যমজ সন্তান? দেখুন তো কী কী চ্যালেঞ্জ অপেক্ষায় আছে আপনার!

যমজ সন্তান? দেখুন তো কী কী চ্যালেঞ্জ অপেক্ষায় আছে আপনার!

যমজ সন্তান; বাবা-মায়ের সাথে সাথে পরিবারের আনন্দ যেন দ্বিগুণ করে নিয়ে আসে ফুটফুটে দুই ছানা। মায়ের কোলে আসার আগে থেকে তাদের নিয়ে পরিকল্পনার শেষ নেই হবু বাবা মায়ের। মাতৃত্ব স্বরূপ আশীর্বাদ সত্যিই দ্বিগুণ হয়ে ধরা দেয় যমজ সন্তানের মায়ের কাছে। দুই সন্তান গর্ভে ধারণ করা চাট্টিখানি কথা নয় বাপু, একথা আমি-তুমি-আপনি সব্বাই জানি। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে যা অসহনীয় বলে মনে হয়, একজন মা-ই হয়তো তার মমতার জোরে তাকে সম্ভব ও সহনীয় করে তুলতে পারেন। গর্ভাবস্থায় শারীরিক কষ্টের কথা ছেড়েই দিলাম; জন্মের পর যমজ সন্তানদের মানুষ করে তুলতে যে কতটা পরিশ্রম, ধৈর্য এবং মানসিক জোরের প্রয়োজন হয়, সেটা লিখে বোঝাতে গেলে একজন মায়ের লড়াইকে ছোট করে ফেলা হবে হয়তো অজান্তেই। কাজেই, সেই স্পর্ধা আর নাই বা করলাম! (Biggest Parenting Challenges of Having Twins in Bangla. Jomoj sontaner jotno.Biggest Parenting Challenges of Having Twins in Bengali.)

 

যমজ সন্তান মানুষ করার চ্যালেঞ্জ! (What are some of the biggest challenges of parenting twins?)

 

যমজ সন্তান জন্ম নেওয়ার পর কোলজোড়া দুই ফুটফুটে সন্তানের মুখ দেখে মায়ের যেন আর আশ মেটে না। শুধু মা নয়, বাচ্চাদের বাবা, পরিবারের সবাই এত আনন্দ কোথায় রাখবেন ভেবে পান না কিছুতেই। কিন্তু, বাস্তবটা একটু কঠিন যে! বিশেষ করে মায়ের জন্য। এই দুই সন্তানকে একসাথে বড় করে তুলতে গিয়ে কার্যতই নাকানিচোবানি খেতে হয় বাবা এবং মাকে। আর যদি নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি হয় বা মা যদি কর্মরতা হন, তা হলে আমাদের সবার পক্ষ থেকে আপনাদের একটা দেড় বিঘত লম্বা সেলাম। সত্যিই বাস্তবিক অর্থে এই মায়েরাই সুপার-ওম্যান এবং বাবারা সুপার-ম্যান। যমজ সন্তানকে একটু একটু করে বড় হতে দেখা যতটা আনন্দের, ঠিক ততটাই ঝক্কির। আজকের প্রতিবেদন সেই সব মায়ের উদ্দেশে, যাঁরা টুইন্স (Twins) বা যমজ সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। কোনও মাতৃত্বই ছোট বা বড় নয় বা কারও কষ্টই কম-বেশি হয় না, তবুও একসাথে দুইটি নবজাতক বা নবজাতিকাকে যারা মানুষ করেন, তাদের স্যালুট করতে ইচ্ছে করে বই কি! এমনই একজন মায়ের অভিজ্ঞতার নিরিখে লেখা আজকের প্রতিবেদন। যমজ বাচ্চা মানুষ করতে কী কী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয় মা-বাবাকে, দেখে নিন একনজরে।

 

