শিশুকে ভালো করে ঘুমাতে দিন। ওর সুন্দর জীবনের চাবিকাঠি আছে এই ঘুমেই

শিশুকে ভালো করে ঘুমাতে দিন। ওর সুন্দর জীবনের চাবিকাঠি আছে এই ঘুমেই

পিকুর বয়স দু’বছর। এই বয়সের বাচ্চারা যতটা দুষ্টু হতে পারে, পিকু তার চেয়ে কম কিছু তো নয়ই, বরং একটু বেশিই বলা যেতে পারে। কিন্তু পিকুর এক অদ্ভুত সমস্যা দেখা দিয়েছে গত কয়েক মাস ধরে। এত দুরন্ত হওয়ার পরেও পিকু যেন একটু বেশিই ভারী হয়ে যাচ্ছে। তা পিকু যে সমবয়সি অন্য বাচ্চাদের চেয়ে সামান্য বেশি খায় না, এটা ওর মা অর্চনা জোর দিয়ে বলতে পারবে না। কিন্তু সে সবের সঙ্গে দুরন্তপনাটাও তো রয়েছে। তা হলে এমন ভারী হয়ে যাওয়ার কারণ কী? বেশ ভয় নিয়েই চিকিৎসকের কাছে ছুটল অর্চনা। আর সেখানে গিয়েই বিষয়টা পরিষ্কার হল। এটা-ওটা জিজ্ঞেস করার পরেই ডাক্তারবাবু জিজ্ঞেস করলেন, পিকু কি কম ঘুমাচ্ছে? মানে, ওর যা বয়স, তাতে এখন ওর দিনের মাথায় ১১ থেকে ১৪ ঘণ্টা ঘুমানো উচিত। পিকু কি তা ঘুমাচ্ছে? অর্চনা জানালো, একেবারেই না। ডাক্তারবাবু বললেন, সেটাই হল এই চেহারা ভারীর কারণ! (Benefits of Sleep for your child’s Growth & development in Bengali, Shishur ghum, Shishur Ghumer Somoysuchi, Shishur ghumer proyojoniyota.Benefits of Sleep for your child’s Growth and development in Bengali.)

 

শিশুর বিকাশে ঘুম কতটা জরুরি (Benefits of Sleep for your child’s Growth & development)

শিশুদের পর্যাপ্ত ঘুম না হলে, তাদের শরীরে লেপটিন হরমোনের ক্ষরণ কমে যায়। এই হরমোনের কাজ হল খিদে নিয়ন্ত্রণ করা। এর ক্ষরণ কমে গেলে, মস্তিষ্ক শরীরকে খিদে নিয়ন্ত্রণ করার সিগন্যাল পাঠাতে পারে না। ফলে বাচ্চারা প্রয়োজনের চেয়ে বেশি খেতে থাকে। আর তার ফলেই এই সমস্যা। আপনি নিজেও দেখেছেন, ঠিকঠাক ঘুম না হলে আপনার সোনামণির কেমন সমস্যা হয়! এটি শুধু যে শারীরিক সমস্যার জন্ম দেয়, তা নয়, একই সঙ্গে মানসিক সমস্যাও ডেকে আনে। কখনও তা বুঝতে পারেন, কখনও তা আপনার চোখ এড়িয়ে যায়। তাই প্রথমেই দেখে নেওয়া যাক, কোন বয়সের শিশুর জন্য কতটা ঘুম  দরকার। আপনিও এই তালিকা ধরে দেখে নিন, আপনার খোকা বা খুকু পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুমাচ্ছে কি না। (Benefits of Sleep for your child’s Growth & development in Bangla)

 

কোন বয়সে কতটা ঘুম (How much sleep do babies need according to their ages):

 

  • ০-৩ মাসের বাচ্চাদের জন্য (Sleep requiered for children upto 3 months old): এই সদ্যোজাত বাচ্চাদের দিনের মধ্যে ১৫ থেকে ১৮ ঘণ্টা ঘুমের প্রয়োজন। মস্তিষ্কের বিকাশের জন্য এই সময়টা তাকে ঘুমাতে দেওয়া খুবই দরকারি। মায়ের সঙ্গে তার বন্ধনটাও এই সময় তৈরি হয়। সেটাও ঘুম কমে গেলে ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে। জেগে থাকার সময়টাও যেন সকালের দিকে হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখা দরকার।

 

  • ৪ থেকে ১১ মাস বয়সি বাচ্চাদের জন্য (Sleep requiered for children from 4 to 11 months old): এই বয়সে দিনের মাথায় ১৪-১৫ ঘণ্টা ঘুম দরকার। এই সময় থেকে ঘুমের জন্য নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়া দরকার। প্রতিদিন যেন শিশু একই সময়ে ঘুমায়। এবং তাকে একা ঘুমানোর অভ্যাসটাও শুরু করা উচিত।

