বাড়ন্ত বাচ্চার শরীরে ক্যালসিয়ামের চাহিদা মেটাতে পারে কোন কোন খাবার

বাড়ন্ত বাচ্চার শরীরে ক্যালসিয়ামের চাহিদা মেটাতে পারে কোন কোন খাবার

সৌরভের মাথা এমনিতে বেশ ঠান্ডা। কিন্তু বড় বিপদের আশঙ্কাটা কী করে যেন, ও আগে থেকে করতে পারে। সৌরভের চোখের মণি ওর ভাইপো বাবান। বাবানের বয়স দেড় বছর। এর মধ্যেই কাকার সঙ্গে তার খুব দোস্তি। বাবান মোটামুটি সুস্থ একটা শিশু। রোগবালাই নেই। (Calcium-Rich Foods for Kids)

কিন্তু গত মাস খানেক ধরে বাবানের দু’হাতের নখ শুষ্ক হয়ে যাচ্ছে, মাঝে মাঝে ভেঙেও যাচ্ছে। সৌরভ তখনই দাদা-বৌদিকে সাবধান করল, বিষয়টা এ ভাবে উপেক্ষা না-করতে। কিন্তু কোনও লাভ হল না। চরম ঠান্ডা মাথার সৌরভ তাতে রেগে আগুন।

একদিন বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার নাম করে নিজেই বাবানকে নিয়ে হাজির পাশের বাড়ির ডক্টর মিত্রর কাছে। ডাক্তারবাবু বাবানকে প্রায় জন্ম থেকেই দেখছেন। নখ দেখেই বললেন, এটা হাইপোক্যালসেমিয়া (Hypocalcemia) বা ক্যালসিয়ামের ঘাটতির লক্ষণ। বাবানকে অবিলম্বে ক্যালসিয়াম-পূর্ণ খাবার খাওয়াতে হবে।

 

ক্যালসিয়ামের অভাবে কী কী সমস্যা হতে পারে শিশুদের? (What happens to children when calcium levels are low?)

  • পেশির সমস্যা: ক্যালসিয়ামের অভাবে পেশিতে ঘনঘন টান ধরতে পারে। হাত-পা এমনকী মুখের পেশিও ক্লান্ত হয়ে পড়ে সহজেই। ফলে নড়াচড়ার সমস্যা দেখা দেয়। সমস্যাগুলো কখনও কখনও ঢাকা পড়ে যেতে পারে। কিন্তু পাকাপাকি ভাবে এর সুরাহা হয় না।

 

  • ভয়াবহ ক্লান্তি: শিশুরা ক্যালসিয়ামের অভাবে সহজেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে। কোনও খেলাধুলা বা দুষ্টুমিতে আগ্রহ থাকে না।

 

  • দাঁতের সমস্যা: ক্যালসিয়ামের অভাবে শিশুর দাঁত সহজেই ক্ষয়ে যায়। দাঁতের গোড়া দুর্বল হয়ে পড়ে।

 

  • নখ ও ত্বকের সমস্যা: বাবানের এই সমস্যার কথা থেকে ক্যালসিয়ামের অভাবের প্রসঙ্গ উঠেছিল। এতে শিশুদের নখ খসখসে এবং ভঙ্গুর হয়ে যায়। ত্বকও শুকিয়ে যায়। অনেক শিশুর চুলের গোড়া দুর্বল হয়ে গিয়ে চুল উঠতে থাকে।

 

  • অস্টিওপোরোসিস: ক্যালসিয়ামের অভাবে শিশুদের এবং বড়দের—সব বয়সের মানুষের মধ্যেই এই সমস্যা দেখা দেয়। হাড় দুর্বল এবং ভঙ্গুর হয়ে পড়ে।
    ক্যালসিয়ামের অভাবে কী কী সমস্যা হতে পারে, তা তো জানা গেল। কিন্তু একটি শিশুর কতটা ক্যালসিয়াম দরকার (Calcium Dose for Child), তারও তো নিশ্চয়ই মাপকাঠি আছে। সেটাও সৌরভকে বলে দিলেন চিকিৎসক।

 

বয়স হিসেবে কতটা ক্যালসিয়াম প্রয়োজন আপনার শিশুর? (For children, the recommended daily allowances for calcium)

  • বয়স ৬ মাসের মধ্যে: ২০০ মিলিগ্রাম প্রতিদিন
  • বয়স ৭ থেকে ১২ মাসের মধ্যে: ২৬০ মিলিগ্রাম প্রতিদিন
  • বয়স ১ থেকে ৩ বছরের মধ্যে: ৭০০ মিলিগ্রাম প্রতিদিন
  • বয়স ৪ থেকে ৮ বছরের মধ্যে: ১০০০ মিলিগ্রাম প্রতিদিন
  • বয়স ৯ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে: ১৩০০ মিলিগ্রাম প্রতিদিন

