ছোট্ট সোনাকে পৃথিবীতে আনতে সিজার? কীভাবে নিজের যত্ন নেবেন, দ্রুত ফিরবেন আগের জীবনে?

ছোট্ট সোনাকে পৃথিবীতে আনতে সিজার? কীভাবে নিজের যত্ন নেবেন, দ্রুত ফিরবেন আগের জীবনে?

মাত্র ছ’দিন হল পামেলা মা হয়েছে। ওর ছোট্ট সোনার নাম রেখেছে সায়ন, ডাকনাম সোনু। সোমক আর ওর প্রথম সন্তান। বিয়ের দীর্ঘ পাঁচ বছর পর আজ ওরা মা-বাবা হয়েছে। তাই বাড়িতে আনন্দের বন্যা। সোনুর হওয়ার দিনটা পামেলার সারা জীবন মনে থাকবে। ছোট থেকেই পামেলা শুনত মা হওয়াটা বড় পরীক্ষা। সত্যি যেন ও একটা বড় পরীক্ষায় পাশ করলো। (Cesarean Delivery; Home Remedies to Recover Fast)

ওই দিন সকালে ও বাড়িতে চা করছিল। চা করতে করতে পেটের কাছে হঠাৎই তীব্র ব্যথা হতে থাকে, ব্যথায় কুঁকড়ে ওঠে ও। সোমক বাড়িতেই ছিল। ও তখনই চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে। তাঁর পরামর্শ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় পামেলাকে। ডাক্তার জানান, সোনুর জন্ম সিজারিয়ান ডেলিভারির মাধ্যমেই হবে। (C-Section: Tips for a Fast Recovery ) সেদিন অপারেশনের সময় পামেলাকে অ্যানেসথেসিয়া দেওয়া হয়। তবে অ্যানেসথেসিয়া দিলেও ব্যথা যে নর্ম্যাল ডেলিভারির থেকে একচুলও কম নয়, তা ও বুঝেছিল জ্ঞান ফেরার পর।

ঘোর কাটতে না কাটতেই তীব্র যন্ত্রণায় কুঁকড়ে উঠছিল শরীরটা। ছোট্ট সোনুর মুখ দেখে মনটাকে শান্ত করছিল, ওকে পৃথিবীতে আনার জন্যই তো এত কষ্ট সহ্য করা। বাড়ি ফেরার আগে সোমক পামেলার ব্যাপারে চিকিৎসকের সঙ্গে বিস্তারিত কথা বলে নেয়। সিজার হলে মায়ের সেরে উঠতে বেশ খানিকটা সময় লাগে। চিকিৎসক তাই নিয়মের একটা লম্বা তালিকা করে দিলেন। (Ways to Improve Recovery After a C-Section) একই সঙ্গে বললেন ক্ষত না সারা পর্যন্ত এই নিয়মের মধ্যেই থাকতে হবে পামেলাকে।

পামেলার মতো যাঁরা সিজারের মাধ্যমে মা হন, তাঁদের সবার মনে একটাই চিন্তা। কত তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ছোট্ট সোনার সব কাজে হাত লাগানো যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, সিজারের পর ক্ষত সারতে অন্তত দেড়মাস সময় লাগে। আর এই সময়টা কিছু নিয়ম মেনে চলতেই হবে। (Cesarean Section (Aftercare Instructions)) চলুন দেখে নেওয়া যাক, চিকিৎসকের লম্বা তালিকায় কী কী পরামর্শ ছিল পামেলার জন্য।

 

সিজারিয়ান ডেলিভারির পর দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠার ঘরোয়া টিপস (Natural Tips for Recovering from C-Section Surgery)

 

