উদ্ধত, বদরাগী, একগুঁয়ে সন্তান; বিষয়টা কিন্তু একেবারেই হেলাফেলার নয়

উদ্ধত, বদরাগী, একগুঁয়ে সন্তান; বিষয়টা কিন্তু একেবারেই হেলাফেলার নয়

দৃশ্য ১: কোনও আবদারে “না” বললেই প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে পড়ছে ৫ বছরের টুবাই। তার মনমতো কোনও কাজ না হলেই চিৎকার করে বাড়ি মাথায় করা তো বটেই, রাগের চোটে সে নিজের মাথা ক্রমাগত ঠুকতে শুরু করছে দেওয়ালে। ওর যে মাথায় ব্যথা লাগছে, এই নিয়ে যেন কোনও হুঁশই নেই। ছেলে মাথা ফাটিয়ে ফেলবে দেখে ভয় পেয়ে ছেলের মনমতো কাজ করতে ছুটলেন মা। তবে ছেলে শান্ত হল। (Common Child Behavior Problems and Their Solutions)

দৃশ্য ২: ৬ বছরের পিকাইকে কারও বাড়ি নিয়ে যেতে ভয় পান তার মা-বাবা। সে কারও বাড়ি গেলেই তাদের আলমারি খুলে সব খেলনা, জিনিস বের করে ছড়িয়ে ফেলে। না বলে হাত দেয় অন্যের দরকারি জিনিসে (Childhood Behavior Problems)। স্বভাবতই বিরক্ত হন আত্মীয়রা।

ওপরে মাত্র দুটো দৃশ্য তুলে ধরেছি, এরকম আরও অনেক আচরণ বাচ্চারা করে থাকে, যেটা করা একেবারেই উচিত নয় বা অন্যদের কাছে অভদ্রতামি। “বাজে ছেলে”, “বদমাইশ বাচ্চা” বা “অভদ্র সন্তান” ইত্যাদি তকমা লাগানো সহজ হলেও এর পিছনে থাকা ব্যাখ্যাটা কিন্তু এত সহজ নয়।

অনেক ক্ষেত্রেই বাবা-মায়ের চেষ্টা কোনও কাজে লাগে না, আবার অনেক ক্ষেত্রে নিজেদের অজ্ঞানতা তাদের চালিত করে বিপথে। সন্তানের সাথে সাথে নিজেদের ভবিষ্যৎও শেষ করতে বসেন তারা।

মনকে নিয়ন্ত্রণ না করতে পারা কোনও কঠিন অসুখ না হলেও একেবারে অবহেলার যোগ্য নয় (Common Behavioural Problems in Children)। আচরণ ও ব্যবহারে অস্বাভাবিকতা নষ্ট করে দিতে পারে সন্তানের জীবন। তাই সন্তানের আচরণের ওপর নজর রাখুন আজ থেকেই। নিজেরা চেষ্টা করুন তাকে শুধরানোর। আয়ত্তের বাইরে চলে গেলে ডাক্তারবাবুর সাহায্য নিতে দ্বিধা করবেন না। আপনার সঠিক সিদ্ধান্ত বদলে দিতে পারে তার আগামী জীবন।

সন্তানের কোন কোন আচরণ একেবারেই কাঙ্খিত নয় (Common Behavioral Issues in Kids) এবং কী কী ঘটনা একেবারেই অবহেলা করবেন না, আজ সেই নিয়েই আমাদের প্রতিবেদন। দেখে নিন নিজের সন্তানের খাতিরে।

 

বাচ্চাদের যে ধরনের আচরণ একেবারেই কাঙ্খিত নয় (Common Childhood Behavioral Problems)

