হাতেখড়ির একাল ও সেকাল

হাতেখড়ির একাল ও সেকাল

স্লেট-চক! সে তো কবেকার কথা। খাতা-পেনসিলও যেন বড্ড সেকেলে আজ। বয়স দুই হতে না হতেই আজকালের কচিকাঁচারা ফোন, ট্যাব কিংবা ল্যাপটপ চিনে যায়। বিনোদন আর বিদ্যা অর্জন চলে একই সঙ্গে। ফলে ঘটা করে হাতেখড়ি অনুষ্ঠানের আর তেমন কোনও প্রয়োজনই পড়ে না এখন। বিশেষ করে শহুরে শিশুদের তো নয়ই। কিন্তু অতীতকে আঁকড়ে বাঁচা বাঙালি কি তার শিকড় এত সহজে ছাড়তে পারে? Changing trends of Hatekhori in Bengali.

না, পারে না। বাচ্চা মোটামুটি ইস্কুলে যাওয়ার লায়েক হলে, আনুষ্ঠানিক ভাবে পড়াশোনার পাঠ শুরুর জন্য় এখনও সরস্বতী পুজোর নির্ঘণ্টই খোঁজেন বঙ্গ বাবা-মায়েরা। সক্কাল সক্কাল স্নান সেরে পাটভাঙা বাসন্তী শাড়ি কিংবা হলদে পাঞ্জাবি। যত্ন করে মায়ের সাজিয়ে দেওয়া, আর তারপরই ছোট্ট ছোট্ট, টালমাটাল পায়ে হাতেখড়ির মঞ্চে হাজিরা দেওয়া! কিন্তু সরস্বতী বন্দনার মন্ত্র যে “শ্বেতপদ্মাসনা দেবীশ্বেতপুষ্পপদ শোভিতাশ্বেতাম্বর ধরানিত্যং শ্বেতগন্ধানুলেপন”! এত শ্বেতের মধ্যে হঠাৎ করে এই হলুদের উদয় হল কোথা থেকে! সে রহস্য এখনও কালের গভীরেই থেকে গিয়েছে। এত সাদার মাঝে বাঙালি তার নিজস্ব ঢঙেই আবিষ্কার করে ফেলেছে হলুদ! সে থাক, ফাগুন মাসের শুক্লা পঞ্চমীতে এখনও এভাবেই বিদ্য়ার দেবীর আবাহন করি আমরা। “নমো সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যে কমললোচনে। বিশ্বরূপে বিশালাক্ষ্মী বিদ্যাংদেহি নমোহস্তুতে”- আদো আদো মন্ত্র আওড়ে, স্লেটে বা খাতায় আঁকিবুঁকি কেটে বিদ্য়ার দেবীকেই সাক্ষী ঠাওরে ইঁদুর দৌড় আর প্রতিযোগিতার জাঁতাকলে সামিল হয়ে পড়ে কচিকাঁচার দল। Vasant panchami in West Bengal.

পোশাকি ভাষায় এরই নাম হাতেখড়ি। আম-বাঙালির তেরো পার্বণের আরও একটা পুঁচকে-পার্বণ। সহজভাবে বলতে গেলে খাতা, পেনসিল ও কলম দিয়ে শিশু যেভাবে লেখাপড়া শুরু করে, সেটাই। প্রথামাফিক হাতেখড়ির আগে বাচ্চাকে ছড়া-কবিতা শেখানো যেতেই পারে। তবে পুরোটাই হতে হবে মুখে মুখে, লেখা নৈব নৈব চ! সংস্কার মেনে সরস্বতী পুজোর সকালেই প্রথম ‘কলম’ ধরবে বাড়ির খুদে সদস্যটি। বাচ্চার হাতে খড়িমাটি ধরিয়ে বাড়িরই বড় কেউ বর্ণের সঙ্গে পরিচয় করায় ওর। স্লেটে একটা গোটা অক্ষর লিখে ফেলতে পারলেই কেল্লাফতে। হাতেখড়ির পালা শেষ, যুদ্ধ শুরু লেখাপড়ার। বাচ্চার বয়স পাঁচ হলেই সাধারণত হাতেখড়ির এই অনুষ্ঠান করা হয়। অন্যথায় অন্য কোনও কারণে আগেও হতে পারে। অনুষ্ঠানপর্ব মিটতে দেরি, তোড়জোড় পড়ে যায়, কোন স্কুলে এবার ভর্তি হবে একরত্তি! সংজ্ঞা লিখতে গেলে এই হল হাতেখড়ির আদ্যোপান্ত।

যুগ বদলালেও ধরনটা আছে একই। তবে ধরন এক থাকলেও যুগের তালে হুজুগের কিছু বদল হয়েছে বই কি। হাতেখড়ি আর আর পাঁচটা পারিবারিক জমায়েতের মতো নয় এখন। এতো এখন রীতিমতে সেলিব্রেশনের ব্যাপার। ছোটরাই সে দিনের অনুষ্ঠানের মধ্য়মণি। লোকটা-জনটা, পাড়া-পড়শি, বন্ধু-বান্ধব ডেকে হই হই ব্যাপার! লুচি-বাঁধাকপি আর শুকনো বোঁদে-সহযোগে এক বিরাট আয়োজন। খাগের কলম কালিতে ডুবিয়ে লিখতে ঠিক কেমন লাগে, সে স্বাদের ভাগ হয়তো মিলবে না এখানে। কালিভরা নিবের কলমও হয়তো দেখা দেবে না। তবে দেখা মিলতে পারে বিদেশি পার্কার কিংবা শেফার্ড পেনের। শিকড় আঁকড়ে বাঁচার তাগিদে সেটাই বা কম কী!

দিদি-ঠাম্মারা গপ্পো করতেন, একবার নাকি হাতেখড়ি হয়ে গেলেই ইস্কুলের জন্য় মন কেমন কেমন করে উঠত তাঁদের। জলদি জলদি নতুন বন্ধু করার তাগিদে তেঁতুল-দানায় চলতো অক্ষর শেখার অভ্যাস! সে সব এখন অতীত। কালের নিয়মে অতীত হয়েছে মায়েদের আমলের স্লেট-চকও। আর তারই সঙ্গে পাততাড়ি গুটিয়েছে কালির কলমের চাপে মধ্য়মা আঙুলের কড়াটাও! থেকে গিয়েছে কেবল বাঙালির আরও বেঁধে বেঁধে থাকার পুরোনো অভ্যাসটা।
আর? আর থেকে গিয়েছে হাতেখড়ি। সে বর্ণেই হোক কিংবা বইয়ে, কিংবা বন্ধুত্বে কিংবা ব্যবসায় কিংবা বাসায় কিংবা বাঙালিয়ানায়…

একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার  হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

null

null