা হয়, কমোডে ফ্লাশ করার সময় যে আওয়াজ হয়, সেটা থেকে বাচ্চাদের মনে অজানা একটা ভয় তৈরি হয়। আবার হঠাৎ কমোডের মতো কোনও নতুন উঁচু জায়গায় বসিয়ে দিলে তার হয়তো মনে হয় সে পড়ে যাবে। মায়ের হাতকেই শক্ত করে আটকে ধরে থাকে সে। নিজের নিরাপত্তার দিকে বেশি মন দেওয়ার জন্য পটি করায় একেবারেই মন থাকে না ওর।

সমাধান: বাচ্চার মধ্যে এই ভয় যাতে না আসে,তার জন্য ব্যবহার করতে পারেন বাচ্চাদের টয়লেট সিট। একেবারে ওই উঁচু কমোডে না বসিয়ে ওর জন্য বরং কিনে আনুন আরামদায়ক একটা টয়লেট সিট। যেখানে ও কিছুক্ষণ বসে থাকলেও ওর কোনও অসুবিধা হবে না। বাচ্চা যখন ওর ছোট্ট টয়লেট সিটে বসেই পটি করতে শিখে যাবে, তখন ওকে পরবর্তী পর্যায়ে নিয়ে যান। কমোড ব্যাপারটা কী সেটা ওকে ভালো করে বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করুন। কমোড কীভাবে কাজ করে এবং ফ্লাশের আওয়াজ কেন হয়, সেটা ওকে বলুন। দরকারে ওর টয়লেট সিট ওর সামনে পরিষ্কার করুন। এতে পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কেও ওর ধারণা জন্মাবে এবং এর পরবর্তীতে কমোড নিয়ে অহেতুক ভয়ও পাবে না।

 

#2. নতুন কিছু অভ্যাসে অস্বস্তি (Baby feels uncomfortable)

এতদিন যে শুয়ে শুয়ে পটি বা হিসু করতো, তার কাছে নতুন একটা জিনিস ব্যবহার করা প্রথম ক্ষেত্রে অস্বস্তির বই কি। সেটা বাচ্চার টয়লেট সিট বা কমোড যাই হোক না কেন, অভ্যেস হতে একটু সময় লাগবেই। আমাদের বড়দের উদাহরণ ধরে দেখুন না; বড়দের অনেকেরই বাইরে কোথাও অন্য জায়গায় বেড়াতে গেলে বা অন্য কারও বাড়ি গেলে প্রথম ২-৩দিন পটি হতে চায় না। আমাদের বড়দেরই এমন অভ্যাস, আর ও তো বাচ্চা। কাজেই সময় লাগবেই।

সমাধান: বাচ্চার জন্য যদি টয়লেট সিট কিনে এনেছেন, তা হলে মাঝে মাঝে ওকে এমনিই বসিয়ে দিন টয়লেট সিটে। ওকে ওখানে বসিয়ে দিয়ে গল্প করুন বা রিল্যাক্সিং কোনও কাজ করুন। তবে সেটা একটু সময়। এতে করে টয়লেট সিটে বসার অভ্যেস ওর তৈরি হয়ে যাবে।

 

#3.কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা (Problems in bowel movement)

বাচ্চার পটি হতে যদি সমস্যা হয় তা হলে বাচ্চার অতক্ষণ বসে থাকার ধৈর্য থাকে না। বাচ্চার যদি কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা থাকে বা পটি ঠিক ভাবে না হয়; তা হলে বাচ্চার পায়ুতে ব্যথা হয় এবং সে টয়লেট সিটে বসে থাকতে চায় না।

সমাধান: বাচ্চা কীরকম খাবার খাচ্ছে, তার খাবারে যথেষ্ট ফাইবার যাচ্ছে কি না এবং বাচ্চা পর্যাপ্ত পরিমাণে জল খায় কি না সেগুলির ওপর বিশেষ নজর দিন। বাচ্চার পটি যদি জলদি এবং আরামদায়ক ভাবে হয়ে যায়, তা হলে বাচ্চা টয়লেট সিটে বসেই পটি করবে।

আরও পড়ুনঃ ৭টি ধাপে শিশুর পটি ট্রেনিং!