  • সবসময় বড়দের কথার অবাধ্যতা করা এবং ইচ্ছে করে বাবা-মায়ের কথা না শোনা।
  • রাগ হলে প্রচণ্ড চিৎকার করা, জিনিসপত্র ছুড়ে ফেলা, ভাংচুর করা, নিজেকে বা সামনে কাউকে আঘাত করা।
  • প্রচণ্ড উদ্ধত, জেদি এবং বদরাগী।
  • খারাপ ভাষায় কথা বলা, স্থান-কাল-পাত্র না মেনে গালাগালি দেওয়া।
  • কারও বাড়ি নিয়ে গেলে অভদ্রতা করা। অনুমতি না নিয়ে অন্যের জিনিসপত্র হাত দেওয়া বা না বলে বাড়ি নিয়ে চলে আসা। (The Most Common Behavior Disorders in Children)
  • খাবার খেতে দিলেই অশান্তি করা, খাবার ছুড়ে ফেলা।
  • প্রায় সময়ই মিথ্যে কথা বলা।
  • বন্ধুদের বা অন্যান্য লোকজনকে আঘাত দিয়ে কথা বলা।
  • স্কুলে সবসময় উদ্ধতভাবে কথা বলা, বন্ধুদের আঘাত করা, গালাগালি দেওয়া।
  • বয়সের তুলনায় অতিরিক্ত পাকা আচরণ বা বড়দের অপ্রয়োজনে নকল করা।
  • মানসিক অস্থিরতার জন্য পড়াশোনা করতে না পারা, কোনও কাজে মনোযোগ না দেওয়া বা সবকিছু শিখতে দেরি। (Types of Behavioural Problems)

 

মা-বাবা হিসেবে আপনারা যেটা করতে পারেন (Treatment of Behavioural Disorders in Children)

  • বাচ্চা যখন অবাধ্যতা করবে, সেই মুহূর্তে তাকে ধমক দিয়ে বা বকে কোনও লাভ হয় না। ঠান্ডা মাথায় জিজ্ঞাসা করুন, কেন ও আপনার কথা শুনছে না? কথা না শোনার শাস্তি হিসেবে একদিন খেলতে যাওয়া বন্ধ করে দিন বা কথা বলাই বন্ধ করে দিন।
  • বাচ্চা যখন প্রচণ্ড রেগে চিৎকার করবে, তখন আপনিও রাগ করে চিৎকার করবেন না। বাচ্চা যদি দেখে, আপনিও চিৎকার করে বা মারধর করেই পরিস্থিতি আয়ত্তে আনছেন, সেও পরবর্তীতে ওই চিৎকারকেই হাতিয়ার বানাবে।
  • বাচ্চার সামনে কখনই কোনও উত্তেজক সিনেমা বা অনুষ্ঠান দেখবেন না। বাড়িতে যেন গালাগালাজ করা, একে অন্যকে দোষারোপ করা বা অশ্রাব্য কথোপকথন; এই ধরনের পরিস্থিতি গড়ে না ওঠে।
  • বাচ্চা যদি গালাগাল দেয়, কখনই মেনে নেবেন না। এবং এটা করুন ছোট থেকেই। আধো-আধো বুলিতে গালাগালি দিলে খুবই মিষ্টি শুনতে লাগতে পারে এবং অনেকে এটা বেশ উপভোগ করেন। কিন্তু
  • ভবিষ্যতের কথা ভেবে এটাকে প্রশ্রয় দেবেন না। বাচ্চা বড় হয়ে গালাগালি দিলে সবচেয়ে লজ্জায় কিন্তু আপনি পড়বেন। তাই লাগাম টানুন আজকেই। শাসন করুন প্রয়োজনমতো।
  • মিথ্যে কথা বলতে থাকলে বাচ্চাকে প্রথমেই মিথ্যেবাদী তকমা যেন না দেওয়া হয়, সেদিকে খেয়াল রাখুন। বাচ্চা কেন মিথ্যে বলছে, ওর এই আচরণের পিছনে কোনও ভয় বা মানসিক উদ্বেগ কাজ করছে কি না বা না চাইতেও ও মিথ্যে বলে কি না, এগুলো বোঝার চেষ্টা করুন।
  • বাচ্চা যেন আপনাকে ম্যানুপুলেট না করে কখনই। বাচ্চাকে ভয় পাবেন না। আইসক্রিম কিনে দিচ্ছেন না বলে বাচ্চা রাস্তায় শুয়ে পড়লো আর আপনি রাস্তায় সিন ক্রিয়েট হচ্ছে ভেবে আইসক্রিম কিনে দিলেন! পরিস্থিতি তখনকার মতো শান্ত হয়ে গেলেও পরবর্তীতে বাচ্চা এই পদ্ধতিই অবলম্বন করবে। ওকে বুঝিয়ে দিন “না” মানে “না”।
  • নিজের ভাইবোন বা বন্ধুদের যদি খারাপ কথা বলে, আঘাত দিয়ে কথা বলে, একদমই প্রশ্রয় দেবেন না। মানুষকে সম্মান করতে, অনুভুতির সমাদর করতে শেখান ছোট থেকে। প্রথম থেকেই কড়া নজর রাখুন।
  • বুঝিয়ে বলে কাজ না হলে বন্ধ ঘরে আটকে রাখুন ঘণ্টাখানেক। আপনি যে ওর এই কাজ পছন্দ করছেন না এবং ওকে যথা শীঘ্র সম্ভব এই অভ্যেস ছাড়তে হবে বুঝিয়ে দিন সেটা।
  • বাচ্চা স্কুলে কেমন থাকে খবর নিন রোজ। বাড়ির মধ্যে এবং বাড়ির বাইরেও ওর ব্যবহার কেমন, খোঁজ রাখুন সবসময়। ওর সাথে বেশি গল্প করুন, মানুষের সাথে মিশতে শেখান এবং সৃজনশীল কাজে নিযুক্ত করুন।

