বিছানায় বাচ্চার প্রস্রাব করা একরকমের ব্যাধি; জেনে নিন কারণ ও প্রতিকার!

বিছানায় বাচ্চার প্রস্রাব করা একরকমের ব্যাধি; জেনে নিন কারণ ও প্রতিকার!

ছোট্ট অভিষেকের বয়স এখন সাড়ে ছয় বছর। কয়েক মাস আগেই ও ক্লাস টু-তে ভর্তি হয়েছে। এমনিতে অভি যথেষ্ট স্মার্ট। যে কোনও কিছুই খুব তাড়াতাড়ি শিখে নিতে পারে। এমনকী ক্লাসের বাকিদের থেকে অনেক আগে ও এবিসিডি শিখে নিয়েছিল। তাও একটা ব্যাপারে ওকে মায়ের কাছে প্রায়ই বকা খেতে হয়। ও নিজেও এই নিয়ে খুব লজ্জা পায়। ব্যাপারটা হল, ও এখনও রাতে বিছানা ভিজিয়ে ফেলে। কিছুতেই হিসু চেপে রাখতে পারে না। বা হিসু পেলে, ঘুম ভাঙে না। (Tips to Handle Your Child’s Bedwetting)

ঘটনাটা একদিনের নয়, ছোট থেকেই চলে আসছে। সূর্যতপা ভেবেছিল ছোটদের ক্ষেত্রে এটাই তো স্বাভাবিক। বড় হলে আপনাআপনি সব ঠিক হয়ে যাবে। তবে আদতে তা হয়নি। বরং স্কুলজীবন শুরু হওয়ার পরও অভির এই কুঅভ্যাস ওকে চিন্তায় ফেলেছে। ওকে বেশ কয়েকবার বোঝানোর পরেও কোনও লাভ হয়নি। অবশেষে সূর্যতপা একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নিল। চিকিৎসককে সমস্ত ব্যাপারটা বলাতে উনি অনেকগুলো দিক তুলে ধরলেন।

 

নকটার্নাল এনিউরেসিস (Nocturnal Enuresis): বাচ্চাদের বিছানা ভিজিয়ে ফেলার এই অভ্যাসকে ডাক্তারি পরিভাষায় নকটার্নাল এনিউরেসিস বলে। এর অর্থ হল রাতের বেলায় অসময়ে মূত্রত্যাগ হয়ে যাওয়া বা মূত্র ধরে‌ রাখার ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলা। বিশেষজ্ঞদের মতে, সব বয়সেই এমন ঘটনা ঘটা সম্ভব। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই ব্যাপারে নিজের হাত থাকে না। খুদেদের ইউরিনারি সিস্টেমের সব অঙ্গ যথেষ্ট পরিণত হয় না। সে কারণে ওদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা বেশি দেখা যায়।

  • কোন বয়সে এমনটা হয়? বিছানা ভেজানো শিশু বয়সে খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। দুই থেকে তিন বছর বয়সে সাধারণত শিশুরা ইচ্ছে মতো হিসু করতে শেখে। এই বয়সে মাত্র ৭ শতাংশ শিশুই নিজেদের হিসুর ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে। বাকিরা সেটা পারে না (Age Range Of Bed-Wetting)। পাঁচের গণ্ডি না পেরনো পর্যন্ত বেশিরভাগ খুদেই বিছানা ভিজিয়ে ফেলে। একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, ৫ বছর পেরোলেও ১৫ শতাংশ বাচ্চার ক্ষেত্রে বিছানা ভিজিয়ে ফেলার প্রবণতা থাকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ১৩-র গন্ডি না-পেরনোর আগে বিছানা ভিজিয়ে ফেলার এই প্রবণতা সম্পূর্ণ যায় না‌।
  • কখন চিন্তা করবেন না? বিশেষজ্ঞদের কথায়, সাধারণত বিছানা ভেজায় না, এমন শিশু যদি মাঝে মধ্যে দু’-একদিন বিছানায় হিসি করে ফেলে, তা হলেও চিন্তার কিছু নেই। নতুন স্কুল যাওয়া খুদের মনে যেমন একরাশ বিস্ময় জেগে ওঠে, তেমনই নানা ব্যাপার নিয়ে ভয়, দুশ্চিন্তাও থাকে। এমন ভয় দুশ্চিন্তার রেশ মনে থাকলে দু’-একদিন বিছানা ভিজিয়ে ফেলা স্বাভাবিক ঘটনা।
  • কখন চিন্তা করবেন? বাচ্চা প্রায়ই বিছানা ভিজিয়ে ফেললে, তা চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। নিয়মিত বিছানা ভেজানোর জন্য সবসময় খুদেই দায়ী, তা কিন্তু নয়। বরং অনেকক্ষেত্রেই দেখা যায়, ওর কোনও ভূমিকাই নেই। বিশেষজ্ঞদের মতে, ইউরিনারি ব্লাডার ঠিক মতো পরিণত না-হলে বা প্রস্রাবের অঙ্গে কোনও সংক্রমণ হলে বিছানা ভিজিয়ে ফেলার অভ্যাস তৈরি হয়। অনেক সময় দেখা যায়, পরিবারের অন্য সদস্যদের ছোটবেলায় বিছানা ভিজিয়ে ফেলার অভ্যাস থাকলে, এই অভ্যাস শিশুর মধ্যে চলে আসে।

 

শিশুরা কেন বিছানা ভিজিয়ে ফেলে? (Why Do Children Wet The Bed?)