#4. আরামদায়ক না হওয়া (Baby feels uneasy)

প্রথমে আসি টয়লেট সিটের কথায়। বাচ্চার জন্য যদি আপনি টয়লেট সিট কিনেছেন এবং সেটা মোটেই তার সাইজের নয়; সেক্ষেত্রে একটু বসলেই বাচ্চার নিতম্ব ও কোমরের ওপর বেশি চাপ পড়ে ব্যথা লাগে। বাচ্চা তাই বসে থাকতে না পেরে উঠে যায়। আবার যদি ওকে সরাসরি কমোডের অভ্যাস করাচ্ছেন, তা হলে কমোডের উচ্চতার জন্য তার পা নীচে ঝোলে। বাচ্চাকে ঠিকভাবে না ধরা হলে বাচ্চা কমোডের ভিতর বেকায়দায় পড়ে গিয়ে আঘাতও পেতে পারে। বড়দের কমোড কোনও দিক থেকেই ১৮ মাসের বাচ্চাকে পটি ট্রেনিং করানোর উপযুক্ত নয়। পটি কী করবে, বাচ্চার পুরো মন পড়ে থাকে তার নিজের শরীর ব্যালান্স করার ওপরেই।

সমাধান: পটি ট্রেনিং শুরুর প্রথম অবস্থায় সবথেকে ভালো হয়, যদি ওর জন্য সঠিক সাইজের একটা টয়লেট সিট কিনে নিয়ে আসেন। এই টয়লেট সিটে একবার অভ্যাস হয়ে গেলে বসে পটি করার ব্যাপারটা বাচ্চা বুঝে যাবে। আরেকটু বড় হলে, ওর সাথে কমোডের পরিচয় করিয়ে দেবেন না হয়।

 

#5.মানসিক ভাবে প্রস্তুত না থাকা (Baby isn’t prepared mentally)

এমনটা মাঝে মাঝেই হয়ে থাকে, মা হয়তো মানসিক ভাবে প্রস্তুত যে, এবার বাচ্চাকে পটি ট্রেনিং করিয়েই ছাড়বেন। কিন্তু, বাচ্চা বেচারা সেই সময়ে একেবারেই প্রস্তুত নয়। কোনও ভাবেই সে টয়লেট সিটে বসছে না বা পটি করছে না। একবার বাচ্চার হয়ে ভেবে দেখুন না, আপনি যে জিনিস শেখাতে মানসিক ভাবে তৈরি, হয়তো ও সেই জিনিস শিখতে এখনই তৈরি নয়।

সমাধান: সব বাচ্চা একভাবে বেড়ে ওঠে না। অনেকে কিছু আগে শেখে আবার অনেকে কিছু পরে। বাচ্চা যদি নিতান্তই পটিতে বসতে না চাইছে, ওকে আরেকটু সময় দিন। আবার ২ মাস পরে না হয় চেষ্টা করবেন। সেই সময়টা বরং ওকে বসে পটি করার ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিন ছবি এঁকে, গল্প বলে। ওর প্রিয় কোনও পুতুল, সেও যে রোজ পটি করতে যায় এবং বসেই পটি করে এই ভাবে বাচ্চাকে বোঝান। পটি করা যে একটা সুঅভ্যাসের মধ্যে পড়ে, বাচ্চাকে বোঝান সেটা। কেউ বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলে তাকে বাহবা দিন। বাথরুমে যা করা হয়, সেটা যে খুব ভালো একটা কাজ এভাবেই বোঝান বাচ্চাকে। প্রয়োজনে বাচ্চাকেও বাহবা দিন এবং আদর করে দিন।

 

#6.বাইরে কোথাও পটি করতে না চাওয়া (Refuses to sit in public toilets)

