সোনামণির শরীর খারাপ? স্যাঁতস্যাঁতে এই মরসুমে ওকে কাবু করতে পারে কোন কোন অসুখ!

সোনামণির শরীর খারাপ? স্যাঁতস্যাঁতে এই মরসুমে ওকে কাবু করতে পারে কোন কোন অসুখ!

গৌতম আর প্রতিমার বাড়িতে যা-যা হয়, নিয়ম মেনে হয়। বেনিয়ম দেখলেই স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই বেদম বিরক্ত হন। কিন্তু তাঁদের একটাই আক্ষেপ, একমাত্র মেয়ে পিয়ালি কোনও নিয়মেরই ধার ধারে না। বছর তিনেক হল পিয়ালির বিয়ে হয়েছে। তারপরেও যে সে খুব একটা বদলেছে তা নয়। কারণ জামাই অনির্বাণও একই গোত্রের। খাবার খাওয়ার সময়ের ঠিক নেই, ঘুমানোর সময়ের ঠিক নেই। দু’বছর হল তারাও আবার বাবা-মা হয়েছে। একরত্তির অপুটাও যে একই রকম উচ্ছন্নে যাবে তা নিয়ে গৌতমবাবুর কোনও সন্দেহ নেই। (Common Monsoon Diseases in Babies and Children)

এর মধ্যে সেই নাতির দেখাশোনার দায়িত্ব আবার পড়েছে গৌতম আর প্রতিমার উপর। কারণ বৃষ্টি উপভোগ করতে মেয়ে-জামাই রওনা দিয়েছে কোডাইকানাল। বাবা-মায়ের কাছে খোকাকে জিম্মা করে দিয়ে যাওয়ার আগে পিয়ালি সব কিছু বুঝিয়ে দিয়েছে। অপু কী খেতে ভালোবাসে, কোন জামা পড়তে ভালোবাসে, কোন কোন শরীর-খারাপ (Monsoon Diseases) হলে কী কী ওষুধ খাওয়াতে হবে—এই সব। কিন্তু সময় মেনে কখন কোনটা করাতে হবে, তার কোনও ঠিক নেই।

সে যাক গে, নাতিকে হাতের কাছে পেয়েই গৌতম ঠিক করেছেন বেশ একটা নিয়মানুবর্তি বানিয়ে ছাড়বেন তাকে। কিন্তু গোল বেধেছ তিন দিন পর থেকেই! অপুর ঠান্ডা লেগেছে,জ্বর-জ্বর ভাব। (Borshar Joto Rog) তার সঙ্গে মারাত্মক সর্দি। সবের মূলে পিয়ালি আর অনির্বাণের বেখেয়ালি জীবনযাপন—এই সব ভাবতে ভাবতেই অপুকে নিয়ে গৌতমবাবু হাজির হলেন চিকিৎসকের চেম্বারে। (Common Monsoon Illnesses)

ডাক্তারবাবু সব কিছু পরীক্ষা করে জানালেন, খুব সম্ভবত অপুর ইনফ্লুয়েঞ্জা হয়েছে। বর্ষার মরসুমের খুব সাধারণ একটি অসুখ। তবে অসুখটা জীবাণুঘটিত এবং খুব ছোঁয়াচে। গৌতমবাবু অবশ্য এই অসুখের পুরো দোষটাই চাপাতে চাইছিলেন অপুর বাবা-মায়ের বেতাল জীবনের ঘাড়ে।

কিন্তু ডাক্তারবাবু মুচকি হেসে জানালেন, বিষয়টা তেমনটাও নয়. আসলে বর্ষাকালে জীবাণুদের বাড়াবাড়ন্ত হয়। তাই বাচ্চারা এই সময় নানা অসুখে মারাত্মক পরিমাণে আক্রান্ত হয়ে পড়তে পারে। (Be Cautious Of These Monsoon Diseases & Prevention) তবে এর পরবর্তী পর্যায়ে নাতিকে খুব নিয়ম মেনেই রাখতে হবে, তার যত্ন নিতে হবে, সেটাও বলে দিলেন ডাক্তারবাবু।

হাঁফ ছেড়ে বাঁছলেন গৌতমবাবু। ভাগ্যিস তাঁর বেয়ারা মেয়ে-জামাইটা এই সময় এখানে নেই, থাকলে নাতিটা হয়তো আরও অসুস্থ হয়ে পড়ত।

