ডায়াপার র‍্যাশ কেন হয়; জেনে নিন প্রতিরোধ ও সহজে সারিয়ে তোলার ঘরোয়া উপায়!

ডায়াপার র‍্যাশ কেন হয়; জেনে নিন প্রতিরোধ ও সহজে সারিয়ে তোলার ঘরোয়া উপায়!

সক্কাল সক্কাল ছানার কান্না শুনে ঘুম ভেঙে গেল মায়ের। ডায়াপারটা ভেজা সপসপে দেখে যেই না ভাঁজটা খোলা, অমনি আরও জোরে চিৎকার একরত্তির! ডায়াপার পুরো খোলার পর হলো রহস্যের সমাধান!

একরত্তির পাছুজুড়ে বেরিয়েছে গুড়িগুড়ি লালচে ফুসকুড়ি। সামান্য ফুলেও গেছে বেচারার ছোট্ট পশ্চাৎপ্রদেশ, সেই সঙ্গে জায়গাটা আবার হালকা গরমও!

নতুন মা তো ভেবেই অস্থির! এত্ত যত্ন, এত্ত পরিচ্ছন্ন রাখা, তা-ও কোথা থেকে এমন ছাইপাশ আক্রমণ করল তার শিশুর শরীরে?

বাইরে থেকে নয় গো, নতুন মা তোমারই সামান্য গাফলতিতে ভেজা, নোংরা ডায়াপার থেকে র‌্যাশ বেরিয়েছে ছোট্ট সোনার শরীরে। ভয়ের কিছু নয়, ঘরোয়া কিছু টোটকা ব্যবহার করলেই দু-তিন দিনে আরাম পাবে ও। তার পরেও যদি না সারে, ডাক্তারবাবু তো আছেনই! (What Causes Diaper Rash? Treatment, Home Remedies in Bangla. Shishur diaper rash er ghoroa protikar.) 

র‌্যাশ এড়াতে ভাবছেন আগের সেই কাঁথা, নেকড়াই ভালো ছিল? তা হলে বলবো,  এ তো বেড়ালের উপর রাগ করে মাটিতে ভাত খাওয়ার সমান। আপনার শিশু যদি খুবই ছোট হয়, তা হলে খুবই ঘনঘন প্রস্রাব-পটি করে করবে ও। কতবার কাঁথা ধোবেন আপনি? কত বারই বা রোদে শুকাবেন? আর যদি রোদ না ওঠে তখন? তাই বলব, নিশ্চিন্তে ডায়াপার ব্যবহার করুন, সেই সঙ্গে খানিক সচেতনও থাকুন। যেমন কেনা ডায়াপারটি যেন শিশুর ওজনের সঙ্গে সেটি যেন সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, ভালো মানের হয়! এরই সঙ্গে প্রয়োজন ডায়াপার পরানো, খোলানোর সময়ে মায়ের কিছু পারদর্শীতা! আজকের প্রতিবেদনে সেই সব নিয়েই আলোচনা করব আমরা। পড়ে নিলেই কেল্লাফতে! আসুন, সবার আগে জেনে নিই, ডায়াপার র‌্যাশ  বিষয়টা আসলে কী; (What Causes Diaper Rash? Treatment, Home Remedies in Bangla)

 

ডায়াপার র‌্যাশ আসলে কী (What is Diaper Rash) 

ডায়াপার র‌্যাশ আর কিছুই নয়, শিশুর ত্বকে র‌্যাশ বা অ্যালার্জির প্রকোপ, যার ফলে চুলকানি, জ্বালাপোড়া হয়। শিশুর ডায়াপারের নীচে, গোপন-ঢাকা জায়গাগুলোতেই মূলত এদের ঘোরাফেরা। ঈস্ট (ছত্রাক), ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস, কিংবা অ্যালার্জি সৃষ্টিকারী রাসায়নিক উপাদান (সাবান বা পারফিউম থেকে) থেকে এরকম হতে পারে। শিশুর ডায়াপারের নীচের ত্বকে যদি লাল গুটির মতো দেখতে পান, নিঃসন্দেহে উপসংহার টানতে পারেন, ডায়পার র‍্যাশই হয়েছে ওর।

