টিকাদানের পর তার কী কী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে, জেনে নিয়ে সচেতন থাকুন!

টিকাদানের পর তার কী কী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে, জেনে নিয়ে সচেতন থাকুন!

দু’দিন ধরে তৃষা ও সৌরভের মধ্যে খুব কথা কাটাকাটি চলছে। তৃষার কথায় টিকা দেওয়া খুব জরুরি। সৌরভের ধারণা টিকা না দিলেও চলে। তা ছাড়া টিকা দিলে নানারকম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। সে কারণেই বাবানের বাপির আরও চিন্তা। যদি দু’জনের মধ্যে এই বিষয়টা নিয়ে কিছুতেই মীমাংসা হচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত রফা হল, দু’জনেই বাবানের চিকিৎসকের কাছে যাবে। এই ব্যাপারে তাঁর পরামর্শ নেবে। তিনি যা বলবেন, তা-ই দু’জনে মেনে নেবে। (Side Effects of Vaccines in Babies and Children)

কথা মতো চিকিৎসকের অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে, দু’জনেই ওঁর চেম্বারে গেল। চিকিৎসককে নিজেদের মন কষাকষির কথা জানাতে তিনি হেসে উঠলেন। বললেন, ওদের দু’জনের কথাই ঠিক। টিকা দেওয়া যেমন জরুরি, তেমনই এর কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও রয়েছে। (What to Expect After Your Child Gets Vaccines ) তবে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ভয়ে টিকা এড়িয়ে চলাটা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ নয়। চিকিৎসক টিকার গুরুত্বটা বুঝিয়ে বললেন ওদের।

 

টিকা কী ও কেন? (Vaccine And Its Importance):

পরিবেশে এমন কিছু রোগের ভাইরাস ছড়িয়ে থাকে, শরীরকে আক্রমণ করার আগেই যাদের প্রতিহত করা যায়। এ জন্য প্রয়োজন নির্দিষ্ট রোগটির বিরুদ্ধে শরীরে অনাক্রম্যতা তৈরি করা। টিকার প্রধান কাজ মানুষের শরীরে এই অনাক্রমতা গড়ে তোলা। টিকার মাধ্যমে খুদের শরীরে নির্দিষ্ট রোগটির অ্যান্টিজেন খুব অল্প পরিমাণে প্রবেশ করানো হয়। এই অ্যান্টিজেনকে প্রতিরোধ করতে শরীর প্রয়োজনীয় অ্যান্টিবডি তৈরি করে। এই অ্যান্টিবডিই খুদের দরকারি। বিশেষজ্ঞদের কথায়, একবার এই অনাক্রম্যতা তৈরি হয়ে গেলে, ভবিষ্যতে রোগটির ভাইরাস খুদেকে আক্রমণ করলেও খুদের কোনও ক্ষতি হয় না। রোগ প্রতিরোধের এই ক্ষমতা গড়ে তুলতেই টিকার প্রয়োজন।
কিছু রোগের সংক্রমণের ফলে মানুষের হাত পা অসাড় হয়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে মৃত্যুও ঘটতে পারে। এই রোগগুলির টিকা নেওয়া থাকলে খুদেকে এমন সমস্যায় পড়তে হয় না।
সৌরভ চিকিৎসককে জিজ্ঞেস করল, তবে এর তো কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও রয়েছে। তাতে বাবানের ক্ষতি হবে না? (Baby Immunisations Side Effects How Long Do They Last) চিকিৎসকের তার উত্তরে বেশ কয়েকটি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে বিশদে আলোচনা করলেন।

 

টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া (Side Effects Of Vaccines):

টিকার মাধ্যমে খুদের শরীরে একধরনের অ্যান্টিজেন প্রবেশ করানো হয়। এর থেকেই ওর শরীরে প্রয়োজনীয় অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। এই অ্যান্টিবডি পরবর্তীকালে খুদেকে রোগটির হাত থেকে বাঁচায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই অ্যান্টিবডি তৈরি হওয়ার সময়েই কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। তবে এগুলোর কোনওটাই তেমন গুরুতর নয়। (Vaccine Side Effects and Adverse Events)

