লক্ষণ ধরা দেবে ছেলেবেলাতেই; অটিজম প্রতিরোধ ও প্রতিকারে আমাদের যা করণীয়!

লক্ষণ ধরা দেবে ছেলেবেলাতেই; অটিজম প্রতিরোধ ও প্রতিকারে আমাদের যা করণীয়!

“আর পাঁচটা মায়ের মতো আমারও মনটা ভরে গিয়েছিল নিজের নাড়ি ছেঁড়া ধনকে প্রথমবার দেখে। পাঁচটা স্বাভাবিক বাচ্চার মতোই দিব্যি একটু একটু করে বেড়ে উঠছিল সে। তার বয়স যখন দেড় বছর, তখন জানতে পারি যে, সে অটিজমের শিকার। পায়ের তলার শক্ত জমিটা যেন মুহূর্তে তছনছ হয়ে গিয়েছিল আমাদের। তারপর, আমি ঠিক করি, আমি লড়বো।  প্রচুর পড়াশোনা, চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে আমি আমার বাচ্চাকে আর পাঁচটা স্বাভাবিক বাচ্চার মতোই মানুষ করা শুরু করি। লিখতে শুরু করি এক অন্য মায়ের গল্প। যে মা তার সন্তানের “অক্ষমতা”কেই তার বিশেষ প্রতিভা ভাবে, যে মা আশেপাশের থেকে উড়ে আসা সমালোচনা এক ফুঁয়ে উড়িয়ে দিতে পারে, যে মা তার “বিশেষভাবে সক্ষম” সন্তানকে যথাযোগ্য সম্মান পাইয়ে দিতে চায়। মা-বাবা হিসেবে লড়াইটা সহজ ছিল না একেবারেই, কিন্তু জীবন মুখ ফিরিয়ে থাকে নি আমাদের থেকে। আমাদের তথাকথিত “অক্ষম” সন্তান আজ নিজের জীবনে সফল। আজ মা হিসেবে সত্যি আমি গর্বিত, আমি সম্পূর্ণ।” – নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মা, বেঙ্গালুরুর বাসিন্দা। 

হ্যাঁ, এটা একজন মায়ের কথাই বলছি আমরা। যিনি প্রমাণ করে দিয়েছেন যে, যথাযথ চিকিৎসা, ভালোবাসা আর সহমর্মিতা পেলে একটি অটিস্টিক বাচ্চাও নিজের জীবনে সফলভাবে সম্মানের সাথে বাঁচতে পারে। কারও সমালোচনা, বাঁকা কথা বা চেরা দৃষ্টিকে পাত্তা না দিলেই হল। (Autism: Characteristics, diagnosis, and understanding)

জানেন কী, সম্প্রতি “স্পেশাল অলিম্পিকে” দু’খানা রৌপ্যপদক জিতে নেওয়া অ্যালেক হিউয়ারমান নামের ছেলেটিও অটিস্টিক! তাই সব অটিস্টিক সন্তানদের মায়েদের বলছি, ভেঙে পড়বেন না বা দুঃখ করবেন না। আপনার সন্তান কোনও ভাবেই অক্ষম নয়। তার বিশেষ প্রতিভাগুলো খুঁজে বার করুন, তাকে আর পাঁচটা স্বাভাবিক সন্তানের মতোই ভাবুন। রইলো বাকি আপনার আশেপাশের সমালোচক বা নিন্দুকরা; তারাই হয়তো পরে আপনার সন্তানভাগ্যকে হিংসে করবে। এই অটিজমের সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান থাকলে যেমন নিজে মানসিক শক্তি পাওয়া যায় আবার আগেভাগে অস্বাভাবিক কিছু বুঝতে পারলে তার চিকিৎসাও জলদি শুরু করা যায়। তাই বিশেষভাবে প্রতিভাবান শিশুদের এই অটিজম নিয়েই আমাদের বিশদ আলোচনা।

কী এই অটিজম? (What is autism?)

অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার (Autism Spectrum Disorder) সাধারণত মানুষের শৈশবস্থার শুরুতেই ধরা পড়ে এবং মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের অটিজম হওয়ার সম্ভাবনা চারগুণ বেশি। এই অসুস্থতায় শিশুর সামাজিকভাবে মেলামেশার ক্ষমতা, ভাব প্রকাশের ক্ষমতা কম হয় এবং চিন্তাশক্তির বিকাশেও দেরি হয়। এক কথায় বললে, মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশ হয় না। প্রত্যেক বাচ্চার ক্ষেত্রে অটিজমের ধরন এবং তার বহিঃপ্রকাশ অন্যরকম হয়ে থাকে। এই অসুস্থতা যত তাড়াতাড়ি শনাক্ত করা যায় ততই ভালো; এক্ষেত্রে চিকিৎসায় উল্ল্যেখযোগ্য সাড়া পাওয়া যায়।

কেন হয়? (Reasons behind autism)

অটিজম কেন হয়, তার কোনও নির্দিষ্ট কারণ এখনও বোঝা যায়নি। মনে করা হয়, জিনগত কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে এই অটিজম হয়।

অটিজমের প্রাথমিক লক্ষণগুলি কী কী (Early Signs Of Autism in Bangla)

অটিজমের লক্ষণগুলিকে প্রধানত তিনভাগে ভাগ করা যায়।

  • সামাজিক মেলামেশায় অসুবিধা বা প্রতিবন্ধকতা
  • ব্যবহারে অস্বাভাবিকতা
  • যোগাযোগ স্থাপনে অক্ষমতা

সামাজিক মেলামেশায় অসুবিধা বা প্রতিবন্ধকতা (Social Difference in Autistic Child)

  • মা-বাবা হাসলে বা অঙ্গভঙ্গী করলে শিশু সাড়া দেয় না। কেউ তার নাম ধরে ডাকলে বুঝতে পারে না।
  • কারও চোখে চোখ রেখে বেশিক্ষণ থাকতে পারে না বা কারও চোখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারে না।
  • বাইরের পরিবেশ সম্পর্কে নির্লিপ্ত থাকে; কোনও কিছুতেই সেরকম আগ্রহ থাকে না। আদর করলে বা ধমকালেও এদের কোনও প্রতিক্রিয়া হয় না।
  • বাবা-মা কিছু দেখাতে চেষ্টা করলে দেখে না বা কী দেখানো হচ্ছে বুঝতে পারে না।
  • কোনও কিছুতে আগ্রহ দেখায় না, আঙুল দিয়ে কোনও জিনিস দেখায় না এবং মা-বাবাকে কিছু বলতে চায় না।
  • সময় বুঝে মুখের ভাব পরিবর্তন করতে পারে না বা অন্যদের মুখের ভাব থেকেও তারা কী বলতে চাইছে বুঝতে পারে না।
  • কারও সাথে বন্ধুত্ব করার মতো ইচ্ছে প্রকাশ করে না।

ব্যবহারে অস্বাভাবিকতা (Behavioral Problems in Autism)

  • বাচ্চাকে যেটা শেখানো হয় বা বাচ্চা যে রুটিন মেনে চলে, বাচ্চা হুবহু সেটাই করতে থাকে। এই নিয়মের বাইরে কোনও দিন একটু এদিক ওদিক হলে বাচ্চা সেটা মেনে নিতে পারে না। একটা নির্দিষ্ট জিনিস পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে মেনে চলতে ভালোবাসে। দৈনন্দিন কাজের সামান্য এদিক ওদিক হলে উত্তেজিত হয়ে পড়ে।
  • কিছু অস্বাভাবিক আচরণ সারাদিন ধরে ক্রমাগত একনাগাড়ে করে যায়।
  • বসে বসে দোলে, হাত নিয়ে ওড়ার মতো ভঙ্গিমা করে, গোড়ালির ওপর ভর দিয়ে হাঁটে, মুখ বিকৃত করে, হাতের আঙুল জোরে জোরে ঘোরায় বা নাড়াচাড়া করে। একই কাজ বা আচরণ একনাগাড়ে করতে থাকে বলে, একে স্টিরিওটাইপ ব্যবহার বলা হয়।
  • কোনও খেলনা খুব বেশি পছন্দ করে, ভেঙে গেলেও সেই খেলনাই তার চাই এবং ওই অবস্থাতেই চাই। কখনও কখনও কোনও খেলনার ভাঙা অংশ নিয়েই খেলতে থাকে কিন্তু নতুন খেলনা দিতে গেলে নেয় না।
  • স্বাভাবিক শিশুর মতো দৃষ্টিপথ হয় না।
  • ব্যথা পেলে প্রকাশ করতে পারে না। গন্ধ, আলো, স্পর্শ বা আওয়াজ ইত্যাদি নিয়ে খুব সংবেদনশীল হয়ে থাকে।
  • প্রচণ্ড জেদি হয়ে পড়ে।
  • খুব চঞ্চল প্রকৃতির হয়।
  • অনেকেই নিজেকে আঘাত করে। হাত কামড়ানো, মাথা ঠোকা ইত্যাদি করে।

