কোনও জ্বর নেই তাও কপাল আগুন! কেন এমন হয়, কী করবেন এই পরিস্থিতিতে?

কোনও জ্বর নেই তাও কপাল আগুন! কেন এমন হয়, কী করবেন এই পরিস্থিতিতে?

খুদে মিঙ্কু মাত্র নয় মাস আগে প্রলয় আর মৈত্রীর সংসারে এসেছে‌। তবে নয় মাস বয়সটা মিঙ্কুর কাছে কোনও ব্যাপারই নয়। সে যে ভীষণ দুষ্টু হবে, সে ব্যাপারে তার বাবা-মা দু’জনেই নিশ্চিত ছিল। যেদিন থেকে হামাগুড়ি দিতে শিখেছে, একদন্ড সে বসে থাকতে চায় না। ওর দুষ্টুমির বহর দেখে মৈত্রীর যেমন আনন্দ হয়, তেমনই চিন্তারও শেষ নেই। গত কিছুদিন ধরে মৈত্রী একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ করছে। মিঙ্কুর কপালটা বেশ গরম থাকে। (Why Is My Baby’s Forehead Hot Although He Doesn’t Have A Fever)

জ্বর সন্দেহ হওয়ায় সে একবার থার্মোমিটার দিয়ে মেপে দেখেছিল। তাতেও উষ্ণতা বেশি দেখাচ্ছে। অথচ খোকার দুরন্তপনার শেষ নেই। তাকে যে কিছুক্ষণ শুইয়ে বা বসিয়ে রাখা যাবে তার উপায় নেই। তৃতীয় দিনও এমন উষ্ণতা দেখে মৈত্রী চিকিৎসকের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিল। চিকিৎসকের কাছে গেলে তিনি মৈত্রীর মুখে পুরোটা শুনলেন। চিকিৎসক নিজেই কয়েকটি ছোটোখাটো পর্যবেক্ষণ করলেন। তারপর বললেন, মিঙ্কু একেবারেই সুস্থ। মৈত্রীর জিজ্ঞেস করে বসলো, তা হলে ওর কপাল সব সময় এমন গরম থাকছে কেন? (Why Baby’s Head is Really Hot But No Fever?) চিকিৎসক এর উত্তরেই বেশ কিছু সম্ভাবনার কথা জনালেন।

ছোট্ট সোনার কপাল গরম থাকলে মায়েদের চিন্তা হবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে কপাল গরম থাকা সবসময় জ্বরের ইঙ্গিত নয়। বরং অন্যান্য কয়েকটি কারণেও কপাল গরম থাকে। চিকিৎসক সেই সম্ভাবনাগুলোই একে একে বলে দিলেন মৈত্রীকে।

 

 

কী কী কারণে জ্বর ছাড়াও গায়ের কপাল গরম হতে পারে শিশুর (Reasons Why A Baby’s Forehead Is Hot)

#1. খুদে উত্তেজিত: ছোট্ট খুদে ভীষণ দুরন্ত। শান্ত হয়ে এক জায়গায় বসে থাকার পাত্র সে নয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, এমন শিশুদের কপাল বা শরীর অন্যান্য শিশুদের তুলনায় বেশি গরম হয়। দৌড়ঝাঁপ বা হামাগুড়ি দেওয়ার সময় ছোট্ট সোনা অনেক শক্তি খরচ করে। এই শক্তি তাপ হয়ে বেরোয়। তা ছাড়া এই সময় শরীর ও মাথার অংশে রক্তপ্রবাহ বেড়ে যায়। ফলে খুদের দেহের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায় (Baby Head is Hot But No Fever)।

কী করবেন: এক্ষেত্রে দুষ্টুর শিরোমণিকে শান্ত করার দায়িত্ব আপনারই। তাকে এমন খেলনা দিন যাতে সে বসে বসে খেলে আর তাতেই মশগুল থাকে। অথবা তার প্রিয় গান শোনাতে পারেন বা কার্টুন চালিয়ে দিতে পারেন। এসবের পাশাপাশি হাতের কাছে ওর জলের পাত্র রাখুন। একান্তই সে শান্ত না হলে তাকে পরিমাণমতো জল খাওয়ান। জল শরীরের তাপমাত্রা ভারসাম্য বজায় রাখে।

 

