শরীরের ভিতর ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছে আরেকটা প্রাণ। গর্ভস্থ সন্তান একটা নির্দিষ্ট সময়ের পরেই নিজের উপস্থিতি জানিয়ে দিচ্ছে তার মাকে। মনে করিয়ে দিচ্ছে, এবার সে তার মায়ের মুখ দেখতে চায়, মায়ের মতোই সেও বড্ড অস্থির তাদের দুজনের এই প্রথম দেখা হওয়ার কথা ভেবে। মাতৃত্বের সর্বপ্রথম ধাপ নিজের সন্তানকে গর্ভে ধারণ করা, নিজের শরীরের ভিতর তিল তিল করে বেড়ে ওঠা আরেকটা প্রাণের অস্তিত্ব অনুভব করা। প্রেগন্যান্সির সম্পূর্ণ সময়টাকে তিনমাস করে ভাগ করা হয়ে থাকে, এবং এই তিনমাস করে সময়কে এক একটি Trimester হিসেবে ধরা হয়। প্রেগন্যান্সির (Pregnancy) শেষের তিনমাস সময় অর্থাৎ ২৮-৪০ সপ্তাহ সময়কে Third Trimester বলা হয়। প্রতিটি Trimester-এ গর্ভস্থ শিশুর বিকাশ কীরকম হয় জানলে, মা নিজের সম্ভাব্য শারীরিক অস্বস্তি সম্পর্কে আগে থেকেই সচেতন থাকে এবং গর্ভস্থ সন্তানের বাড়-বৃদ্ধি অনুভব করে তাকে জলদি দেখার জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত হতে থাকে। গর্ভাবস্থার শেষ তৃতীয় মাস বা Third Trimester চলাকালীন প্রত্যেক সপ্তাহে শিশুর মধ্যে কী কী পরিবর্তন আসে বা শিশুর Growth কীভাবে হয়, এই নিয়েই আমাদের আজকের আলোচনা। (Gorvabosthar sesh tin mase bachchar bikash kivabe hoy? Your Baby’s Development in the Third Trimester)
প্রেগন্যান্সির ২৮ তম সপ্তাহে গর্ভস্থ সন্তানের চোখের পাতা তৈরি হয়ে যায় এবং শিশু আংশিকভাবে চোখ খুলতে পারে। এইসময় শিশুর ওজন প্রায় ১০০০ গ্রাম মতো হয়ে থাকে ও দৈর্ঘ্য ৩৮ সেন্টিমিটার। স্নায়ুতন্ত্র শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে শুরু করে ও শ্বাসপ্রশ্বাস প্রক্রিয়া নিয়মিত হতে সাহায্য করে। দৃষ্টিশক্তির বিকাশ ঘটার কারণে, বাইরে আলো জ্বালালে পেটের ভিতর থেকেও শিশু তা অস্পষ্টভাবে অনুভব করতে পারে।
গর্ভস্থ শিশু তার ছোট্ট ছোট্ট হাত-পা টেনে আড়মোড়া ভাঙে এবং মায়ের পেটে লাথি মারতে শুরু করে। শিশুর মাথার খুলি এবং হাড়ের গঠনও বেশ মজবুত হয়ে যায়। এই সপ্তাহে যদি শিশু জন্মগ্রহণ করে, তা হলে হয়তো তার জন্য কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাসের ব্যবস্থা করতে হবে না কারণ শ্বাসযন্ত্র জরায়ুর বাইরে শ্বাস নেওয়ার জন্য প্রায় প্রস্তুত।
এসময় বাচ্চার ওজন প্রায় ১৩০০ গ্রাম এবং দৈর্ঘ্য ৪০ সেন্টিমিটার হয়ে থাকে। । বাচ্চা পুরোপুরি চোখ খুলতে পারে। মাথায় চুল গজাতে শুরু করে। বাচ্চার শরীরে অস্থি মজ্জা থেকে লোহিত রক্তকণিকা তৈরি হতে থাকে। গর্ভস্থ শিশু আঙুল মুঠো করে ধরতে পারে। শিশু আকারে বড় হওয়ার সাথে সাথে অ্যামনিওটিক তরলের (amniotic fluid ) ঘনত্ব কমতে শুরু করে। এই সপ্তাহ চলাকালীন শিশু প্রায় ১ লিটার অ্যামনিওটিক তরলের মধ্যে ভেসে থাকে। শিশুর আঙুলে নখ তৈরি হয়ে যায় এবং শিশুর নড়াচড়া বাইরে থেকেও বোঝা যায়।
গর্ভস্থ সন্তানের প্রধান প্রধান অঙ্গগুলি নিজেদের গঠন প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করে ফেলে। এই সপ্তাহ থেকে দ্রুতগতিতে শিশুর ওজন বাড়তে থাকে। এসময় শিশুর আয়তন অনেকটা আনারসের মতো হয়ে যায়। শিশু বেশি ছটফট করে এবং মাকে কিছুসময় পরপরই লাথি মারতে থাকে ও হাত দিয়ে ধাক্কা দেয়। শিশুর আকার বেশ বড় হয়ে যাওয়ার কারণে মায়ের ফুসফুসের ওপর চাপ বাড়ে এবং মায়ের শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে অসুবিধা হয়। শিশুর হাত-পা পরিপুষ্ট হয়ে ওঠে। এছাড়াও শিশু REM ( Rapid Eye Movement )-এর পর্যায়ে অনেক বেশি সময় কাটায়।
