হবু মায়ের ব্রেস্টেও হয় নানা পরিবর্তন; সে বদলের হাল হকিকত জানেন তো?

হবু মায়ের ব্রেস্টেও হয় নানা পরিবর্তন; সে বদলের হাল হকিকত জানেন তো?

কনসিভ করার পরের মুহূর্ত থেকে মেয়েদের শরীরে শুরু হয় নানান পরিবর্তন। ভিতরে ভ্রূণ তৈরি হতে থাকে একটি পূর্ণ মানুষের আকৃতি পাওয়ার জন্য; আর মেয়েটি তৈরি হতে থাকে “মা” হওয়ার জন্য। শরীরের ভিতরে ঘটে চলা কাজকারবার, হরমোনের তুমুল দাপাদাপির প্রভাব লক্ষ্য করা যায় বাইরে থেকেও। মাতৃত্বের পুরো ব্যাপারটায় মহিলাদের স্তন বা ব্রেস্ট খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা ভূমিকা পালন করে। সেই তো জোগান দেয় শিশুর প্রথম খাবারের। পুরো প্রেগন্যান্সি জুড়েই চলতে থাকে তারও অদলবদল। ডেলিভারির পরে মায়ের শরীরের মতো স্তনও আস্তে আস্তে আগের অবস্থায় ফিরতে চেষ্টা করে। তবে, অনেকসময়ই কিছুটা বদল থেকেই যায় সারাজীবনের জন্য, আর সেটাই হয়তো বহন করে মাতৃত্বের চিহ্ন! (Breast Changes During Pregnancy)

প্রত্যেক ট্রাইমেসটারে কিছু কিছু নতুন পরিবর্তন হয়ে থাকে হবু মায়ের স্তনে। (Breast Changes During Pregnancy Week by Week) সবার ক্ষেত্রে সময় বা পরিবর্তনের মাত্রা সমান নয় অবশ্যই। প্রত্যেকের শরীর আলাদা এবং তাদের প্রতিক্রিয়ার ধরনও আলাদা। তাও, সাধারণভাবে একটা খসড়া সাজানোর চেষ্টা করলাম আজ। প্রেগন্যান্সি চলাকালীন ব্রেস্টে কী ধরনের পরিবর্তন ঘটে, কেন ঘটে সবকিছুই বিশদে রইল প্রতিবেদনে।

 

প্রথম ট্রাইমেসটারে যা যা পরিবর্তন হয় (First Trimester Breast Changes):

প্রথম ট্রাইমেসটার অর্থাৎ কনসিভ করার পর থেকে ১৩ সপ্তাহ পর্যন্ত সময়ে গর্ভাবস্থায় হবু মায়ের ব্রেস্টে যা যা পরিবর্তন হয়;

  • স্পর্শকাতর ব্রেস্ট: কনসিভ করেছেন কিন্তু এখনও নিজে বুঝতে পারেননি বা টেস্ট করাননি; এসময় যদি ব্রেস্ট খুব স্পর্শকাতর হয়ে পড়ে, ব্যথা হয় বা ফোলা ফোলা লাগে; সেটা কিন্তু গর্ভধারণ করার ইঙ্গিত হতে পারে (Breast Changes During Early Pregnancy)। ব্যথা হয় নিপলেও, এতটাই যে স্পর্শ করলেই ব্যথা লাগে। গর্ভাবস্থার প্রথম দিকে যেসব লক্ষণগুলি দেখা যায়; তার মধ্যে কিন্তু এইটি অন্যতম।
  • আকারে বড় হয়ে যাওয়া: স্তন বা ব্রেস্টের আকারে বেশ ভালোরকম পরিবর্তন হয়। যে কাপ সাইজের ব্রা পরেন, তার থেকে এক বা দুই সাইজ বেড়ে যাতে পারে। প্রথমবার যারা মা হতে চলেছেন, তাদের ক্ষেত্রে এই পরিবর্তনটা বেশি চোখে পড়ে। প্রথম ট্রাইমেসটারেই এই সাইজের পরিবর্তন শুরু হয় এবং পুরো প্রেগন্যান্সি জুড়েই এটা চলতে থাকে। শুধু তাই নয়, ডেলিভারির পরে বাচ্চাকে ব্রেস্টফিড করানোর পিরিয়ডটাতেও মায়ের স্তন আকারে বাড়ে। কম সময়ে সাইজের খুব বেশি পরিবর্তন হলে দেখা দিতে শুরু করে স্ট্রেচ মার্কও।
  • নীল শিরা-উপশিরার আগমন: গর্ভাবস্থা চলাকালীন মায়ের শরীরে রক্তের পরিমাণ ৫০ শতাংশ বেড়ে যায়। এরই ফলাফল হিসেবে, ত্বকের নীচে শিরা-উপশিরা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পেট এবং স্তনে এই শিরাগুলি বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়। এই শিরা বা ভেইনসগুলির মাধ্যমেই মায়ের শরীর থেকে রক্ত এবং পুষ্টিপদার্থ ভ্রূণের কাছে পৌঁছে যায়।