ডাক্তারবাবু গৌতমবাবুকে এটাও মোটামুটি বুঝিয়ে দিয়েছেন, বর্ষাকালে বাচ্চাদের কোন কোন অসুখ হতে পারে। গৌতমবাবুও তা নোট করে নিয়েছেন। মেয়ে-জামাই কলকাতায় ফিরলে তাদের হাতে ধরিয়ে দেওয়ার মতো করেই বানিয়ে ফেলেছেন তালিকা। আপনাদের জন্য এই পাতায় রইল সেই তালিকাই। (Common Illnesses Occurring in the Monsoon)

 

 

বর্ষার দুর্ভোগ; স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে বাড়ে এই ৭ রোগ
(7 Most Common Monsoon Diseases)

 

#1. ইনফ্লুয়েঞ্জা: অপুর ইনফ্লুয়েঞ্জা (Influenza) দিয়েই কথা বলা শুরু হয়েছিল। তাই ওই অসুখটার কথাই প্রথমে বলা যাক। বর্ষায় শিশুদের ক্ষেত্রে এটা খুব সাধারণ একটা সমস্যা। সাধারণ জীবাণুঘটিত অসুখই বলা যায় একে।

  • কারণ: বাতাসে এই অসুখের জীবাণু প্রচুর পরিমাণে ছড়িয়ে থাকে। বর্ষাকালে তাদের বাড়বাড়ন্ত হয়। শুধু শিশুদের কেন, বড়দেরও নাক বা মুখ দিয়ে এই জীবাণু ঢুকে শরীরে রোগবালাই বাড়িয়ে দিতে পারে (Viral Infection Symptoms)।
  • লক্ষণ: প্রচণ্ড সর্দি, সঙ্গে জ্বর। গলা ভেঙে যায় বহু বাচ্চার ক্ষেত্রেই। শরীরে ব্যথাও হয় এর বাড়াবাড়ি হলে।
  • সাবধানতা: শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা যত বেশি থাকে, শিশুর শরীর এই ভাইরাসের সঙ্গে তত ভালো করে মোকাবিলা করতে পারে। ফলে ওকে পুষ্টিকর তো বটেই পাশাপাশি ভিটামিন-সমৃদ্ধ খাবার খেতে দিন। (Rainy Season Diseases) চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে ডায়েট-চার্ট বানিয়ে নিতে পারেন। অসুখটা হলে চিকিৎসকই বলে দিতে পারেবন, কী-কী ওষুধ খাওয়াতে হবে।

 

#2. ডেঙ্গি: বর্ষাকালে মশার কামড়ে এই রোগ ছড়ায়। এখন তো ডেঙ্গির (Dengue) বেশ বাড়াবাড়ি হয়েছে।

  • কারণ: মশা এই রোগের জীবাণুর বাহক। মশার কামড় থেকে ছোটদের তো বটেই বড়দেরও এই রোগ হতে পারে।
  • লক্ষণ: প্রচণ্ড জ্বর। তার সঙ্গে গাঁটে-গাঁটে ব্যথা। সারা শরীরের পেশি নাড়ানোর মতো ক্ষমতাও থাকে না। শিশুরা অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ে। মাথা যন্ত্রণা হয়। কিছু ক্ষেত্রে শরীরের ভিতরে রক্তক্ষরণের পর্যন্ত আশঙ্কা থাকে।
  • সাবধানতা: জানলা-দরজা বন্ধ করে এয়ার কন্ডিশনার চালিয়া শিশুকে রাখার ব্যবস্থা না-থাকলে ওকে মশারির মধ্যে রাখুন। ঘরে মশা তাড়ানোর তেল ব্যবহার করতে পারেন। কিন্তু তার সব ক’টি শিশুদের জন্য ভালো নয়। (Common Problems During Rainy Season) কোন তেল ব্যবহার করলে শিশুর ক্ষতি হবে না, তা বিশেষজ্ঞের থেকে জেনে নিন। আর শিশু এই রোগে আক্রান্ত হলে ততক্ষণাৎ চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান। না-হলে মারাত্মক বিপদ হতে পারে।

 