#1.ঘুম গিয়েছে নিরুদ্দেশে (Less sleep)-> নতুন মা আর ঘুম, এই দুটো ব্যাপার যেন পরস্পরের বড্ড বিরোধী। কচি বাচ্চার সময় তো আর আমাদের সময় ধরে চলে না। এমনিতেই সে দিনে ঘুমিয়ে রাতে খেলতে বেশি আগ্রহী আর মা’টিকেও তার সাথে পাল্লা দিয়ে জেগে থাকতে হয়। যমজ বাচ্চার ক্ষেত্রে একবার আন্দাজ করে দেখুন ব্যাপারটা কেমন হতে পারে। সকালে হয়তো একজন ঘুমোচ্ছে, একজন জেগে আছে; অতএব মাও শুতে পারলো না। দুজনেই যদি মা ন্যাওটা হয়ে থাকে, তা হলে তো হয়েই গেলো। যে কোনও একজন জেগে থাকলেই মা’কে জেগে থাকতে হবে। রাতের পর রাত সমান তালে দু’জনের ন্যাপি পাল্টানো, সময় সময় খাওয়ানো আর দু’জনকে সঙ্গ দেওয়ার বহর দেখে নিদ্রাদেবী মায়ের সাথে কার্যত আড়িই করে দেন। লাগাতার এরকম বিশ্রামের অভাব, পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়ার ফলে মায়ের শরীর ভেঙে যায়, ডেলিভারির পর ঠিক করে বিশ্রামও নিতে পারেন না যমজ সন্তানের মা।

 

#2. দু’জনকে ব্রেস্ট ফিডিং করানো (Breast feeding issues)-> দু’টিই তো নাড়ি ছেঁড়া ধন। তাই মা সবসময় চেষ্টা করেন, তাদের পুষ্টিতে যেন কোনও ঘাটতি না থেকে যায় বা ঠিক সময়ে তারা খাবার পায়। দুটি ছোট্ট শিশুকে ২-৩ ঘণ্টা পরপর ব্রেস্ট ফিডিং করাতে একটি মায়ের কী পরিমাণ স্ট্যামিনা প্রয়োজন, সেটা লিখে আর বোঝাই কী করে! ভাবতে গেলেই যেখানে আমাদের পেট গুড়গুড় করছে! আর আরেকটা কথা, শুনতে কষ্ট হলেও মানাতে হবে। মায়ের শরীরের ওপরের অংশের গঠনে বেশ রদবদল আসে যমজ সন্তানকে ব্রেস্ট ফিডিং করিয়ে। সুঠাম চেহারার সুন্দরী তন্বীটির হয়তো বিশেষ ধরনের ব্রা এবং অন্তর্বাসের প্রয়োজন পড়ে ভবিষ্যতে।

 

#3. একজন থামলে আরেকজন কাঁদে (One starts to cry when other stops)-> একজন হয়তো সবে স্নান সেরে, ন্যাপি পাল্টে বেশ ফিট বাবুটি সেজে পরিষ্কার হয়ে শুলেন; ২ মিনিটের মধ্যে আরেকজন ন্যাপি ময়লা করে ফেলে চিল চিৎকারে বাড়ি মাথায় করতে শুরু করলেন। সহোদর/ সহোদরার কান্না শুনে আরেকজন চুপ থাকেন কেমন করে? ব্যাস, শুরু হয়ে গেলো দুই জনের সম্মিলিত গগনভেদী চিৎকার। বাড়ির লোকজন সাহায্য করেন, বাবাও যথাসম্ভব সাপোর্ট দেওয়ার চেষ্টা করছেন, কিন্তু একরত্তি দুটোই শুধু মায়ের গায়ের গন্ধ চিনে বসে আছে। দুজনকে চুপ করাতে মা’কেই চাই। মা বেচারি দুজনকে কোলে নিয়ে চুপ করাতে গিয়ে কিছুক্ষণ পরে নিজেই হাউহাউ করে কান্না শুরু করলেন। পরিস্থিতি বড্ড বেগতিক দেখে হয়তো চুপ করতে পারে খুদেগুলো। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যমজদের মধ্যে কিছু মিল দেখা যায়। যেমন, একজনের জ্বর হলে অন্যজনেরও জ্বর হয়; একজনের পেট গোলমাল হলে অন্যজনের শুরু হয়। ফলস্বরূপ, মায়ের ঝক্কি বাড়ে।

আরও পড়ুনঃ  সংক্রমণ, আঁচড় এড়াতে আজই শুরু হোক ছোট্ট নখের যত্নআত্তি!