 

আরও পড়ুন: শুধু শেখানো নয়, শিশুর খাতিরে বদলাতে হবে আপনাদেরও। শৃঙ্খলা শিখতে হবে শিশুর সাথেই!

 

বাচ্চার অস্বাভাবিক ব্যবহারের কারণ ওর কোনও অসুস্থতা নয় তো? (Diagnosis of Children’s Behavioural Disorders)

বাচ্চারা বদমাইশি করে, দুষ্টুমি করে, জেদও করে। কিন্তু, বাবা-মা যদি সঠিক সময়ে লাগাম টানেন বা একটু ধৈর্য সহকারে বাচ্চাকে খারাপ-ভালোর পার্থক্য বুঝিয়ে দেন, বড় হওয়ার সাথে সাথে বাচ্চা কিন্তু অনেক নমনীয়, শান্ত ও বুঝদার হয়।

কিছু কিছু ক্ষেত্রে ঘটনা ঘটে একটু অন্যরকম ভাবে। বাবা, মা হাজার চেষ্টা করা সত্ত্বেও বা ধৈর্য ধরে বোঝানো সত্ত্বেও বাচ্চার আচরণে কোনও পরিবর্তন হয় না। যত দিন যায়, তার বিরক্তি, রাগ, জেদ সবকিছুই যেন আরও বেয়াড়া আর খাপছাড়া হয়ে যায়। শান্ত হওয়ার ৫ মিনিটের মধ্যে আবার ভুলে যায় সবকিছু।

এসব ক্ষেত্রে হাত গুটিয়ে বসে থাকাটা বোকামি ছাড়া কিছু নয়। সবরকম চেষ্টা করার পরেও সন্তান যদি হাতের বাইরে চলে যায়, তা হলে সেটা হয়তো ওর ইচ্ছাকৃত নয়। মানসিক কোনও সমস্যা বা বিহেভিওরাল ডিসঅর্ডারে (Behavioral Disorders) ভুগছে সে।