 

দ্বিতীয় ট্রাইমেসটারে যা যা পরিবর্তন হয় (Second Trimester):

দ্বিতীয় ট্রাইমেসটার অর্থাৎ গর্ভাবস্থার ১৪ থেকে ২৭ সপ্তাহ। এই সময় হবু মায়ের স্তনে যা যা পরিবর্তন হয়;

  • এরিওলার রং গাঢ় হয়ে যাওয়া: নিপলের চারপাশের অংশ অর্থাৎ এরিওলার রং আগের থেকে গাঢ় হয়ে যায়। দ্বিতীয় ট্রাইমেসটার চলাকালীন এরিওলা রং ও বিস্তার, দুই ক্ষেত্রেই পাল্টাতে থাকে। অনেকে মনে করেন, ছোট্ট বাচ্চা যাতে সহজেই নিপলের অবস্থান বুঝতে পারে সেজন্যই এরিওলার রং ঘন হয়ে যায়। (Breast Change During Pregnancy Second Trimester)
    হরমোনের মাত্রার দারুণ হেরফেরেই এইসব পরিবর্তন ঘটে। ডেলিভারির পরে এবং ব্রেস্টফিড করানোর পিরিয়ড শেষ হলে এরিওলা আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসে। অনেকের ক্ষেত্রে আবার কিছুটা ডার্ক হয়েই থেকে যায়। \
  • এরিওলা বাম্পস: এরিওলা বাম্পস হল, এরিওলার ওপরে গজিয়ে ওঠা ছোট্ট ছোট্ট ফোলা অংশ। গর্ভাবস্থায় এই এরিওলা বাম্পসের আগমন ঘটে। এদের গজিয়ে ওঠার কারণ বাচ্চাকে মায়ের দুধ খেতে সাহায্য করা। এই ছোট্ট ছোট্ট ফোলা অংশগুলো আসলে এক ধরনের তেল নিঃসরণকারী গ্রন্থি, ডাক্তারি পরিভাষায় একে বলে মনটগোমারি টিউবারক্লেস (Montgomery’s tubercles)।
  • নিপল ডিসচার্জ শুরু হওয়া: অনেক হবু মায়েরই দ্বিতীয় ট্রাইমেসটার চলাকালীন নিপল ডিসচার্জ শুরু হয়। আবার অনেকের শুরু হয় তৃতীয় ট্রাইমেসটারে বা ডেলিভারির পরে। যে কোনও সময়েই নিপল ডিসচার্জ হতে পারে; তবে ব্রেস্ট ম্যাসাজ করলে বা স্টিমুলেট করলে এই ডিসচার্জ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এইসময় নিপল থেকে যে ডিসচার্জ হয়; তা হলুদ রঙের এবং ঘন একটি তরল। এর নাম কোলস্ট্রাম বা শালদুধ। বাচ্চা জন্মানোর পরে প্রথম এই দুধই খায়।
  • ব্রেস্টে লাম্প গজানো: হবু মায়ের স্তনে কিছু লাম্পসও দেখা দিতে পারে। ভয় পাবেন না, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এইসব লাম্প ভয়ের কোনও কারণ নয়। ক্লগড মিল্ক ডাকটের কারণে ব্রেস্টে লাম্প গজিয়ে উঠতে পারে। তবে সাবধান থাকা সবসময় ভালো। ডাক্তারবাবুর সাথে কথা বলে প্রয়োজনে কিছু টেস্ট করিয়ে রাখুন। যদি কোনও টিউমার জাতীয় বদ জিনিসের আগমন ঘটে, তাকে সারিয়ে তোলা যাবে প্রথমেই। তবে মায়ের বয়স ৩৫ এর কম হলে এর আশঙ্কা খুবই কম; তবু সাবধানের মার নেই। (Lump on Breast During Pregnancy)

 

আরও পড়ুন: আপনার প্রেগন্যান্সি টেস্ট: কোথায়, কখন, কীভাবে ও কেন

 