 

  • ১ থেকে ২ বছরের বাচ্চাদের জন্য (Sleep requiered for children from 1 year to 2 yeras old): এই বয়সের বাচ্চাদের প্রতিদিন ১১ থেকে ১৫ ঘণ্টা ঘুমাতে দেওয়া উচিত। এই বয়সে রাতে ভয় বা দুঃস্বপ্ন দেখাটাও খুব অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু তবু নির্দিষ্ট সময় তাকে একা ঘুমাতে দেওয়া উচিত। কারণ এই বয়সেই সামাজিক বোধগুলো জন্মাতে শুরু করে। ঘুম কম হলে যা ক্ষতিগ্রস্থ হয়।

 

  • ৩ থেকে ৫ বছরের বাচ্চাদের জন্য (Sleep requiered for children from 3 to 5 yeras old): ১১ থেকে ১৪ ঘণ্টা ঘুমাতে দেওয়া উচিত এই বয়সে। ঘুমের সময়ে যেন নড়চড় না হয়। আর শিশুর শোওয়ার ঘরে টেলিভিশন একদম নয়।

 

  • ৬ থেকে ১১ বছরের বাচ্চাদের জন্য (Sleep requiered for children from 6 to 11 yeras old): ৯ থেকে ১১ ঘণ্টা ঘুম দরকার এই বয়সে। শোওয়ার ঘরে থেকে টেলিভিশন এবং কমপিউটার দূরে রাখা উচিত।

 

মোটামুটি এই হল নানা বয়সে কতটা ঘুম দরকার তার পরিমাপ। এই পরিমাণ ঘুম না পেলে শিশুর মধ্যে নানা ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। একনজরে সেগুলোও দেখে নেওয়া যাক।

 

আরও পড়ুনঃ মোবাইল ফোন খেলনা নয়; দূরে রাখুন বাচ্চাকে!

 

 

পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে কোন কোন সমস্যা? (What happens when babies don’t get enough sleep?)

 

  • মস্তিষ্কের বিকাশ রোধ (Brain development stops): পর্যাপ্ত ঘুম না পেলে শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশ রোধ হতে পারে। যা ভবিষ্যতের জন্য খুবই সমস্যার।

 

  • শারীরিক বৃদ্ধি হ্রাস (Physical growth stops): শিশুর বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় হরমোনের ক্ষরণ শুধুমাত্র ঘুমের সময়ই হয়। ঘুমে টান পড়লে শিশুর বৃদ্ধির হারও কমে যায়।

 

  • শরীর ভারী বা ওবেসিটি (Obesity): কম ঘুমালে শরীরে লেপটিন হরমোনের ক্ষরণ বাড়ে। যা হল খিদেকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য দরকারি হরমোন। এই হরমোনের অভাবে খিদের উপর আর নিয়ন্ত্রণ থাকে না। ফলে শিশু বেশি খায়। এবং ওজন বাড়তে থাকে।

 

  • শেখার আগ্রহ কমে (Lack of interest in learning new skills): কম ঘুমালে শিশুর শরীরে কোর্টিসল বা স্ট্রেস হরমোনের ক্ষরণ বাড়ে। এতে শিশু মানসিক ভাবে খুব চাপে থাকে এবং নতুন কিছু শেখার প্রতি তার আগ্রহ কমে যায়।

 

  • রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে (Low immunity): কম ঘুমালে শিশুর শরীর ক্লান্ত থাকার কারণে রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। অল্পেই ঠান্ডা লাগা বা অসুস্থ হয়ে পড়ার প্রবণতা দেখা যায় এই সব শিশুর মধ্যে।

 

 

শিশুর বিকাশে ঘুম কতটা জরুরি (Benefits of Sleep for your child’s Growth & development)

ঘুমের অভাবে কোন কোন সমস্যা হয়, তা তো জানা গেল। এবার দেখে নেওয়া দরকার,

 

সঠিক পরিমাণে ঘুম পেলে শিশুর কোন কোন উপকার হয়।(Benefits of sleep for child’s growth and development in Bangla)

 

#1. শেখার ক্ষমতা (Learning power): যে শিশু পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমায়, তার শেখার ক্ষমতা বাড়ে। খুব সহজেই সে নতুন কিছু শিখে নিতে পারে। একদম ছোট বয়স থেকেই তাদের মধ্যে মনঃসংযোগ করার ক্ষমতাও দ্রুত বৃদ্ধি পায়। চট্ করে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রেও এই দলের শিশুদের বেশি পারদর্শী বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এমনকী পরবর্তী সময়ে এই দলের শিশুরা পড়াশোনাতেও বেশি মনোনিবেশ করতে পারে। মাথা ঠান্ডা রাখার ক্ষেত্রে এরা অন্যদের থেকে এগিয়ে থাকে।