ডায়াপার র‍্যাশের ফলে শিশুর কোমল ত্বক লালচে আঁশযুক্ত হয়ে পড়ে। অনেক সময় জায়গাটি সামান্য গরম হয়ে থাকে। কখনও কখনও এই র‍্যাশ শিশুর পেট, থাই পর্যন্তও ছড়িয়ে যায়।  

ডায়াপার পরানোর জায়গায় অল্প খোঁচা খোঁচা কালচে দাগ দেখলেও অবজ্ঞা করবেন না, ডায়াপার র‌্যাশেরই পূর্বাবস্থা সেটা। ছুঁলে দেখবেন জায়গাটা হালকা ফোলা, আর হাত দিলেই অস্বস্তি হচ্ছে শিশুর বা বেজায় কাঁদছে সে!

 

শিশুর ডায়াপার র‍্যাশ কেন হয়? (Causes of Baby Diaper Rash in Bengali)

নতুন কোনও খাবার কিংবা শিশুর নিজেরই প্রসাব! ডায়াপার র‍্যাশ ছড়াতে পারে নানান উদ্ভট কারণে। দেখে নিন সেগুলো;

 

#1. ডায়াপার যদি ভেজা থাকে (Wet Diapers): নিম্নমানের ডায়াপার ব্যবহার করলে খুব তাড়াতাড়িই সেটা ভরে যায়, আর তোমার অজান্তেই ছোট্ট শিশু ভেজা ডায়াপারে শুয়ে থাকে বেশ কিছুটা সময়। এরই মধ্য়ে সে যখন পটি বা মলত্যাগ করে ফেল, সমস্যা শুরু হয় তখনই। হিসু-পটি সব মিলেমিশে বিচ্ছিরি অ্যামোনিয়া গ্যাস তৈরি হয়। এ কারণেই শিশুর পেট খারাপ হলে ডায়াপার র‍্যাশের আশঙ্কা থাকে অনেকটা বেশি! তা বাদে দীর্ঘ সময় একই ডায়াপার পরিয়ে রাখলেও উঁকিঝুঁকি মারতে মারে লালচে গুটিগুলো!

 

#2. সলিড খাবার শুরুর সময় (Introducing Solids): মুখে ভাতের পর সলিড খাবার শুরুর সময়ও ডায়াপার র‍্যাশ হতে পারে শিশুর। যে কোনও নতুন খাবারই শিশুর মলের ধরন পাল্টে দেয়। নতুন খাবারে অভ্যস্ত হতে ছোট্ট পেটের বেশ কিছুটা সময়ও লেগে যায়, আর এরই কারণে মাঝেসাঝে সে খারাপও হতে পারে। আর উপরেই তো বললাম, পেট খারাপ হলে রক্ষে নেই! লেজুড় হবেই হবে ডায়াপার র‍্যাশ। স্তন্যপান করানো মায়ের পেট খারাপ হলেও এর আক্রমণ হতে পারে!

 

#3. ব্যাকটেরিয়া বা ছত্রাকের আক্রমণ (Bacterial Infection): ভেজা ডায়াপার ব্যাকটেরিয়া বা ছত্রাকের বংশবিস্তারের জন্য মধুর পরিবেশ তৈরি করে! ফলে শিশুর ত্বকে বিশেষ করে যে যে স্থানে কাটা দাগ বা ফাটা আছে, সেখানে এদের উৎপাত হয় সবচেয়ে বেশি।

 

#4. অ্যান্টিবায়োটিক (Consuming Antibiotics): তুমি বা তোমার শিশু-দু’জনের একজনও যদি নিয়মিত কোনও অ্যান্টিবায়োটিক খেতে থাকো, তা হলে কিন্তু শিশুর শরীরে ডায়াপার র‍্যাশ গজাতেই পারে। কেন না রোগ সারাতে গিয়ে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের উপাদানগুলো শরীর থেকে উপকারী ব্যাকটেরিয়াদেরও অনেকাংশে তাড়িয়ে দেয়। এরই ফলে অ্যান্টিবায়োটিক সেবনে ডায়রিয়ার আশঙ্কাও তৈরি হয়ে যায়। আর শিশুর ডায়রিয়া হলে তো কথাই নেই…ঘুরেফিরে সেই পেট-খারাপের তত্ত্বই সামনে আসবে বারবার!

