পাক ধরা চুল, ক্ষীণ-দৃষ্টি, অশক্ত শরীর অথচ তীক্ষ্ণ স্মৃতিশক্তি! এক পাল খুদের মধ্যে মধ্যমণি হয়ে বসে আছেন থুরথুরে ঠাকুরমা। আর তাঁর ঝুলি থেকে বেরিয়ে আসছে ভূত-পেত্নি, দৈত্য-দানো, লালকমল-নীলকমল, রাজ-রাজাদের দারুণ সব গপ্পো! সেই গল্প থেকেই স্বপ্ন। আর স্বপ্ন থেকে কল্পনা। যার কোনওটা শেখায় নির্ভীকতা, কোনওটা নৈতিকতা…
অতীতের এই রেওয়াজ ইদানীং কমেছে। পাঠ্যক্রম ও প্রতিযোগিতার চাপে গল্প শোনা তো দূর অস্ত, গল্পের বইয়ের ধারপাশ দিয়ে হাঁটারও সময় পাচ্ছে না কচিকাঁচার দল। শুধু তাদেরই বা দোষ দিলে চলে কী করে! ছোট্ট ছোট্ট পরমাণু পরিবারগুলিতে ঠাকুরমার অস্তিত্বই বা কোথায় এখন! সদ্য বসতে শেখা বাচ্চাকে আয়ার কাছে রেখেই সংসারের হাল টানতে দিনভর দৌড়ে যাচ্ছেন মা-বাবা। গল্প পড়ে শোনানো যেন বিলাসিতারই সমতূল! (Benefits of Reading to Your Baby)
কিন্তু মনোবিদরা ঠিক কী বলছেন জানেন? তাঁরা বলছেন, দিনের গল্পই রাতে স্বপ্ন হয়ে ফেরে…শিশু যদি গল্পই না শোনে তা হলে কোনও কিছু কল্পনা করার রসদ সে পাবে কোথায়? যদি কল্পনাই না করতে পারে তা হলে তার চিন্তন-মননের বিকাশ হবে কী করে? আর যদি চিন্তন-মনন, মানে ভাবনাচিন্তা করার কোনও ক্ষমতাই না তৈরি হয় তখন? তখন আর কী! থমকে যাবে আপনার শিশুর বিকাশের প্রক্রিয়াটাই! তাই বলছি, শুধু গল্পের খাতিরে নয়, বাড়ন্ত বাচ্চাকে গল্প শোনান তারই বিকাশের খাতিরে…
দেখে নিন, গল্প শোনা এবং পরবর্তীতে সেটাকে বলা ও লেখার মধ্যে দিয়ে কীভাবে শিশুর বিকাশ হয়!
#1. শব্দভান্ডার বৃদ্ধি পাবে (Improves vocabulary)
অনুকরণ, অনুসরণ করেই নানা কিছুু শিখে নেয় শিশু। আপনি যখন ওকে গল্প পড়ে শোনাবেন, সেটাও সে অনুকরণ করারই চেষ্টা করবে। আপনি যে ভাষার প্রয়োগ করছেন, মিষ্টি মিষ্টি যে শব্দগুলো ওর সামনে উচ্চারণ করবেন, সেগুলোই আত্মস্থ করবে ও। গল্পের বইয়ের রুচিশীল ও শিশুদের বোঝার উপযোগী ভাষাই ধীরে ধীরে ওর মনে শব্দের ভান্ডার তৈরি করে দেবে!
