সন্তানধারণে অক্ষমতা? নারীই একা দায়ী নয় সবসময়!

সন্তানধারণে অক্ষমতা? নারীই একা দায়ী নয় সবসময়!

প্রথমেই বলে রাখি, আজকের এই প্রতিবেদন কিন্তু আমাদের অর্থাৎ মেয়েদের জন্য নয়। এই প্রতিবেদনটি আমাদের প্রত্যেকের নিজেদের ভালোবাসার মানুষটির জন্য, আমাদের পাশে ছায়া হয়ে থাকা আমাদের প্রত্যেকের জীবনসঙ্গীর জন্য। সময় বিশেষে সবরকম সাপোর্ট দেওয়া, মনোবল বাড়ানো এবং একজন উপযুক্ত বন্ধুর মতো পাশে থাকাই তো একজন উপযুক্ত সহধর্মিণীর কর্তব্য। তাই, এই প্রতিবেদনটি সব বন্ধুরা মন দিয়ে পড়ুন এবং আপনার সঙ্গীকেও পড়তে দিন। হতে পারে, আপনাদের কোনও সমস্যার সমাধান পেয়ে গেলেন এখানেই, বা আগামী সমস্যা এড়াবার হাল-হদিস পেয়ে সতর্ক হয়ে গেলেন এখন থেকেই। দুদিকেই  আপনাদের দু’জনেরই লাভ। তাই না? Male Infertility: Causes and treatment or purusher bondhatyo in Bangla.

 

পুরুষের বন্ধ্যাত্ব প্রতিরোধের উপায় (Male Infertility: Causes and Prevention)

শুনতে আমাদের খারাপ লাগতে পারে, কিন্তু এখনও আমাদের সমাজের একাংশ মহিলাদেরই একটা বাচ্চা জন্ম দেওয়ার হর্তা কর্তা বিধাতা ভেবে থাকে। বাচ্চা হচ্ছে না, সব মহিলার দোষ; ছেলে না হয়ে মেয়ে হলো, তাও মহিলার দোষ। কিন্তু এমনটা যে একটুও না, সেটা আদৌ ক’জন জানেন? আর যারা জানেন, তারা মন থেকে কতটা মানেন তাতে বড্ড সন্দেহ আছে। নিশ্চয় জানেন, বিজ্ঞান এরকম বলে না। একটা বাচ্চার জন্ম অবশ্যই তার মা দেয়, কিন্তু তাকে সৃষ্টির পিছনে মা ও বাবা উভয়েরই গুরুত্ব সমান। অনেকদিন ধরে চেষ্টা করেও কনসিভ না করতে পারলে, আমাদের সমাজ প্রথমেই মহিলার দিকে আঙুল তোলে এবং বন্ধ্যার তকমা লাগিয়ে দেয়। জানেন কী? এই বন্ধ্যাত্ব মহিলাদের একচেটিয়া রোগ-সম্পত্তি নয়, পুরুষরাও ভুগতে পারেন বন্ধ্যাত্বের সমস্যায়। একজন পুরুষের শারীরিক সমস্যার কারণে সন্তানধারণে সম্পূর্ণ সক্ষম এক মহিলা কনসিভ করতে পারেন না। পুরুষদের বন্ধ্যাত্বের সমস্যা ও সমাধান সংক্রান্ত আলোচনা নিয়েই আজ এই প্রতিবেদন। নিজে পড়ুন এবং সঙ্গীকেও পড়তে দিন।   

 

পুরুষদের বন্ধ্যাত্ব (purusher bondhatyo) আগে থেকে বোঝার কোনও উপায় আছে কী?

সাধারণত দেখা যায়, সন্তানধারণে অক্ষম দম্পতিদের মধ্যে ৩৫ শতাংশ ক্ষেত্রে মহিলা দায়ী থাকেন আর ৩৫ শতাংশ ক্ষেত্রে পুরুষ দায়ী থাকেন। বাকি ৩০ শতাংশের মধ্যে ২০ শতাংশ ক্ষেত্রে উভয়েই দায়ী থাকেন আর ১০ শতাংশর ক্ষেত্রে কোনও নির্দিষ্ট কারণ জানা যায় না। পুরুষদের এই বন্ধ্যাত্ব রোগ  বোঝার একটাই লক্ষণ; প্রোটেকশন ছাড়া সম্পূর্ণ সুস্থ মহিলা সঙ্গীর সাথে বারবার সহবাস করার পরেও সন্তান না আসা।

আরও পড়ুন (Also Read): Reason for not getting pregnant

পুরুষদের বন্ধ্যাত্বের কারণগুলি কী কী? (Causes of Male Infertility in Bengali)->

পুরুষদের মধ্যে বন্ধ্যাত্বের কারণগুলিকে আমরা মোটামুটি তিন ভাগে ভাগ করতে পারি;

