ছোট্ট সোনার মন ও শরীরের বিকাশে কোন বয়সে, কোন খেলনা দরকারি

ছোট্ট সোনার মন ও শরীরের বিকাশে কোন বয়সে, কোন খেলনা দরকারি

ছোট্ট জিশানের বয়স এখন মাত্র ছ’মাস। গত সপ্তাহেই ওর অন্নপ্রাশন হয়ে গেল। সেই উপলক্ষ্যে ঘর ভর্তি হয়ে গিয়েছে হাজারও গিফ্টে। গিফ্টের মধ্যে খেলনার সংখ্যাই বেশি। (How to Develop Mental Health Using Toys like, Abacus for Kids?)

খেলনাগুলো দেখতে দেখতে সায়নীর মনে পড়ল পামেলার বলা কথাটা। সায়নীর বন্ধু পামেলা একজন শিশুস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ। জিশানকে জন্মের পর থেকে ও-ই চিকিৎসা করছে। ওর কথায় শিশুর জন্য খেলনা নির্বাচন খুব গুরুত্বপূর্ণ‌‌ (Educational Benefits of Providing Toys To Your Children)। কারণ শিশুর মানসিক বিকাশে খেলনা বড়সড় ভূমিকা নেয়।

কথাটা মনে পড়তেই সায়নী ফোন করল পামেলাকে। জিজ্ঞেস করল, এত খেলনার মধ্যে কোনটা তুলে দেওয়া উচিত জিশানের হাতে? কোনটা ওর বেড়ে ওঠার জন্য এই সময় উপযোগী? আর কোনটা ওর থেকে দূরে রাখাই ভালো (What Toys Can Help a Child’s Mental Development)?

পামেলা সবটা শুনে শিশুর বিকাশের কয়েকটি দিক সম্পর্কে সায়নীকে জানালো। বললো, শিশুর এই দিকগুলোই প্রথমে খেয়াল রাখা উচিত।

 

শিশুর বিকাশে খেলনার ভূমিকা ( Educational Benefits of Providing Toys to Your Children):

  • আবেগ প্রকাশ: জন্মের পর ছোট্ট শিশুর মধ্যে হাসি কান্না ইত্যাদি আবেগগুলোর যথাযথ বিকাশ প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, শুধু কান্না তাদের মনকে ডিপ্রেসড করে। তাই হাসি, অবাক হওয়া ইত্যাদি আবেগও তার মধ্যে ফুটিয়ে তোলা প্রয়োজন। খেলনা শিশুর এই পজিটিভ আবেগের বিকাশে সাহায্য করে।
  • মনোযোগ বৃদ্ধি: খুদে সোনার মনোযোগ বৃদ্ধি করা বাবা-মায়ের কাছে বড়সড় চ্যালেঞ্জ। নয়তো ভবিষ্যতে পড়ায় মন বসবে কী করে? বিশেষজ্ঞদের কথায়, খেলনা নিয়ে ছোট্ট সোনা সময় কাটালে মনোসংযোগের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় (Benefits of Educational Toys)। তবে খেলনার পরিমাণ বেশি হলে চলবে না। একই সময় একটি খেলনা নিয়েই ওকে খেলতে দিন।
  • নিয়ম মানা: জন্মের পর ছোট্ট সোনা নিয়ম-কানুন কী জিনিস তা শিখবে কীভাবে? এই প্রশ্ন অনেক বাবা-মায়ের মনেই আসে। মনোবিদদের কথায়, খেলনা নিয়ে খেলতে খেলতেই নিয়ম ব্যাপারটা সম্পর্কে ওর একটা ধারণা জন্মায়। কিছু খেলনা রয়েছে যা একটি নির্দিষ্ট নিয়মে না-খেললে সাড়া দেয় না, যেমন ব্যাটারিচালিত খেলনা। এই ধরনের খেলনাই নিয়ম সম্পর্কে ওর ধারণা গড়ে দেয় (The Benefits of Play)
  • এমপ্যাথি তৈরি করা: সমানুভূতি বা এমপ্যাথি একজন মানুষের প্রধানতম গুণ। সব বাবা-মা চান, তাঁদের সন্তানের মধ্যেও এই গুণটা তৈরি হোক। এতে সমাজে আর পাঁচজন মানুষের সঙ্গে মিশতে ওর সুবিধে হবে। এবং ধৈর্য ধরার মানসিকতা তৈরি হবে। শিশু বয়সে একমাত্র খেলনাই খুদের মধ্যে এই গুণটির বিকাশ করতে‌ পারে। মেক-বিলিভ ধরনের খেলা ওর মধ্যে এই বৈশিষ্ট্য গড়ে তোলে।
  • বাধা পেরিয়ে চলা: সঠিক খেলনা নির্বাচন ছোট্ট সোনাকে শিশু বয়স থেকেই ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করে দেয়। বাধা পেরিয়ে কীভাবে এগিয়ে চলতে হয়, তার শিক্ষাও খুদের জীবনে প্রয়োজন। খেলনাই খুদেকে বাধা পেরিয়ে এগিয়ে চলার প্রাথমিক ধাপগুলো শেখায়। যেমন প্রবলেম সলভিং গেম বাচ্চাকে সমস্যা সমাধান করতে শেখায় (How Does Abacus Help Your Child?)।
  • ক্রিয়েটিভিটি: শিশুর মধ্যে ক্রিয়েটিভিটি বিকাশের প্রাথমিক উপায় হিসেবে খেলনার গুরুত্ব যথেষ্ট। ছোট্ট বয়সে যখন সে আঁকা, নাচ, গান কিছুই শিখে ওঠেনি, তখন ক্রিয়েটিভ খেলনাই পারে ওর মধ্যে ক্রিয়েটিভিটির বীজ (Learning with Fun) বুনে দিতে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, ব্লক অ্যারেঞ্জিং গেম অর্থাৎ ব্লক সাজানোর খেলা বাচ্চাদের ক্রিয়েটিভ ভাবনাকে জাগিয়ে তোলে।