#1. সাবধানে স্তন্যপান: সিজারিয়ান ডেলিভারির পর শিশুকে স্তন্যপান করানো মায়েদের কাছে একটা বড় চ্যালেঞ্জ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সময় মায়েদের উচিত চেয়ারে বসে শিশুকে দুধ খাওয়ানো। কারণ এতে শিরদাঁড়া সোজা থাকে। সামনের দিকে ঝুঁকে দুধ খাওয়ালে পেটের কাটা জায়গায় চাপ পড়ে। এতে ওই অংশের পেশির বিন্যাস নষ্ট হতে পারে। তাই দুধ খাওয়ানোর সময় যতটা সম্ভব মেরুদন্ড সোজা রাখা উচিত।

 

#2. ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার: মা হওয়ার পর ছোট্ট সোনার দেখভাল নিয়েই আপনি ব্যস্ত। ভাবুন তো এর মধ্যে হঠাৎ যদি কোষ্ঠকাঠিন্য হয়! শুনতে অবাক লাগলেও কোষ্ঠকাঠিন্য সিজারিয়ান ডেলিভারির পর স্বাভাবিক ঘটনা। কাটা জায়গা শুকোতে যে অ্যান্টিবায়োটিক, পেইনকিলার ইত্যাদি খেতে হয়, তাদেরই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হল কোষ্ঠকাঠিন্য। একারণেই চিকিৎসকরা মাকে ছুটি দেওয়ার সময় মনে করিয়ে দেন ফাইবার সমৃদ্ধ খাবারের কথা। কারণ ফাইবার মানবদেহের পৌষ্টিকতন্ত্রের কাজকে সহজ করে দেয় ও খাবার হজমে সাহায্য করে। তাই শাকসবজি, ওটস-এর মতো খাবার দিয়ে সাজাতে হবে মায়ের প্লেট। (Home Remedies for Recovery after Cesarean Delivery)

 

#3. প্রচুর তরল খান: সিজারের মাধ্যমে ছোট্ট সোনা হওয়ার পর প্রত্যেক মা-ই কোষ্ঠকাঠিন্যের সম্মুখীন হন‌। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওষুধের পাশাপাশি তরলের অত্যাধিক ক্ষরণও এর কারণ। সিজারিয়ান ডেলিভারির সময় মায়ের শরীর থেকে প্রচুর পরিমাণে ফ্লুইড বেরিয়ে যায়। যার ফলে শরীরে তরলের ভারসাম্য নষ্ট হয়। তাই ফ্লুইডের পরিমাণ ঠিক রাখতে চিকিৎসকরা প্রচুর পরিমাণে তরল পানীয় যেমন বিভিন্ন ফলের রস খাওয়ার পরামর্শ দেন। ফলের রসের পাশপাশি এই সময় প্রতিদিন অন্তত তিন থেকে চার লিটার জল খাওয়া উচিত।

 

#4. এসেন্সিয়াল তেলের গন্ধ: প্রেগন্যান্সির সময় ও সন্তানের জন্ম দেওয়ার পর মানসিক চাপ কাটাতে চিকিৎসকরা এসেন্সিয়াল তেলের কথা বলেন। (C Section Recovery) এই তেলের সুগন্ধ‌‌‌ নিয়মিত নিলে মানসিক দুশ্চিন্তা কেটে গিয়ে মন শান্ত হয়। সিজারিয়ান ডেলিভারি হলে মায়েরা এই তেলের সুগন্ধ নিতে পারেন। এতে ক্ষত অংশের ব্যথা কিছুক্ষণের জন্য হলেও ভুলে থাকা যায়।

 

#5. পুষ্টিকর খাবার খান: মায়ের শরীর সবেমাত্র বড় আকারের ধকল সহ্য করেছে। তাই শরীরকে আগের মতো সুস্থ স্বাভাবিক করে তুলতে দরকার পুষ্টিকর খাদ্য। সিজারিয়ান ডেলিভারির সময় শরীরের প্রচুর পেশি এবং কোষের ক্ষতি হয়। যা সারিয়ে তুলতে দরকার পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রোটিন, ভিটামিন ও ফাইবার সমৃদ্ধ ডায়েট। (How to Heal Faster from a C Section) সিজার হওয়ার পর তাই মায়ের প্লেটে থাকুক ওটস, ডাল, মাছ, ডিম, আমন্ড ও বিভিন্ন ধরনের ফল।