#1. ব্যথায় লাল হয়ে যাওয়া: টিকা দেওয়ার সময় শরীরের যে অংশে ইনজেকশন ফোটানো হয়, সেই অংশে ব্যথা হতে পারে। বেশিরভাগ শিশুরই এই ব্যথা হয়। কিছুক্ষেত্রে জায়গাটা লাল হয়ে যায়। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ওই ব্যথা কমে যায়। একই সঙ্গে লালভাবটিও কমে আসে।

#2. ফুলে যাওয়া: টিকা দেওয়ার পর ব্যথার অংশ ফুলে যেতে পারে। (Symptoms After Baby Vaccinations) কিছু টিকার ক্ষেত্রে এই ফোলাভাব সারাজীবন থেকে যায়। আবার কিছু ক্ষেত্রে ক’দিন বাদে ফোলাভাব ধীরে ধীরে কমে যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, ফোলা অংশে ব্যথা না থাকলে ও ফোলা অস্বাভাবিক আকারের না হলে এই নিয়ে চিন্তার কিছু নেই।

#3. হালকা জ্বর: টিকাকরণের অন্যতম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হল জ্বর। শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হওয়ার লক্ষণ হিসেবেই এই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। শুনতে অবাক লাগলেও, এই ধরনের জ্বরে তাপমাত্রা সাধারণত একশো থেকে ১০১ ডিগ্রি ফারেনহাইটের মধ্যেই থাকে। (Baby Cold After Vaccinations) চিকিৎসকের কথায়, টিকার কারণে জ্বর হলে তা ২৪ ঘণ্টার বেশি থাকে না। কোনও টিকার দ্বিতীয় বা তৃতীয় ডোজ দেওয়ার পর জ্বর হওয়া খুব স্বাভাবিক।

#4. অত্যাধিক কান্না: খুদে খোকাখুকুর ইচ্ছের বিরুদ্ধে তার গায়ে ইনজেকশন ফোটানো হবে। এতে ওর খারাপ তো লাগবেই। তাই কান্নাকাটিও স্বাভাবিক। তা ছাড়াও ইনজেকশনের ছুঁচ গায়ে ফুটলে ওর ব্যথা লাগে। সেই ব্যথা সহ্য করতে না পেরেই কেঁদে ফেলে চোখের মণি। (Baby Crying Uncontrollably After Vaccination) চিকিৎসকের কথায়, একটু বড় বাচ্চারা আবার ইনজেকশন দেখলে ভয়েই কেঁদে ফেলে। তবে কোনও ক্ষেত্রেই কান্না বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। বিশেষজ্ঞদের অভিজ্ঞতা, আদর করে একটু ঘুরিয়ে আনলেই ধীরে ধীরে শান্ত হয় শিশুরা।

 

আরও পড়ুন: জটিল ও মারণ নানা রোগের হাত থেকে রক্ষা পেতে সময় মেনে টিকা দিন আপনার শিশুকে!

 

#5. বমি: টিকাকরণের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে সোনামণির বমিও হতে পারে। অনেক সময় অত্যাধিক কান্নাকাটির ফলেও বমি হয়। চিকিৎসকের কথায়, এক-দুই বছরের কমবয়সি শিশুদের ক্ষেত্রে বমির এই প্রবণতা বেশি দেখা যায়।

#6. বিরক্তি দেখানো: খুদের শরীরে অ্যান্টিবডি প্রবেশের কারণে এটি হয় না। বরং ওর ইচ্ছের বিরুদ্ধে ওকে টিকা দেওয়া হয় বলেই ও বিরক্ত হয়। এমনকী মেজাজও হারিয়ে ফেলে। তবে বিশেষজ্ঞদের কথায়, কিছুটা সময় গেলে আদরের মাধ্যমে ওকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যায়।

#7. খিদে না পাওয়া: খিদে না পাওয়া টিকাকরণের অন্য একটি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। শরীরে ফরেন এলিমেন্ট (Foreign Element) প্রবেশ করায় শরীর মানিয়ে নিতে একটু সময় নেয়। এ থেকেই খাবার খাওয়ার ইচ্ছে সাময়িকভাবে লুপ্ত হয়। তবে অন্যান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মতো এটিও খুব কম সময়ের জন্য স্থায়ী হয়। (What Every Parent Should Know About Immunizations)

