জন্মের পর প্রতি মুহূর্তে একটু একটু করে বেড়ে উঠছে একরত্তি ছানাটি। ছোট্ট ছোট্ট হাত-পা ওয়ালা পুতুলটার মধ্যে একটু একটু করে জন্ম নিচ্ছে বোধবুদ্ধি, সজাগ হচ্ছে সব ইন্দ্রিয়গুলি। আর বাচ্চার এই বেড়ে ওঠার প্রত্যেকটা মাইলস্টোন পেরোতে দেখা একজন মায়ের কাছে যে কী আনন্দের অনুভূতি সেটা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। যারা নতুন মা হয়েছে, তারা বড্ড বেশি উৎসুক আর উদ্বিগ্ন থাকে তার বাচ্চার বাড়-বৃদ্ধি ঠিকমতো হচ্ছে কি না, তাই ভেবেই। নতুন মায়েদের চিন্তা কমাতেই আজ আমাদের এই প্রতিবেদন। তবে মনে রাখবেন, এই সব পরিবর্তন কিন্তু সব বাচ্চার ক্ষেত্রে এক নাও হতে পারে। আমরা একটা সাধারণ খসড়া বানানোর চেষ্টা করেছি শুধু আপনার জন্য। জন্মের পর থেকে ১২ মাস পর্যন্ত কীভাবে হয় শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ, দেখে নিন এক নজরে। (Baby Growth; Month by Month in Bangla. Boyosmafik shishur bikash. Baby growth month by month in Bengali.)
#1. শিশুর বয়স ১ মাস (1month old baby)
বাচ্চার জন্মের সময় যে উচ্চতা থাকে, তার থেকে ১.৫-২ ইঞ্চি লম্বা হয়।
শারীরিক ও মানসিক বিকাশ (Physical and mental development)->
- শিশু ৮-১২ ইঞ্চি পর্যন্ত দূরের জিনিস দেখতে পায়। খেলনা বা অন্য যে কোনও মনোহারী বস্তুর থেকে বেশি লক্ষ্য করে মানুষের মুখ বা মায়ের মুখ।
- চোখের সামনে আঙুল নাড়ালে সে আঙুলটা দেখবে এবং তার গতিবিধি লক্ষ্য করার চেষ্টা করবে।
- গন্ধ চিনতে শেখে। মিষ্টি গন্ধ বাচ্চারা খুব পছন্দ করে। আপনি যদি বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ান, তা হলে সে এই দুধের গন্ধও চিনতে পারে।
- মায়ের গলার স্বর চিনতে পারে ও মায়ের গন্ধ চিনে নিতে পারে। তাই মা আশেপাশে থাকলে দিব্য নিশ্চিন্ত থাকে খুদে। স্পর্শ ও ঘ্রাণের মাধ্যমেই শিশু বুঝে নিতে পারে মায়ের আদর।
- আরামের অনুভূতি বুঝতে শেখে। নরম কিছুর ওপর বাচ্চাকে রাখলে ওর আরাম হয় এবং বাচ্চা নিরাপদ বোধ করে।
#2. শিশুর বয়স ২ মাস (2 months old baby)
শারীরিক ও মানসিক বিকাশ (Physical and mental development)->
- দৃষ্টিশক্তির ওপর নিয়ন্ত্রণ আরও ভালো হয়। কোনও জিনিসকে বাচ্চার চোখের সামনে নাড়ালে সে ভালোভাবে সেটা লক্ষ্য করে। এমনকি, ১৮০ ডিগ্রি পর্যন্ত তার দৃষ্টিশক্তি ঘোরাফেরা করতে পারে।
- বাচ্চা মায়ের মুখ চিনে যায় এবং স্পর্শে স্বস্তি বোধ করে।
- আপনি যখন কিছু বলছেন, সেটা ও মন দিয়ে শোনার চেষ্টা করবে এবং মাঝে মাঝে গলা থেকে স্বর বের করে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে। তাই বাচ্চার সাথে যত খুশি কথা বলুন।
- হাত-পা নেড়ে আনন্দ ও বিরক্তি প্রকাশ করবে।
- গায়ে জোর বাড়বে খুদের। শূন্যে ছোঁড়া ওর লাথি একটা খেয়ে দেখুন, বুঝতে পারবেন।
