ছোট্টবেলার যত্ন-অভ্যাসের ওপরই ভবিষ্যতের দাঁতের স্বাস্থ্য-সৌন্দর্য নির্ভরশীল; সতর্ক হোন আজই!

ছোট্টবেলার যত্ন-অভ্যাসের ওপরই ভবিষ্যতের দাঁতের স্বাস্থ্য-সৌন্দর্য নির্ভরশীল; সতর্ক হোন আজই!

কয়েকদিন ধরেই বড্ড উসখুস করছে ছোট্ট ছানাটি। মাড়ি কিসকিস করতে করতে আচমকা প্যাঁ করে কান্না, তারপর একটু আধটু গা গরম, পেট গোলমাল ইত্যাদি ইত্যাদি জ্বালা-যন্ত্রণার পরে একটা মিষ্টি সকালে একটা মিষ্টি সাদা দাঁত উঁকি দিল। কোথায়? আপনার ফোকলা সুন্দর বা সুন্দরীর মুখের ভিতর। কী আনন্দ বলুন তো! আপনি হইচই করে বাড়ি মাথায় করলেন, ছানার প্রথম দুধে দাঁত দেখা দিয়েছে বলে পটাপট খান দশেক ছবি উঠে গেল সে দাঁতের। দাঁতের প্রথম খাতির যত্ন বেশ ভালোই হল। উত্তেজনা কমলে বলুন, কাজের কথায় আসি! এই যে বাচ্চার প্রথম দুধে দাঁতটি উঁকি দিল, এবং বাকি সাঙ্গোপাঙ্গরাও একে একে আসবে, এদের তো সত্যিকারের যত্ন-আত্তি বিশেষ প্রয়োজন। জন্মের পর থেকেই বাচ্চার মাড়ির যত্ন নিতে হয়, সে তো আগেই বলেছিলাম, এবার প্রয়োজন আরও সতর্ক হওয়ার। কারণ, এই ছোট্টবেলার যত্ন ও অভ্যাসের ওপর ভিত্তি করেই ভবিষ্যতের দাঁতের স্বাস্থ্য ও সৌন্দর্য নির্ভরশীল। শিশুর দাঁত ও মাড়ির সঠিক যত্নের আদ্যোপান্ত জেনে নিন জলদি। (Baby Teeth Care In Bangla: Brushing First Teeth, Teething, Gum Care, and More in Bangla)

বাচ্চার দুধে দাঁত কী

জানেন কি, শিশু ১০ জোড়া দাঁত নিয়েই জন্মায়? দাঁতগুলো মাড়ির নীচে আড়াল থাকে বলে আমরা দেখতে পাই না। বাচ্চার জন্মের পর যে দাঁতগুলি ওঠে, তা একটি নির্দিষ্ট বয়সের পর পড়ে যায় এবং নতুন দাঁত গজায়। শিশুর মাড়ি ঠেলে ওঠা প্রথম দাঁতগুলিকেই দুধে দাঁত বলা হয়। বাচ্চার বয়স ৬-৮ মাস হলে, প্রথমে ওপরের পাটি ও নীচের পাটি মিলিয়ে ৪ টি দাঁত গজায়। ৩ বছর বয়সের মধ্যে বাচ্চার ২০টি দাঁত গজিয়ে যায়। অবশ্য এই সময় বাচ্চা বিশেষে কম বেশি হতেই পারে।

বাচ্চার মাড়ির যত্ন নেবেন কীভাবে? (Baby’s gum care)

বাচ্চার জন্মের পরে যদি আপনি ভাবেন যে, ও তো শুধু দুধ খায় বা ওর তো দাঁত নেই তাই মুখ পরিষ্কারের দরকার নেই, তা হলে কিন্তু বড্ড ভুল করছেন। বাচ্চার মাড়ি নিয়মিত পরিষ্কার করলে ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ করতে পারে না, মুখে দুর্গন্ধ হয় না এবং মাড়ির স্বাস্থ্যও ভালো থাকে। দাঁত না থাকলেও শিশুর মাড়ি যেভাবে পরিষ্কার করবেন,

