‘খোকা ঘুমালো, পাড়া জুড়ালো, বর্গি এলো দেশে’; হ্যাঁ, খোকা বা খুকু ঘুমাবে, পাড়াও হয়তো কিছুক্ষণ জুড়াবে, কিন্তু বর্গি তো দূরের কথা, মা শুতে আসার আগেই খোকা বা খুকুটি আবার উঠে প্যাটপেটিয়ে চেয়ে থাকবে। আবার রাত হলে তো কথাই নেই। বাচ্চা বেশ ঘুমোচ্ছে, যেই মা বাড়ির সব কাজ সেরে শুতে এলো, অমনি তিনি ‘প্যাঁ’ সিগনাল দিয়ে উঠে পড়লেন। সারা সকাল,সারা দুপুর নাক ডেকে ঘুমিয়ে দস্যি ছানার ইচ্ছে হল যে, তিনি সারারাত জেগে মায়ের সাথে খেলবেন, বাবাকে হাত-পা দিয়ে ঠেলবেন। আর বেচারি মা, সারাদিনের ক্লান্তিতে চোখের পাতা জড়িয়ে আসছে ঘুমে, অথচ ঘুমানোর উপায় নেই। আবার একটানা ঘুমও নেই তার চোখে। ২-৩ ঘণ্টা পর পর রাতে উঠে কান্না শুরু করে দিচ্ছে দস্যিটা। Getting Baby to sleep through the night in Bangla.
যে সব বাড়িতে ছোট্ট একটি একরত্তি সদস্য আছে, তাদের কাছে এই ঘটনাগুলো নিতান্ত হৃদয়বিদারক এবং অতি সাধারণ। কিন্তু, বাচ্চাটিকে তো আর দোষ দেওয়া যায় না। দিন বা রাতের তফাতই যে করতে পারে না পুঁচকেটা। কোন সময় জেগে থাকতে হয়, কোন সময় নাক ডাকিয়ে ঘুমাতে হয়, এসব ওর জ্ঞানেই নেই। ফলস্বরূপ, মা পর্যাপ্ত বিশ্রাম পায় না রাতে বা বারবার উঠতে হয়। কিন্তু, এভাবে তো চলতে দেওয়া যায় না। রাতে বার বার উঠতে হলে বা ভালো মতো ঘুম না হলে যে অসুস্থ হয়ে পড়বেন আপনি। পুঁচকে তো সারাদিন যখন তখন ঘুমিয়ে তার ক্লান্তি মিটিয়ে নেবে, তার কাছে না হয় দুনিয়াটা আরামের এখন। আপনার তো আর সেই জো টি নেই কো! কী করলে বাচ্চা সারারাত একটানা ঘুমাবে বা রাতে কম উঠবে, তার কিছু টিপস বলে দিচ্ছি আমরা। জেনে নিয়ে প্রয়োগ করুন দেখি!