#3. ম্যালেরিয়া: এটিও মশাবাহিত রোগ। বর্ষাকালের সবচেয়ে কমন অসুখ (Malaria Symptoms)।

  • কারণ: বর্ষায় এখানে-সেখানে জমে থাকা জলে মশা সহজে বংশবিস্তার করে। মেয়ে অ্যানোফিলিস মশার কামড়ে এই রোগ ছড়ায়।
  • লক্ষণ: শুরু হয় হালকা জ্বর দিয়ে। তারপর ক্রমশ উত্তাপ বাড়তে থাকে। ম্যালেরিয়ার প্রধান লক্ষণ নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসা। শরীর প্রচণ্ড দুর্বল হয়ে পড়ে এই অসুখের কারণে।
  • সাবধানতা: ডেঙ্গির মতো এক্ষেত্রেও শিশুকে মশারির মধ্যে রাখার চেষ্টা করুন। বাড়ির চারপাশে জল জমে থাকতে দেবেন না। শিশু ম্যালেরিয়ার আক্রান্ত কি না, তা রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমেই টের পাওয়া যায়। এই অসুখ হলে চিকিৎসকের পরামর্শ মতো ওষুধের কোর্স করাতেই হবে।
    পাশাপাশি, ঘরোয়া টোটকায় বাচ্চাকে মশার হাত থেকে বাঁচানোর কিছু উপায়ও বাতলে দিচ্ছি আমরা। পড়ে নিন> মশা মারতে ৫ টোটকা দাগা

 

আরও পড়ুন: বাড়িতেই বানান চ্যবনপ্রাশ ও কফ সিরাপ, জেনে নিন উপকারিতাও

 

#4. টাইফয়েড: বর্ষার অতি পরিচিত অসুখ। মূলত জলবাহিত রোগ (Symptoms of Typhoid)।

  • কারণ: বর্ষাকালে অপরিচ্ছন্নতা থেকে এই রোগ ছড়ায়। জলে বা অশুদ্ধ খাবারে টাইফয়েডের জীবাণু বেশি পরিমাণে জন্মায়। তা শিশুর পেটে গেলেই টাইফয়েড জাঁকিয়ে বসবে।
  • লক্ষণ: জ্বর, পেটে ব্যথা এই রোগের প্রধান লক্ষণ। জীবাণুর বাড়বাড়ন্ত হলে মাথা ব্যথাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে দ্রুত চিকিৎকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। (Tips To Prevent Monsoon Diseases In Toddlers Naturally)
  • সাবধানতা: টাইফয়েডের জীবাণু তাড়ানো খুব কঠিন। অসুখ সেরে গেলেও গলব্লাডারে এই জীবাণু থেকে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। তাই এই রোগ থেকে খুব সাবধান। শিশুকে পরিচ্ছন্ন রাখুন। পরিষ্কার জল আর খাবারও খাওয়ান। কেউ টাইফয়েডে আক্রান্ত হলে, তাকে বাকিদের থেকে দূরে রাখতে হবে। অন্য ঘর হলে সবচেয়ে ভালো হয়। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়ম মেনে চিকিৎসা করাতে হবে আক্রান্তর।

 

#5. গ্যাসট্রোএনটেরাইটিস: বর্ষাকালে জীবাণুঘটিত রোগের অন্যতম। সহজ কথায় যাকে বলে পেটের গোলমাল

  • কারণ: বর্ষাকালে শিশুরা অপরিচ্ছন্ন হাতে কোনও খাবার খেলে বা হাত মুখে দিলে এই রোগ ছড়াতে পারে (Diarrhea Prevention)। একসঙ্গে নানাবিধ জীবাণুর আক্রমণে এই অসুখ হয়।
  • লক্ষণ: পেটের ব্যাপক গণ্ডগোল এর প্রধান লক্ষণ। পাশাপাশি বহু শিশুরই বমি হতে থাকে এই রোগের কারণে। শরীর প্রচণ্ড দুর্বল হয়ে পড়ে।
  • সাবধানতা: শিশুকে সব সময় পরিচ্ছন্ন রাখার চেষ্টা করুন। দেখুন যেন নোংরা হাতে কোনও খাবার না-খায়। ফিল্টার করা জল খাওয়ান। একবার এই রোগে আক্রান্ত হলে ওকে মশলাপাতি দেওয়া খাবার বা অতিরিক্ত মিষ্টি খাবার দেবেন না। চিকিৎসকের থেকে জেনে নিন ওষুধের তালিকা। এমনকী এই রোগের সূত্র ধরে পড়ে কলেরা (Cholera) পর্যন্ত হতে পারে। তাই সে বিষয়েও সাবধান থাকুন। (Monsoon Diseases in Babies and Children)