#2. গরম জামাকাপড়: শুনতে অবাক লাগলেও এমন ঘটনা অসম্ভব নয়। বাচ্চাকে গরম জামা পরিয়ে রাখলে তার শরীর গরম তো হবেই। পাশাপাশি মাথার তাপমাত্রাও বেড়ে যেতে পারে। ফলে কপালে হাত দিলে তাপমাত্রা বেশি মনে হয়। গরম জামাকাপড় জামার ভিতরের বায়ুকে গরম করে তোলে। বাইরের বায়ু কাপড় ভেদ করে সহজে ভিতরে ঢুকতে পারে। ভিতরের গরম বায়ুর সংস্পর্শে থাকার ফলে শরীরের তাপমাত্রা ধীরে ধীরে বেড়ে যায়। যা মাথার তাপমাত্রাও বাড়িয়ে দেয়।

কী করবেন?: কপালের তাপমাত্রা বেড়ে গেলে গরম জামাকাপড় খুলে দিন অথবা পুরো না-খুলে আলগাও করে দিতে পারেন। হাওয়া চলচল করতে পারে এমন জামাকাপড় বাচ্চাকে পরান‌। এতে সোনামণি গরমের কারণে অস্বস্তিবোধ করবে না।

 

#3. ভুল থার্মোমিটার: অনেকসময় দেখা যায়‌ যে থার্মোমিটার দিয়ে তাপমাত্রা সেটি কোনও কারণে ভুল পাঠ দিচ্ছে। তাপমাত্রার হেরফের বা যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে এমন ঘটনা অস্বাভাবিক নয়। এদিকে খারাপ থার্মোমিটার ভুল পাঠ আপনাকে দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। তাই মাথায় রাখুন সবসময় থার্মোমিটারের নির্দেশ ঠিক নাও হতে পারে।

কী করবেন: একটি থার্মোমিটারে বিশ্বাস না-রেখে একাধিক থার্মোমিটার দিয়ে খুদের তাপমাত্রা মাপুন। একাধিক থার্মোমিটার এক জায়গায় না-রেখে বরং আলাদা আলাদা জায়গায় রাখুন। এতে পরিবেশগত কারণে একটি খারাপ হলেও অন্যগুলো ঠিকঠাক থাকবে। একটি থার্মোমিটার ভুল পাঠ দিলেও সব ক’টি থার্মোমিটার ভুল পাঠ দিতে পারে না। তাই অনেক বিশেষজ্ঞই একাধিক থার্মোমিটার ব্যবহারের পরামর্শ দেন।

 

#4. দাঁত উঠছে: বিশেষজ্ঞদের কথায় ছোট্ট সোনার দাঁত ওঠার সময় শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার। তাই দাঁত উঠছে এমন সময় খুদের কপাল গরম দেখে ঘাবড়ে যাওয়ার কিছু নেই। প্রথম দাঁত ওঠার সময় তাপমাত্রা সাধারণত ১০০.৫ ডিগ্ৰি ফারেনহাইট থাকে। তাপমাত্রা ১০১ ডিগ্ৰি ফারেনহাইট ছাড়িয়ে গেলে তখন বিষয়টি গুরুতর হয়ে ওঠে।

কী করবেন: থার্মোমিটারে তাপমাত্রা বেশি থাকলে পরিষ্কার আঙুল দিয়ে দেখে নিন খুকুমণির দাঁত উঠছে কি না (Why is My Baby’s Head Hot)। থার্মোমিটারে তাপমাত্রা ১০০ থেকে ১০১-এর মধ্যে থাকলে চিন্তার কারণ নেই। ১০১ ছাড়িয়ে গেলে দেরি না-করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

 

#5. শোওয়ার ভঙ্গি: শোওয়ার ভঙ্গির কারণেও কপালের তাপমাত্রা বেড়ে যায়। ছোট্ট সোনা বিছানায় উবুড় হয়ে শুলে মাথায় রক্তের প্রবাহ বেড়ে যায়। এর ফলে মাথার তাপমাত্রা শরীরের তুলনায় বেশি হয় (Toddler Feels Warm But No Fever)।

কী করবেন?: এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞরা ছোট্ট সোনাকে সবসময় চিৎ হয়ে শোওয়ানোর পরামর্শ দেন। উবুড় হয়ে শুলে শিশুর শ্বাসপ্রশ্বাসেও অল্প সমস্যা হয়। নিশ্বাসের মাধ্যমে যথেষ্ট তাপ না-বেরোলে দেহের উষ্ণতাও বাড়তে থাকে। তাই ও ঘুমের মধ্যে উবুড় হয়ে গেলে ওকে চিৎ করে বা পাশ ফিরে শুইয়ে দিন।

 

আরও পড়ুন: কোন বয়স থেকে জল খেতে পারবে ছোট্ট সোনা? বয়স ভেদে পরিমাণই বা কতটা?

