সন্তান হাঁপানিতে আক্রান্ত হয়েছে কি না, কীভাবে বুঝবেন; কী সতর্কতা নিলে ভালো থাকবে সে!

সন্তান হাঁপানিতে আক্রান্ত হয়েছে কি না, কীভাবে বুঝবেন; কী সতর্কতা নিলে ভালো থাকবে সে!

নিশ্বাস -প্রশ্বাসের ছন্দ নিয়মিত হওয়ার ওপর যে আমাদের বেঁচে থাকা বা সুস্থ থাকা কতটা নির্ভরশীল, সে কি আর আলাদা করে বলার অপেক্ষা রাখে? আমাদের এই শ্বাস নেওয়ার প্রক্রিয়ায় তুমুল গোলমাল দেখা দেয় হাঁপানি রোগের কবলে পড়লে। শ্বাস নিতে চেয়েও শ্বাস নিতে না পারা, শরীরে অক্সিজেনের অভাব পূরণ করার জন্য হাঁ করে একটু বাতাস ভিতরে নেওয়ার চেষ্টা; কী পরিমাণ কষ্টকর আন্দাজ করতে পারছেন তো? এই হাঁপানি বা শ্বাসকষ্টের পোশাকি নাম অ্যাজমা। কোলে করে যে ছোট্ট শরীরটাকে নিয়ে ঘুরছেন, সে যদি হাঁপানির কবলে পড়ে, তার কষ্টটা একটু আন্দাজ করার চেষ্টা করুন, চোখে জল আসতে বাধ্য। (Asthma in Children: Symptoms, Treatment, Diagnosis, and More; Asthma in Children in Bangla)

শিশুর হাঁপানি; জেনে নিন লক্ষণ ও প্রতিরোধ (Asthma in Children & Infants: Symptoms and Treatments)

দুর্ভাগ্যবশত, শিশুদের ওপর এই হাঁপানি রোগের আক্রমণ বেশ ভালো হারেই হয়ে থাকে। জানেন কি, বাংলাদেশে বর্তমানে হাঁপানি রোগীর সংখ্যা ৭০ লাখেরও বেশি, আর এর মধ্যে একটা বড় অংশ শিশু? প্রত্যেক বছর এই রোগের দাপট বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। সবথেকে দুঃখজনক, অজ্ঞানতা বা কুসংস্কার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বেশিরভাগ হাঁপানি রোগীকে এখনও জল পড়া, তাবিজ-মাদুলি বা ঝাড়ফুঁকের ভরসায় ফেলে রেখে দেওয়া হয় দিনের পর দিন। স্বাভাবিক ভাবে, বাড়ে রোগের কষ্ট ও রোগীর জটিলতা। বাংলাদেশে হাঁপানি আক্রান্তদের মাত্র ৫ শতাংশ মানুষ ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা করাতে যান। এই চরম কষ্ট কিন্তু সহ্য করতে হয় আপনার আদরের সন্তানটিকেও। হাঁপানি রোগের লক্ষণ বা তার চিকিৎসা সংক্রান্ত সম্যক জ্ঞান থাকলে, শুধু যে রোগের প্রাথমিক অবস্থাতেই শনাক্তকরণ সম্ভব তাই নয়, দ্রুত চিকিৎসা শুরু হয় বলে আরাম পায় শিশুটিও। আপনার সন্তান হাঁপানিতে আক্রান্ত হয়েছে কি না, কীভাবে বুঝবেন বা কী সতর্কতা নিলে ভালো থাকবে শিশুটি, দেখে নিন একনজরে।

কী এই হাঁপানি বা অ্যাজমা (What is Asthma)

শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহ হলে বা শ্বাসনালী ও ফুসফুসের মধ্যে বায়ু চলাচল বাধা পেলে, স্বাভাবিক ছন্দে নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়।একেই হাঁপানি বা অ্যাজমা বলা হয়।

মোটামুটি কত বয়সের শিশুদের হাঁপানি হতে পারে? (Asthma Attacks in Toddlers)

শিশু বা বয়স্করা এই হাঁপানি রোগে আক্রান্ত হতে পারে। তবে শিশুদের মধ্যে এই রোগ হওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট বেশি। অ্যাজমা এন্ড অ্যালার্জি ফাউন্ডেশন অফ আমেরিকা (Asthma and Allergy Foundation of America) -র মতে, যেসব শিশুদের ভবিষ্যতে হাঁপানি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তাদের অর্ধেকের বেশি শিশুর মধ্যে ৫ বছর বয়সের আগেই হাঁপানি রোগের কিছু কিছু লক্ষণ প্রকট হয়ে ওঠে। যত তাড়াতাড়ি এই রোগের উপসর্গ চিনে শিশুদের সঠিক চিকিৎসা শুরু করা যায়, ততই ভালো। ভবিষ্যতে বাড়াবাড়ির হাত থেকে শিশু রক্ষা পায় আবার হাঁপানির টানের নিদারুণ কষ্টও তাকে সহ্য করতে হয় না। সাধারণত, ১০-১৫ বছর বয়সে শিশুর হাঁপানি সেরে যায়।