 

#6. হেপাটাইটিস এ: জলবাহিত রোগ। শিশুদের পাশাপাশি বড়দেরও হতে পারে (Hepatitis A)।

  • কারণ: অপরিশুদ্ধ জল থেকে তো বটেই, পাশাপাশি আক্রান্ত ব্যক্তির মল থেকেও এই রোগের জীবাণু ছড়ায়। মলের ওপর মাছি বা অন্য পতঙ্গ বসার পর সেগুলো যদি কোনও ফল বা খাবারে বসে, তা হলে সেখান থেকে এই জীবাণু ছড়িয়ে পড়তে পারে।
  • লক্ষণ: জন্ডিসের মতো চোখ হলুদ হয়ে যায় অনেকের ক্ষেত্রেই। কারণ এই জীবাণু আক্রমণ করে মানুষের লিভারে। খিদে কমে যায়, বমি হতে থাকে এবং ভয়ঙ্কর পেটের গোলমাল হয়। (How To Keep Your Kids Safe From Common Monsoon Illnesses)
  • সাবধানতা: শিশুদের ভ্যাকসিন দেওয়াটা দরকারি। পাশাপাশি খুব পরিশুদ্ধ জল এবং খাবার দিতে হবে। দরকার হলে ফুটিয়ে জল খাওয়াতে হবে। বাইরের কাটা ফল বা অন্য খাবার এই মরসুমে নয়। রোগে আক্রান্ত হলে ততক্ষণাৎ চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে।

 

#7. লেপ্টোস্পিরোসিস: একে ওয়েলস সিনড্রম-ও বলে। বর্ষাকালে অপরিশুদ্ধ জল থেকে এই রোগ ছড়ায়।

  • কারণ: মূলত অপিরশুদ্ধ জল থেকেই এই রোগ ছড়ায়। তবে শিশুরা মাঠে খেলার সময় কাদা মাখলে, সেই কাদা যদি কোনও কারণে মুখে যায়, তা হলেও এই অসুখ হতে পারে।
  • লক্ষণ: মোটের উপর ইনফ্লুয়েঞ্জার মতোই লক্ষণ এই রোগের। মাথাব্যথা, জ্বর, সারা গায়ে যন্ত্রণা।
  • সাবধানতা: মাঠে খেলতে গেলে, ঠিকঠাক জুতো পরে পাঠান। পাশাপাশি আপনার বাড়িতে পোষ্য থাকলে তাকেও পরিচ্ছন্ন রাখুন। কারণ বাইরে থেকে সে ঘুরে এলে, তার সূত্র ধরেও এই জীবাণু আপনার সোনার কাছে পৌঁছে যেতে পারে। আর এই রোগে আক্রান্ত হলে চিকিৎসকের সঙ্গে সত্ত্বর যোগাযোগ করুন।

 

উপরে লেখা সমস্ত অসুখের বিবরণ শুনে গৌতমবাবু তো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন কী করবেন। (Most Common Monsoon Diseases) মেয়ে-জামাই ফিরলে তাদের হাতে কোন তালিকা ধরিয়ে দেবেন। আর ডাক্তারবাবু এটাও বলে দিলেন, এই অসুখগুলোর বাইরেও শিশুরা বর্ষাকালে অহরহই ভাইরাল জ্বরে আক্রান্ত হয়। তা নিয়ে ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
শুধু ওকে ঠিকঠাক ভাবে যত্ন করলে, আর পরিচ্ছন্ন খাবার আর জল খাওয়ালেই ও দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবে। আর পরামর্শ দেওয়ার জন্য চিকিৎসকরা তো রয়েইছেন। (Common Monsoon Diseases in Babies and Children)

 

আরও পড়ুন: বাচ্চার ঠান্ডা লাগার ধাত? ঘরোয়া খাবারেই সমাধান আছে সাধারণ সর্দি-জ্বর, খুশখুশে কাশির

 

একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার  হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

null

null