#2. শোনার দক্ষতা বৃদ্ধি পায় (Improves listening skills):
ছোট্ট শিশুরা মোটেই কিছু শুনতে ভালোবাসে না। তার চেয়ে দুষ্টুমি করা, সদ্য শেখা শব্দগুলো আওড়ে যেতেই বেশি স্বচ্ছন্দ তারা। আপনি যদি রোজ নিয়ম করে গল্প শোনান ওকে, তা হলে গল্পের প্রতি আগ্রহ তৈরি হবে ওর এবং মন দিয়ে কিছু শোনার দক্ষতাও তৈরি হবে। এরই সাথে কোনও কিছু সহজে বোঝার ক্ষমতাও তৈরি হবে ওর।
#3. সৃজনশীলতা ও কল্পনা শক্তি বাড়ায় (Improves thinking & imagination power):
গল্প শুনতে শুনতেই মনে মনে কল্পনার দুনিয়া তৈরি করতে থাকে শিশুর মন। শোনার সাথে সাথেই একটা ঘটনা মনে মনে এঁকে ফেলতে চায় সে। এভাবে গল্পের দৃশ্য, প্লট সবই ছকে যায় ওর মনে। যার ফলে ধীরে ধীরে বিকাশ হয় কল্পনাশক্তির। এবং তারই সাথে বিকাশ ঘটে শিশুর সৃজনশীলতারও।
#4. স্মৃতিশক্তি ধারালো হয় (Boosts memory):
সন্তানকে গল্প শোনানর মাধ্যমে ওর কতটা মনে রাখার ক্ষমতা তৈরি হয়েছে, ওর স্মৃতিশক্তিই বা কতটা প্রখর হচ্ছে, তাও যাচাই করতে পারবেন আপনি। আজ একটা গল্প শুনিয়ে তার মানে ভালো করে বুঝিয়ে দিন। কিছুদিন যাক, পুঁচকেটাকেই বলুন সেই গল্পটা আপনাকে শোনাতে, মানে বোঝাতে!
#5. প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা আরও সহজ হবে (Helps to do well in school):
অনেক বাচ্চারই মুখস্থ করার ক্ষমতা থাকে প্রবল। কোনও কিছু না বুঝেই সেটা ঝরঝরে মুখস্থ করে ফেলে পরীক্ষায় দারুণ ফল সে করে ফেলে। কিন্তু আপনার সন্তানের যদি ছোট থেকেই শোনার মানসিকতা ও অভ্যাস থাকে তা হলে আগামী দিনে স্কুলের পড়া আরও সহজ হয়ে যাবে ওর কাছে। যা-ই পড়ুক না কেন, সেটা অনেক সহজ হবে তার কাছে। যে কোনও জিনিসই সহজে রপ্ত করতে পারবে সে!
#6. যোগাযোগ দক্ষতা বৃদ্ধি (Enhances communication skills):
স্বভাবগত ভাবেই শিশুরা বড্ড লাজুক ও নরম হয়। কোনও কিছু নিয়ে প্রশ্ন করতে সংকোচ হয় তাদের। আপনার সন্তানের যদি গল্প শোনার অভ্যাস থাকে, তা হলে এই সমস্যা কাটিয়ে উঠবে সে। যে কোনও কিছুই বিশ্বাসের সাথে প্রশ্ন করতে পারবে। এভাবে যোগযোগ দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে তার!
এতো গেল গল্পের বই পড়ে শোনানোর উপকারিতার সাতকাহন। কিন্তু জানেন কি, গল্প পড়ারও একটা ধরন-ধারণ আছে? না জানলেও কুছ পরোয়া নেহি। নীচেই রইল তার টিপস! The benefits of Reading to Your Baby in Bangla.
#1. কোন সময়ে গল্প (Which is the best time for story telling):
গল্প পড়ে শোনানোর আবার সময় হয় নাকি! ঘুমের আগে হোক, পড়া শেষ করার পর হোক, বাসে হোক, ট্রেনে হোক- রোজ নির্দিষ্ট সময় আপনার সন্তানটিকে গল্প শোনান। এতে ওর ভিতর শৃঙ্খলাও তৈরি হবে ধীরে ধীরে। কাহিনিগুলো শুনে ওর চোখ-মুখের অভিব্যক্তি কী হচ্ছে, তা-ও নজর রাখুন। যখন দেখবেন ওর মনোযোগ সরে গিয়েছে, জোর করবেন না। মনে রাখবেন, জোর করতে গেলে গল্পের প্রতিই বিরক্তি তৈরি হতে পারে ওর! গল্পের বই পড়ে শোনানোর সময় টিভি, কম্পিউটারও বন্ধ রাখুন। এতে ওর মনোযোগে ঘাটতি হতে পারে!