এছাড়া টিকা দেওয়ার পর খুদের শরীরে আরও কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যেতে পারে। বাবানের চিকিৎসকের কথায়, সেগুলি খুবই বিরল বা রেয়ার (Rare)। (Serious Side Effects of Vaccines) দশ হাজার শিশুর মধ্যে এক দু’জনের ক্ষেত্রে এমন সমস্যা দেখা যেতে পারে। তিনি সেগুলো নিয়েও ওদের কয়েকটি তথ্য জানিয়ে দিলেন।

  • ফিট: টিকা দেওয়ার সময় ইনজেকশনের ভয়ে বা ব্যথায় অনেকসময় খুদের ফিট হয়ে যেতে পারে। চিকিৎসকের কথায়, অত্যাধিক কান্নাকাটির ফলেও এমন ঘটনা ঘটে। এমন পরিস্থিতিতে দেরি না করে খুদেকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া উচিত।
  • উচ্চ তাপমাত্রার জ্বর: জ্বরের তাপমাত্রা একশো বা ১০১ এর বেশি উঠে গেলে তখন সত্যি চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। তবে সহজ কয়েকটি ওষুধ বা ঘরোয়া পদ্ধতির মাধ্যমেই খুদের জ্বর দূর করা যায়। এক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া একান্ত জরুরি‌।
  • অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া: আগের দু’টি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার তুলনায় এটি আরও বিরল। পঞ্চাশ হাজার শিশুর মধ্যে একজনের ক্ষেত্রে এমন প্রতিক্রিয়া দেখা দিলেও দিতে পারে। তাই বিশেষজ্ঞরা এই লক্ষণ সম্পর্কেও বাবা-মায়েদের অবগত করে রাখেন। চিকিৎসকের কথায়, সদ্যোজাত খুদের শরীরেও মায়ের থেকে অর্জিত অনাক্রম্যতা থাকে। টিকার অ্যান্টিজেন শরীরে প্রবেশ করলে এই অর্জিত অনাক্রম্যতা শরীরকে রক্ষা করতে বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে। অনাক্রম্যতার এই অস্বাভাবিক আচরণের কারণেই খুদের দেহে অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া দেখা দিলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তার চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। চিকিৎসক প্রাথমিক চিকিৎসার মাধ্যমেই এই সমস্যা সারিয়ে তোলেন। (Side Effects of Vaccines in Babies and Children Up To 5 Years)

এছাড়াও চিকিৎসক টিকা সম্পর্কে কিছু সাধারণ তথ্য জানালেন (What Every Parent Should Know About Immunizations);

  • কিছু টিকার ক্ষেত্রে জ্বর হওয়াটাই স্বাভাবিক। তাই চিকিৎসক টিকা দেওয়ার আগে নির্দিষ্ট গ্রুপের ওষুধ খাইয়ে দেন।
  • কয়েকটি টিকার ক্ষেত্রে ইনজেকশন ফোটানো অংশে ঘা তৈরি হয়। চিকিৎসকের মতে, এই ঘা হওয়া স্বাভাবিক। তবে কোন ক্ষেত্রে এমন হবে, তা চিকিৎসকই বলে দিতে পারবেন।
  • কিছু নির্দিষ্ট টিকা একবার দিলে প্রয়োজনীয় অ্যান্টিবডি তৈরি হয় না। তাই একাধিকবার দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। তবেই ডোজটি সম্পূর্ণ হয়।

চিকিৎসকের মুখ থেকে বিস্তারিত শোনার পর সৌরভ আশ্বস্ত হয়। ও চিকিৎসককে জানায়, টিকার গুরুত্ব সম্পর্কে এতকিছু জানতই না। তৃষা তো সৌরভের কথা শুনে অবাক। তবে একইসঙ্গে মনে মনে খুশিও। (Side Effects of Vaccines in Babies and Children)

 

আরও পড়ুন: টিকার ব্যথা আর নয়। ছোট্ট সোনার ভ্যাকসিনের ব্যথা কমানোর সহজ, ঘরোয়া রাস্তা!

 

একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার  হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব। 

 

null

null