বাচ্চা হলে কী হবে, তারও কিন্তু ঘেন্নাপিত্তির জ্ঞান টনটনে। একটা সাধারণ পাবলিক টয়লেটে আপনি পারবেন নাক না কুঁচকে পটি করে আসতে? আপনার বাচ্চার ক্ষেত্রেও তাই ঘটে। আপনার হয়তো সমস্যা এখানে যে, বাচ্চা দিব্যি বাড়িতে টয়লেট সিটে পটি করে, বাইরে গেলে কেন করে না! কারণ একটাই, ও বাচ্চা। আপনি যে কাজটা মুখ-নাক চেপে করে আসতে পারেন, ও সেটা বাইরে বেরিয়ে ডায়াপারে করা শ্রেয় বোধ করে।

সমাধান: বাচ্চা মোটামুটি একটু বোঝদার না হওয়া পর্যন্ত ওর ছোট্ট টয়লেট সিটটি নিয়েই বাইরে যান। এতে বাইরে ডায়াপারে পটির ভয়ও থাকবে না আবার বেড়াতে গিয়েও চেনা জায়গায় সুন্দর পটি করবে বাচ্চা। শুধু তাই নয়, বাচ্চার ইনফেকশন হওয়ার আশঙ্কাও কম হয় এতে।

 

#7. সময়ের সঠিক জ্ঞান না হওয়া (Understanding day and night)

বাড়ন্ত বাচ্চার মগজে দিন ও রাতের ব্যাপারটা ঢুকলেও রাতে যে বিছানা ভেজাতে নেই, এটা তার মাথায় থাকে না। পটি ট্রেনিং পুরো হওয়ার পরেও রাতে বিছানায় হিসু তো বটেই, পটিও করে ফেলতে পারে বাচ্চা। এ কিন্তু খুব স্বাভাবিক একটি ঘটনা। সব মা-ই এই ধরনের ঘটনার সাক্ষী।

সমাধান: বাচ্চাকে গল্প করে বা আদর করে বোঝাতে হবে যে রাত্রে হিসু পেলে বা পটি করতে হলে সে যেন আপনাকে ডাকে। রাতে বিছানা ভেজানো কম করতে ওকে রাতে বেশি লিকুইড খাওয়াবেন না। একটু সময় তো ওকে দিতেই হবে সবকিছু অভ্যেস করতে, আর আপনি ততক্ষণ ধৈর্য ধরুন।

 

শিশুর পটি ট্রেনিং (Potty Training Tips in Bengali)

 

বিশেষ কিছু কথা (Some more tips)

  • বাচ্চাদের পটি ট্রেনিং করানো ধৈর্যের কাজ অবশ্যই। কখনই ওকে জোর করবেন না বা পটি করা নিয়ে ভয় দেখাবেন না।
  • প্রথম প্রথম বরং এমন একটা ভাব দেখান, যেন ও কী করলো না করলো তাতে আপনার সত্যি কিছু যায় আসে না। আর জানেন তো, আপনি যাতে মন দেবেন না, তাতেই বাচ্চার কৌতূহল বেশি।
  • বাচ্চার পটির সময়টা যেন রিল্যাক্সিং হয়। করতে হবেই বা না করা পর্যন্ত ওঠা চলবে না; এই ধরনের মনোভাব নিয়ে থাকলে আপনার বাচ্চা কিন্তু আর দ্বিতীয় দিন পটিতে বসবে না
  • কমোডে পটি করা শেখানোর সময় বিশেষ যত্নশীল থাকবেন। বাচ্চা যেন পড়ে না যায়।
  • পটি ট্রেনিং চলাকালীন বাচ্চা যদি অসাবধানে বাইরে পটি করে ফেলে, তা হলে তাকে ধমকাবেন না।
  • টয়লেট সিট ও নিজের হাত বাচ্চার সামনে জীবাণুনাশক সাবান দিয়ে পরিষ্কার করুন। বাচ্চার হাত নোংরা না হলেও তা সাবান দিয়ে ধুয়ে দিন। পরিচ্ছন্নতার বোধ গড়ে উঠবে এভাবেই।

আরও পড়ুনঃ ছানার স্নানের সময় হোক আরাম আর স্ফূর্তির

একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার  হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

null

null