#1. শারীরিক অসুস্থতা (Medical problems)-> পুরুষের বন্ধ্যাত্বের জন্য দায়ী শারীরিক সমস্যাগুলি হল; স্পার্ম-এর গুণগত মান ও পরিমাণ দুইয়ের ওপরই নির্ভর করে মহিলার কনসিভ করা। পুরুষের প্রতি মিলিলিটার সিমেনে ১৫ মিলিয়ন বা ১৫০ লাখের কম স্পার্ম থাকলে তাকে “লো স্পার্ম কাউন্ট” বলে। আর এই অসুস্থতাকে অলিগোজুসপারমিয়া (oligozoospermia) বলে।

  • যৌনরোগের কারণে হওয়া ইনফেকশন।
  • Varicocele রোগের প্রভাবে স্পার্ম-এর গুণগত মান কমে যাওয়া।
  • ইজাকুলেশনের সময় সমস্যার জন্য; একে ডাক্তারি ভাষায় Retrograde ejaculation বলা হয়। এক্ষেত্রে, মিলনের চরম মুহূর্তে, সিমেন ব্লাডারে চলে যায় এবং ইজাকুলেশন হয় না। স্পাইনাল কর্ডে আঘাত, ডায়াবেটিস, বিশেষ কোনও ওষুধের প্রভাবে এবং ব্লাডারে ও প্রোস্টেটের অস্বাভাবিকতার ফলে এমনটা হয়ে থাকে।  
  • অণ্ডকোষের অস্বাভাবিকতা।
  • শরীরে হরমোনের মাত্রাজনিত সমস্যা। টেস্টোস্টেরোন হরমোন কম উৎপন্ন হলে বা থাইরয়েড, অ্যাড্রিনাল ও পিটুইটারি গ্রন্থি ঠিকমতো কাজ না করলে পুরুষের শরীরে হরমোনের মাত্রার ওঠা-পড়া হয়। এরই পরোক্ষ প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় পুরুষের জননতন্ত্র।
  • অজান্তে যদি এমন কিছু ওষুধ দীর্ঘদিন ধরে পুরুষ খেয়ে থাকেন, যার ফলে শরীরে শুক্রাণু বা স্পার্ম তৈরি হওয়া কমে যায়, তা হলেও বন্ধ্যাত্ব আসে।
  • ক্রোমোজোমাল সমস্যার জন্য বা আগে কোনও বিশেষ অপারেশন হলে।
  • স্পার্ম বের হওয়ার রাস্তায় কোনও কারণে ব্লকেজ তৈরি হলে।
  • স্পার্ম-এর গতি কম হলে।
  • এছাড়া, কোনও টিউমার থাকলে বা শারীরিক কোনও বড় অসুস্থতায় ভুগলে পুরুষের প্রজনন ক্ষমতা কমে যায়।  

 

#2. পরিবেশের প্রভাব (Environmental effect)-> আশেপাশের পরিবেশ ও কাজের জায়গার পরিবেশ পুরুষদের প্রজনন ক্ষমতায় বিশেষ ভূমিকা নেয়; যেমন,

  • যদি পুরুষ এমন কোনও জায়গায় কাজ করেন, যেখানে অণ্ডকোষ অনেকটা সময় উত্তপ্ত থাকে অর্থাৎ খুব গরম পরিবেশে একনাগাড়ে কাজ।
  • ইন্ডাস্ট্রিতে ব্যবহার হওয়া কিছু কেমিক্যাল যেমন টলুইন, বেঞ্জিন, জাইলিন, পেস্টিসাইডস ইত্যাদি নিয়ে বেশি কাজ করলে স্পার্ম সংখ্যায় কমে।
  • ক্ষতিকারক রেডিয়েশন ও ধাতুর প্রভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হয় পুরুষের জননতন্ত্র।

 

#3. নিম্নমানের জীবনযাত্রা ও অন্যান্য (Lifestyle and others)->

  • অতিরিক্ত মদ্যপান।
  • ড্রাগসেবন ও অতিরিক্ত ধূমপান।
  • অত্যধিক ওজন।
  • অতিরিক্ত স্ট্রেস।
  • মানসিক চাপ ও ডিপ্রেশনের প্রভাব।
  • সবসময় টাইট অন্তর্বাস পরে থাকা।
  • পারিবারিক ধারায় অণ্ডকোষের সমস্যা।
  • পুরুষের বয়স ৪০-এর বেশি হলে।

 

কীভাবে শনাক্তকরণ হয়? (How to diagnose male infertility)

