ঘটনা ১: আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেই মনটা কেমন যেন ব্যাজার হয়ে যাচ্ছে। হবে নাই বা কেন? মুখে যেন কোনও জেল্লাই নেই। ত্বকের দশা কেমন যেন দিনদিন ম্যাড়ম্যাড়ে হয়ে যাচ্ছে। ফাউ হিসেবে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে খান পাঁচেক গা-জ্বালানি ব্রণ। সুন্দর চোখগুলো তো কালি পড়েই ঢেকে যেতে বসেছে। (Foods For Glowing Skin And Shiny Hair)
ঘটনা ২: শ্যাম্পু করলেই হুসহুস করে মুঠি মুঠি চুল লাফিয়ে লাফিয়ে হাতে উঠে আসছে। চুলে চিরুনি পড়লো কি পড়লো না, খান দশেক চুল মুখ ভেংচে মেঝেতে ঝরে পড়লো, দিয়ে বাতাসে উড়ে উড়ে চলে গেল। শুধু কী ওদের ঝরেই শান্তি, না গজাচ্ছে, না বাড়ছে! স্বাস্থ্য তো কবেই চলে গেছে (Meyeder Chuler Jotno)। ফলস্বরূপ, আপনি একপিঠ লম্বা, নিষ্প্রাণ ৫ গাছি চুল নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
আপনি তো নিজের চুল আর ত্বকের যথাসাধ্য যত্ন নিচ্ছেন। (Best Foods for Healthy Skin and Hair ) ইন্টারনেট ঘেঁটে, শিলনোড়ায় বেঁটে, নানারকম উপটান বানিয়ে সময় পেলেই লাগাচ্ছেন। নামী দামি সান প্রোটেকশন ক্রিম, নাইট ক্রিম, টোনার বা ওই ধরুন গিয়ে চুলে লাগানোর সেরাম, হেয়ার জেল, সব কিন্তু ড্রেসিং টেবিল ভর্তি। সময় পেলেই চুল ও মুখে ঘসে ফেলেন নিয়ম করে (Meyeder Toker Jotno)। কিন্তু হা হতোস্মি! কাজের নামে লবডঙ্কা।
দেখুন, আপনি আপনি করে বলছি বটে, কিন্তু এইসব চুল ও ত্বকের সমস্যায় কিন্তু আমি, আমরা, তোমরা, আপনি ও আপনারা; সবাই জর্জরিত। হাজারকুড়ি ক্রিম বা জেল বা তেল মুখে মেখে, চুলে লাগিয়ে যখন কিছু পার্থক্য বুঝতে পারি না, তখনই আমাদের মনে হয় সবকটা প্রোডাক্ট মিথ্যেবাদী বা ঘরোয়া উপটানের কোনও গুণই নেই।
আসলে জানেন কি, আমাদের গলদটা একদম গোড়ায়! অফিসের চাপ আর সংসারের হাজারখানেক কাজ সামলে গুছিয়ে বসে ভালো করে খাবারটা খান? ব্রেকফাস্টে নাকে মুখে যাহোক কিছু গুঁজে দৌড় দিচ্ছেন, বাইরে অফিসের রাস্তায় খিদে পেলে একটা চিকেন রোল বা ফুচকা খেয়ে পেট ভরে নিচ্ছেন বা বাচ্চা কাঁদছে বলে কোনও রকমে ভাত আর ডাল চটকে না চিবিয়ে গিলে নিলেন। কি, মিলছে তো কথাগুলো? (Sasthoujjol Jholmole Sundor Chuler Tips)
ত্বক বা চুল কিন্তু আমাদের শরীরের অভ্যন্তরীণ স্বাস্থ্যেরই প্রতিফলন হিসেবে ধরা দেয় সবার চোখে। শরীরে যদি খাবারের মাধ্যমে যথেষ্ট পরিপোষক না যায়, তা হলে আমাদের ত্বক ও চুলের স্বাস্থ্যও চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গাছের গোড়ায় যেমন জল দিতে হয় তার বৃদ্ধির জন্য, আমাদের ত্বক ও চুলেরও সেই রকম পুষ্টির প্রয়োজন ভিতর থেকে।