 

আরও পড়ুন: সি সেকশন ডেলিভারি হতে চলেছে? জেনে রাখুন এগুলো

 

#6. অল্প হাঁটুন: সিজারিয়ান ডেলিভারির পর মায়েদের শিরায় রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই কাটা জায়গা শুকোনোর সঙ্গে সঙ্গে অল্প হলেও কিছুক্ষণ হাঁটাচলা করার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা। হাঁটাচলার ফলে সারা শরীরে রক্তের সরবরাহ ঠিক থাকে, রক্ত জমাট বাঁধার আশঙ্কা থাকে না। পাশাপাশি পৌষ্টিকতন্ত্রে হজমের কাজও ঠিকঠাক হয়। বিশেষজ্ঞরা বলেন, ছোট্ট সোনার জন্মের দুই-তিন সপ্তাহ পর থেকে প্রতিদিন ৩০ মিনিট হাঁটাহাঁটি করা উচিত। তবে সিঁড়ি বেয়ে ওঠানামা বা খুব জোরে হাঁটবার কোনও প্রয়োজন নেই। এতে ক্ষতি হতে পারে ক্ষতস্থানের পেশিগুলির।

 

#7. ভালো সময় কাটান: শিশুর জন্মের পর মায়ের শরীরে খুব দ্রুত হরমোনের হেরফের ঘটতে থাকে। তার উপর সিজারিয়ান ডেলিভারি। এই দুই মিলে মায়ের মানসিক অবস্থা থাকে দুর্বল। তাই চিকিৎসকদের মতে, মা হওয়ার পর যেটুকু অবসর সময় পাওয়া যাবে, সেই সময়টা নিজের পছন্দের হবি নিয়ে বা প্রিয় বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করে কাটান। (C-Section Recovery; Natural Tips for Healing ) এতে যেমন মন ভালো থাকে, তেমনই ক্ষতস্থানের ব্যথা সহ্য করার জন্য দরকারি মানসিক দৃঢ়তাও পাবেন

 

#8. ভারী কাজ বন্ধ: সিজারিয়ান ডেলিভারির পর ভারী জিনিস তোলা বা বয়ে এদিক থেকে ওদিক নিয়ে যাওয়া একবারেই উচিত নয়। এতে পেটের পেশিগুলোতে অত্যন্ত চাপ পড়ে যার ফলে বড়সড় ক্ষতি হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুর থেকে বেশি ভারী এমন কোনও জিনিসই তোলা উচিত নয় এই সময়ে। ছোট্ট সোনার কাজের ক্ষেত্রেও বাড়ির লোকের সাহায্য নেওয়াই ভালো।

 

#9. যৌন মিলন নয়: সিজারিয়ান ডেলিভারির পর বেশ কিছু মাস মোটেই সঙ্গমে লিপ্ত হওয়া উচিত নয় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এই সময় যৌন মিলনের ফলে পেলভিক অঙ্গগুলোয় প্রচন্ড চাপ পড়ে যা মায়ের স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়। শরীরের ভিতরের ক্ষত সারতেও বেশ কিছুটা সময় লেগে যায়। (Home Remedies for C Section Recovery) তাই এই সময় সঙ্গমরত হলে ক্ষতিগ্ৰস্ত পেশিগুলোর আরও ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

 