  • একটি পাত্রে ঈষদুষ্ণ জল নিয়ে তাতে একটা পরিষ্কার, নরম কাপড় ভিজিয়ে বাচ্চার মাড়ি আলতো করে মুছে দিন। দিনে দুইবার এটা করুন। খাওয়ার পরে বাচ্চার মাড়ি ও মুখ পরিষ্কার করে দেওয়া খুব ভালো অভ্যাস। কাপড় দিয়ে নিয়মিত পরিষ্কার করে দিতে পারেন জিভটিও।
  • শিশুর দাঁত ওঠার সময় ভালো করে নিজের আঙুল পরিষ্কার করে, শিশুর মাড়িতে আলতো হাতে চাপ দিয়ে ম্যাসাজ করে দিন। এতে বাচ্চা খুবই আরাম পাবে।

আরও পড়ুন: কীভাবে পরিষ্কার করবেন গুবলে ছানার লাল জিভ?

বাচ্চার দাঁতের যত্ন নেবেন কীভাবে? (How do you look after your baby’s teeth?)

দুধে দাঁত তো ক’দিন পরে পড়েই যাবে, তাই ওগুলোর ছবি তুলেই খুশি থাকি, এই ভাবনা কিন্তু ভুল করেও মনে আনবেন না। এই দাঁতগুলোই কিন্তু আপনার বাচ্চার স্থায়ী দাঁতগুলোর জন্য জায়গা তৈরি করে রাখছে, দুধে দাঁতের স্থানেই গজাবে স্থায়ী দাঁত। তাই দুধে দাঁত ও তার সংলগ্ন মাড়ির স্বাস্থ্য ভালো রাখা খুবই জরুরি। এর ওপরেই নির্ভর করে আগামী দাঁতের স্বাস্থ্য। দুধে দাঁতের যত্ন নেবেন যে ভাবে, তা হল;

  • ছোট্ট মাথা, লম্বা হাতল আর নরম ব্রিসলস দেওয়া একটা বেবি টুথব্রাশ নিয়ে আসুন ওর জন্য। এই বেবি ব্রাশ যেন ভালো কোনও কোম্পানির হয়।
  • বাজারে অনেক নামীদামি কোম্পানির বেবি টুথপেস্ট পাওয়া যায়।এই সব পেস্টে খুব কড়া কোনও রাসায়নিক থাকে না এবং বাচ্চা অল্প গিলে ফেললেও তার কোনও ক্ষতি হয় না।
  • ব্রাশ জলে খুব ভালো করে ভিজিয়ে নিয়ে ১টি চালের দানার পরিমাণ বেবি টুথপেস্ট লাগিয়ে নিন। এবং বাচ্চার দাঁত আলতো হাতে ব্রাশ করে দিন।
  • বাচ্চার বয়স ৩ বছর হয়ে গেলে পেস্টের পরিমাণ হবে একটি মটরশুঁটি দানার মতো।
  • বাচ্চা যতদিন পর্যন্ত নিজে নিজে মুখে জল নিয়ে কুলকুচি করে পেস্টের ফেনা ফেলতে না শেখে, ততদিন নিজে সামনে থেকে ওকে সাহায্য করুন। সাধারণত, ৫-৬ বছর বয়সে বাচ্চারা সঠিক ভাবে কুলকুচি করতে শিখে যায়।
  • সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরে এবং রাতে খাবার পরে নিয়মিত ব্রাশ করান। এতে যেমন শিশুর ভবিষ্যতের অভ্যাস ভালো হবে, সেরকমই দাঁত ও মাড়িও ভালো থাকবে।
  • প্রত্যেকবার খাওয়ার পরে আপনি আঙুল দিয়ে ঘষে বাচ্চার দাঁত পরিষ্কার করে দিন।
  • বাচ্চা একটু বড় হয়ে গেলে ব্যবহার করতে পারেন ফ্লস। এতে দাঁতের ফাঁকে যে ময়লা ব্রাশ করে বেরোয় না, তাও বেরিয়ে যায়।

ব্রাশ করার সঠিক পদ্ধতি (Right way of brushing baby’s teeth)

