বাচ্চার সাধারণ কয়েকটি অসুখের ব্যাপারে যা না জানলেই নয়!

বাচ্চার সাধারণ কয়েকটি অসুখের ব্যাপারে যা না জানলেই নয়!

বয়সটা নেহাতই কচি বলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা খুব একটা শক্তিশালী হয় না; তাই ঘুরেফিরে হানা দেয় ভাইরাস আর ব্যাকটেরিয়ার দল। সহজেই কাবু করে ফেলে একরত্তিগুলোকে।
তবে ঘাবড়ে যাওয়ার কিছু নেই। সামান্য সতর্ক থাকলে বা অসুখগুলো সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল থাকলে নিজেই যত্ন করতে পারবেন বাচ্চার। অন্তত প্রথমেই ঘাবড়ে যাবেন না। প্রাথমিক যত্ন নিয়ে ডাক্তারবাবুর পরামর্শ নিয়ে সুস্থ করে তুলতে পারবেন কোলের ছানাকে। (Common Childhood Illnesses and Their Treatments)

বছরভর বাচ্চারা কিছু কিছু অসুখে প্রায়ই ভুগে থাকে। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে খুব সাধারণ কয়েকটি অসুখের কথাই (Childhood Illnesses) বলবো আজ প্রতিবেদনে। নাহ, ডাক্তারি বিশ্লেষণে যাব না মোটেই, সহজ ভাষায় রোগের নাম, কারণ ও সাধারণ প্রতিকারের কথাই বলবো আমরা। আপনাদের সাবধান করে দেওয়াই আমাদের উদ্দেশ্য মাত্র। বাচ্চার খাতিরে চোখ বুলিয়ে নিন প্রতিবেদনে। (Preventing and Treating Common Children’s Illnesses)

 

  #1. গলা খুস্খুস (Sore Throat)

 অত্যন্ত বিরক্তিকর একটি অসুখ এই গলা খুস্খুস করা। অসুখ না বলে একে উপসর্গ বললেও বিশেষ ভুল কিন্তু বলা হবে না। বড়রাই অস্থির হয়ে পড়েন, আর কচিগুলোর কথা না হয় ছেড়েই দিলেন।

  • ঠান্ডালেগে ঘুসঘুসে সর্দি বা ভাইরাল ইনফেকশন এই গলা খুস্খুস করার কারণ হতে পারে।
  • বাচ্চাদের ক্ষেত্রে কখনই কিছু হলেই অ্যান্টিবায়টিক ধরিয়ে দেওয়া ঠিক নয়; এতে শরীরের নিজের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়; তাই সব ধরনের গলা খুসখুসানিতে ওষুধ দেওয়ার মোটে দরকার নেই।
  • ভাইরাসের আক্রমণে গলা খুস্খুস হলে তা বিনা ওষুধেই সেরে যাবে; ৭ দিনের মধ্যেই।
  • বাড়িতে গারগেল করা বা আদা, মধু, তুলসীপাতা দিয়ে চা করে দিন আপনার বাচ্চাটিকে। ঘরোয়া পথ্যেই অনেক আরাম পাবে ও। বারবার খাওয়ান হাল্কা গরম জলও।
  • আর যদি স্ট্রেপটোকক্কাল (Streptococcal) নামের ইনফেকশনটির দরুন এই গলা খুস্খুস হয়ে থাকে; সেক্ষেত্রে ডাক্তারবাবু বাচ্চাকে অ্যান্টিবায়টিক ওষুধ দেবেন।
  • গলা খুস্খুসানিতে খুব কষ্ট পেলে, খাবার খেতে গেলে বমি হয়ে গেলে বা জ্বর এসে গেলে বা নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে গেলেও না সারলে ডাক্তারি পরীক্ষা আবশ্যক। ইনফেকশন হয়েছে কি না; তা বোঝা যাবে ল্যাব টেস্টের মাধ্যমেই। আর ডাক্তারবাবু ঠিক সেভাবেই দেবেন ওষুধ।
  • এই ইনফেকশনের ব্যাকটেরিয়া মূলত হাঁচি, কাশির থেকে ছড়ালেও আক্রান্ত বাচ্চার ব্যবহৃত খেলনা থেকেও ছড়াতে পারে। (Common Childhood Illnesses and Their Treatment)

