কী কী সংক্রমণ হতে পারে আপনার বাচ্চার? চিনে নিন তার ধরন-ধারণ, জেনে নিন প্রতিকারের উপায়!

কী কী সংক্রমণ হতে পারে আপনার বাচ্চার? চিনে নিন তার ধরন-ধারণ, জেনে নিন প্রতিকারের উপায়!

দেবাদিত্য এমনিতেই একটু বাতিকগ্রস্ত। কোনও বিষয়ে কোনও সমস্যা না-থাকলেও, হাত না-ধুয়ে খাবারের টেবিলে হাত দেওয়া যাবে না, স্নান না-করে বিছানায় ওঠা যাবে না—এমন নানা রকম বাতিক আছে ওর। এক কথায় দেবাদিত্যকে শুচিবাইগ্রস্ত বলাই যায়। এই পিটপিটে স্বভাবটা আরও বেড়ে যায় ওর ছয় মাসের কন্যা সন্তান পিপলির প্রসঙ্গ উঠলেই।
শুধু সাবানে হবে না, তারপর হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার না-করে কেউ পিপলিকে ধরতে পারবে না, ওকে কোলে নিতে পারবে না। দেবাদিত্যর একটাই ভয়, যদি পিপলির ইনফেকশন হয়ে যায় (Common Baby Infections)! তাই সবেতেই বাড়াবাড়ি।

এর মধ্যেই হঠাৎ একদিন পিপলির জ্বর। সে তো বাচ্চাদের জ্বর হতেই পারে। কিন্তু তার সঙ্গে ডানহাতের তালুর উল্টো পিঠ পিপলি ক্রমাগত ডানকানে ঘষছে। দেবাদিত্যর ছোটবেলার বন্ধু ধীমান পেশায় ডাক্তার (Sisur Sonkromon)। সঙ্গে সঙ্গেই ফোন গেল তার কাছে। ধীমানের মত, পিপলির হয়তো কানে কোনও ধরনের ইনফেকশন হয়েছে (Bacterial Infection in Child Symptoms)।

ব্যস! বাড়িশুদ্ধ লোকের রক্ষে নেই। কেউ নিশ্চয়ই পরিষ্কার না-হয়ে পিপলিকে ধরেছিল! তাই এই ইনফেকশন। দেবাদিত্যর আক্রমণ থেকে রক্ষা পাচ্ছে না তার স্ত্রী পায়েলও। জটিল পরিস্থিতিতে ওই দিন বিকেলেই দেবাদিত্য আর পায়েল ছুটল শিশুস্বাস্থ্য-বিশেষজ্ঞের চেম্বারে (Baby Virus Symptoms)।

চিকিৎসকের কথায় কিছুক্ষণের মধ্যেই পরিষ্কার হল, শিশুদের প্রচণ্ড আগলে রাখলেও তাদের নানা কারণে ইনফেকশন হয়ে যেতেই পারে। প্রচণ্ড পরিচ্ছন্ন থেকেও সব সময় তা এড়িয়ে চলা সম্ভব নয়। আর পিপলির যা হয়েছে, তা-ও খুব সাধারণ এক ইনফেকশন। বহু শিশুরই হয়। এবং এটা মোটেও ছোঁয়াচে নয়। তাই অন্য কারও থেকে এই জীবাণু এসে পিপলির কানে ঢুকেছে এমন ভাবার কারণ নেই।

এরপরই ডাক্তারবাবু দেবাদিত্য আর পায়েলকে বুঝিয়ে দিলেন, বাচ্চারা ঠিক কোন কোন ধরনের ইনফেকশনে মাঝে মধ্যেই আক্রান্ত হয়ে পড়ে। আরও বড় কথা কোন কোন পথে এই জীবাণুরা বাচ্চাদের আক্রমণ করে, সেটাও জানালেন তিনি (Viral Infections in Toddlers)। আপনারা, যাঁরা সদ্য বাবা-মা হয়েছেন, বা যাঁদের বাড়িতে ছোট শিশু রয়েছে, তাঁরাও মিলিয়ে দেখে নিতে পারেন এই তালিকা।