- বাচ্চার নড়াচড়া অনেক সাবলীল হয়ে যাবে। হাত মুখের মধ্যে পুরে দেওয়া বা আঙুল চোষা শুরু হতে পারে এখন থেকেই।
- আপনার কথায় সাড়া দেওয়ার চেষ্টা করবে এমনকি হাসতেও পারবে শিশু।
- নিজের অনুভূতি বা বোধ-বুদ্ধি সম্পর্কে আস্তে আস্তে সচেতন হতে শুরু করবে।
- কিছুটা সময় পেটের ওপর ভর দিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলে হাত-পা তোলার চেষ্টা করবে। এতে ওর মাংস পেশীগুলি সবল হবে। তবে, যাই করুন, বাচ্চার মাথায় সবসময় যেন সাপোর্ট থাকে। এসময় ঘাড় সোজা হয় না বলে অতর্কিতে ঘাড়ে আঘাত লাগার আশঙ্কা বেশি।
#3. শিশুর বয়স ৩ মাস (3 months old baby)
শারীরিক ও মানসিক বিকাশ (Physical and mental development)->
- বাড়ি ভর্তি মানুষের মাঝে দিব্যি খুঁজে পাবে তার মা ও বাবাকে। মা, বাবা বা খুব প্রিয় কাউকে দেখলে চোখে- মুখে আনন্দের অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলবে।
- প্রিয়জনের গলা শুনলে হাসবে একরত্তিটি।
- গলা দিয়ে অদ্ভুত সব আওয়াজ বের করে সবার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে, একটানা দুর্বোধ্য ভাষায় আগডুম-বাগডুম কী যে বলে যাবে, তা বোধ করি মা-ই বুঝবেন।
- যত খুশি গান করুন, কথা বলুন বা গল্প করুন শিশুর সাথে। এই সময় থেকেই তার শব্দভাণ্ডার তৈরি হতে শুরু করে, যা ওকে আর কিছুদিন পরেই কথা বলতে সাহায্য করবে।
- পেটের ওপর ভর দিয়ে উপুড় করে শোওয়ালে শরীরের ওপরের অংশ ও মাথা ওপর দিকে তোলার চেষ্টা করবে।
- মাথার ওপর ঝোলানো কোনও খেলনা দেখলে হাত দিয়ে সেটা ধরতে ও নাড়াতে চেষ্টা করবে।
- নিজের পছন্দ-অপছন্দ বোধ তৈরি হবে শিশুর মধ্যে।
- হাতের মুঠো বন্ধ করবে এবং খুলবে নিজের ইচ্ছেমতো।
- এই সময় থেকে শিশু আর আগের মতো ঘুমবে না।
- নিজের বুড়ো আঙুল বা বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ এবং বাকি আঙুলগুলির মধ্যে তফাত বুঝতে শিখবে শিশু।
#4.শিশুর বয়স ৪ মাস (4 months old baby)
শারীরিক ও মানসিক বিকাশ (Physical and mental development)->
- শুধু হাত বা আঙুল নয় আর,অন্য জিনিসপত্রও মুখের মধ্যে ঢোকানোর চেষ্টা করবে পুঁচকেটি।
- মজার মুখভঙ্গী করলে শিশু বুঝতে পারবে ও মজা পাবে।
- উজ্জ্বল রঙের খেলনা, মিউজিক্যাল খেলনা ইত্যাদি তার খুব পছন্দ হবে এসময়। শুধু শিশুর পছন্দ নয়, এই সব খেলনা শিশুর মোটর স্কিল তৈরির ভিত শক্ত করতে শুরু করে এখন থেকেই
- নিজের হাত ও দৃষ্টি নিয়ন্ত্রণ করতে শিখে যায় শিশু।
- বাচ্চা পাশ ফিরতে পারবে। পেটের ওপর শুইয়ে দিলে আবার নিজেকে নিয়ে পালটি খেয়ে সোজা হয়ে যাবে বা এর উল্টোটাও করতে পারে। কনুইয়ের ওপর ভর দিয়ে ওঠার চেষ্টা করবে।
- অনেক বাচ্চার ফোকলা মুখে দাঁতের উঁকিঝুঁকি দেওয়া শুরু হয় এখন থেকেই। কাজেই সামনে যা পাবে, তাতেই কামড় বসাতে ইচ্ছে হবে তার।
#5.শিশুর বয়স ৫ মাস (5 months old baby)