 

শিশুর ডায়াপার র‍্যাশ প্রতিরোধের উপায় (Tips to Prevent Diaper Rash in Babies) 

ডায়াপার র‍্যাশ একবার থাবা বসিয়ে ফেললে তখন প্রয়োজন ঘরোয়া টোটকা, ওষুধপত্তরের। কিন্তু সেটাকে যদি আমরা আসতেই না দিই? মিছি মিছি ছোট্ট মানুষগুলোকে কষ্টই বা দেবেন কেন? আসুন দেখে নিই ডায়াপার র‍্যাশ প্রতিরোধে কী কী পদক্ষেপ করতে পারেন আপনি!

  • যে খাবারে শিশুর অ্যালার্জি হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে, সেগুলো এড়িয়ে চলুন।
  • সঠিক সাইজের ডায়াপার কিনুন।
  • রাতের বেলায় আপনার এবং শিশুর যাতে ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটে, তার জন্য আপনার সন্তানের চেয়ে দুই সাইজ বড় ডায়াপার ব্যবহার করতে পারেন। তবে এটা শুধু রাতে। দিনের বেলায় বড় ডায়াপার শিশুর অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
  • যতবার পারেন শিশুর ন্যাপি পরিবর্তন করে দিন। এতে তার নিতম্ব পরিষ্কার ও শুকনো থাকবে।
  • শিশুকে কিছুক্ষণ ডায়াপার ছাড়া খালি গায়ে রাখুন।
  • ত্বকের ভেজা ভাব কাটাতে অ্যালোভেরা জেল ব্যবহার করুন।
  • শিশুর জামাকাপড় ধোওয়ার সময় সুগন্ধী সাবান বা ডিটারজেন্টের ব্যবহার এড়িয়ে চলুন। এগুলো অনেক সময় ফুসকুড়ির কারণ হতে পারে।
  • শিশুকে স্নানে বাচ্চাদের জন্যই তৈরি সাবান আর হালকা গরম জল নিন।
  • ন্যাপি পাল্টানোর সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন তার নিতম্বের অংশ পুরোপুরি শুকনো থাকে।
  • গরম জলে অল্প পরিমাণ ওটমিল মিশিয়ে তা দিয়ে শিশুকে স্নান করাতে পারেন।
  • শিশুর জন্য় নরম, তুলতুলে ডায়াপার কিনুন।
  • ডায়াপার বদলের সময় শিশুর নিতম্ব পাতলা তোয়ালে অথবা তুলো দিয়ে আলতো করে মুছিয়ে নিন। কখনও জোড়ে ঘষে মুছবেন না!
  • পেট্রোলিয়াম জেলি, পেট্রোলিয়াম অয়েন্টমেন্ট ব্যবহার করুন। এগুলো নানা অস্বস্তিকর অবস্থা থেকে সুরক্ষিত রাখে।
  • ছেলে হলে ডায়াপার পরানোর সময় ডায়াপারটি আটকানোর আগে শিশুর লিঙ্গটি নীচের দিক করে বসান। এটি ওর প্রস্রাব গড়িয়ে কোমরের উপরের দিকে আসতে বাধা দেবে।
  • শিশুর নাভির নাড়িটি যদি এখনও পড়ে না গিয়ে থাকে, তা হলে জায়গাটি শুকনো রাখতে ডায়াপারের কোমরের কাছের অংশটি ভাঁজ করে রাখুন। নাড়ি পড়ে যাওয়ার কিছুদিন পর পর্যন্ত এমনটি চালিয়ে যান।
  • জীবাণু প্রতিরোধ করতে শিশুর ডায়াপার বদলানোর পর ভালো করে হাত ধুয়ে নিন।

 

শিশুর ডায়াপার র‍্যাশ সারিয়ে তোলার ঘরোয়া উপায় (Home Remedies for Diaper Rashes in Bangla)

গুচ্ছের সতর্কতা সত্ত্বেও ডায়াপার র‍্যাশ যদি হয়েও যায়, তাতেও ঘাবড়ে যাওয়ার কিচ্ছুটি নেই। সঠিকভাবে যত্ন নিলে দু-তিন দিনের ভেতরই তা ঠিক হয়ে যায়। দেখে নিন, র‍্যাশ তাড়ানোর ৭টি টিপস!