 

#2. কানে ব্যথা বা কান কটকট (Ear Pain)

সেই যে দাঁত ওঠার সময় থেকে কানে ব্যথা, কান সুড়সুড় করা শুরু হয় ছানাগুলোর; তা যেন চলতেই থাকে বছরভর। এমনিই ছোট্ট বলে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম বলে ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়াও যেন মজা পেয়ে বসে। বারবার সময় নেই, অসময় নেই সুযোগ পেলেই কাবু করে ফেলে ছানাগুলোকে।

  • কানে ব্যথা হওয়ার পিছনে দাঁত ওঠা ছাড়াও যে কারণগুলি অন্যতম তা হল, কানে ইনফেকশন বা ওটিটিস মিডিয়া (otitis media), ক্যানালের স্কিনে ইনফেকশন বা সুইমারস ইয়ার (swimmer’s ear), সাইনাস ইনফেকশন, প্রচণ্ড ঠান্ডালাগা ইত্যাদি।
  • বাচ্চার কানে ব্যথা হওয়ার সাথে সাথে যদি জ্বর আসে বা শরীরে আনুষঙ্গিক আরও অস্বস্তি দেখা দেয়; সেক্ষেত্রে ডাক্তারবাবু যথাযথ পরীক্ষা করে অ্যান্টিবায়টিক ওষুধ দিতে বাধ্য হন।
  • যেসব কানে ব্যথার উৎস ভাইরাস হয়, সেখানে এই জাতীয় কড়া ওষুধের প্রয়োজন হয় না। হাল্কা কাপড় থুপির সেঁক বা ঘরোয়া কিছু পথ্যেই সে আরাম পায়।

 

 

#3. ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন (Urinary Tract Infection)

আমাদের রেচন তন্ত্র দুটি কিডনি বা বৃক্ক, একটি ইউরিনারি ব্লাডার বা মূত্রথলি, দুটি ইউরেটার এবং ইউরেথ্রা বা মূত্রনালী নিয়ে তৈরি। এই রেচনতন্ত্রের কোনও অংশে জীবাণুর সংক্রমণ হয়ে শরীরে যে অসুস্থতা দেখা দেয় তাকে ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন (urinary tract infection) বা UTI বলা হয়।

  • মেয়েদের মূত্রনালীর দৈর্ঘ্য খুবই কম হওয়ায় আক্রমণকারী ব্যাকটেরিয়া খুব সহজেই হামলা করতে পারে রেচনতন্ত্রের অন্যান্য অংশের ওপর। ছেলেদের মূত্র নালীর দৈর্ঘ্য যেখানে ৮ ইঞ্চি, সেখানে মেয়েদের মূত্র নালীর দৈর্ঘ্য মাত্র ১.৫ ইঞ্চি।
  • আবার মেয়েদের পায়ুছিদ্র ও মূত্র ছিদ্র খুব কাছাকাছি থাকে বলে পায়ু থেকেও ব্যাকটেরিয়া সহজেই পৌঁছে যেতে পারে মূত্র নালীতে।
  • বাচ্চাদের ক্ষেত্রে অনেকসময় নিম্নমানের ডায়াপার থেকেও এই মূত্রনালির সংক্রমণ হতে পারে। নিম্নমানের ডায়াপার বাচ্চার পটি, হিসু শুষে নিতে সময় নেয় বা ঠিকমতো পারে না। এর থেকেও ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া শরীরে ক্ষতি করার একটা মস্ত সুযোগ পেয়ে যায়।
  • ইউরিন করার সময় জ্বালা হবে, বাচ্চা বারবার ইউরিনের জায়গায় হাত দেবে, চুলকাতে চাইবে, প্রস্রাব বা ইউরিনের রঙে পরিবর্তন ও দুর্গন্ধ, পেটে ব্যথা, আচমকা জ্বর এই ইনফেকশনের ইঙ্গিত দিতে পারে।
  • প্রচুর পরিমাণে জল খাওয়ান বাচ্চাকে। ৬ মাসের বেশি বয়স হলে আনারস, ক্র্যানবেরি, ব্লুবেরির জ্যুস খাওয়াতে পারেন। ক্র্যানবেরি জ্যুসকে UTI-এর প্রাকৃতিক ওষুধ বলতে পারেন। বাচ্চাকে প্রোবায়োটিক জাতীয় খাবার এবং ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ান।
  • একটা তোয়ালে গরম জলে ডুবিয়ে ভালো করে নিংড়ে নিয়ে বাচ্চার তলপেটে সেঁক দিন। ঘরোয়া উপায়ে বাচ্চা যদি আরাম না পায়, দেরি না করে ডাক্তারি পরামর্শ নিন। (Most Common Childhood Illnesses)