বাইরে থেকে কোনও কিছু লাগালে বা মাখলে সেটা সেই স্বাস্থ্য ধরে রাখতে সাহায্য করে। ত্বককে ভিতর থেকে সুন্দর করে তুলতে ও আকর্ষণীয় চুলের অধিকারিণী হতে আপনাকে একটু পরিবর্তন আনতে হবে নিজের ডায়েটে। (Meyeder Rupchorcha) কোন ৯ টি খাবার আমাদের ত্বক আর চুলের স্বাস্থ্যরক্ষায় অপরিহার্য, দেখে নিন এইখানে।
কোন ৯টি খাবার আমাদের ত্বক আর চুলের স্বাস্থ্যরক্ষায় অপরিহার্য (Top 9 Foods that Surely Gives You Glowing Skin & Shiny Hair)
#1. হলুদ: হলুদের জীবাণুনাশক ধর্মের কথা সব্বাই জানি। বিভিন্ন ঘরোয়া উপটান বা ফেস প্যাক তো বটেই, হলুদ খেলেও কিন্তু ত্বক দারুণ সুন্দর হয়। হলুদে থাকা কিউকারমিন (Cucurmin) নামক ফাইটোনিউট্রিয়েনট উপাদানটিই হলুদের অ্যানটিব্যাকটেরিয়াল, অ্যানটিইনফ্লামেটরি, অ্যানটি ফাঙ্গাল ও অ্যানটি ভাইরাল ধর্মের জন্য দায়ী। (Tok Forsa Hobar Upay) শরীরের বাইরে ও ভিতরেও ক্ষতিকারক জীবাণু ধ্বংস করে এই হলুদ।
কীভাবে খাবেন: রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে একটুকরো কাঁচা হলুদ ধুয়ে খোসা ছাড়িয়ে কাঁচা চিবিয়ে খান। তারপরে ব্রাশ করবেন। সকালে খেতে না পারলে, রাতে শুতে যাওয়ার আগে একগ্লাস দুধের সাথে খেয়ে ফেলুন। এক সপ্তাহের মধ্যে ফলাফল দেখতে পাবেন।
#2. পালং শাক: পালং শাক বিটা ক্যারোটিনে সমৃদ্ধ। এই উপাদানটিই শরীরে ভিটামিন A-তে পরিবর্তিত হয়। ভিটামিন A নামকরা অ্যানটি এজিং পরিপোষক। ত্বকের বয়স আটকে রাখতে অপরিহার্য এই ভিটামিন। ত্বকের আর্দ্রতা ধরে রেখে বলিরেখা আসা কম করে এবং মৃতকোষ দূর করে এই পরিপোষক। পালং শাক খেলে বয়সজনিত কারণে হওয়া ত্বকের ক্ষতি রোধ হয় এবং দূষণের হাত থেকেও ত্বক রক্ষা পায়। (What to Eat for Shiny Hair & Glowing Skin)
কীভাবে খাবেন: পালং শাকের সম্পূর্ণ গুণ পেতে একে ভিটামিন C সমৃদ্ধ কোনও খাবারের সাথে মিশিয়ে খান। যেমন, পালং শাকের স্যালাড বানিয়ে ওপরে পাতিলেবুর রস ছড়িয়ে নিলেন, বা পালক পনির বানানোর সময় একটু লেবুর রস দিয়ে দিলেন। এতে স্বাদও বাড়ল আবার আপনার কাজও হল।
#3. গ্রিন টি: গ্রিন টি অ্যান্টিঅক্সিডেনটের অন্যতম প্রাকৃতিক উৎস। এপিগালোকেটেচিন গ্যালাটে (Epigallocatechin Gallate (EGCG)) নামের ফাইটোনিউট্রিয়েনট উপাদানটি গ্রিন টিতে ভরপুর মাত্রায় রয়েছে। নিয়মিত গ্রিন টি খেলে ক্ষতিকর ফ্রি র্যাডিক্যালস ত্বকের ক্ষতি করতে পারে না। ত্বকে আসা কালো দাগ, লাল ভাব বা বয়সের আগে ত্বক বুড়িয়ে যাওয়ার মতো সমস্যার সমাধানে পারদর্শী এই গ্রিন টি। আবার যে হরমোনের প্রভাবে ত্বকে ব্রণ গজিয়ে ওঠে, সেই DTH হরমোনের মাত্রাও কম করে এই গ্রিন টি। এর ফলে, ত্বকে ব্রণর আক্রমণ কমে (Bangla Health Tips)। সব মিলিয়ে সুন্দর, স্বাস্থ্য ঝলমল ত্বকের চাবিকাঠি গ্রিন টি বললে ভুল বলা হয় না।