 চিকিৎসকের কাছ থেকে তথ্যগুলো পাওয়ার সময় ওর মনে প্রশ্ন জাগে, কী কী কারণে ছোট্ট সোনা এমন করে? চিকিৎসককে সে কথা জিজ্ঞেস করতেই তিনি বেশ কয়েকটি কারণের কথা জানালেন। এর মধ্যে অভ্যাসগত কারণের পাশাপাশি নানা শারীরিক কারণও ছিল।

  • জেনেটিক কারণ: বিশেষজ্ঞদের মতে, খুদের মধ্যে বিছানা ভিজিয়ে ফেলার অভ্যাস জেনেটিক কম্পোনেন্টের মাধ্যমেও আসতে পারে। অনেক সময় দেখা যায়, যে শিশু যে সমস্যায় ভুগছে, তার বাবা, মা, ঠাকুর্দা, ঠাকুমার ক্ষেত্রেও সেই সমস্যা ছিল।
  • মানসিক চাপ: খুদের প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা ওর মনে যথেষ্ট প্রভাব ফেলে। ওর ঘুমের মধ্যেও সেই সব অভিজ্ঞতা প্রভাব ফেলতেই পারে। যার ফলে বিছানা ভিজে যায়। (Common Reasons Why Children Wet the Bed)
  • ঘুমের সমস্যা: বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ঘুমের সমস্যার জন্যই ছোট্ট সোনা বিছানা ভিজিয়ে ফেলে। ওর ঘুমের নিয়মিত ব্যাঘাত ঘটলে এমনটা হয়। অনেকসময় বাচ্চার সঙ্গে যিনি শোন, তার নাক ডাকার কারণে ঘুমে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়। এছাড়াও টিভির আওয়াজ, পোষ্যের ডাকের জন্যও শান্তির ঘুমে ছেদ পড়ে। তবে ঘুমে ব্যাঘাত ঘটলেই শুধু এমনটা হয়, তা নয়। সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, খুদেরা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হলেও একই সমস্যা হতে পারে।
  • সময়: ৫ বছর বয়সের মধ্যেই ছোট্ট খুদের প্রধান অঙ্গগুলো অনেকটাই পরিণত হয়ে যায়। তবে কিছু ক্ষেত্রে বেশি সময় লাগতেই পারে (Bedwetting in Under-5s)। বিশেষজ্ঞদের মতে, পাঁচ বছরে অনেক শিশুরই ইউরিনারি ব্লাডারের সব পেশি ঠিক মতো ডেভেলপ করে না। তাই বিছানা ভিজিয়ে ফেলার অভ্যাস থেকেই যায়। ব্লাডারের পেশি পরিণত হলে এই প্রবণতা কমতে থাকে।

কারণগুলো শোনার পর সূর্যতপা বুঝতে পারল, খুদে অভির সমস্যায় ওর নিজের হাত হয়তো নেই। শুধু শুধু বকাঝকা করেও যে ও ঠিক করেনি— তাও বুঝলো। চিকিৎসককে ও জিজ্ঞেস করলো, ‘ওর এই অভ্যাস তো পাল্টানো দরকার। মা হিসেবে আমি ওকে কী ভাবে সাহায্য করতে পারি?’ চিকিৎসক তখন বেশ কয়েকটি সমাধানের পথ বলে দিলেন।

 

আরও পড়ুন: অটিজম কী, কেন? লক্ষণ ও প্রতিরোধের উপায়

 

বাচ্চার বিছানায় প্রস্রাবের সমস্যা আটকাবেন যেভাবে (How to Help Your Child Stop Wetting the Bed)

#1. বকাঝকা নয়: ছোট্ট সোনা বিছানা ভিজিয়ে ফেলেছে বলে ওকে একদম বকাঝকা করা ঠিক নয়। এতে হিতে বিপরীত হতে পারে। বাচ্চার বিছানা ভিজিয়ে ফেলার পিছনে যেমন ওর মানসিক চাপ থাকতে পারে, তেমনই ঘুমের ব্যাঘাতের জন্যও হতে পারে। তাই সঠিক কারণ না-জেনেই ওকে বাকঝকা করলে ও মুষড়ে পড়বে, এবং ভয় পাবে।