 

এবার দেখে নেওয়া যাক, ক্যালসিয়ামের ঘাটতি দূর করতে কোন কোন খাবার আপনার সন্তানকে খাওয়াবেন।

 

ক্যালসিয়ামের ঘাটতি দূর করতে কোন কোন খাবার দেবেন সন্তানকে (Best Food Sources Of Calcium For Children)

#1. দুধ (Milk): দুধে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম থাকে। বাচ্চারা নিয়মিত দুধ খেলে তাদের শরীরে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি তুলনায় অনেকটাই কম হয়। অনেক বাচ্চা দুধ খেতে চায় না। তাদের দই বা চিজ খাওয়াতে পারেন। এগুলিও একই রকম ভাবে ক্যালসিয়ামের প্রয়োজনীয়তা মেটায়।

#2. সয়া-দুধ (Soy Milk): আপনার সন্তান গোরুর দুধ খেতে পারে না? চিন্তা করার কিছু নেই। ওর ক্যালসিয়ামের প্রয়োজনীয়তা মেটাতে পারে সয়া-দুধ। যাদের ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স থাকে (Calcium Rich Foods for Babies with Milk Allergy), তাদের এই দুধ খাওয়ানো হয়। শিশুদের পাশাপাশি বড়রাও ক্যালসিয়ামের ঘাটতি মেটাতে নিয়মিত খেতে পারেন এই দুধ।

#3. কমলালেবু (Oranges): ভিটামিন সি-এর প্রয়োজনীয়তা মেটাতে শিশুদের কমলালেবু খাওয়ানো হয়। বড়রা কমলালেবু খান ভিটামিন সি-এর জন্যই। কিন্তু আপনি কি জানেন, ক্যালসিয়ামের প্রয়োজনীয়তা অনেকটাই মেটাতে পারে এই কমলালেবু?
একটি কমলালেবুতে প্রায় ৫০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম রয়েছে, যা আপনার সন্তানের দৈনিক ক্যালসিয়ামের চাহিদা অনেকটাই পূরণ করতে পারে। তবে ওকে প্যাকেট-বন্দি বা বোতল-বন্দি কমলা লেবুর রস দেবেন না। তাজা কমলালেবু বা তার থেকে বের করা রসই ওকে দিন।

 

আরও পড়ুন: বাড়ন্ত বাচ্চার সুস্বাস্থ্যে আয়রন সমৃদ্ধ ১০টি খাবার

 

#4. কাঠবাদাম বা আমন্ড (Almonds): মস্তিষ্কের বিকাশে কাঠবাদাম বা আমন্ডের ভূমিকা অতুলনীয়। কিন্তু মনে রাখবেন, ক্যালসিয়ামের জোগান দিতেও কাঠবাদাম দারুণ কার্যকরী (Calcium-Rich Foods for Kids)। একটি কাপের তিন ভাগের এক ভাগে যতটা আমন্ড ধরে, তাতেই রয়েছে প্রায় ১১০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম। আপনার সোনার যতটা ক্যালসিয়াম দরকার তার অনেকটাই পূরণ করতে পারে এই আমন্ড। পিনাট বাটারের বদলে ওকে আমন্ড বাটার-ও খাওয়াতে পারেন। সেটিও ক্যালসিয়ামের চাহিদা পূরণ করবে।

#5. সামুদ্রিক মাছ (Salt Water fish): টুনা, স্যামন বা সার্ডিন-এর মতো মাছে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম রয়েছে। ভারতের অধিকাংশ জায়গায় এই সব মাছ তাজা অবস্থায় পাওয়া একটু কঠিন। কিন্তু ক্যান-বন্দি করে সেগুলি বিক্রি হয়। তাতেও ক্যালসিয়ামের পরিমাণ নেহাত কম নয়।
তাই নির্দ্বিধায় আপনার খোকা-খুকুকে এই মাছ খাওয়াতে পারেন। (Non-Milk Sources of Nutrients for Toddlers) তবে ক্যান-বন্দি মাছ খাওয়ানোর আগে চিকিৎসকের থেকে জেনে নিন, কোন ব্র্যান্ডের ক্যানের মাছ ওর কোনও ক্ষতি করবে না। মাছ ছাড়াও বেশ কিছু ধরনের মাংসে বিপুল পরিমাণে ক্যালসিয়াম থাকে। চিকিৎসকের থেকে জেনে তবেই সেই মাংস খাওয়াবেন ওকে।