কীভাবে খাবেন: সকালে ব্রেকফাস্টের কিছু সময় পরে ৪/৫ টি আমন্ড ও এক কাপ গ্রিন টি খান মধু দিয়ে। শরীরচর্চা করলে তার আগে খেতে পারেন এক কাপ। রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগেও গ্রিন টি খাওয়া বিশেষ ভালো। ত্বকের স্বাস্থ্য ভালো তো হবেই, শরীরের অবাঞ্ছিত মেদ কমাতেও সাহায্য করবে এই ‘চা’।
#4. তিসি বীজ: ওমেগা ৩ এবং ওমেগা ৬-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ দুটি ফ্যাটি অ্যাসিডের উৎস এই তিসি বীজ বা ফ্ল্যাক্সসিড। ব্রণ, অ্যাকনে, একজিমার মতো ত্বকের সমস্যা প্রতিরোধে শরীরকে সাহায্য করে এই ফ্যাটি অ্যাসিডরা। ক্ষতিগ্রস্ত ত্বককে সেরে উঠতে এবং তাড়াতাড়ি নতুন কোষ তৈরি করতেও সাহায্য করে।
কীভাবে খাবেন: স্যালাডের সাথে মিশিয়ে বা ব্লেন্ডারে পেস্ট করে খেয়ে নিতে পারেন।
#5. ডিম: চুলে ডিম লাগানোর উপকারিতার কথা কে না জানে! ঠিক একইরকম ভাবে ডিম খেলে শরীরের অন্যান্য উপকারের সাথে সাথে চুল ও ত্বকও বড্ড লাভবান হয়। ডিম থেকে যেসব পরিপোষক পাওয়া যায়, তার মধ্যে সালফার অন্যতম। এই সালফার শরীরকে ভিটামিন বি শোষণ করতে সাহায্য করে আবার লিভারের কর্মক্ষমতাও বাড়ায়। ত্বকের কোলাজেন বা চুলের কেরাটিন, দুইয়ের তৈরিতেও সালফার ভূমিকা নেয় (Diet Plan for Healthy Skin and Hair)। ফলস্বরূপ, চুল চকচকে হয়, নখের স্বাস্থ্য ভালো হয় এবং ত্বকও প্রাণবন্ত উজ্জ্বল হয়।
কীভাবে খাবেন: আপনার খুশিমতো! পোচ করুন, সেদ্ধ করুন, উলটে ভাজুন, পাল্টে ভেঙে খান, যখন ইচ্ছে খান। ডিমই তো! শুধু তেলে ভাজা অমলেটটা কম খেলেই হবে।
আরও পড়ুন: প্রেগন্যান্সির পরে বাড়তি ওজন চটজলদি কমাবেন কীভাবে? রইল সহজ এবং নিরাপদ উপায়
#6. গাজর, মিষ্টি আলু: গাজরে আছে উচ্চ মাত্রায় বিটা ক্যারোটিন, অ্যান্টিঅক্সিডেনটস এবং ভিটামিন A। এই উপাদানগুলি শরীরের ভিতর থেকে সমস্ত টক্সিন বা ক্ষতিকর পদার্থ যে শুধু বার করে দেয় এই নয়, রোদের কারণে ত্বকের যে ক্ষতি হয়, তার থেকেও ত্বককে বাঁচায়। বলিরেখা, বয়সের ছাপ আসার প্রবণতাও কম করে। ত্বকের ওপর দ্রুতগতিতে মৃত কোষ জমার পরোক্ষ কারণ হিসেবে দেখা দেয় ব্রণ (Toker Jotno)। নিয়মিত গাজর খেলে এই সমস্যা নিয়ন্ত্রণে আসে এবং ব্রণ কম হয়। শুধু তাই নয়, ভিটামিন A স্কিন-ক্যান্সার কোষের বাড়বৃদ্ধিও কমিয়ে দিতে পারে।মিষ্টি আলু খেলেও একই উপকারিতা পাওয়া যায়। (Foods For Glowing Skin And Shiny Hair)
কীভাবে খাবেন: গাজর বা মিষ্টি আলু রাখুন রোজের খাদ্যতালিকায়।খুব বেশি পরিমাণে না হলেও অল্প খান রোজ।স্যালাড, স্যুপ বা তরকারি, বানিয়ে নিতে পারেন স্বাদ ও ইচ্ছেমতো।