শারীরিক ও মানসিক বিকাশ (Physical and mental development)->
- বিভিন্ন রঙের মধ্যে পার্থক্য বোঝার ক্ষমতা বাড়ে।
- আওয়াজ হলে সেটা শুনে ঘাড় ঘোরাতে পারে।
- একটু দূরে কোনও খেলনা বা ওর প্রিয় জিনিস থাকলে সেটা দেখতে পায় ও নিতে চেষ্টা করে।
- আপনি যদি কিছু বলেন, সেটা নিজের মতো করে নকল করার চেষ্টা করে।
- নিজের ছোট্ট হাতগুলো নিয়ে যেন বড্ড বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ে খুদেটি। হাতগুলো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখা বা সবকটা আঙুল দিয়ে একটা জিনিস আঁকড়ে ধরার মতো মজাদার কাজ করতে থাকে সে। হাত জড়ো করে খেলবেও সে।
- পেটের ওপর ভর দিয়ে নিজে নিজে গড়াতে শিখবে এবার। অতএব, আপনি সাবধান। হামাগুড়ি দেওয়ার প্রস্তুতির প্রথম পাঠ নেওয়া শুরু করেছে ও। চোখে চোখে রাখুন সবসময়।
#6. শিশুর বয়স ৬ মাস (6 months old baby)
শারীরিক ও মানসিক বিকাশ (Physical and mental development)->
- নিজের সব খেলনা, হাতের কাছে পাওয়া জিনিসপত্র মন দিয়ে নাড়াচাড়া করে দেখবে। সেটাকে মুখে পুরতেও কোনও আপত্তি নেই ওর।
- শব্দ শুনলেই চট করে ঘুরে তাকাবে। মহিলা ও পুরুষের গলার আওয়াজের মধ্যে পার্থক্য করে নেবে সহজেই।
- মুখ থেকে কিছু কিছু অর্থপূর্ণ আওয়াজ বের করার চেষ্টা করবে।
- আপনি একটু সাহায্য করলে ও বসতে পারবে, তবে বেশিক্ষণ পারবে না বসে থাকতে।
- পরিচিত ও অপরিচিত বোধ তৈরি হবে। চট করে অন্য কোনও অপরিচিত মানুষের কোলে যেতে চাইবে না।
- কোনও জিনিস এক হাত থেকে অন্য হাতে নিতে পারবে।
#7.শিশুর বয়স ৭ মাস (7 months old baby)
শারীরিক ও মানসিক বিকাশ (Physical and mental development)->
- বিভিন্ন ধরনের শব্দ বোঝার শক্তি তৈরি হয়।
- কারও কথা বলার ধরন বা ভাব লক্ষ্য করে বাচ্চা উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করে।
- দৃষ্টিক্ষমতা অনেক উন্নত হয়।
- কারও সাহায্য ছাড়াই বসতে পারে।
- ওকে উঁচু করে ধরা হলে পায়ের ওপর একটু করে ভর দিতে পারে।
#8.শিশুর বয়স ৮ মাস (8 months old baby)
শারীরিক ও মানসিক বিকাশ (Physical and mental development)->
- হামাগুড়ি দেওয়ার সব প্রস্তুতি শুরু করে দেবে। মাটিতে নামিয়ে রাখলে সারাক্ষণই দেখবেন হয় এদিকে পালটি খাচ্ছে নয় ওদিকে উল্টে যাচ্ছে।
- নানারকম খেলনা বা নানা আকারের জিনিসের ওপর আকৃষ্ট হয় এবং সেগুলো নিয়ে বোঝার চেষ্টা করে।
- বেশ ভালোভাবেই বসতে শিখে যায় ও বসে বসে দুলতে চেষ্টা করে।
- অনেক বাচ্চা হামা দেওয়ার প্রাথমিক পাঠ শুরু করে ফেলে।
#9.শিশুর বয়স ৯ মাস (9 months old baby)
শারীরিক ও মানসিক বিকাশ (Physical and mental development)->
- বাচ্চা নিজের ঘরের সবকিছু ভালোভাবে দেখতে পায়।
- মনে রাখতে পারে। বাচ্চা বুঝতে পারে যে, ও এখন যেটা দেখতে পাচ্ছে না বা লুকিয়ে রেখেছেন আপনি, সেটা আবার ও দেখতে পাবে।