 

প্রথমে দেখে নেওয়া যাক,
কোন কোন রাস্তায় বাচ্চাদের মধ্যে ইনফেকশন ছড়ায় (How infection spreads among kids)

 

 

  • সরাসরি ছোঁয়া: বাচ্চাদের আদর করা, তাদের চুমু খাওয়ার মাধ্যমে এক ধরনের জীবাণু বাচ্চাদের শরীরে ঢুকে পড়তে পারে। এই জীবাণুরা চোখ, নাক, মুখ, এমনকী ত্বকের মধ্যে দিয়েও সংক্রমণ ঘটাতে পারে।

 

  • পরোক্ষ ছোঁয়া: এই জীবাণুরা আরও শক্তিশালী। কোনও সংক্রামিত বা জীবাণুর বাহক ব্যক্তি হয়তো শিশুর খেলনা বা জামা ধরলেন। পরে সেখান থেকে জীবাণু সংক্রামিত হল শিশুর শরীরে (Most Common Childhood Illness)।

 

  • জলীয় মাধ্যম: সংক্রামিত ব্যক্তির হাঁচি বা কাশির মধ্যে যে জলকণা বা সূক্ষ ফোঁটা থাকে, তার মাধ্যমে জীবাণু পৌঁছে যায় নিকটবর্তী শিশুর শরীরে। তাই শিশুর সামনে হাঁচি-কাশি এলে, তা সব সময় রুমাল বা টিস্যু দিয়ে ঢেকে নেওয়া উচিত।

 

  • বাতাসের মাধ্যমে: এই জীবাণুরা বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায়। চিকেনপক্স বা হামের জীবাণু এই গোত্রভুক্ত। একে নিয়ন্ত্রণ করার একমাত্র রাস্তা শিশুদের ভ্যাকসিন দেওয়া। এক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তি শিশুর সামনে না-এলেও জীবাণু শুধু বাতাসের মাধ্যমে শিশুর শরীরে ঢুকতে পারে (Common Baby Infections)।

 

 

এবার দেখে নেওয়া যাক,
বাচ্চাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মাত্রায় কোন কোন ইনফেকশন বা সংক্রমণ দেখা যায় (Common Baby Infections you must know about)

 

#1. সাধারণ ঠান্ডা লাগে: অল্প জ্বর, সর্দি, নাকবন্ধ, হাঁচি, কাশি, গলায় ব্যথা—এ সবই সাধারণ জ্বরের লক্ষণ। শিশুদের মধ্যে অহরহ এই ইনফেকশন দেখা যায় (Bacterial Infections in Babies and High Fever)। এতে শিশুর খিদে কমে যেতে পারে।

  • কীভাবে ছড়ায়: অন্যের হাঁচি, কাশি, ছোঁয়া থেকে এই ধরনের জ্বর হতে পারে। মরসুম বদলের সময়ও বিভিন্ন ধরনের জীবাণুরা সক্রিয় হয়ে ওঠে। তার থেকেও এই জ্বর হতে পারে।
  • কী করবেন: জল বা দুধ বেশি করে খাওয়ান ওকে। শরীরে যত ফ্লুইড যাবে, ততই ভালো। বাচ্চা শক্ত খাবার খেতে চাইলে বাধা দেবেন না। নাক বন্ধ হয়ে গেলে, পরিষ্কার রুমাল বা টিস্যু দিয়ে নাক পরিষ্কার করে দিন। বাড়াবাড়ি হলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

 

#2. ব্রংকিওলাইটিস: সাধারণত এক বছরের কম বয়সি শিশুদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা বেশি হয়। জ্বর, সর্দি, কাশি, গলাব্যথা—এর প্রধান লক্ষণ।