এক্ষেত্রে প্রয়োজন একজন শিশু মনস্তত্ত্ববিদের পরামর্শ। মনকে কীভাবে আয়ত্তে আনা যাবে, অনুভূতিকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে এসব কিছু নিয়ে সাহায্য করতে পারেন মনোবিদই। শুধু সন্তানকে নয়, মা-বাবাকেও তারা দিয়ে দেবেন গাইডলাইন।

 

বাচ্চার অস্বাভাবিক ব্যবহারের পিছনে লুকিয়ে থাকতে পারে মানসিক কিছু অসুস্থতা। যেমন:

  • অপজিশনাল ডেফিইয়ানট ডিসঅর্ডার (oppositional defiant disorder (ODD)
  • কন্ডাক্ট ডিসঅর্ডার (Conduct Disorder (CD)
  • অ্যাটেনশন হাইপারঅ্যাকটিভিটি ডিসঅর্ডার (Attention Deficit Hyperactivity Disorder (ADHD)

 

#1. অপজিশনাল ডেফিইয়ানট ডিসঅর্ডার (oppositional defiant disorder (ODD): ১০-১২ বছরের নীচে বাচ্চারা এই অসুস্থতায় আক্রান্ত হয়। মেয়েদের তুলনায় ছেলেরাই এতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রচণ্ড রাগ, বায়না, মুখে মুখে তর্ক করা, কথা না শোনা, আত্মবিশ্বাস কমে যাওয়া, অন্যকে দোষারোপ করা, খারাপ ব্যবহার ইত্যাদি এই রোগের সাধারণ লক্ষণ।

#2. কন্ডাক্ট ডিসঅর্ডার (Conduct Disorder (CD)): এক্ষেত্রেও দেখা গেছে ছেলেরাই বেশি আক্রান্ত হয়। বাবা-মায়ের অবাধ্যতা করা, কম বয়সে নেশার জিনিসে আসক্তি, পশুপাখিদের কষ্ট দেওয়া, হিংসাত্মক কাজে উৎসাহ, মারামারি করা, বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার প্রবণতা এবং কিছু ক্ষেত্রে আত্মঘাতী হওয়ার প্রবণতাও (Bad Child Behavior Examples) দেখা যায় এই মানসিক রোগে আক্রান্তদের ক্ষেত্রে।

#3. অ্যাটেনশন হাইপারঅ্যাকটিভিটি ডিসঅর্ডার (Attention Deficit Hyperactivity Disorder (ADHD): মেয়ে সন্তানের তুলনায় ছেলেরাই এই ধরনের মানসিক অসুস্থতার শিকার বেশি হয়। এক্ষেত্রেও উদ্ধত স্বভাব, ভুলে যাওয়ার প্রবণতা, অন্যের কথার ওপর কথা বলা, চিৎকার করা, প্রচণ্ড চঞ্চল মন ইত্যাদি উপসর্গ হিসেবে দেখা দেয়।

দেখতে গেলে, এই ধরনের মানসিক অসুস্থতার লক্ষণগুলো মোটামুটি একই ধরনের হয়ে থাকে। চেষ্টা করেও যদি কাজ না হয় সেক্ষেত্রে শিশু মনোস্তত্ত্ববিদের সাহায্য নেওয়াটা একান্ত জরুরি (How to Help a Child with Behavior Problems)। নানারকম থেরাপি, মেডিটেশন এবং মেডিকেশনের সাহায্যে এর নিরাময় সম্ভব। তাই সতর্ক থাকুন আজ থেকেই। বাচ্চার শরীর নিয়ে আপনি যত সচেতন, মনের খবরও রাখুন ঠিক ততটাই। (Common Child Behavior Problems and Their Solutions)

 

আরও পড়ুন: ছোট্ট সোনার যদি কোনও বিপদ হয়? আগে থেকে ওকে সতর্ক করে রাখার উপায় কী কী?

 

একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার  হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

 

 

null

null