জন্মের পর ২-৩ মাস পর্যন্ত বাচ্চাদের ২ ঘণ্টা পরপর বুকের দুধ খাওয়াতে হয়। এই সময় বাচ্চারা সারা দিনে প্রায় ১০-১৮ ঘণ্টা ঘুমায়। কখনও কখনও একটানা ৩-৪ ঘণ্টাও ঘুমিয়ে নেয়। যে সময়টা তারা জেগে থাকে, সেটা রাত ১টার পরও হতে পারে, আবার ভোর ৪টার সময়ও হতে পারে। এতটুকু বাচ্চাকে তার নিজের মতো করেই খেতে ও ঘুমতে দেওয়া উচিত। তাই যেসব মায়ের বাচ্চা ২-৩ মাসের বা তার কম, তারা বাচ্চা যখনই ঘুমবে, তখনই একটু করে ঘুমিয়ে নিন। কারণ রাতে আপনার ঘুম হবে কি না, তাই নিয়ে কোনও গ্যারান্টি নেই। বাচ্চা আরেকটু বড় হয়ে গেলে অর্থাৎ, ৫-৬ মাসের হয়ে গেলে একটানা ৬ ঘণ্টা পর্যন্ত ঘুমাতে পারে। এইটাই সঠিক সময়, আস্তে আস্তে এমন কিছু কৌশল করা যাতে আপনার বাচ্চা রাতে কম ওঠে বা অনেকক্ষণ একটানা ঘুমায়। বাচ্চার বয়স মাথায় রেখে কৌশলগুলি প্রয়োগ করুন।
Also read: ছানার স্নানের সময় হোক আরাম আর স্ফূর্তির
একরত্তি ছানা দিন বা রাতের পার্থক্য কিছুই করতে পারে না। সেটা বোঝাতে হবে আপনাকেই। প্রত্যেকদিন রাতে বাচ্চা শোওয়ার আগে এমন কিছু করুন যাতে বাচ্চা বুঝতে পারে, যে এবার ওকে ঘুমতে হবে। অনেক বাচ্চার গায়ে জল পড়লে তাদের আরাম হয়, কুসুম কুসুম গরম জলে ওর হাত-পা একটু মুছিয়ে দিতে পারেন। বাচ্চা যে ঘরে ঘুমবে, সেই ঘরে নাইট ল্যাম্প জ্বালিয়ে দিন। সেই সময় যেন আর কোনও কোলাহল শিশুর কানে না আসে। হালকা কোনও মিউজিক চালিয়ে দিন বা নিজেই একটু গুনগুন করুন। শোওয়ানোর সময় ঘরের পরিবেশ একই রকম রাখার চেষ্টা করুন এবং রোজ একই রকম কাজ করুন। যাতে কিছুদিন পর, ওই কাজগুলি করা হলে বা ওই নাইট ল্যাম্প জ্বললেই শিশু বুঝতে পারে এবার ঘুমের সময় হয়ে গিয়েছে এবং এটা রাত।
দিনের বেলা যতটা সম্ভব ব্যস্ত রাখুন বাচ্চাকে। একদম ছোট বাচ্চার কথা আলাদা, কিন্তু বাচ্চা একটু হাত পা ছুঁড়ে খেলতে শিখে গেলে, তাকে দিনের বেলা খেলতে দিন। ওর সাথে কথা বলুন, গল্প করুন বা ওকে খেলান। অনেক সময় বোর হয়ে বাচ্চা ঘুমিয়ে পড়ে অসময়ে, এবং সারাদিন কোনও শারীরিক পরিশ্রম হয় না বলে রাতে আর ঘুমতে চায় না। তাই দিনের বেলা বাচ্চাকে চনমনে রাখুন। যেসব কাজ করলে বা খেলা করলে বাচ্চা খুব মজা পায় সেগুলি করুন। এতে রাতে ঘুম আসবে তাড়াতাড়ি।
বিকেলের পর থেকে এমন কিছু খেলাবেন না বা করবেন না, যাতে বাচ্চা উত্তেজিত হয়ে ওঠে। কোনও কিছু খেলনা নিয়েই হোক বা মায়ের কোলে চেপে নাচাই হোক, সন্ধ্যের সময় বাচ্চা যদি একবার মেতে ওঠে, তা হলে কিন্তু তাকে ঘুম পাড়ানো বড্ড মুশকিল।
রাতে নিজে যখন শুতে যাবেন, তার আগে আস্তে আস্তে বাচ্চাকে একটু উঠিয়ে ওকে একটু ব্রেস্ট মিল্ক খাইয়ে দিন। এতে রাতে তাড়াতাড়ি উঠে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই কমবে আর আপনিও অন্তত ৫ ঘণ্টা নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারবেন।