 

#4. ত্বকের ইনফেকশন (Skin Infection)

বাচ্চার ত্বক খুব নরম ও স্পর্শকাতর হওয়ায় ইনফেকশন প্রবণ হয়ে থাকে এটিও।

  • বাচ্চার ত্বকে ফোঁড়া, কালো দাগ, র‍্যাশ বা চুলকানি যাই হোক না কেন, ডাক্তারি পরামর্শ নিন প্রথমেই। কারণ, ত্বকের ওপরে হওয়া যে কোনও অসুবিধায় আপনার বাচ্চা আরামসে হাত দিতে পারবে।
  • যে কোনও ইনফেকশন থেকে অস্বস্তি হলে, সেটা যদি ত্বকের ওপর বা মাথায় হয়; বাচ্চা কিন্তু সহজেই সেখানে হাত দিতে পারবে বা চুলকালে নখ দিয়ে চুলকে নিতেও পারবে। আর তাতে, বিপদ বাড়বে বই কমবে না।
  • একদম ছোট্ট বাচ্চার মাথায় হতে পারে ক্র্যাডল ক্যাপের মতো সমস্যা। নিজে হাতে বা চিরুনি দিয়ে ঘষাঘষি করতে যাবেন না কোনও ভাবেই। আলতো হাতে যত্ন নিন বা প্রথমেই ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
  • আপনাদের পরিবারে যদি এমন কোনও ত্বকের অসুখ থাকে যেটা উত্তরাধিকার সূত্রে বাচ্চার জিনেও আসতে পারে; সেক্ষেত্রে ওর ডাক্তারবাবুকে আগে থেকেই জানিয়ে রাখুন।

 

আরও পড়ুন: অনেক খুদের শরীরেই দুধ সহ্য হয় না। কারণ হতে পারে ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স!

 

#5. সাধারণ সর্দিকাশি (Common Cold and Cough)

 ছোট্ট বাচ্চাদের বছরে প্রায় ৬-৮ বার ঠান্ডালেগে সর্দিকাশি হয়। কাজেই বুঝতে পারছেন, বাচ্চার ক্ষেত্রে এই ঠান্ডালাগাটা কতটা সাধারণ। (Childhood Infectious Diseases)

  • রেস্পিরেটরি ট্র্যাক্ট-এ ভাইরাসের আক্রমণ হলে সর্দি হতে পারে। নাক দিয়ে জল পড়া, হাঁচি, কাশি ৭-১০ দিন থেকে যেতে পারে উপসর্গ হিসেবে।
  • সর্দি জমে গিয়ে যদি বাচ্চার সবুজ কফ ওঠে, তা হলেও কিন্তু ওষুধ যে খেতেই হবে এমনটা নয়। সাধারণ কোনও সর্দি বা ঠান্ডালাগায় বাচ্চাদের কড়া ওষুধ না খাওয়ানোই উচিত। সেক্ষেত্রে ঘরোয়া চ্যবনপ্রাশ বা আদা-গোলমরিচের টোটকার ওপর ভরসা করলেই ফল পাবেন আপনি।
  • কিন্তু যদি এই ধরনের শরীর খারাপ সাইনাস ইনফেকশনের জন্য হয়ে থাকে বা খুব জ্বর আসে, সেক্ষেত্রে অবশ্যই ওষুধ প্রয়োজন, এবং ডাক্তারি তত্ত্বাবধানে। (Common Childhood Illnesses)