#7. শণ বীজ: শণ বীজ বা চিয়া সিড চুল ও ত্বকের জন্য আরেক গুরুত্বপূর্ণ খাবার। প্রোটিন, ওমেগা ৩ এবং ফাইবারে ভরপুর এই শণ বীজ নিজের ওজনের ১২ গুণ বেশি জল শোষণ করতে পারে। তাই শুধু রূপবর্ধক খাবার হিসেবে নয়, শণবীজকে ডায়েট ফুড হিসেবেও ব্যবহার করেন অনেকে।
কীভাবে খাবেন: স্মুদিতে মেশাতে পারেন। রাতভর জলে ভিজিয়ে পাতিলেবুর রস ও মধু মিশিয়ে সক্কাল সক্কাল খেয়ে নিন। ত্বক আর চুলও নজরকাড়া হবে। আবার চেহারাও ছিপছিপে হবে।
#8. ডার্ক চকোলেট: প্রথমেই বলে রাখি, এক্ষেত্রে চকোলেটের আগে যেন ‘ডার্ক’ কথাটি অবশ্যই বসে। হ্যাঁ, ডার্ক চকোলেটের কোকোয়াতে অ্যান্টি এজিং অ্যান্টিঅক্সিডেনট রূপে থাকে ফ্ল্যাভোনয়েডস। সূর্যরশ্মির ক্ষতিকর আলট্রাভায়লেট রশ্মি থেকে ত্বককে রক্ষা করে এবং ত্বকে বলিরেখা, ফাইন লাইনস এবং ট্যান পড়া কম করে। (Superfoods For Hair and Skin)
কীভাবে খাবেন: এটা বুঝি বলে দিতে হবে? আরে, চকোলেট বলে কথা। আসতে যেতে, ব্যাগ থেকে বার করুন আর খান। তবে ডার্ক চকোলেটই খাবেন কেমন!
#9. আমন্ড, আখরোট: এই দুটি বাদাম গোত্রীয় খাবার খেতে যতটা ভালো,কাজেও সমান পটু। আমন্ড-এ উচ্চ মাত্রায় ভিটামিন E এবং ফ্ল্যাভোনয়েডস থাকে, যা ত্বকের দারুণ স্বাস্থ্যের অন্যতম শর্ত। চুলও উপকার পায় এই আমন্ড থেকে। ফাইবার ও প্রোটিনের অন্যতম উৎস এই বাদামটি ম্যাঙ্গানিজ ও সেলেনিয়ামেও সমৃদ্ধ। এই উপাদানগুলিই চুলের স্বাস্থ্যও ভালো করে তাকে ভিতর থেকে চকচকে করে তোলে।
এবার আসি আখরোটের কথায়। আখরোট ওমেগা ৩ এবং ওমেগা ৬-এর গুরুত্বপূর্ণ উৎস। ত্বকের আর্দ্রতা বজায় রাখা তো বটেই, চুলের প্রাণও ফেরাতে পারে এই আখরোট। এতে থাকা প্রোটিন চুলের ফলিকল তৈরিতে সাহায্য করে। এর ফলে, চুল ঘন ও শক্তিশালী হয়। (Meyeder Chule ar TokerJotno) এছাড়াও, এতে আছে ভিটামিন E, যা ত্বক ও চুল দুইয়েরই স্বাস্থ্য রক্ষায় অপরিহার্য।
কীভাবে খাবেন: বিকেলের দিকে ফুচকা, রোল বা কাটলেটে পেট না ভরিয়ে এক মুঠো আমন্ড, আখরোট খেয়ে ফেলুন কচমচিয়ে। আপনি ইচ্ছে করলে এই বাদামগুলো ড্রাই রোস্ট করে গুঁড়ো করে মেশাতে পারেন স্মুদিতেও।
এছাড়াও, মরসুমি ফল,সবুজ তরি-তরকারি খান যথেষ্ট পরিমাণে।তেলে ভাজা, মশলাদার খাবার একটু এড়িয়ে চলুন।দিনে অন্তত ৭-৮ ঘণ্টা ভালো করে ঘুমোন আর জল খান রোজ ৪-৫ লিটার। ত্বক ও চুল নিয়মিত পরিষ্কার রাখুন ও তার যত্ন করুন।ত্বক বা চুলের কোনও সমস্যায় কোনও ওষুধ বা সাপ্লিমেনট বা ভিটামিন ট্যাবলেট নিজে কিনে খাবেন না। (Beauty Foods For Glowing Skin And Shiny Hair) ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করুন। মন ভালো রাখুন, ভালো খান, সবসময় সুন্দর থাকবেন।
আরও পড়ুন: আকর্ষণীয় উজ্জ্বল ত্বকের গোপন রহস্য ফাঁস ১০টি টোটকায়!
একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।
null
null