  • কীভাবে ছড়ায়: সাধারণ জ্বরের মতোই এটাও অন্যের হাঁচি, কাশি বা ছোঁয়া থেকে এই জীবাণুর সংক্রমণ হয়। এই জীবাণুও খুব সহজেই শিশুদের আক্রান্ত করে ফেলে। তবে এ থেকে শিশুরা সেরেও ওঠে তাড়াতাড়ি।
  • কী করবেন: বেশি মাত্রায় ফ্লুইড দিন ওকে। চিকিৎসকের পরামর্শে জ্বরের ওষুধ এবং বন্ধ নাক খোলার ওষুধ দিতে পারেন।

 

#3. ইনফ্লুয়েনজা: জ্বর, সর্দি, ঠান্ডা লাগা তো আছেই (Overview of Viral Infections in Children)। তার সঙ্গে এই ইনফেকশনে অনেক শিশুরই মাথা যন্ত্রণা শুরু হয়। পাশাপাশি তাদের খিদে চলে যায়।

  • কীভাবে ছড়ায়: এটা মূলত বাতাস-বাহিত জীবাণুর সংক্রমণ থেকে হয়। একে আটকানোর উপায় নেই।
  • কী করবেন: ইনফ্লুয়েনজার ভ্যাকসিন রয়েছে। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী, তার ব্যবস্থা করতে হবে। লক্ষণগুলো দেখা দেওয়ার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই শিশুর চিকিৎসা শুরু করা প্রয়োজন।

 

#4. গলা ফোলা: এক্ষেত্রে শিশুদের গলার ভিতর ফুলে যায়। অল্প জ্বর হতে পারে। সারা গায়ে শিরিস কাগজের দানার মতো লাল-লাল চুলকানি হতে পারে।

  • কীভাবে ছড়ায়: সরাসরি ছোঁয়া থেকে এই রোগ ছড়াতে পারে। শিশুদের সামনে হাঁচলে বা কাশলেও, সংক্রমিত ব্যক্তির থেকে এই রোগ শিশুদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
  • কী করবেন: অবিলম্বে চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলুন। এই সমস্যায় সাধারণত অ্যান্টিবায়োটিক খেতে হয় না। তবে উপশমের জন্য চিকিৎসক রাস্তা বলে দেবেন।

 

আরও পড়ুন ঃ বাচ্চার ভাইরাল ইনফেকশনে যত্ন নেবেন কীভাবে?

 

#5. পারভো: এক্ষেত্রে গালে লাল ফুসকুরি বেরোয়। তারপর কয়েক দিনের মধ্যে তা সারা গায়ে ছড়িয়ে পড়ে। শিশু খুব অসুস্থ হয় না (Common Infections and Your Child)।

  • কীভাবে ছড়ায়: সরাসরি ছোঁয়া বা পরোক্ষ ছোঁয়া থেকে এই রোগ ছড়ায়।
  • কী করবেন: নিজে থেকেই এই রোগ সারে। তবে গর্ভবতী মহিলাদের বাড়ির কোনও শিশুর এই অসুখ হলে অবিলম্বে চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলতে হবে, না-হলে গর্ভের ক্ষতি হতে পারে।

 

#6. কানে সংক্রমণ: কানে ব্যথা। সঙ্গে জ্বর। কোনও কোনও শিশুর কান থেকে ফ্লুইড-ও বেরোয়।

  • কীভাবে ছড়ায়: সাধারণত জ্বর হলে পরিবেশে থাকা জীবাণুর আক্রমণে এই রোগের জন্ম হয়। একেবারেই ছোঁয়াচে নয় (Sisur Sonkromon)।
  • কী করবেন: চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলুন। অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজন হতে পারে।

 

#7. মোলাস্কাম: শিশুর সারা গায়ে ছোট ছোট ফুসকুরি তৈরি হয়। গোলাপি রঙের এই ফুসকুরির সংখ্যা ২০-র আশেপাশে হতে পারে। তবে অনেক শিশুর শত খানেকও হয়। এর ভিতরে সাদা ঘণ ফ্লুইড থাকে। এগুলি চুলকায়।