  • সিমেন অ্যানালিসিসের মাধ্যমে শুক্রাণু বা স্পার্ম-এর গুণগত মান ও পরিমাণ বোঝা যায়।
  • Scrotal ultrasound নামে একটা বিশেষ পরীক্ষায় অণ্ডকোষ সংক্রান্ত সব অস্বাভাবিকতা শনাক্ত করা যায়।
  • এছাড়াও হরমোনের মাত্রা পরীক্ষা করে, Post-ejaculation urinalysis পরীক্ষা, Testicular biopsy ও জেনেটিক কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে পুরুষের বন্ধ্যাত্বের কারণ শনাক্ত করা হয়।

 

কী কী পদ্ধতিতে চিকিৎসা হয়? (Types of Treatments for Male Infertility)

আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্র অনেক উন্নত হওয়ায়, যে কোনও সমস্যার চিকিৎসা করানোর সুযোগও অনেক বেশি। পুরুষদের বন্ধ্যাত্ব রোগেরও বিশেষ চিকিৎসা হয়ে থাকে। বিশেষ অপারেশনের মাধ্যমে, হরমোনের ওষুধ প্রয়োগ করে চিকিৎসা করা হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে পুরুষের স্পার্ম সংগ্রহ করে তারপরে সবথেকে ভালো গুণমানের কয়েকটি স্পার্ম বিশেষ উপায়ে বাছাই করে মহিলার শরীরে যোনিপথ দিয়ে বিশেষ উপায়ে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। চিকিৎসার পরেও স্বাভাবিক উপায়ে মহিলা কনসিভ করতে না পারলে এই পদ্ধতি বা IVF-এর সাহায্য নেওয়া হয়। অনেক ক্ষেত্রে নেওয়া হয় ডোনার স্পার্ম। তবে, এক্ষেত্রে দম্পতির সম্মতি নিয়েই সব চিকিৎসা করা হয়।

 

কিছু বিশেষ তথ্য পুরুষদের জন্য (Some more to remember)

  • প্রতিদিন কিছুটা হলেও হাঁটাহাঁটি বা ব্যায়াম করা উচিত। অতিরিক্ত ওজন শুধু এইসব ক্ষেত্রেই নয়, ডেকে আনতে পারে আরও অনেক গভীর রোগ।
  • অতিরিক্ত মদ্যপান, ধূমপান থেকে বিরত থাকুন।
  • যদি আপনার কাজের জায়গা স্বাস্থ্যকর না হয়, তা হলে প্রয়োজনীয় সতর্কতা নিন।
  • অন্তর্বাস নিয়মিত বদলে ফেলুন এবং খুব টাইট অন্তর্বাস অনেকক্ষণ পরে থাকবেন না।
  • নিয়মিত সহবাস করুন।
  • সহবাসের সময় লুব্রিকেনট ব্যবহার করবেন না। বেশির ভাগ  লুব্রিকেনট স্পার্ম-এর গতি কমিয়ে দেয় ও স্বাভাবিক চলাচলে বাধা দেয়। এমন কিছু লুব্রিকেনট ব্যবহার করুন, যা স্পার্ম-এর কাজে কোনও বাধা সৃষ্টি করবে না। প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
  • অতিরিক্ত স্ট্রেস নেবেন না, প্রয়োজনে মেডিটেশন করুন।
  • পেস্টিসাইড, ক্ষতিকর রশ্মি, অন্যান্য টক্সিন ও ভারী ধাতুর প্রভাব থেকে দূরে থাকুন।
  • নিজে নিজে কোনও সাপ্লিমেনট বা ওষুধ দীর্ঘদিন ধরে খাবেন না। প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
  • নিজের শরীরে অস্বাভাবিক কোনও পরিবর্তন লক্ষ্য করলে তা ডাক্তারকে জানান।
  • ডাক্তারের সাথে খোলাখুলি ভাবে কথা বলুন। এটা একটা সমস্যা মাত্র, এতে লজ্জা পাওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই। শরীর মাত্রেই সমস্যা আসবে। তাই লুকিয়ে রেখে ডিপ্রেশন বাড়াবেন না বা সঠিক কারণ না জেনে সঙ্গীকে দোষারোপ করবেন না।

        সঠিক সময়ে সচেতন হলে চিকিৎসা সম্ভব বই কি। তাই নির্দিষ্ট সময়ের পরে কনসিভ না করলে দু’জনেই সবকিছু পরীক্ষা করিয়ে নিন। তাতে, বিভ্রান্তিও কম থাকে আর ফলও ভালো হয়।

      

আরও পড়ুন (Also Read): Female Infertility Casues and Remedies

একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার  হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

null

null