 

#6. শ্বাসের সমস্যা (Breasthing Trouble)

ব্রংকাইটিস যেরকম বড়দের বেশি কাবু করে, বাচ্চাদের ক্ষেত্রে সেটা করে ব্রঙ্কিওলাইটিস। শীতের সময় বা ঋতু বদলের সময় এর প্রকোপ বেশি হয়।

  • শ্বাস নেওয়ার সময় শোঁ-শোঁ করে আওয়াজ হয়।
  • এই অসুখটিও ভাইরাসেরই দান এবং প্রাথমিক ক্ষেত্রে কড়া ওষুধ প্রয়োজন হয় না।
  • সতর্কতা ও যত্নেই বাচ্চা আরাম পায়। শ্বাসকষ্ট বা অ্যাজমার ওষুধ এক্ষেত্রে নিতে হয় না। খুব কষ্ট হলে ডাক্তার সাময়িক আরাম দিতে নেবুলাইজার ব্যবহার করতে বলেন।
  • বাচ্চার গায়ের তাপমাত্রা, অন্য শারীরিক কষ্ট বা ডিহাইড্রেশনের কোনও লক্ষণ; এইসব কিছু নিয়ে সতর্ক থাকা বিশেষ জরুরি।
  • আবার সাইনাস যদি ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত হয় সেক্ষেত্রে ব্যাকটেরিয়াল সাইনুসাইটিস দেখা দিতে পারে। সারাক্ষণ নাক থেকে সর্দি পড়া, রগে দপদপে ব্যথা, দিনের বেলাতেও কাশি এসব কিছু একটানা ৭ দিন থেকে যেতে পারে।
  • কফ যদি হলুদ হয়ে যায় এবং তার সাথে জ্বর আসতে থাকে; সেক্ষেত্রে এই সাইনাস সংক্রমণ সারাতে অ্যানটিবায়টিকের প্রয়োজন হয়।

 

#7. পেটের অস্বস্তি (Stomach Infections)

এমনি এমনি, অল্পস্বল্প পেটে ব্যথা হলে ঠিকাছে। কিন্তু এই ব্য়থা বাচ্চাদের কাবু করে ফেলতে পারে গ্যাসট্রএনটেরাইটিস (Gastroenteritis)।

  • বমি, ডাইরিয়া বা তলপেটে ব্যথা ইত্যাদি এর উপসর্গ হিসেবে দেখা দেয়।
  • অনেক রকম ভাইরাস, এমনকি নোরোভাইরাসও এই অসুখ সৃষ্টির অন্যতম কারণ। আর এই ভাইরাসগুলি সহজেই ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে বাচ্চাদের ওপর হানা দিতে এদের সুবিধেই হয়।
  • ডিহাইড্রেশন এড়াতে (Childhood Deseases) এসময় প্রচুর পরিমাণে জল খাওয়া বিশেষ প্রয়োজন তবে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি নয়। এছাড়া ওআরএস এবং যথাযথ ডায়েট মেনে চলা উচিত এসময়ে।
  • সাধারণত কয়েকদিন পরে ঘরোয়া পথ্যেই আরাম পায় বাচ্চা; কিন্তু ডাক্তারের সান্নিধ্যে থাকা একান্ত প্রয়োজন।

বাচ্চার ব্যাপারে সদা সতর্ক থাকুন। টুকটাক উপায়ে কাজ না হলে বা বাচ্চা আরাম না পেলে দেরি না করে ডাক্তারের পরামর্শ দিন। ডাক্তার দেখানো মানেই কিন্তু কড়া ওষুধ খাওয়ানো নয়। প্রয়োজন বুঝলে তবেই তিনি ওষুধ দেবেন। কাজেই ভরসা রাখুন ও চোখ-কান খোলা রাখুন। (Common Childhood Illnesses and Their Treatments)

আরও পড়ুন: সদ্যোজাত খুদের দেখভাল করবেন কীভাবে? মায়ের জন্য রইল কিছু টিপস!

 

একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার  হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

 

null

null