জানেন কি, ঠিক কতটা বিপজ্জনক জনপ্রিয় জনপ্রিয় আর পরিচিত খেলনা বেবি ওয়াকার?

জানেন কি, ঠিক কতটা বিপজ্জনক জনপ্রিয় জনপ্রিয় আর পরিচিত খেলনা বেবি ওয়াকার?

বাড়িতে খেলনার ছড়াছড়ি চারদিকে। শো-কেসের ওপর বসে বিশাল টেডি বিয়ার পা দোলাচ্ছে, টেবিলের তলায় দম দেওয়া বানরছানা খঞ্জনী বাজাচ্ছে, মাটিতে কু-ঝিকঝিক করে ঘুরে বেড়াচ্ছে খেলনা রেল গাড়ি। এছাড়াও, কত পুতুল আর কত্ত গাড়ি-ঘোড়া যে আপনি নিয়ে এসেছেন আপনার সোনামণির জন্য, তার তো ইয়ত্তা নেই। শুধু কী আপনি, মামা-দাদু-মাসি-পিসি যেই বেড়াতে আসে, হাতে একটা খেলনা নিয়ে ঢোকে তাদের আদরের দস্যিটির জন্য। এতদিন তো না হয় আপনার রাজপুত্তুর বা রাজকন্যেটি শুয়ে, বসে হামাগুড়ি দিয়েই কাটাচ্ছিলেন; কিন্তু এবার তো সময় চলে এসেছে “হাঁটি হাঁটি পা পা” করার। ব্যাস, আপনাকে আর পায় কে? ভাবতে বসে গেছেন, ওর জন্য কী এমন খেলনা আনা যায়, যাতে ও জলদি জলদি হাঁটতে শিখে সারা বাড়ি তুরতুরিয়ে ঘুরে বেড়ায়? সমাধানও পেয়ে গেছেন ২ মিনিট ভেবে আর ৩ জনকে জিজ্ঞেস করেই, এতটাই জনপ্রিয় আর পরিচিত সেই খেলনা; নাম, ওয়াকার। (Baby walkers: Are they safe? in Bangla. Baby walker ki stotyi dorkar?)

 

শিশুর জন্য ওয়াকার, সত্যিই কি দরকার? (Are Infant Walkers Safe?)

দাঁড়ান দাঁড়ান; এতো তাড়াহুড়ো করে এখনই নাই বা বেরোলেন ওয়াকার কিনতে! জানি, ওই বাজনা বাজানো, আলো জ্বলা ওয়াকারে চেপে আপনার পুঁচকে কত্ত আনন্দ পাবে তা কল্পনা করেই আপনি প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন। কিন্তু বন্ধু, উত্তেজনায় লাগাম টানুন। বাচ্চার জন্য শখ করে যা কিনে আনতে যাচ্ছেন, সেটি আদৌ আপনার বাচ্চার জন্য নিরাপদ কি না জানেন? আপনি বলতেই পারেন, সবাই তো ব্যবহার করে, অনেক দিন থেকেই চলে আসছে এই ওয়াকার। ওয়াকার আসলে কী বা বাচ্চার কীভাবে ক্ষতি করতে পারে, এগুলো না জানলে আমিও আপনাকে বলতাম, “যান যান শিগগির একটা ওয়াকার কিনে আনুন দেখি; পুঁচকেকে চাপিয়ে ছবি পাঠাবেন আমায়।” আপনি বরং প্রতিবেদনটি পুরোটা পড়ে জেনে নিন যে, বাচ্চাকে হাঁটা শেখাতে ওয়াকার কেনার সত্যি কি দরকার আছে বা ওয়াকার কি আদৌ নিরাপদ বাচ্চার জন্য? তারপরে সিদ্ধান্ত নেবেন আপনিই। (Baby walkers: Are they safe? in Bangla)

 

বেবি ওয়াকার আসলে কী (What is a baby walker in Bengali?) 

বেবি ওয়াকার হল এক বিশেষ ধরনের খেলনা, যার সাহায্যে বাচ্চা হাঁটতে পারে বা হাঁটার চেষ্টা করতে পারে। এই খেলনাটির বয়স বেশ অনেকটাই পুরনো। আশি শতকের অনেকটা আগে থেকেই বেবি ওয়াকার বাবা-মায়ের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এই বেবি ওয়াকারে চাকা লাগানো থাকে এবং শিশুর বসার মতো একটা জায়গাও থাকে। এই খেলনায় ভর দিয়ে শিশু মাটিতে পা ফেলতে পারে ও ইচ্ছেমতো সামনে-পিছনে ঘোরাফেরা করতে পারে। আগে এই ওয়াকার, বেবি ট্রেনার, বেবি রানার্স, স্ট্যান্ডিং স্টুল ইত্যাদি নামেও পরিচিত ছিল। এখন যে ওয়াকারগুলি কিনতে পাওয়া যায়,  সেগুলি বেশ আকর্ষণীয় ও শিশুদের ব্যস্ত রাখার জন্য পারফেক্ট। আধুনিক ওয়াকারে চেপে শিশু ঘুরে বেড়ালে তাতে আলো জ্বলে, শিশু হাত দিয়ে চাপড় দিলে তাতে বাজনা বেজে ওঠে। স্বাভাবিক ভাবেই, শিশুরাও খুব পছন্দ করে এই ওয়াকারে সময় কাটাতে।

 

বাবা-মায়েরা কেনো ওয়াকার কিনতে চান? (Parents want to buy baby walker for kids, why?)