 

#1. ঘরে তৈরি ডায়াপার র‍্যাশ ক্রিম (Make your own diaper rash cream): বাজার চলতি ক্রিম, রাসায়নিক নিয়ে ধন্দ থাকলে ঘরেই বানিয়ে নিন ডায়াপার র‍্যাশ ক্রিম। সমানুপাতে অলিভ অয়েল আর শিয়া বাটার নিন। আর মেশান আর একটু বেশি পরিমাণ নারকেল তেল। সব মিলিয়ে ক্রিম বানিয়ে রেখে দিন ফ্রিজে। প্রতিবার ডায়াপার বদলের সময়ে ফ্রিজ থেকে বের করে, হালকা গরম করে, হাতে ঘষে শিশুর ত্বকে আলতো হাতে প্রয়োগ করুন। ১৫ মিনিট রেখে তবেই ডায়াপার পরান শিশুকে।

 

#2. বুকের দুধ (Use breast milk): এই টোটকাটা নতুন করে হয়তো না বললেও চলে। আর কিচ্ছু নয়, স্রেফ বুকের দুধই অনেক সময় মোক্ষম ওষধির মতো কাজ করে ডায়াপার র‍্যাশের চিকিৎসায়। শিশুর ত্বকের ফুসকুড়ি, লালচে দাগগুলোয় কয়েক ফোঁটা বুকের দুধ লাগিয়ে দিন। শুকিয়ে গেলে নরম কাপড় বা বেবি ওয়াইপস দিয়ে মুছিয়ে নিন।

 

#3. দই, বেকিং সোডার প্যাক (Yogurt and Baking Soda): আর একটা সহজ উপায়ও আছে। যার রসদ মিলবে আপনার রান্নাঘরেই। শিশুর র‌্যাশের জায়গা পরিষ্কার করে তার উপর এক-দুই টেবিল-চামচ টক দই লাগিয়ে দিন। শুকিয়ে গেলে ধুয়ে ফেলুন। এবার বেকিং সোডার প্রলেপ লাগান ওই জায়গায় এবং এক ঘণ্টা রেখে দিন। সবশেষে জায়গাটা পরিষ্কার করে মুছে অলিভ অয়েল লাগিয়ে দিন। আরাম পাবে শিশু।

 

#4. গরম জলে স্নান (Warm Bath): ডায়াপার র‍্যাশের সমস্যা কমাতে কুসুম গরম জলে শিশুর স্নানও খুবই কাজে আসতে পারে। তা ছাড়া একটা গামলায় হালকা গরম জল (শিশুর জন্য সহনশীল এমন গরম জল) নিয়ে শিশুকে উবু করেও রাখতে পারেন। দিনে তিনবার এমন করলে শিশু অনেকটা স্বস্তিবোধ করবে। ডায়াপার র‍্যাশ থেকে চুলকানি অনেকটাই কমে যাবে।  

দু-তিনদিন এই টোটকাগুলো প্রয়োগ করার পরেও র‍্যাশ যদি না কমে, তখন যেন ডাক্তার দেখাতে ভুলবেন না! দেখে নিন ডাক্তার দেখানো কখন দরকার;

 

ডাক্তার কখন জরুরি? (When to Consult a Doctor?)

  • দুই-তিন দিনের ভেতর অবস্থার উন্নতি না হলে
  • র‍্যাশ থেকে যদি হলদে তরল বের হয়
  • র‍্যাশ গুরুতর হতে থাকে
  • বাচ্চার জ্বর হলে
  • বাচ্চার ত্বকের ভাঁজে লালচে ভাব দেখা দিলে
  • ছত্রাকের সংক্রমণ বুঝতে পারলে
  • লাল ব্রণর মত দানা দেখা দিলে

 

শিশুরা তার অস্বস্তি, কষ্টের কথা আপনাকে বোঝাতে পারবে না। আপনাকেই তাই বুঝে নিতে হবে, কখন, কী প্রয়োজন ওর। র‍্যাশ অতি সাধারণ ব্যাপার হলেও এ থেকে বড় সমস্যা হতে পারে যদি আপনি যথাযথ ব্যবস্থা না নেন!

একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার  হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

null

null