 

#2. দ্রুত বৃদ্ধি (Faster growth): আগেই বলা হয়েছে, ঘুমালে শিশুর শরীরে সেই সব হরমোনের ক্ষরণ হয়, যেগুলো তার বৃদ্ধিতে কাজে লাগে। তাই যে শিশু যত বেশি ঘুমায়, সে তত তাড়াতাড়ি বাড়ে। এমনকী তার রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতাও কম ঘুমানো শিশুদের থেকে বেশি। কারণ পর্যাপ্ত ঘুম বাইরের জীবাণুর সঙ্গে লড়াই করার জন্য শরীরকে তৈরি করে তোলে। পরবর্তী সময়ে এই শিশুরা সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হয়।

 

#3. মন ভালো থাকে (Healthy mood): বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে সব শিশুরা পর্যাপ্ত ঘুমায়, তাদের শরীরে এনার্জি বা শক্তির পরিমাণ অন্য শিশুদের তুলনায় বেশি হয়। ফলে তারা একেবারেই ঘ্যানঘ্যানে হয় না। বরং তাদের মেজাজ অন্য শিশুদের তুলনায় ভালো থাকে। যদি আপনার সোনামণি খুব ঘ্যানঘ্যানে হয়ে যায়, তা হলে তার পিছনে ঘুমের অভাবটাও একটা কারণ হতে পারে।

 

#4. মিশুকে স্বভাবের (Good social behaviour): পরিসংখ্যান বলছে, যে সব শিশুরা পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমায় তারা সহজেই অন্যের সঙ্গে মিশতে পারে এবং নতুন পরিবেশে খাপ খাইয়ে নিতে পারে।

 

#5. হৃদযন্ত্রের জন্য ভালো (Sleep helps the heart): যে সব শিশুরা পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমায়, তাদের হৃদযন্ত্রও শক্তিশালী হয়। পরবর্তী সময়ে বা বেশি বয়সে তাদের হৃদয়ন্ত্রের সমস্যার আশঙ্কাও কমে।

 

 

বাবা-মায়েদের জন্য কয়েকটা টিপস (Tips for better sleep):

 

  • প্রতিদিন ঘুমের সময়টা যেন এক থাকে, সেদিকে নজর রাখুন।

 

  • আপনার শিশু যে ঘরে ঘুমাচ্ছে, সেই ঘর যতটা সম্ভব অন্ধকার রাখুন। এবং পারলে সেই ঘর একেবারে নিস্তব্ধ রাখুন।

 

  • শিশুকে নরম বিছানায় শুতে দিন। চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে তার গদি এবং বালিশ বাছুন।

 

  • ঘুমাতে যাওয়ার আগে শিশুকে বাথরুম থেকে ঘুরিয়ে আনুন। বা সে যেন নিজেই ঘুরে আসে—সেই অভ্যাস তৈরি করুন। এতে মাঝপথে ঘুম ভাঙার আশঙ্কা কমবে।

 

  • শিশুকে জোর করে ঘুম থেকে তুলবেন না। খেয়াল রাখুন তার যেন নিজে ঘুমাতে যাওয়ার এবং ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস তৈরি হয়ে যায়।

 

  • শিশুর শোওয়ার ঘরে টেলিভিশন বা কমপিউটার একেবারে নয়। এই সব যন্ত্রের আলোয় ওর ঘুমের ব্যাঘাত হয়।

 

  • শিশুর হাতে মোবাইল ফোন যতটা সম্ভব কম তুলে দিন। ঘুমাতে যাওয়ার আগে তো মোবাইল একেবারেই দেবেন না। এতে ঘুমের সমস্যা তো হয়েই থাকে, পাশাপাশি চোখেরও মারাত্মক ক্ষতি হয় এর ফলে।

 

মনে রাখবেন, আপনার সোনামণিকে ভালো খাবার খাওয়ানো বা আরামে রাখাটাই যথেষ্ট নয়। তাকে ভালো ঘুম দেওয়াটাও তার ভবিষ্যতের জন্য খুব দরকারি। সেটা দিতে পারলে, আপনি তাকে একটা সুন্দর জীবন দিতে পারবেন।

আরও পড়ুনঃ রাতভর শিশুর নিশ্চিন্ত ঘুমের ৭টি সহজ টিপস!

 

একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার  হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

null

null