Also read: বমি, পেট খারাপ? বাচ্চার জন্য ঘরোয়া প্রতিকার

হাঁপানি রোগের লক্ষণগুলি কী কী? (Symptoms of Asthma in Children)

একটি বাচ্চা যেহেতু নিজের মুখে তার শারীরিক কষ্টগুলো বলে বোঝাতে পারে না, তাই শরীরে কোনও কষ্ট হলে মা-বাবাকেই তা বুঝে নিতে হয়। শিশুদের মধ্যে হাঁপানি রোগের যেসব প্রাথমিক উপসর্গ দেখা যায়, সেগুলি হল;

  • নিশ্বাস নেওয়ার সময় সাঁই সাঁই আওয়াজ হওয়া।
  • ঘন ঘন খুব দ্রুত নিশ্বাস নেওয়ার চেষ্টা।
  • নিশ্বাস নেওয়ার সময় নাকের পাটা ফুলে থাকা।
  • মুখে, নখে বা ঠোঁটে নীলাভ ভাব, যা অক্সিজেনের অভাবে হয়ে থাকে।
  • নিশ্বাস নেওয়ার সময় পেটের ওঠা-নামা স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি হয়। মনে হয়, শিশু যেন নিশ্বাস নেওয়ার সময় নাকের সাথে পেটের পেশীও সমানভাবে ব্যবহার করছে।
  • ক্রমাগত কাশি হওয়া, রাতে কাশির প্রাবল্য বাড়ে। সর্দি-জ্বর সেরে গেলেও কাশি দীর্ঘস্থায়ী হয়।
  • ঋতু পরিবর্তনের সময় শ্বাসকষ্ট।
  • ঠিক করে নিশ্বাস নিতে না পারার জন্য রাতে ঠিক করে ঘুমোয় না।
  • অতিরিক্ত ক্লান্তি ভাব, খাবার খাওয়ার সময় অস্বস্তি হওয়া, বেশিক্ষণ কোনও শারীরিক পরিশ্রম করতে না পারা বা খেলাধূলা করতে না পারা।

বাচ্চাদের অ্যাজমা হওয়ার সম্ভাব্য কারণ (Reason Behind Asthma in Babies)

  • কোনও ভাইরাল ইনফেকশন।
  • ধুলো-বালি বা উগ্র কোনও গন্ধ।
  • ধূপের গন্ধ, সিগারেটের ধোঁয়া, কোনও সুগন্ধি।
  • বিছানার চাদর, বালিশ,কার্পেট, কম্বলে থাকা ধুলো।
  • বাড়িতে লোমশ পোষ্য যেমন, কুকুর বা বিড়াল থাকলে তাদের লোম। বাতাসে যে লোম ওড়ে, তা থেকেই হাঁপানি হতে পারে বা বাড়তে পারে।
  • বাতাসে ভাসমান ফুলের রেণু।
  • কোনও বিশেষ পোকামাকড় যেমন আরশোলা থেকেও এই রোগ হতে পারে।
  • অ্যাসপিরিন জাতীয় ওষুধ।

কোন শিশুদের হাঁপানিতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি (Babies Who are Prone to Asthma)

  • যাদের বাবা-মা বা নিকটাত্মীয় হাঁপানি রোগে আক্রান্ত। পারিবারিক ইতিহাস এই রোগের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।
  • যেসব মহিলা গর্ভাবস্থায় ধূমপান করেন।
  • অত্যধিক বায়ুদূষণের মধ্যে বেড়ে ওঠা বাচ্চা।
  • অ্যালার্জি হওয়ার ধাত বেশি।

কীভাবে চিকিৎসা করা হয়? (Treatment of Asthma in Children)

বাচ্চা হাঁপানিতে আক্রান্ত হলে তাকে যেসব ওষুধ দেওয়া হয়, তা সাধারণত ইনহেলার বা স্প্রের মাধ্যমে দেওয়া হয়ে থাকে। বাচ্চা একদম ছোট হলে ঠিক করে ইনহেলার টানতে পারে না। সেক্ষেত্রে বিশেষ ধরনের মাস্ক ব্যবহার করা হয়। এই মাস্ক শিশুর মুখে পরিয়ে দিলে প্রয়োজনীয় ওষুধ শিশু পেয়ে যায়। মাস্ক পরানোর সময় প্রথম ক’দিন কান্নাকাটি করলে বা ছটফট করলেও তা খুলে দেবেন না। ডাক্তার যেভাবে বলেছেন, সেভাবে মাস্কটি পরিয়ে রাখুন নির্দিষ্ট সময় মেনে। এই মাস্কেই স্প্রের মাধ্যমে ওষুধ দেওয়ার ব্যবস্থা করা থাকে। মাস্ক পরা অবস্থায় কাঁদলেও শিশুর দেহে প্রয়োজনীয় ওষুধ ঢুকে যাবে। শিশুর ফুসফুসে সরাসরি ওষুধ ঢোকার জন্য এই ব্যবস্থাটি খুবই কার্যকরী।