  • ওপরের মাড়ি ও নীচের মাড়ির সব দাঁত ব্রাশ করুন।
  • মুখের একপ্রান্ত থেকে শুরু করে অপরপ্রান্ত পর্যন্ত পুরোটা ব্রাশ করুন।
  • খুব জোরে জোরে ব্রাশ করবেন না বা অনেকক্ষণ ধরে ব্রাশ করবেন না।
  • একদম ছোট্ট বাচ্চাকে কোলে বসিয়ে তার মাথা আপনার হাতে রেখে, আস্তে আস্তে গোল গোল করে ব্রাশ ঘুরিয়ে দাঁত পরিষ্কার করে দিন।
  • বাচ্চা একটু বড় হলে, তাকে অন্যভাবে ব্রাশ করতে শেখান। সামনে পিছনে ব্রাশ করলে দাঁতের গোড়া ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই দাঁত ব্রাশ করুন ওপর নীচে।
  • বেশি পেস্ট নিলে বেশি পরিষ্কার হয়, এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। পরিমিত মাত্রায় পেস্ট ব্যবহার করুন।

দাঁতের যত্নের সুঅভ্যাস শিশুর মধ্যে গড়ে তুলবেন কীভাবে? (Make brushing a habit in kids)

  • বাচ্চার সামনে নিজে প্রত্যেকদিন ব্রাশ করুন এবং ওর মতো করেই খেলতে খেলতে ওকে এর প্রয়োজনীয়তা বলুন।
  • দাঁতে পোকা হলে কেমন হয় বা ক্যাভিটি ব্যাপারটা দেখতে কেমন, তা বাচ্চাকে ছবি দেখিয়ে বলুন। ওর প্রিয় পুতুল ওর হাতে দিয়ে বলুন, পুতুলটির দাঁত ব্রাশ করে দিতে। এতে ওই ব্রাশ করা কাজের ওপর বাচ্চার আগ্রহ জন্মাবে।
  • খাওয়া, ঘুমানো ইত্যাদির মতো, নিয়মিত দাঁত ব্রাশ করা যে একটা কাজ, সেটা ওকে বোঝান।
  • বাচ্চা কেক,চকলেট খাবেই। বেশি মিষ্টিজাতীয় জিনিস খাওয়ার পরে ভালো করে কুলকুচি করে মুখ ধুতে শেখান।

কী কী খাবার খাওয়ালে দাঁতের স্বাস্থ্য ভালো হয়? (Foods to strengthen teeth)

  • প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার।মুরগীর মাংস এবং ডিম এই ক্ষেত্রে খুব উপকারী। মুরগীর মাংস আর ডিমের মতো প্রাণীজ প্রোটিনে উচ্চমাত্রায় ফসফরাস থাকে, যা দাঁতের জন্য খুবই ভালো। এছাড়াও বিনস, বাদাম ইত্যাদি।
  • ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার। দুধ, দই, পনির এই সব খাবারে উপস্থিত ক্যালসিয়াম একদিকে যেমন হাড় শক্ত করে, আবার দাঁতের এনামেলের স্বাস্থ্যও ভালো করে।
  • কমলালেবু, সবুজ তরিতরকারি, স্ট্রবেরি,আলু,পাতিলেবু ইত্যাদি ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার।
  • তাজা সবজি ও ফলমূল।
  • পর্যাপ্ত পরিমাণে জল।

আরও পড়ুন: ইকিড় মিকিড় দাঁতের সারি, শক্ত হবে তাড়াতাড়ি

মনে রাখুন কয়টি কথা (Points to remember) 

  • বাচ্চার দাঁত ওঠার সময় বাচ্চা অত্যধিক কাঁদলে বা ওর জ্বর এলে ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করুন।
  • কোনও কারণে মাড়ি লাল হয়ে ফুলে গেলে বা রক্ত পড়লে সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার দেখান।
  • দাঁত ওঠার সময় বাচ্চা সামনে যা পায় তাই কামড়াতে চায়। কোনও ধারালো বা নোংরা জিনিস ওর হাতের নাগালে রাখবেন না।
  • দুধে দাঁত বেরনোর সময় ওকে ভালো মানের টিদার কিনে দিন। এটা চিবোলে ও আরাম পাবে।
  • দাঁতে কোনও অসুবিধা না থাকলেও বছরে অন্তত একবার ডেন্টিস্টের কাছে নিয়ে যান।
  • বাচ্চাকে ছোট থেকে অতিরিক্ত চকোলেট, আইসক্রিম বা মিষ্টি খাওয়ার অভ্যাস করাবেন না। শুধু দাঁতের জন্যই না, এই অভ্যাস শরীরের অন্যান্য ক্ষতিও করতে পারে ভবিষ্যতে।

একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার  হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

null

null