#4.দু’টিকেই সমান ভাবে সময় দেওয়া (Distributing love simultaneously)-> মা সবসময় চাইবেন দুটিকেই সমান ভাবে সময় দিতে। কারও যেন কখনও না মনে হয় “ মা ওকে বেশি ভালোবাসে।” বাড়ন্ত বাচ্চাদের অনেকটা পৃথিবী যেহেতু মাকে ঘিরে গড়ে ওঠে, তাই মায়ের জায়গাটায় তারা বড্ড বেশি স্পর্শকাতর হয়। দুজনকে সমানভাবে আদর করা, সমান ভাবে সময় দেওয়া এবং সমানভাবে যত্ন করা মায়ের কাছে একটা চ্যালেঞ্জ বই কি!

 

#5.দ্বিগুণ দুষ্টুমি (Double mess)-> যমজ দুটি রত্ন হামা দিতে শুরু করলে বা হাঁটি হাঁটি পা পা শুরু করলে মায়ের ওজন অর্ধেক হতে বাধ্য। দুজনেই স্বাধীন হওয়ার প্রথম পর্যায় যতটা চুটিয়ে অনুভব করতে চায়, ততই মায়ের ঘামের পরিমাণ সমানুপাতিক হারে পাল্লা দিয়ে বাড়ে। আবার শুধু কী হামা বা হাঁটা, দুজনের মাথায় দুরকমের ফন্দি ঘোরে। নতুন কিছু আবিষ্কারের চেষ্টায় একজন খাবারের বাটি উল্টে চামচ দিয়ে বাজনা বাজায়, আরেকজন খাট থেকে সব কাপড়-জামা ছুঁড়ে ফেলে নিজের হাতের জোর পরীক্ষা করে। দুজনকে একসাথে খাবার খাওয়ানোও ছোটখাটো একটা যুদ্ধ বলা চলে।

 

#6.বাচ্চাদের মধ্যে কম্পিটিশন ও ঝগড়া সামলানো (Competition and squabble)-> দুষ্টুমি, ঝগড়া এসব তো হবেই। এর খেলনা ও নেবে, আবার ওর পুতুলটা এর চাই। দুষ্টুমি বা মারপিট একটু একটু ভালো, বাচ্চারা এগুলো করবে না তো কি আমরা করবো নাকি? তবে ছোটখাটো খুনসুটি যেন কখনই হিংসার পর্যায়ে না পৌঁছায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হয় মা-বাবাকেই। আবার দুজনেই পড়াশোনায় সমান ভালো নাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে, কখনই তুলনা করা উচিত নয়। যে পড়াশোনায় ভালো, তাকে তার জন্য বাহবা দিন, আর যে ছবি আঁকায় ভালো তাকে তার জন্য পিঠ চাপড়ান। এভাবেই একটা সুস্থ ভাই-বোন বা ভাই-ভাই বা বোন-বোন সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
অনেক সময় দেখা যায়, একজন চুপচাপ আরেকজন বড্ড ডানপিটে। ছোট থেকেই ডানপিটেকে বোঝাতে হয় যে “ ও তোমার ভাই/ বোন আর ওকে সবকিছু থেকে প্রোটেক্ট করার দায়িত্ব তোমারই”। আবার যে চুপচাপ ঠান্ডা মাথার মানুষ, তাকে হয়তো বোঝানো হল, “ ভাই/ বোন যাতে কোনও দুষ্টুমি করে আঘাত না পায়, সেটা কিন্তু তোমাকেই দেখতে হবে”। মোদ্দা কথা, বড্ড বেশি যত্ন করে এবং আদর দিয়ে গড়ে দিতে হয় দুজনের সম্পর্কের মজবুত ভিত। আর বাবা-মায়ের ভূমিকা এখানে প্রচুর।

 