#2. জল কম খাওয়ান: বিছানা ভিজিয়ে ফেলার ব্যাপারটা নেহাতই অভ্যাসের জন্য হলে, ঘুমতে যাওয়ার আগে ওকে কম জল খাওয়ান। রাতের খাবারেও যাতে জলের পরিমাণ কম থাকে, সেদিকে নজর রাখুন। কম জল খেলে রেচন প্রক্রিয়ায় প্রস্রাবও কম উৎপাদন হয়। এতে বিছানা ভেজানোর মতো ঘটনা কম ঘটবে (How to Stop Bed Wetting)।

#3. যথেষ্ট ঘুম: ছোট্ট সোনার যাতে ঘুমের সময় কোনও রকম ব্যাঘাত না হয়, তার ব্যবস্থা আপনাকেই করতে হবে। ও নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ কতটা আনতে পারবে, তা নির্ভর করবে ওর ঘুম কেমন হচ্ছে, তার উপরেই।

#4. ওকে সময় দিন: মনের মধ্যে কোনও ভয় বা দুশ্চিন্তা নিয়ে ও যাতে ঘুমোতে না যায়, তা দেখার দায়িত্ব মায়েরই। তাই প্রতি রাতে ওর সঙ্গে কথা বলে মনের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করুন। কোনও ভয়ের আভাস পেলে ওকে বোঝান, এই নিয়ে চিন্তার কারণই নেই। ওকে নিশ্চিন্তে ঘুমোনোর ব্যবস্থা না-করলে ওর ঘুম ভালো হওয়ার সম্ভাবনা কম।

#5 দারুচিনি গুঁড়ো: ঘরোয়া টোটকা হিসেবে বাচ্চাকে রোজ সকালে এক টুকরো করে দারুচিনি চিবিয়ে খেতে দিতে পারেন ওকে। এক কাপ কুসুম গরম জলে দারুচিনি গুঁড়ো মিলিয়েও দিতে পারেন। নতুবা সরাসরি জলখাবারে মিলিয়ে খেতে দিন। পাউরুটির টোস্ট বা রুটির ওপর দারুচিনি গুঁড়ো অল্প চিনি মিলিয়ে ছড়িয়ে দিলে একেবারেই মন্দ লাগবে না খেতে!

#6. অলিভ অয়েল: ট্রাই করতে পারেন অলিভ অয়েলও! পরিমাণ মতো অলিভ অয়েল সামান্য গরম করে নিন। তারপর বাচ্চার নিন্মাঙ্গের আশপাশে ভালো করে সেটি ম্যাসাজ করুন। ঘুমের মধ্যে প্রস্রাবের সমস্যা পুরোপুরি সারিয়ে তুলতে প্রতিদিন একইভাবে মালিশ করুন। নিমেষে মিলবে নিষ্পত্তি।

#7. মধু: এক্ষেত্রে কাজে আসতে পারে মধুও। প্রতিরাতে শোওয়ার আগে এক চামচে মধু খাইয়ে দিন বাচ্চাকে। জলখাবারে এক গেলাস দুধের সাথে এক চামচে মধু মিশিয়েও দিতে পারেন। আর এই মধু এমনই এক টোটকা, যেটা বাচ্চারা হেসেখেলে খেয়েও নেবে!

#8. চিকিৎসকের পরামর্শ নিন: কোনও কোনও সময়ে ইউরিনারি ব্লাডারের সমস্যা থেকেও খুদের এই সমস্যা হতে পারে। ওকে জিজ্ঞেস করুন, হিসু পেলেই সঙ্গে সঙ্গে হয়ে যাবে— এমন মনে হয় কি না। এমনটা ব্লাডারের সমস্যাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া একান্ত প্রয়োজন (Best Solutions to Beat Bedwetting)।

চিকিৎসকের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করার পর সূর্যতপা বুঝতে পারে অভির সমস্যা। ওদের ছোট্ট পরিবারে অভির বাবাই দশ বছর পর্যন্ত এই সমস্যায় ভুগতো। সে কারণেই হয়তো অভির মধ্যে এই সমস্যাটা এখনও রয়েছে। চিকিৎসকের কথা মতোই ও অভিকে এর জন্য আর কখনওই বকাঝকা করেনি‌। বরং নির্দিষ্ট সময় টয়লেটে যাওয়ার জন্য উৎসাহ দিত। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চলায় কিছু দিনেই দেখা গেল অভির আর এই সমস্যা নেই। ততদিন অবশ্য সূর্যতপাকে বিছানার কাপড় কাচাকাচির ঝক্কি পোয়াতে হয়েছে। তবে অভির সমস্যা মিটে যাওয়ায় ও-ই সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছে। (Tips to Handle Your Child’s Bedwetting)

 

আরও পড়ুন: ছোট থেকেই শুরু হোক নিয়মানুবর্তিতার শিক্ষা, জেনে নিন কৌশল

 

একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার  হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

 

null

null