গর্ভাবস্থার এসময়ে শিশু প্রায় ১৭০০ গ্রাম ওজনের হয়ে যায় এবং লম্বায় ৪৩ সেন্টিমিটার হয়ে যায়। শিশু শ্বাস নেওয়া শুরু করে। শিশুর ওজন প্রত্যেক সপ্তাহে প্রায় ২৫০ গ্রাম করে বাড়তে থাকে। চুলের বিকাশ সম্পূর্ণ হয়। শিশুর শরীর ক্যালসিয়াম, আয়রন ইত্যাদি প্রয়োজনীয় খনিজ শোষণ করতে শুরু করে। শিশুর মাথা নীচের দিকে নামতে থাকে অর্থাৎ প্রসবের জন্য প্রস্তুত হতে শুরু করে দেয়। শিশুর ত্বক নরম, মসৃণ চুলের মতো একটি স্তর দিয়ে ঢাকা থাকে, একে লানুগো(lanugo) বলে। এই সপ্তাহ থেকে লানুগো মিলিয়ে যেতে শুরু করে।
বাচ্চার চোখ আলোর প্রতি সংবেদনশীল হয়ে পড়ে। হাড় শক্ত ও মজবুত হতে শুরু করে। মাথার খুলির বিকাশ সম্পূর্ণ হয়ে গেলেও তার কাঠামো নরম থাকে। প্রসবের সময় জন্মপথ দিয়ে বেরিয়ে আসতে যাতে কোনও অসুবিধা না হয়, মূলত তার জন্যই শিশুর খুলির কাঠামো কোমল ও নমনীয় থাকে। শিশুর আকার এসময় বেশ বড় হয়ে যায়, যার ফলে সে খুব বেশি নড়াচড়া করার জায়গা পায় না। বাইরে হওয়া আওয়াজ, মায়ের দৈনন্দিন খাদ্যাভ্যাস ইত্যদি সমস্ত কিছুর ওপর এসময় গর্ভস্থ সন্তানের নড়াচড়া নির্ভর করে। (Your Baby’s Development in the Third Trimester)
বাচ্চার ওজন প্রায় ২১০০ গ্রাম হয়ে যায় ও দৈর্ঘ্য হয় প্রায় ৪৭ সেন্টিমিটার। দ্রুতগতিতে ফুসফুসের বিকাশ হতে থাকে এবং পুত্রসন্তানের ক্ষেত্রে অণ্ডকোষ আস্তে আস্তে নিচের দিকে নামতে শুরু করে। শিশুর নখের বিকাশও সম্পূর্ণ হয়ে যায়।
এই সময়ের পর থেকে শিশু ওজনে বাড়লেও লম্বায় আর বাড়ে না। সমস্ত ইন্দ্রিয় আরও সজাগ হয়ে উঠতে শুরু করে এবং কিডনির গঠন সম্পূর্ণ হয়। শিশু নড়াচড়া করলে এসময় মায়ের পেটে হাল্কা ব্যথা হতে পারে। ব্যথা অনেকক্ষণ স্থায়ী হলে বা খুব বেশি মনে হলে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন।
শিশুর অন্ত্রে মিকোনিয়াম (meconium) নামে এক ধরনের কালচে সবুজ পদার্থ তৈরি হয়। প্রসবের পর প্রথম কয়েকদিন শিশু এই মিকোনিয়াম মল হিসেবে ত্যাগ করে। মায়ের পেটে থাকাকালীন শিশু অ্যামনিওটিক তরল গিলে ফেলে এবং তা থেকেই এই মিকোনিয়াম তৈরি হয়। বাচ্চা যদি একদম নড়াচড়া না করে, তা হলে সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
বাচ্চা এসময় প্রসবের জন্য পুরোদমে প্রস্তুত হতে শুরু করে দেয়। বাচ্চার মাথা যদি নীচে না থাকে, তাহলে ডাক্তার তার মাথা নীচে করানোর জন্য চিকিৎসা শুরু করেন। এসময় শিশু সঠিক ভাবে নিশ্বাস প্রশ্বাস নিতে পারে।
এসময় বাচ্চার ওজন প্রায় ২৯০০ গ্রাম হয়। মায়ের শরীরের অ্যান্টিবডি শিশুর শরীরে যেতে থাকে। শিশুর নাড়ি মোটা হয়ে যায় এবং শিশু জরায়ুর বাইরের পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য পুরোপুরিভাবে প্রস্তুত হয়ে যায়। শিশু ধীরে ধীরে নীচের দিকে নামা শুরু করে।
বাচ্চার শরীরে চর্বির স্তর এখনও জমতে থাকে, যাতে সে বাইরে আসার পর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। শিশুর পেশির শক্তি অনেকটাই বেড়ে যায়। শিশুর আকার এসময় একটা বড় তরমুজের মতো হয়ে যায়।
বাচ্চার ওজন প্রায় ৩৩০০ গ্রাম হয়ে থাকে। বাচ্চা এবার যে কোনও সময় ভূমিষ্ঠ হতে পারে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নির্দিষ্ট দিনের আগে বা পরে বাচ্চার জন্ম হয়। তাই ৩৬ সপ্তাহ থেকেই সতর্ক থাকা প্রয়োজন। এই আলোচনায় সাধারণভাবে বাচ্চার যে ওজন বা আয়তনের কথা বলা হয়েছে, প্রত্যেক বাচ্চার ওজন ও আয়তনের সাথে তার অল্পবিস্তর হেরফের ঘটলেও বাচ্চার সুস্থতাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। (Your Baby’s Development in the Third Trimester)
একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।
null
null