  • কীভাবে ছড়ায়: এমনিতে ছোঁয়াচে নয়। পরিবেশ থেকে আসে। তবে এক জায়গায় প্রদাহ হলে, সেই জায়গাটা চুলকালে তার থেকে রস বেরিয়ে শরীরের অন্যত্র হতে পারে।
  • কী করবেন: চিকিৎসককে দেখিয়ে জেনে নিন, সত্যিই মোলাস্কাম কি না। নিয়মিত হাত পরিষ্কার করে তবেই শিশুর গায়ে হাত দিন। আর অবশ্যই শিশুকে পরিচ্ছন্ন রাখুন।

 

#8. লাল চোখ: চোখ লাল হয়ে যায়। চুলকাতে থাকে। শিশুর দেখতে সমস্যা হয় (Infection in Newborn Babies)।

  • কীভাবে ছড়ায়: প্রচণ্ড ছোঁয়াচে। প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ছোঁয়া—সব রকম ভাবে এই অসুখ হতে পারে।
  • কী করবেন: চিকিৎসককে জানান। তিনি ওষুধ তো দেবেনই। পাশাপাশি প্রতি বার পরিষ্কার করে ধোঁয়া নরম কাপড় দিয়ে শিশুর চোখ পরিষ্কার করুন।

 

#9. পেটের সংক্রমণ: এক্ষেত্রে ভয়ানক পেটের গণ্ডগোল দেখা যায়। শিশুর খিদে একেবারে কমে যায়। জ্বরও হতে পারে।

  • কীভাবে ছড়ায়: সংক্রামিত ব্যক্তির সরাসরি ছোঁয়া বা পরোক্ষ ছোঁয়া থেকে হতে পারে।
  • কী করবেন: কোনও ভাবে যেন ডিহাইড্রেশন না-হয়। নিয়মিত জল বা অন্য ফ্লুইড দিতে থাকুন। শিশুর পায়খানায় যদি রক্ত থাকে, তবে অবিলম্বে চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করে ওষুধ খাওয়াতে হবে।

 

#10. চর্মদল: খুবই কমন একটি সংক্রমণ। শিশুর নাকের নীচে বা মুখের চারপাশে লালচে রঙের ছোট ছোট ফোসকার মতো দেখা যায় (Detecting Bacterial Infections in Babies)। ভিতরে তরল পদার্থ থাকে।

  • কীভাবে ছড়ায়: সংক্রামিত ব্যক্তির সরাসরি ছোঁয়া বা পরোক্ষ ছোঁয়া থেকে চর্মদল ছড়াতে পারে। শিশুর জামা-কাপড়ে সংক্রামিত ব্যক্তির ছোঁয়া থেকেও এই অসুখ ছড়ায়।
  • কী করবেন: এটি ব্যাকটেরিয়া-ঘটিত সংক্রমণ। ওষুধের জন্য চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলুন। পাশাপাশি পরিষ্কার নরম কাপড় বা তুলো দিয়ে আক্রান্ত জায়গা নিয়মিত পরিষ্কার করে দিন।

 

শিশুর যে কোনও ইনফেকশনেই চিকিৎসকের কথা বলাটা জরুরি (Common Baby Infections)। তবে এটাও মনে রাখা দরকার, অনেকগুলো ইনফেকশনই শিশুকে পরবর্তী সময়ে রোগ প্রতিরোধ করার জন্য প্রস্তুত করে। তাই ছোট্ট সোনাকে পরিবেশ থেকে খুব দূরে দূরে না-রেখে, তাকে এর মধ্যেই বাড়তে দিন। সে হয়ে উঠবে সুপার-সোনা।

 

আরও পড়ুনঃ বাচ্চার ঠান্ডা লাগার ধাত? ঘরোয়া খাবারেই সমাধান আছে সাধারণ সর্দি-জ্বর, খুশখুশে কাশির

 

একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার  হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

null

null