#10. সাবধানে হাঁচি কাশি: বিশেষজ্ঞদের মতে, হাঁচি বা কাশি পেলেই আগের মতো আর নিরাপদে হাঁচা বা কাশা যাবে না। হাঁচি বা কাশি হল শরীরের এক তাৎক্ষণিক প্রতিবর্ত ক্রিয়া। এই প্রতিবর্ত ক্রিয়ার উপর এই সময় নিয়ন্ত্রণ রাখা জরুরি। নয়তো পেটের ক্ষতিগ্ৰস্ত পেশিতে টান লেগে ব্যথা হতে পারে। এমনকী এতে পেশির বড় ক্ষতিও হতে পারে। তাই সিজারের পর ক্ষত না সেরে ওঠা পর্যন্ত হাঁচি বা কাশির ক্ষেত্রে সাবধান থাকুন।

 

কী কী বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে এবং কোন কোন পদ্ধতি আপনাকে দ্রুত সারিয়ে তুলবে, তা তো জানা হল। (Cesarean Operation) কিন্তু এরপরেও কখনও কখনও চিকিৎসকের কাছে যেতেই হবে। কী অবস্থায় চিকিৎসকই একমাত্র ভরসা, এক ঝলকে দেখে নেওয়া যাক সেটাও।

 

 

কখন ডাক্তার ডাকবেন (When to Call Doctor)

সিজারের পর সব নিয়ম মানলেও শরীর সব সময় সঙ্গ দেয় না। অনেক সময় দেখা যায় ক্ষতস্থান সেরে ওঠার বদলে সেখানে ছড়িয়ে পড়েছে সংক্রমণ বা ইনফেকশন। যার কারণ হতে পারে জীবাণু বা শরীরের ভিতরের কোনও সমস্যা। এমন পরিস্থিতি সামাল দিতে চিকিৎসকই ভরসা। সংক্রমণের লক্ষণগুলো হল:

  • কাটা জায়গা লাল: কাটা জায়গা কতটা শুকোচ্ছে তা প্রতিদিন নজরে রাখুন। যদি কাটা জায়গা বরাবর কোনও অংশ লাল হয়ে যায়, তবে অবশ্যই চিকিৎসককে তা জানান (C-Section Risks & Complications)।

 

  • যোনিপথ দিয়ে ক্ষরণ: বাথরুমে গেলে খেয়াল রাখুন যোনি দিয়ে কোনও দুর্গন্ধযুক্ত ক্ষরণ হচ্ছে কি না‌। দুর্গন্ধযুক্ত ক্ষরণ বা প্রচন্ড রক্তপাত— কোনওটাই মায়ের শরীরের জন্য ভালো লক্ষণ নয়। এমন ঘটনা ঘটলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

 

  • জ্বর: সিজারের ব্যথা থাকলেও ছোট্ট সোনাকে নিয়ে কেটে যাচ্ছে সারাদিন। এরই মধ্যেই হঠাৎ জ্বর হল, আর তাপমাত্রাও একশোর বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্ষতস্থানে সংক্রমণ হচ্ছে কি না তা অনেকসময় বোঝা যায় না। তবে জ্বর সংক্রমণেরই একটি লক্ষণ। তাই এই সময় দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। (Complications of Cesarean Deliveries)

 

সোনুর মুখ চেয়েই প্রায় দেড়মাস সব ব্যথা সহ্য করেছিল পামেলা। ব্যথার কথা অতটা মাথাতেই আসত না ওর। তবে সোমক সব সময় চোখে চোখে রাখত পামেলাকে। চিকিৎসকের কথা মতো চলায় দেড়মাসের আগেই ক্ষতস্থান অনেকটা শুকিয়ে যায়। আপনার ছোট্ট সোনাও তো সিজারিয়ান বেবি!

তাই আপনাকে পামেলার মতোই নিজের প্রতি নজর রাখতে হবে। কারণ আপনি ভালো না থাকলে আপনার ছোট্ট সোনা যে মোটে ভালো থাকবে না। (Cesarean Delivery; Home Remedies to Recover Fast)

 

আরও পড়ুন: সিজারিয়ান ডেলিভারি; জরুরি অবস্থা না ঐচ্ছিক সিদ্ধান্ত!

 

একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার  হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

null

null