#2. কীভাবে গল্প বাছাই করবেন (What types of books are suitable for babies):
গল্প-কাহিনির মধ্য়ে দিয়েই শিশুর নৈতিকতা, মূল্যবোধ তৈরি হয়। এমন গল্পই তাই বেছে নিন, শিশু যেটা শুনে মজা পাবে সেই সাথে তাতে শিক্ষণীয় বার্তাও থাকবে। বই বাছাই করার আগে দেখে নিন সেটি যাতে রঙিন-ছবিওয়ালা হয়। পপ আপ বই পেলে তো কথাই নেই! কথা দিতে পারি, চোখ ফিরবে না আপনার সন্তানের। যদি বাচ্চা একটু বড় হয়, তা হলে ওকে সঙ্গে নিয়েই বই কিনতে যান!
#3. সুর করে, ছড়া কেটে শোনান (How to better narrate stories to kids):
একঘেয়ে ভাবে একটা গপ্পো শোনার চেয়ে সুর করে, ছড়া কেটে তা বললে অনেক বেশি উপভোগ করে শিশুরা। তাই যে গল্পই পড়ুন না কেন, সেটাকে শিশুর কাছে আকর্ষণীয় করে তুলুন। গল্পে যদি পশু-পাখির কোনও চরিত্র পান, তাদের ডাক নকল করে শিশুকে শোনান। এগুলো ওর মনোযোগ ধরে রাখবে। রাজা-রানির গল্প হলে দুটো পুতুল বসিয়েই গল্প শোনান। এতে গল্পের মধ্যে অনেক তাড়াতাড়ি ঢুকতে পারবে আপনার শিশু।
#4. এক গল্প বারবার বলুন (Repeat stories):
ছোটরা একই গল্প বারবার শুনতে পছন্দ করে। আর মজার বিষয় হলো, প্রতিবারই একই রকম উৎসাহ নিয়ে গল্পটা আত্মস্থ করে তারা। এই কারণেই আপনার কাছে পুরনো গল্প শোনারই আবদার করতে পারে ও। বিরক্ত হবেন না, বরং আপনিও চেষ্টা করুন আগের বারের মতোই গল্পটা মজা-রস মাখিয়ে আবার পরিবেশন করার। শিশুর মনে থাকছে কি না পরখ করে নিতে গল্পের খানিক অংশ আপনি বললেন, খানিকটা বলতে দিলেন ওকে! The benefits of Reading to Your Baby in Bangla.
জগতের এক সেরা রূপকার পিকাসো বলতেন, ‘তুমি যা কিছু কল্পনা করতে পারো, তা-ই সত্যি’। সেই কল্পনার দরজাটা আজকের প্রজন্মের কাছে আরও একবার তুলে ধরতেই এত্ত কিছু লিখে ফেলা আজ! বাঙালি শিশুর ভাণ্ডারে যুগ যুগ ধরে রয়ে গিয়েছে চ্যাং-ব্যাং, ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমী, সাত ভাই চম্পারা। কল্পনার নদী বেয়ে তেপান্তরের মাঠ পেরোতে একটুও দেরি হয় না তার! বাঙালি সব শিশুই শৈশবে এক। বড় হয়ে ভিন্ন। আর এই এক থাকার জায়গাতেই ফিরে আসুক মা-দিদিমার আঁচলে ছেয়ে থাকা নানান গল্প…
আরও পড়ুন (Also Read): Brain Development Toys for Kids
একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।
null
null