বাচ্চা সব সময় মায়ের সান্নিধ্য পছন্দ করে এবং মায়ের কাছেই তারা নিজেদের সবথেকে বেশি নিরাপদ মনে করে। কিন্তু, সারাক্ষণ তো মায়ের বাচ্চাকে নিয়ে বসে থাকলে চলবে না। একদম ছোট বাচ্চা ঘুমিয়ে গেলে তার বুকের ওপর পাতলা একটা কাপড় দিয়ে রাখুন। এতে বাচ্চা মনে করবে যে, মা তার গায়ে হাত দিয়ে আছে বা মা পাশেই আছে। ২-৩ মাসের কম বয়সি বাচ্চা ঘুমানোর সময়ও এই কৌশল করতে পারেন। তবে কখনই ভারী কিছু ওর গায়ে চাপা দেবেন না। একটু বড় বাচ্চার ক্ষেত্রেও নরম বালিশ ও নরম তোয়ালে এমন ভাবে রাখুন যেন বাচ্চা সুরক্ষিত বোধ করে এবং আচমকা ভয় পেয়ে জেগে না যায়। বাচ্চার বয়স ৬ মাস পেরিয়ে গেলে ওর পাশে দিতে পারেন ছোট্ট একটা সফট টয়। আপনি পাশ থেকে উঠে গেলে ও দিব্যি বুঝতে পারে। তাই এমন পরিবেশ রাখুন যেন ও আরাম পায় ও নিরাপদ বোধ করে।
রাতে বাচ্চা উঠলেই সঙ্গে সঙ্গে তাকে ব্রেস্ট মিল্ক ধরিয়ে দেবেন না। এতে কিন্তু অভ্যেস খারাপ হবে। বাচ্চা কিন্তু শুধু খিদে পেলেই রাতে ওঠে, এমনটা একেবারেই না। বাচ্চা উঠে যাওয়ার পর কিছুক্ষণ তাকে অন্যভাবে শান্ত করার চেষ্টা করুন, ঘুমপাড়ানি গান হোক বা কোলে নিয়ে একটু দুলিয়ে দেওয়া। বাচ্চার যখন ঘুম ঘুম ভাব থাকবে তখন এরকম করলেই সে একটু পরে ঘুমিয়ে যাবে। যদি বাচ্চার সত্যি খিদে পায় বা অন্য কোনও শারীরিক কষ্ট হয়, তা হলে আপনি নিজেই বুঝে যাবেন। কিন্তু ও ওঠার পর একটু অপেক্ষা করুন। ওকে নিজে নিজে ঘুমানো শিখতে দিন। রাতে শুতে যাওয়ার সময় শিশু যদি হাই তোলে, চোখ কচলায়, অর্থাৎ তার ঘুম ঘুম ভাব এসেছে, তখন তাকে নাইট ল্যাম্প জ্বালিয়ে ও হালকা গান শুনিয়ে কোলে নিয়ে একটু দুলিয়ে দিন। শিশু দিব্যি ঘুমিয়ে পড়বে। (Getting Baby to sleep throughout the night in Bangla) টিপস তো গেল, কিন্তু জানেন কি,
শিশুদের পর্যাপ্ত ঘুম না হলে, তাদের শরীরে লেপটিন হরমোনের ক্ষরণ কমে যায়। এই হরমোনের কাজ হল খিদে নিয়ন্ত্রণ করা। এর ক্ষরণ কমে গেলে, মস্তিষ্ক শরীরকে খিদে নিয়ন্ত্রণ করার সিগন্যাল পাঠাতে পারে না। ফলে বাচ্চারা প্রয়োজনের চেয়ে বেশি খেতে থাকে। আর তার ফলেই এই সমস্যা। আপনি নিজেও দেখেছেন, ঠিকঠাক ঘুম না হলে আপনার সোনামণির কেমন সমস্যা হয়! এটি শুধু যে শারীরিক সমস্যার জন্ম দেয়, তা নয়, একই সঙ্গে মানসিক সমস্যাও ডেকে আনে। কখনও তা বুঝতে পারেন, কখনও তা আপনার চোখ এড়িয়ে যায়। তাই প্রথমেই দেখে নেওয়া যাক, কোন বয়সের শিশুর জন্য কতটা ঘুম দরকার। আপনিও এই তালিকা ধরে দেখে নিন, আপনার খোকা বা খুকু পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুমাচ্ছে কি না। (Benefits of Sleep for your child’s Growth & development in Bangla)