 

সোনামণির কপাল কী কী কারণে গরম হতে পারে তা তো জানা গেল। তবে সবসময় যে এই ঘটনাগুলো ঘটে তা কিন্তু নয় (Baby Head Warmer Than Body)। বরং অনেকক্ষেত্রেই বিষয়টা চিন্তার হয়ে দাঁড়ায়। তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে ছোট্ট সোনার বড়সড় ক্ষতিও হতে পারে।

সাডেন ইনফ্যান্ট ডেথ সিনড্রোম (Sudden Infant Death Syndrome): ছোট্ট সোনার দেহ বাইরের পরিবেশের সঙ্গে সহজে মানিয়ে নিতে পারে না। বিজ্ঞান বলছে, শিশুদের তাপনিয়ন্ত্রক অঙ্গগুলো সম্পূর্ণ পরিণত না-হওয়ার জন্যই এমনটা হয়। এই অবস্থায় পরিবেশের উষ্ণতা অল্প সময়ের মধ্যে বেড়ে গেলে শিশুর শরীরের উষ্ণতাও পাল্লা দিয়ে বেড়ে যায়। কিন্তু ছোট্ট সোনা তা সহ্য করতে পারে না। ফলে শিশুমৃত্যুর মতো দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটে। বিজ্ঞানের পরিভাষায় এর নাম ‘সাডেন ইনফ্যান্ট ডেথ সিনড্রোম’। এই সিনড্রোমে জ্বরের লক্ষণ দেখা না-দিলে তাপমাত্রায় যথেষ্ট পরিবর্তন হয় (Why is My Baby’s Head Hot but Body Cold)।

কী করবেন: পরিবেশের তাপমাত্রার হঠাৎ হেরফের শিশুকে ঘরের মধ্যেই রাখুন। প্রয়োজন অনুযায়ী ও যাতে ঠান্ডা পরিবেশ পায়, তার ব্যবস্থা করতে পারেন। গরমের কারণে ওর মধ্যে কোনও পরিবর্তন দেখলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

 

কখন চিকিৎসকের কাছে যাওয়া সত্যিই জরুরি সে ব্যাপারেও জেনে নেওয়ার দরকার। মৈত্রীকে মিঙ্কুর চিকিৎসক সেই ব্যাপারেও বিস্তারিত বুঝিয়ে দিলেন (Why My Baby’s Head Hot)।

  • অ্যাংজাইটি (Anxiety): চারপাশের পরিবেশ অশান্ত থাকলে বা কোনও কারণে ছোট্ট সোনার মেজাজ বিগড়ে গেলে ও প্রচন্ড কাঁদতে থাকে। এই অবস্থায় শরীরের তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। উষ্ণতা বিপজ্জনকভাবে বেড়ে গেলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

 

  • বমি ও ডায়রিয়া: জলের ঘাটতি হলে দেহের উষ্ণতা বেড়ে যায়। ছোট্ট সোনার গায়ের উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণে তাই প্রাথমিকভাবে জলই প্রয়োজন। জল দেওয়া সত্ত্বেও যদি উষ্ণতা বাড়তে থাকে আর বমি, ডায়রিয়ার মতো সমস্যা দেখা দেয়, তবে ওকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন।

মিঙ্কুর চিকিৎসক ওর দুরন্তপনার গল্প শোনার পর হেসে উঠলেন। ওকে আদর করতে করতে মৈত্রীকে বললেন ওর দুরন্তপনার মাঝে মাঝে ওকে একটু জল খাইয়ে দেবেন। দেখবেন, কপাল গরম হওয়ার ঘটনা আর ঘটছে না (Baby Hot Head Cold Body)। মৈত্রী চিকিৎসকের অভয় পেল।

সেদিন থেকেই মৈত্রী ওকে ওর দস্যিপনার মাঝে মাঝে প্রয়োজন অনুযায়ী জল খাইয়ে দেয়। শেষে চিকিৎসকের কথাই ঠিক প্রমাণিত হল, কপাল গরম হওয়ার ঘটনাটা দু’-একদিন পর থেকেই হাওয়া। এরপর মৈত্রীকেও মাঝে মাঝে ওর দস্যিপনার সঙ্গী হতে দেখা গিয়েছে। (Why Is My Baby’s Forehead Hot Although He Doesn’t Have A Fever)

 

আরও পড়ুন: বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার পর আপনার প্রি-ম্যাচিওর ছানার যত্ন নেবেন কীভাবে? থাকল টিপস!

 

একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার  হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

null

null