যোগাযোগ স্থাপনে অক্ষমতা (Problem to Communicate in Autistic Child)

  • আঙুল দিয়ে কোনও জিনিস দেখাতে পারে না বা অন্যদের সাথে নিজের অনুভূতি ভাগ করতে পারে না।
  • যার কাছে যেমন ভাবে কথা শোনে, একদম সেইভাবেই সেই সুরেই কথাটি আবার বলতে থাকে।
  • প্রায় ১৬ মাস বয়স পর্যন্ত একটা কথাও বলে না।
  • ঠিক গুছিয়ে কথা সাজাতে পারে না বা কথা বলতেও ভালোবাসে না।
  • সংখ্যা, কিছু বিশেষ বিষয়, সঙ্কেত ইত্যাদি নিয়ে আগ্রহ থাকে এবং ভালো মনে রাখতে পারে।
  • কথা বলার সময় অনেক অপরিচিত ও অপ্রাসঙ্গিক শব্দ ব্যবহার করে যা সাধারণের বোধগম্যের বাইরে। ঠিক করে অর্থপূর্ণ বাক্য গঠন করতে পারে না এবং কথা বলতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলে।

অটিজম এর চিকিৎসা (Autism Treatment for Children)

সাধারণত ১৮ মাসের মধ্যেই বোঝা যায় যে, শিশু অটিজমে আক্রান্ত কি না। যদি তেমন কোনও লক্ষণ চোখে পড়ে, তা হলে সময় নষ্ট না করে তখনই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। প্রাথমিক অবস্থায় অটিজম নির্ণয় করতে পারলে এবং উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করলে অনেকাংশেই এর মোকাবিলা করা যায়। এবং সময়ের সাথে সাথে নিজের মতো করেই জীবনটা সফল করতে পারে সেই শিশুও। প্রয়োজন শুধু অনেকটা ভালোবাসা, সহানুভূতি আর প্রিয়জনের সঙ্গ। এই শিশুরা একেবারেই আলাদা নয়, এরা একটু অন্যরকম। আর এই অন্যরকম হওয়ার মধ্যেই হয়তো লুকিয়ে আছে তার বিশেষত্ব। মা হয়ে কখনই সন্তানের অসুস্থতা লুকিয়ে রাখবেন না, কোনও অস্বাভাবিক কিছু দেখলে সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারের পরামর্শ নিন। বাচ্চা অটিস্টিক হলে তার সাথে বন্ধুর মতো মিশুন, ওকে খেলা শেখান, ওর মতো করে শব্দভাণ্ডার সাজিয়ে তুলুন, শিশুকে ব্যক্তিগত কাজ শেখান, বাচ্চার ইচ্ছেকে গুরুত্ব দিন। প্রয়োজনে অটিস্টিক বাচ্চার মায়েদের জন্য যে বিশেষ ক্লাস থাকে, সেগুলো করুন। কখনই নিজেকে বা নিজের ভাগ্যকে দোষ দেবেন না।

অটিজম প্রতিরোধে কী করণীয়? (Can Autism Be Prevented?)

অটিজমের যেহেতু কোনও নিরাময় নেই, তাই একমাত্র সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমেই এর প্রতিরোধ করা সম্ভব। পরিবারের কারও অটিজম অথবা কোনও মানসিক এবং আচরণগত সমস্যা থাকলে, পরবর্তী সন্তানের ক্ষেত্রে অটিজমের ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। এক্ষেত্রে পরিকল্পিত গর্ভধারণ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। গর্ভাবস্থায় অধিক দুশ্চিন্তা না করা, পর্যাপ্ত ঘুম ইত্যাদি ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। আরও কিছু বিষয় খেয়াল রাখতে হবে। যেমন –

  • বেশি বয়সে বাচ্চা না নেওয়া।
  • বাচ্চা নেয়ার আগে মাকে রুবেলা ভ্যাকসিন (Rubella vaccine) আবশ্য়িক।
  • গর্ভাবস্থায় চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনও ওষুধ খাবেন না।
  • মায়ের ধূমপান, মদ্যপানের মতো কোনও অভ্যাস থাকলে গর্ভধারণের আগে অবশ্যই তা ছেড়ে দিতে হবে।
  • বাচ্চাকে অবশ্যই মায়ের বুকের দুধ খাওয়াতে হবে।

একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার  হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

null

null