মোটামুটি এই হল নানা বয়সে কতটা ঘুম দরকার তার পরিমাপ। এই পরিমাণ ঘুম না পেলে শিশুর মধ্যে নানা ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। একনজরে সেগুলোও দেখে নেওয়া যাক।
ঘুমের অভাবে কোন কোন সমস্যা হয়, তা তো জানা গেল। এবার দেখে নেওয়া দরকার, সঠিক পরিমাণে ঘুম পেলে শিশুর কোন কোন উপকার হয়। (Benefits of sleep for child’s growth and development in Bangla)
#1. শেখার ক্ষমতা (Learning power): যে শিশু পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমায়, তার শেখার ক্ষমতা বাড়ে। খুব সহজেই সে নতুন কিছু শিখে নিতে পারে। একদম ছোট বয়স থেকেই তাদের মধ্যে মনঃসংযোগ করার ক্ষমতাও দ্রুত বৃদ্ধি পায়। চট্ করে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রেও এই দলের শিশুদের বেশি পারদর্শী বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এমনকী পরবর্তী সময়ে এই দলের শিশুরা পড়াশোনাতেও বেশি মনোনিবেশ করতে পারে। মাথা ঠান্ডা রাখার ক্ষেত্রে এরা অন্যদের থেকে এগিয়ে থাকে।
#2. দ্রুত বৃদ্ধি (Faster growth): আগেই বলা হয়েছে, ঘুমালে শিশুর শরীরে সেই সব হরমোনের ক্ষরণ হয়, যেগুলো তার বৃদ্ধিতে কাজে লাগে। তাই যে শিশু যত বেশি ঘুমায়, সে তত তাড়াতাড়ি বাড়ে। এমনকী তার রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতাও কম ঘুমানো শিশুদের থেকে বেশি। কারণ পর্যাপ্ত ঘুম বাইরের জীবাণুর সঙ্গে লড়াই করার জন্য শরীরকে তৈরি করে তোলে। পরবর্তী সময়ে এই শিশুরা সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হয়।
#3. মন ভালো থাকে (Healthy mood): বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে সব শিশুরা পর্যাপ্ত ঘুমায়, তাদের শরীরে এনার্জি বা শক্তির পরিমাণ অন্য শিশুদের তুলনায় বেশি হয়। ফলে তারা একেবারেই ঘ্যানঘ্যানে হয় না। বরং তাদের মেজাজ অন্য শিশুদের তুলনায় ভালো থাকে। যদি আপনার সোনামণি খুব ঘ্যানঘ্যানে হয়ে যায়, তা হলে তার পিছনে ঘুমের অভাবটাও একটা কারণ হতে পারে।
#4. মিশুকে স্বভাবের (Good social behaviour): পরিসংখ্যান বলছে, যে সব শিশুরা পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমায় তারা সহজেই অন্যের সঙ্গে মিশতে পারে এবং নতুন পরিবেশে খাপ খাইয়ে নিতে পারে।
#5. হৃদযন্ত্রের জন্য ভালো (Sleep helps the heart): যে সব শিশুরা পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমায়, তাদের হৃদযন্ত্রও শক্তিশালী হয়। পরবর্তী সময়ে বা বেশি বয়সে তাদের হৃদয়ন্ত্রের সমস্যার আশঙ্কাও কমে।
Also read: আঠারো মাস হতেই মায়ের দুধ খাওয়ার ইতি!
একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।
null
null