#6. কড়াইশুঁটি (Green peas): কড়াইশুঁটির মধ্যে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম রয়েছে। এক কাপ কড়াইশুঁটিতে প্রায় ৪৫ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম থাকে। শিশুরা যদি এমনি এমনি কড়াইশুঁটি খেতে না-চায় তা হলে সুপ বা অন্য তরকারির মধ্যে কড়াইশুঁটি দিয়ে ওকে খাওয়ান। ক্যালসিয়ামের চাহিদা অনেকটাই মিটবে।এছাড়াও কড়াইশুঁটিতে রয়েছে ভিটামিন কে। এই ভিটামিন আপনার সন্তানের হাড় শক্তপোক্ত (Calcium for Toddlers) করতে সাহায্য করে।

#7. ডিম (Egg): ডিমের মধ্যে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম। কিন্তু কোন বয়সে আপনার সোনাকে ডিম খাওয়ানো শুরু করবেন, সেটা চিকিৎসকের থেকে ভালো করে জেনে নেওয়া দরকার। তিনি গ্রিন সিগন্যাল দিলেই আপনার সন্তানকে খাওয়াতে পারেন ডিম।
নানা রকম পদ রান্না করতে পারেন এই ডিম দিয়ে। যেমন মুখোরোচক, তেমনই ক্যালসিয়ামের চাহিদা মেটাবে এই সব পদগুলি।

#8. রাঙা আলু (Sweet Potato): রাঙা আলু ক্যালসিয়ামের চাহিদা মেটাতে দুর্দান্ত। একটি রাঙা আলুতে প্রায় ৫৫ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম রয়েছে। আর রান্না করা এক কাপ রাঙা আলুতে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ থাকে প্রায় ৭৬ মিলিগ্রাম। ফলে রাঙা আলু দিয়ে আপনার খোকা-খুকুর জন্য বানাতে পারেন নানাবিধ পদ, যা ওর ক্যালসিয়ামের চাহিদা মেটাতে পারবে।

#9. বিনস (Beans): শীতের সময় তো বটেই, প্রায় সারা বছরই অল্পবিস্তর বিনস পাওয়া যায়। জানেন কি এই বিনস ক্যালসিয়ামে ঠাসা? আপনার সোনার জন্য বিনস দিয়ে নানা পদ রান্না করে দিতে পারেন। স্বাদবদল যেমন হবে, তেমনই চাহিদা মিটবে ক্যালসিয়ামেরও।
এছাড়াও বিনস-এর মতো সবজিতে থাকা ভিটামিন শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াবে।

#10. ব্রকোলি (Broccoli): শাকসবজি খেতে অনেক শিশুই নাক সিঁটকায়। কিন্তু তেমনটা করলে তো খুব বিপদ! কারণ শাকসবজি শুধুমাত্র ক্যালসিয়ামের জোগান দেয় না, একই সঙ্গে ভিটামিন-সহ অন্যান্য পুষ্টিকর উপাদানের চাহিদাও মেটায়। সবজির মধ্যে ব্রকলি ক্যালসিয়ামে পরিপূর্ণ। (Non Dairy Foods that are Rich in Calcium)
যদিও ভারতের বেশিরভাগ জায়গায় শীতকাল ছাড়া ব্রকোলি পাওয়া মুশকিল। কিন্তু শীতকালে আপনার খোকা-খুকুকে এই ব্রকোলি দিয়ে নানাবিধ পদ রান্না করে দিতে পারেন। হয়তো সুস্বাদু এই সবজিটি খেতে ও ততটা আপত্তি করবে না। তাতে আপনারও শান্তি।

এছাড়াও দৈনিক খাবারের তালিকায় এমন বহু পদই রয়েছে, যা ক্যালসিয়ামের চাহিদা অনেকটা পূরণ করে। তবে কোনটায় কতটা ক্যালসিয়াম রয়েছে, সেই তালিকা বানিয়ে দিতে পারেন বিশেষজ্ঞই। তাঁদের কাছ থেকেই জেনে নিন কোন বয়সের শিশুকে কোন কোন খাবার কতটা পরিমাণে দেবেন।
সৌরভও যেমন ডাক্তারবাবুর কাছে জেনে নিয়েছে বাবানকে কী খাওয়াতে হবে। বাড়ি ফিরেই সেই তালিকাটা দাদা-বৌদির সামনে ফেলে কড়া ধমক দেবে বলেও সে ঠিক করে রেখেছে। (Calcium-Rich Foods for Kids)

 

আরও পড়ুন: শিশুর জন্য অপরিহার্য পাঁচ ভিটামিন

 

একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার  হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

null

null