 

 

আরও পড়ুনঃ কচি বয়সটাই সোনার মস্তিষ্কের বিকাশে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। কীভাবে সাহায্য করবেন আপনি?

 

মস্তিষ্ক এবং স্নায়ুতন্ত্রকে পরিপক্ক করে তুলতে পারে বাছাই করা খেলনা (Specific Toys Can Boost Baby’s Brain Power):

শুধু মানসিক বিকাশ নয় মস্তিষ্ক ও স্নায়ুর বিকাশেও খুদের খেলনাপাতি সমান সাহায্য করে (What Kind of Toys Can Help a Child’s Development?)। পামেলা তেমন কয়েকটি বিষয়ও তুলে ধরল।

  • হাত ও চোখের কোঅর্ডিনেশন: খেলনা শিশুর হাত ও চোখের কোঅর্ডিনেশনেও সাহায্য করে। জন্মের পর শিশুর স্নায়ু অপরিণত থাকায় হাত ও চোখের নাড়াচাড়া একই সঙ্গে হয় না। বরং খেলনা নিয়ে খেলতে খেলতেই ওর হাত ও চোখের নাড়াচাড়ায় সামঞ্জস্য আসে।
  • মোটর স্কিলের বিকাশ: শিশুবয়সে মোটর স্কিলের বিকাশ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মোটর স্কিলের সাহায্যে শিশু একটি কাজ ঠিক ভাবে করতে শেখে, সে জল খাওয়াই হোক বা হামা দেওয়া। জন্মের পর এই স্কিলটি বাচ্চার মধ্যে গড়ে তুলতে সাহায্য করে ওর খেলনা। খেলনা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতেই ওর মধ্যে এই স্কিলটির বিকাশ হয়।
  • কারণ-ফল সম্পর্কে ধারণা হওয়া: একটি কাজ করলে, তার থেকে কী হতে পারে সে সম্পর্কে শিশুর ধারণা গড়ে ওঠা প্রয়োজন। তবেই সে নিজেকে বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারবে। এই কারণ ও ফল সম্পর্কে শিশুর ধারণা জন্মায় খেলনার সঙ্গে সময় কাটানোর মধ্যে দিয়ে।
  • লজিক সম্পর্কে ধারণা: ছোট্ট সোনা একটু বড় হলে লজিক অর্থাৎ যুক্তি সম্পর্কে তার ধারণা জন্মাতে থাকে। একটি কাজ কেন করা উচিত, করলে কী ভালো হয় বা খারাপ হয় সে সম্পর্কে ওর মনে ধারণা জন্মায়‌। কাজের প্রকৃতি বুঝে ও সেই কাজটা সমর্থনও করে। যেমন খুদে খেতে না-চাইলেই তাকে এই সময় বুঝিয়ে সুঝিয়ে খাওয়ানো যায়। কারণ সে বোঝে না-খেলে বড় হওয়া যায় না।(How to Develop Mental Health Using Toys like, Abacus for Kids?)