- মা বা বাবা বলতে পারে। হ্যাঁ/ না বললে বুঝতে পারে।
- হাত মুঠো করে কোনও জিনিস টানতে পারে ও ধরে রাখতে পারে।
- কারও সাহায্য ছাড়াই দিব্য বসে থাকতে পারে।
- উঁচু কিছু পেলে তাতে ভর দিয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে।
#10.শিশুর বয়স ১০ মাস (10 months old baby)
শারীরিক ও মানসিক বিকাশ (Physical and mental development)->
- প্রত্যেকের গলার স্বর এবং ভিন্ন ভিন্ন আওয়াজ চিনে যায়। কখন আপনি ডাকছেন বা কখন দরজা খুলছেন, সব বুঝতে পারে।
- হাত কী করে কাজে লাগাতে হয়, বুঝে যায়। আপনি যদি ওকে এমন একটা খেলনা দেন, যেটা বোতাম টিপলে আলো জ্বলে, ও সেই বোতাম টিপে আলো জ্বালাতে পারবে।
- যেমন ভাবে খুশি হামা দিয়ে এগিয়ে যাবে ও, গড়িয়েই হোক বা কম্যান্ডো স্টাইল, সেটা একদম ওর ইচ্ছে।
- যদি বাচ্চার হামা দিতে ইচ্ছে না করে, তা হলে হয়তো দাঁড়ানোর চেষ্টা শুরু করে দিল।
- আপনি ধরে থাকলে দুই পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে পারবে ও।
- পরিষ্কার করে মা ও বাবা বলতে শিখবে।
- কোনও কিছু পছন্দ হলে আঙুল তুলে দেখাতে পারবে।
#11.শিশুর বয়স ১১ মাস (11 months old baby)
শারীরিক ও মানসিক বিকাশ (Physical and mental development)->
- দৃষ্টিশক্তি ও শোনার ক্ষমতা বেশ ভালোই মজবুত হয়ে ওঠে বলে চারপাশে কী হচ্ছে সেটা ও দিব্যি বুঝতে পারে।
- প্রায় ২০ ফুট দূরের জিনিস দেখতে পায়।
- বাড়ির মধ্যে আসবাবপত্র ধরে নিজে নিজেই দাঁড়িয়ে পড়বে এবং চুটিয়ে হামা দেবে।
- জিভ কোথায়, দাঁত কোথায় ইত্যাদি বললে ও সেটা বুঝবে এবং আঙুল দিয়ে দেখাবে।
#12.শিশুর বয়স ১২ মাস (12 months old baby)
শারীরিক ও মানসিক বিকাশ (Physical and mental development)->
- ছবিওয়ালা বই পড়ে শোনালে সে ছবিও দেখবে আবার আপনার কথাও শুনবে।
- টা টা করতে বলুন, দিব্যি করে দেখাবে। অর্থাৎ, আপনার কথা বুঝতে শিখবে; আপনি কিছু বললে সেটা শুনবে।
- কোনও জিনিস লুকিয়ে দিলে খুঁজে বের করতে পারবে।
- কোনও খেলনা কীভাবে জোড়া লাগাতে হবে বা কৌটোতে কিছু ভরে দেওয়ার মতো কাজ করার বোধ-বুদ্ধি আসবে ওর মধ্যে।
- পায়ের ওপর জোর পায় ও আস্তে আস্তে হাঁটতে শুরু করবে। একা একা হাঁটতে না পারলেও মাটির ওপর পা ফেলে এগিয়ে যাওয়া বেশ শিখে যায়।
মনে রাখুন কিছু কথা (Some more to remember)->
- প্রত্যেক বাচ্চার শরীর আলাদা, তাই অনেকের ক্ষেত্রেই এই বেড়ে ওঠার পর্যায় আগে-পরে হতে পারে।
- বাচ্চা যেন সুষম পুষ্টি ও পর্যাপ্ত বিশ্রাম পায়, সেদিকে খেয়াল রাখুন।
- নিয়মিত ডাক্তারের সংস্পর্শে রাখুন বাচ্চাকে; তা হলে বাচ্চার বেড়ে ওঠা স্বাভাবিক কি না, তা নিয়ে আর দুশ্চিন্তা হবে না আপনার।
একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।
null
null