#7.আইডেন্টিটি ক্রাইসিস এবং সেপারেশন ক্রাইসিস (Identity & separation crisis)-> যমজ সন্তান অনেকে হুবহু দেখতে হয়; এদের মধ্যে পার্থক্য বাইরের মানুষ করতে পারেন না সহজে। আবার অনেকের চেহারায় বিস্তর ফারাক থাকে। যমজ সন্তান একটি ছেলে এবং একটি মেয়ে হলে এই একই দেখতে ব্যাপারটা থাকে না। একটু বড় হওয়ার পর বাচ্চাদের মধ্যে নিজেদের সত্ত্বা তৈরি হয় এবং নিজেদের পছন্দ বা ইন্টারেস্টের জায়গা তৈরি হয়। একইরকম দেখতে বাচ্চাদের ক্ষেত্রে অনেকসময়ই মানুষ আলাদা করে বুঝতে পারেন না এবং একের কাজ অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দেন। এক্ষেত্রে, বাবা-মাকে খুব ভাবনা চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। দুজনের আলাদা প্রতিভা বুঝে তাদের উৎসাহ দেওয়া, দুজনের আলাদা বন্ধু-বান্ধব তৈরিতে সাহায্য করা এবং দুজনকে সম্পূর্ণ আলাদা দুটো মানুষ হিসেবে দেখা খুবই প্রয়োজন। এতে দুজনের কেউই কোনও মনকষ্টে ভোগে না। শুধু বাড়ন্ত সময়ে নয়, ভবিষ্যতে সারাজীবন যাতে তারা “অনেকটা এক দেখতে” দুটো পৃথক সত্ত্বা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে, তার গোড়াপত্তন করতে হয় মা বাবাকেই। (Biggest Parenting Challenges of Having Twins in Bangla.)
সাধারণত, যমজ বাচ্চারা একে ওপরের সবথেকে ভালো বন্ধু হয়। একে অপরকে ছেড়ে থাকতে পারে না। শুনতে কঠিন হলেও এই ব্যাপার এড়ানোর জন্য একটু বড় হওয়ার পর থেকে দু’জনকে দু’জনের থেকে কিছুটা সময় আলাদা রাখা উচিত। ভয় পাবেন না, এতে ভালোবাসা কমে না, বরং দু’জনের আলাদা ব্যক্তিত্ব তৈরিতেই সাহায্য হয়। যেমন, একজন আঁকতে খুব ভালোবাসে, তাকে পাঠালেন আঁকার ক্লাসে; আরেকজন ভালোবাসে গান করতে, তাকে কিনে দিলেন ছোট্ট একটা হারমোনিয়াম। প্রত্যেকটা ব্যাপার খুবই সেনসিটিভ এবং বাবা-মাকে এগুলো বুঝতে প্রচুর ধৈর্য ধরে হোম- ওয়ার্ক করতে হয়।

 

যমজ সন্তান মানুষ করার চ্যালেঞ্জ! (What are some of the biggest challenges of parenting twins?)

 

বিশেষ কিছু কথা:

  • যমজ সন্তানের মা হওয়া মুখের কথা না। কিন্তু মায়েরও তো বিশ্রাম প্রয়োজন। তাই বাবা এবং বাড়ির অন্য সদস্যদের হেল্প নিন। প্রথম থেকেই কাউকেই মা ন্যাওটা করে রাখবেন না।
  • বিরক্তি আসবে, আসবে মুড স্যুইংস; কিন্তু দুটোকে কোলে নিলেই আবার তা কোথায় চলে যাবে। তাই নিজে বাচ্চা মানুষ করতে পারছেন না বা তাদের সঠিক যত্ন করতে পারছেন না এই ভেবে নিজেকে দুঃখ দেবেন না। মনে রাখবেন, আপনি শ্রেষ্ঠ মা।
  • বাচ্চাদের ওপর ভুল করেও কখনও পক্ষপাতিত্ব করবেন না। ওদের যে আপনি সমান ভালোবাসেন, সেটা প্রয়োজনে দেখিয়ে দিন। জন্মদিনে নিয়ে আসুন দুই রঙের দুটো আলাদা কেক, ওরা কেক কাটুক দু’জনেই। বড় হয়ে গেলে ওরা নিজেরাই বুঝে যাবে আপনার ভালোবাসা।
  • নিজের যত্ন নিন, নিজেকেও ভালবাসুন। শারীরিক দিক থেকে চনমনে থাকতে হলে মানসিক স্বাস্থ্যটাও ভালো রাখতে হয় যে। যে কোনও সমস্যায়, আপনার পাশে সবসময় আছি আমরা, হাতটা বাড়িয়েই দেখবেন না হয়!

আরও পড়ুনঃ ছানার স্নানের সময় হোক আরাম আর স্ফূর্তির

একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার  হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

null

null