  • বাবা-মা’দের ধারণা যে, ওয়াকারে চাপিয়ে দিলে বাচ্চা তাড়াতাড়ি হাঁটতে শিখে যাবে।
  • বাচ্চাকে ওয়াকারে চাপিয়ে দিয়ে অনেক মা-ই নিজেদের ঘর-সংসারের কিছু কাজ এগিয়ে নিতে চান।
  • বাচ্চা জেদ করলে বা বায়না ধরলে ওয়াকারে চাপিয়ে ঘুরিয়ে তাকে শান্ত করা যাবে।

আরও পড়ুন (Also Read): Pacifier Guide for Kids

ওয়াকার ব্যবহার কি আদৌ নিরাপদ? ( What is a baby walker?)

বাচ্চার বয়স ১ বছর হল কি হল না, তার জন্য কিনে নিয়ে এলেন ওয়াকার। জানেন কি, বাচ্চার জন্য কতটা বিপদজনক এই ওয়াকার?

  • শিশু মোটেই তাড়াতাড়ি হাঁটতে শেখে না (Delay in walking)-> প্রাকৃতিক নিয়মের বিরুদ্ধাচারণ করলেই শরীর তার উল্টো জবাব দেবে। সব কিছুর একটা নির্দিষ্ট সময় আছে, এবং সেই সময়টা আমাদের বাচ্চাকে দেওয়া উচিত। বাবা মায়েদের ধারণা যে, বাচ্চাকে একটা ওয়াকার কিনে এনে দিলেই সে সবার থেকে তাড়াতাড়ি হাঁটতে শিখবে। আদৌ তা হয় না। উল্টে, যে সব শিশুকে ৮-৯ মাস বয়স হতে না হতেই ওয়াকারে চাপিয়ে দেওয়া হয়, তারা নিজের থেকে পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে চায় না আর। শিশু হামাগুড়ি দেওয়ার পরেই তার শরীর পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ানোর জন্য উপযুক্ত হয়। ওয়াকারে বসিয়ে রাখলে বাচ্চা নিজের পা দেখতে পায় না এবং তার পা যে কী কাজে লাগতে পারে সেই বিষয়ে ভাবার চেষ্টা করে না। ফলস্বরূপ, ওয়াকারের সাপোর্টে মাটিতে পা ছুঁইয়ে কিছুটা করে এগোলেও পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ানোর অভ্যেস তৈরি হয় না তার। অর্থাৎ, বাবা-মায়ের আশায় জল। বাচ্চার হাঁটা শিখতে তুলনামূলক দেরিই হয়ে যায়।
  • শিশুর মাংসপেশি সবল হয় না (Weak muscles)-> গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব শিশু ওয়াকারে অভ্যস্ত, তারা ধীরে ধীরে অলস হয়ে পড়ে। বাচ্চা যদি কিছু নেওয়ার কারণেই হোক বা ঘুরে বেড়ানোর জন্যই হোক, কিছুটা করেও হামাগুড়ি দেয়, তা হলে তার পেশী সবল হয়। ওয়াকারে চাকা লাগানো থাকায় শিশু আর সেই কষ্টটুকু করতে চায় না। দু-একবার পা ছুঁইয়ে নিলেই তো ওয়াকার গড়গড় করে এগিয়ে যায়। তাই শিশুর শারীরিক পরিশ্রম আসলে কমে যায়। আবার ওয়াকারে চেপে থাকলে বাচ্চার পায়ের নীচের পেশী যদিও বা শক্ত হয়, কোমর বা থাই-এর দিকের পেশী সেই তুলনায় দুর্বল থাকে। মাংসপেশী  শক্তপোক্ত হতে পারে না ও স্বাভাবিক ভাবে বাড়তেও পারে না। এর ফলে, ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিশুর স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়াগুলিও।
  • শিশুর শারীরিক বৃদ্ধি ও মোটর স্কিল ক্ষতিগ্রস্ত হয় (May affect normal growth and motor skills)-> উপযুক্ত বয়স না হলে, বাচ্চার মেরুদণ্ড তার শরীরের ভার নিতে পারে না, এবং হাঁটা-চলায় সাবলীল হয় না শিশু। সেই সময়ের আগেই জোর করে যদি শিশুকে ওয়াকার দিয়ে হাঁটানোর চেষ্টা করেন, তা হলে মেরুদণ্ডের ক্ষতি হয়। বাচ্চার নিতম্বের বাড়-বৃদ্ধি বা গঠনও ঠিক ভাবে হতে পারে না। ক্ষতিগ্রস্ত হয় মোটর স্কিলও। নিজে দেখে, নিজের হাত-পা কে কীভাবে কাজে লাগাতে হয়, সেই নিয়ে চিন্তা করা কমিয়ে দেয় বাচ্চাটি। চেহারার সার্বিক গড়নেও দেখা যায় পার্থক্য। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব শিশুরা ওয়াকার ব্যবহার না করে নিজে নিজে হাঁটতে শিখেছে তাদের পেশীর গঠন ওয়াকার-নির্ভর বাচ্চাদের থেকে অনেকটাই আলাদা এবং ওই বাচ্চারা বেশ শক্তপোক্তও হয়। কোনও কিছু ধরে উঠে দাঁড়ানো, হামা টেনে কিছু নেওয়ার চেষ্টা এই সব কাজগুলি শিশুর পেশীকে একটু একটু করে হাঁটার উপযোগী করে তোলে, ওয়াকারে যেটা হয় না।
  • মারাত্মক ভাবে শিশু আঘাত পেতে পারে (Increased possibility of getting injured)-> ওয়াকার থেকে মারাত্মক ভাবে আঘাত পেতে পারে শিশু। যেমন, ওয়াকার চাকা লাগানো হওয়ায় শিশু অনেক সময় গতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে পড়ে যাওয়ার বা কোথাও জোরে ধাক্কা খেয়ে শরীরের নরম জায়গায়, মাথা ও ঘাড়ে আঘাত লাগার সম্ভাবনা প্রবল। এই আঘাতের রেশ সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হতে পারে বাচ্চাকে।
  • ওয়াকার থেকে হওয়া দুর্ঘটনা অনেক বাচ্চার অকালমৃত্যুর কারণ।
  • গোড়ালি ও আঙুল মচকে যেতে পারে।
  • বাচ্চার উচ্চতা একটু বেড়ে যাওয়ায়, নাগালের মধ্যে কোনও বিপদজনক জিনিস পেয়ে গেলে মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে।