 

কোন বয়সে কোন খেলনা উপযুক্ত? (Choose the Right Toys for the Right Age)

খেলনার উপকারিতা সম্পর্কে তো ভালোভাবে জানা গেল। কিন্তু কোন ধরনের খেলনা ওকে দেওয়া উচিত সে ব্যাপারে সায়নী চিন্তায় ছিল‌ (How Important are Educational Toys to A Child Development?)। পামেলা সেই মুশকিলও আসান করে দিল।

#1. শূন্য থেকে ১২ মাস: বিশেষজ্ঞদের কথায়, শিশুদের খেলনার নির্বাচন, বয়স অনুযায়ী হওয়া উচিত। কারণ সব বয়সে সব ধরনের খেলনা ওর জন্য উপযুক্ত নয়। খুদের জন্মের পর প্রথম তিনমাস ওর দৃষ্টি ঝাপসা থাকে। তাই আশেপাশের কোনও কিছুই ও ভালো করে দেখতে পায় না। বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই সময় ওদের খেলনা হিসেবে রংবেরঙের জিনিস বাছা উচিত। সাদা বা কালো রঙের খেলনা এই সময় একেবারেই নয়। একটু বড় হলে ওর দোলনার চারপাশে রঙিন স্টাফড পুতুল রাখুন। এছাড়া ওর খুদে হাঁ-এর থেকে আকারে বড় পশমের বল নিয়েও খেলা করতে দিন।‌ এছাড়াও কিনে দিতে পারেন অ্যাক্টিভিটি বোর্ড।
#2. ১২ মাস থেকে দুইবছর: এই বয়সে শিশুর কার্যকারণ সম্পর্কে ধারণা জন্মাতে থাকে। তাই বিশেষজ্ঞরা এমন কিছু খেলনার কথা বলেন, যাতে ও ইনপুট দিলে খেলনা থেকে একটি আউটপুট বা রেসপন্স পাওয়া যায়। যেমন রোবটের বোতাম টিপলে সে হাঁটতে শুরু করে বা খেলনা পাখির বোতাম টিপলে সে কথা বলতে থাকে। এই সময় ও অ-আ-ক-খ শিখতে না-পারলেও চারপাশের জিনিসগুলোর নাম শিখতে শুরু করে। এমনকী খেলনার রেসপন্স দেখে রেসপন্সও করে। তাই এই সময় ওকে স্ট্যাকিং রিংস, নেস্টিং কাপস, পুল অর পুশ টয় জাতীয় খেলনা কিনে দিন।
#3. দুই থেকে তিন বছর: এই বয়সে খুদের মোটর স্কিল উন্নত হতে থাকে (Development of Fine and Gross Motor Skills)। ছোট্ট সোনা এই সময় মেক-বিলিভ ধরনের খেলা পছন্দ করে। এর অর্থ মেয়েরা তাঁদের পুতুলকে খাওয়ায়, ছেলেরা বাসে ছোট ছোট মানুষ বসিয়ে চালায়। আসলে চার পাশে এতদিন সে যা দেখেছে, সেগুলোই সে নিজে নিজে করার চেষ্টা করে। বিশেষজ্ঞদের কথায়, দুই বছর বয়স পেরোলে খোকা-খুকুকে স্টাফড পুতুল, ট্রাক, বাস, ব্লক সাজানোর গেম ইত্যাদি কিনে দেওয়া উচিত।
#4. তিন থেকে চার বছর: তিন থেকে চার বছর বয়সে খুদের মধ্যে লজিক সম্পর্কে ধারণা অনেকটাই গড়ে ওঠে। এই সময় তার খেলনাগুলোও তাই লজিক সম্পর্কিত হওয়া উচিত। এই সময় ওকে সহজ পাজল গেম, ব্লক গেম ইত্যাদি দেওয়া যেতে পারে। এছাড়াও অ্যাবাকাসের প্রাথমিক নিয়মগুলোও খেলাচ্ছলে ওকে শেখানো যায়। বিশেষজ্ঞদের কথায়,বাচ্চারা সাধারণত চার বছর বয়স থেকেই অ্যাবাকাস শিখতে শুরু করে (Buy a Toy Like an Abucus) । তাই এই সময়টাই অ্যাবাকাস নিয়ে খেলার জন্য উপযুক্ত বয়স।

পামেলার পরামর্শ পেয়ে আশ্বস্ত হয় সায়নী। এরপর পামেলার কথা মতোই জিশানের জন্য খেলনা বেছে নেয় অন্নপ্রাশনের গিফ্টের থেকে। তবে বাকি খেলনাগুলোও আলমারিতে তোলা থাকে। সময় হলেই সেগুলো জিশানের খেলার সঙ্গী হয়ে উঠবে।(How to Develop Mental Health Using Toys like, Abacus for Kids?)

 

আরও পড়ুনঃ শুধু গল্পের খাতিরে নয়, আপনার বাড়ন্ত বাচ্চাকে গল্প শোনান তারই বিকাশের খাতিরে

 

একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার  হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

 

null

null