শিশুর হাঁপানি হলে যেসব সতর্কতা নিতে হবে (Precautions for Asthma in Kids)

  • বাড়িতে লোমশ পোষ্য থাকলে তাকে নিয়মিত স্নান করান। একদম ছোট শিশুর মধ্যে যদি হাঁপানির লক্ষণ দেখা দেয়, তার কাছে কোনও কুকুর বা বিড়াল আসতে দেবেন না বা বাড়িতে ওই জাতীয় পোষ্য আর রাখবেন না।
  • বিছানার বালিশ, চাদর, কম্বল নিয়মিত পরিষ্কার রাখুন এবং কাচার পর উজ্জ্বল সূর্যালোকে শুকিয়ে নিন। প্রয়োজনে ভ্যাকুয়াম ক্লিনার ব্যবহার করে বাড়ির ধুলো পরিষ্কার করুন। জানলার পর্দা নিয়মিত পরিষ্কার করুন।
  • কার্পেটে প্রচণ্ড ধুলো বসে যা আমরা চোখে দেখতে পাই না। বাড়িতে কার্পেট রাখবেন না। কার্পেট রাখলে নিয়মিত ভ্যাকুয়াম ক্লিনার দিয়ে ধুলো পরিষ্কার করুন।
  • বাচ্চাকে সফট টয় কিনে দেবেন না। এর থেকেও হাঁপানি বাড়তে পারে।
  • শিশু যে ঘরে থাকে, সেখানে ধূপ জ্বালাবেন না। কোনও উগ্র সুগন্ধি বা রুম ফ্রেশনার ব্যবহার করবেন না।
  • শিশুর জিনিসপত্র ছাড়াও বাড়ি ঘর পরিষ্কার রাখুন।
  • বাইরে বেরোলে শিশুকে মাস্ক ব্যবহার করতে দিন। এতে দূষণ, ধুলো বা ফুলের রেণু থেকে হওয়া হাঁপানি থেকে রক্ষা পাবে ও।
  • এয়ারকন্ডিশনড গাড়ি যত সম্ভব কম ব্যবহার করুন।
  • যে জায়গায় ধুলো বালি উড়ছে, সেখান থেকে শিশুকে সরিয়ে নিয়ে যান।

ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবেন কখন (When to Call a Doctor)

  • হাঁপানির টান হঠাৎই শুরু হয়। ইনহেলার বা নেবুলাইজার দেওয়ার পরও কোনও কাজ না হলে বা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আরাম না হলে, সত্ত্বর ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান।
  • শিশু প্রচণ্ড অস্থির হয়ে পড়ে,ঠিক ভাবে কাঁদতেও পারে না বা কিছু বলতে পারে না।
  • শ্বাসকষ্টের জন্য খাবার গিলতে না পারলে।
  • শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়ার জন্য বমি করে ফেললে।
  • শ্বাসের কষ্টে চোখ ঠিকরে বেরিয়ে এলে, চোখ -মুখ লাল হয়ে গেলে।

Also read: হোমিওপ্যাথি কি বাচ্চার জন্য নিরাপদ?

মনে রাখুন কয়টি কথা (Things to Keep in Mind)

  • বাচ্চার হাঁপানির টানের উপসর্গগুলি ভালো করে চিনে রাখুন।
  • নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
  • ইনহেলার, মাস্ক বা স্প্রে ওষুধের সঠিক ব্যবহার বিধি জেনে নিন ও নিয়মিত বাচ্চাকে দিন।
  • যে কোনও এমারজেন্সিতে কীভাবে নেবুলাইজার বা অক্সিজেন মাস্ক ব্যবহার করবেন তা জেনে রাখুন।
  • বাচ্চাকে নিজের অজ্ঞানতা বা কুসংস্কারের কারণে কষ্ট পেতে দেবেন না। হাঁপানি রোগের যথাযথ চিকিৎসা হলে বাচ্চা আরাম পায় এবং যখন তখন হাঁপানির টান ওঠে না। যতদিন না পুরোপুরি এই রোগ সেরে যায়, ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে থাকুন। এই চিকিৎসা সময়সাপেক্ষ হলেও মাঝপথে তা বন্ধ করে দেবেন না। হিতে বিপরীত হবে।

একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার  হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

null

null