তৃতীয় ট্রাইমেসটারে যা যা পরিবর্তন হয় (Third Trimester):

তৃতীয় ট্রাইমেসটার হল ২৮ থেকে ৪০ সপ্তাহ পর্যন্ত সময়। গর্ভাবস্থার শেষ পর্যায় এই তৃতীয় ট্রাইমেসটার। এই সময় মায়ের স্তনে যেসব পরিবর্তন দেখা যায়;

  • পরিবর্তন চলতেই থাকে: প্রথম ও দ্বিতীয় ট্রাইমেসটারে যা যা পরিবর্তন হয়েছিল, সেইগুলোই চলতে থাকে এই শেষ পর্যায়েও। স্তন আরও ভারী ও বড় হয়ে যায়, নিপল ও এরিওলার রং আরও ঘন হয়। এসময় কোলস্ট্রাম আরও ঘন ঘন বেরোতে থাকে। (Breast Changes During Pregnancy)
  • স্ট্রেচ মার্ক বাড়তে পারে: পেটের সাথে বুকেও বেড়ে যেতে পারে স্ট্রেচ মার্ক। লাল রঙের এই রেখাগুলি দেখা দিতে পারে থাইতেও। আকারের পরিবর্তনেই এমনটা দেখা যায়।

 

গর্ভাবস্থায় স্তনে যেসব পরিবর্তন হয়, সেগুলো মানিয়ে নেবেন কীভাবে (How can You handle pregnancy and breast changes)?

#1. সঠিক সাইজের ব্রা কিনুন: পুরনো ব্রা টাইট হচ্ছে, অস্বস্তি সত্ত্বেও পরে আছেন সেটাই। এটা ভুল, কিনে আনুন নতুন আরামদায়ক ব্রা। এসময় ব্রা কেনার সময় দেখে নেবেন;

  • ব্রা যেন বেশ ভালো সাপোর্ট দেয় অর্থাৎ কাপ সাইজ দেখে নিন
  • কাঁধের স্ত্র্যাপ চওড়া হবে
  • কাপের নীচে যে ব্যান্ড থাকে সেটা যেন চওড়া হয়, তাহলে সাপোর্ট ভালো হয়।
  • পিছনে হুক দেওয়া ব্রা কিনুন, বেশি আরাম পাবেন।
  • কাপের ভিতরে পাতলা তার বা নরম তার বসানো থাকে নানা আধুনিক শেপওয়্যার ব্রা-তে। এসময় এগুলো একদম নয়।
  • রাতে ব্রা পরে শুতে অস্বস্তি হলে কটনের স্পোর্টস ব্রা পরতে পারেন।

#2. ভরসা রাখুন ব্রেস্ট প্যাডে: এখন কিনলেও কাজে লাগবে, আর ডেলিভারির পরে তো কিনতে হতোই। কিনে নিন গর্ভাবস্থাতেই। অসময়ে লিকেজ হলে বাঁচিয়ে দেবে আপনাকে।

#3. তেল ও ময়েসচারাইজার লাগানো: স্তনের ত্বক নরম রাখতে ও চুলকানি ভাব থেকে মুক্তি পেতে লাগাতে পারেন তেল এবং কোকোয়া বাটার/নারকেল তেল সমৃদ্ধ ক্রিম/ময়েসচারাইজার।

#4. ব্লকড মিল্ক ডাকটের চিকিৎসা করবেন যেভাবে: হালকা গরম সেঁক দিন, ব্রেস্টের যে জায়গায় ব্যথা, সেখান থেকে নিপলের দিকে আলতো হাতে ম্যাসাজ করুন। আরাম পাবেন।
আগেও যেমন বলেছি, আজও বলছি; আপনার শরীর সবথেকে ভালো বোঝেন আপনি নিজে। নিজের শরীরের সমস্ত পরিবর্তন বোঝার চেষ্টা করুন, স্বাভাবিক পরিবর্তন আপনি জানেন; তাও সেটা আপনার ডাক্তারবাবুকে জানিয়ে রাখুন। আপনার শরীর একটু একটু করে প্রস্তুত হচ্ছে “মা” হওয়ার জন্য। চুটিয়ে উপভোগ করুন এই সময়টা। (Breast Changes During Pregnancy)

 

আরও পড়ুন: গর্ভকালীন দিনগুলোয় আপনার গোপনাঙ্গের যত্ন নেওয়ার গোপন কথা

 

একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার  হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব। 

 

null

null