 

কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা? (What experts say?) 

ইতিমধ্যেই,বাইরের কিছু দেশ, যেমন কানাডাতে ২০০৪ সাল থেকেই এই ওয়াকার ব্যবহার নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। American Academy of Pediatricians (AAP) যুক্তরাষ্ট্রে ওয়াকার ব্যবহার নিষিদ্ধ করার ফরমান জারি করেছে। আমাদের দেশেও, চিকিৎসকরা এই ওয়াকার ব্যবহারকে মোটেই প্রশ্রয় দেন না।

 

বিকল্প হিসেবে আপনি যা করতে পারেন? (What you should do?)

  • বাচ্চারা ৮-৯ মাস বয়স থেকে একটু একটু পা ফেলা শুরু করে। কিন্তু পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে হাঁটতে অনেকের ১৪-১৮ মাস পর্যন্ত সময় লেগে যায়। বাচ্চাকে নির্দিষ্ট সময়টা দিন।
  • যদি ওয়াকার কিনেই ফেলেছেন বা উপহার হিসেবে বাড়িতে এসেছে, সেটা ফেলে দিতে হবে না। বাচ্চাকে ওয়াকারে চাপান ওই খেলনার মতোই, কোনও কিছু শেখাতে নয়। ওয়াকারে চাপিয়ে নিজে অন্য কোথাও চলে যাবেন না, বাচ্চা যেন চোখের সামনেই থাকে। দিনে ৫-১০ মিনিট নিজে ধরে চাপাবেন আবার নামিয়ে দেবেন। বাচ্চার ডাক্তারের অনুমতি নিয়ে নিন। রোজ যে চাপাতেই হবে, তার কোনও মানে নেই। তবে যদি দেখেন, বাচ্চা ওতে চাপার জন্য জেদ শুরু করেছে বা চাপলে নামতে চাইছে না, পত্রপাঠ বিদায় করুন ওয়াকারকে।
  • বাচ্চাকে বরং বাইরে খেলতে নিয়ে যান, যেখানে সবাই খেলাধুলা করে সেরকম জায়গায় নিয়ে যান। অন্যদের খেলতে দেখে, বাচ্চা নিজেও হাঁটার জন্য অস্থির হবে। আলতো হাতে ধরে ধরে ওকে হাঁটতে শেখান।
  • নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরেও যদি বাচ্চা না হাঁটে, তা হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।

আরও পড়ুন (Also Read): Brain Development Toys for Kids

একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার  হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

null

null