শ্বাসকষ্টের সমস্যা বা অ্যাজমা বড় বিপদ ডাকবে না তো? সামলাবেন কী করে?

শ্বাসকষ্টের সমস্যা বা অ্যাজমা বড় বিপদ ডাকবে না তো? সামলাবেন কী করে?

প্রস্মিতার শ্বাসকষ্টের সমস্যা বা অ্যাজমা রয়েছে। ওর বর অভিজিৎকে এমনটাই জানালেন প্রস্মিতার চিকিৎসক। একসপ্তাহ ধরে ওর গলায় আর বুকে প্রচণ্ড কফ জমে আছে। গত দু’দিন ধরে নিঃশ্বাস নেওয়ার সময় সোঁ-সোঁ করে আওয়াজও হচ্ছে। ব্যাপারটা গুরুতর বুঝতে পেরে অভিজিৎ চিকিৎসকের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেয়। প্রস্মিতা এখন গর্ভবতী। কিন্তু ওর অ্যাজমা হল কী করে? চিকিৎসক বুঝিয়ে দিলেন অ্যাজমা হওয়ার কারণ। (How to Deal With Asthma During Pregnancy)

 

অ্যাজমা হওয়ার কারণ (Causes Of Asthma)

এর পিছনে অনেকগুলো কারণ থাকতে পারে। একেক জনের ক্ষেত্রে একেকটি কারণ দায়ী। বিশেষজ্ঞরা যে কয়েকটি কারণের কথা বলেন, তার মধ্যে রয়েছে আবহাওয়া পরিবর্তনের প্রভাব, ধুলোবালি, কোনওরকম ধোঁয়া, বাড়ির পোষ্যের লোম ইত্যাদি। গর্ভে ভ্রুণ আসার আগে অ্যাজমা হলে সেটি শরীরের তেমন কোনও ক্ষতি করতে পারে না। তবে গর্ভবতী অবস্থায় এটি জটিল সমস্যার আকার নিতে পারে। গর্ভাবস্থায় মায়ের শরীরে ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন হরমোনের পরিমাণে পরিবর্তন আসে। প্রোজেস্টেরন হরমোনের কারণে মায়ের ফুসফুস এই সময় বেশি সক্রিয় হয়। অ্যাজমা হলে ইস্ট্রোজেনের কারণে নাক বন্ধ হয়ে গিয়ে নিঃশ্বাসে বাধা সৃষ্টি করে। ফলে মায়ের ফুসফুসে সঠিক পরিমাণ অক্সিজেন যায় না।

 

অ্যাজমার লক্ষণ (Symptoms of Asthma during Pregnancy)

অভিজিৎ না-জিজ্ঞেস করলেও চিকিৎসক ওকে বলে দিলেন অ্যাজমার লক্ষণগুলো। অ্যাজমা আগে কখনও না-হলেও গর্ভাবস্থায় এটি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কয়েকটি লক্ষণ (Developing Asthma During Pregnancy) দেখলে সহজেই বোঝা যায় অ্যাজমা হয়েছে কি না।

  • সোঁ-সোঁ আওয়াজ: অ্যাজমার প্রধান লক্ষণ হল শ্বাস নেওয়ার সময় সোঁ-সোঁ আওয়াজ। এই আওয়াজের কারণ মূলত বুকে জমে থাকা কফ। জমে থাকা কফের পরিমাণ যথেষ্ট বেশি হলে শ্বাস নেওয়া ও ছাড়ার সময় এমন আওয়াজ হতে থাকে।
  • শ্বাসকষ্ট: সাধারণ সর্দি ও অ্যাজমার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। তাই অ্যাজমা চেনার প্রাথমিক উপায় শ্বাসকষ্ট (Coughing and Wheezing During Pregnancy)। অ্যাজমা হলে শ্বাসনালী জুড়ে প্রচণ্ড কফ জমতে থাকে। এতে শ্বাসনালীর মধ্যে দিয়ে বায়ু চলাচলের জায়গা কমে যায়, যার ফলে শ্বাস নিতে অসুবিধা হয়।
  • কাশি: অ্যাজমার আরেকটি প্রধান লক্ষণ কাশি। সাধারণ সর্দির তুলনায় এক্ষেত্রে কাশির পরিমাণ বেশি হয়।
  • অল্প পরিমাণে নিঃশ্বাস: বিশেষজ্ঞদের মতে, অ্যাজমা হলে নিঃশ্বাসের আকার ছোট হয়ে যায়। সাধারণ সময়ে এক নিঃশ্বাসে যতটা বায়ু ফুসফুসে যায়, এই সময় তার পরিমাণ অনেক কমে যায়। বরং অতটা নিঃশ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করলে বুকে ব্যথা হয়।

অভিজিতের মনে একটা প্রশ্ন বারবার ঘুরপাক খাচ্ছিল। গর্ভাবস্থায় অ্যাজমা হলে কী হতে পারে প্রস্মিতার? তাদের সন্তানেরই বা কী সমস্যা হতে পারে? চিকিৎসককে এই কথা জিজ্ঞেস করার পর তিনি বেশ কয়েকটি সমস্যা কথা বললেন।

 

আরও পড়ুন: নতুন মায়ের এমন হতেই পারে! চিন্তা নেই, মন খারাপের সমাধান আছে নাগালেই

 

গর্ভাবস্থায় শ্বাসকষ্ট হলে কী কী সমস্যা দেখা দিতে পারে (Asthma and Pregnancy Complications)

  • গুরুতর মর্নিং সিকনেস (Severe Morning Sickness): গর্ভাবস্থায় মর্নিং সিকনেস অনেক হবু মায়ের ক্ষেত্রেই দেখা যায়। মর্নিং সিকনেসে সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর পেটে ব্যথা করে, বমি বমি পায়‌। বিশেষজ্ঞদের মতে, অল্প মর্নিং সিকনেস মায়ের শরীরের কোনও ক্ষতি করে না। তবে অ্যাজমা হলে এই মর্নিং সিকনেস গুরুতরভাবে বেড়ে যায়। যাকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয় সিভিয়ার মর্নিং সিকনেস। মায়ের শরীরের জন্য এটি বিপদ ডেকে আনতে পারে।
  • উচ্চ রক্তচাপ (Hypertension): অ্যাজমার ফলে রক্তচাপ অনেকটাই বেড়ে যায়। এমনিই গর্ভাবস্থায় মায়ের রক্তচাপ সাধারণ অবস্থার তুলনায় বেশি থাকে। তার উপর অ্যাজমা হলে পরিস্থিতি আরও গুরুতর হয়ে ওঠে। রক্তচাপ অত্যন্ত বেশি হয়ে গেলে মায়ের প্লাসেন্টায় সঠিক পরিমাণে রক্তের সরবরাহ হয় না। এতে ভ্রুণের শরীরে প্রয়োজন অনুযায়ী অক্সিজেন ও পুষ্টিদ্রব্য না-ও পৌঁছাতে পারে। জন্মের সময় শিশুর ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে কম হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
  • প্রিটার্ম লেবার (Preterm Labour): তৃতীয় ট্রাইমেস্টারে যদি অ্যাজমা হয়, প্রিটার্ম লেবারের আশঙ্কা তখন প্রবল হয়ে ওঠে। প্রিটার্ম লেবারের অর্থ হল সঠিক সময়ের আগেই শিশুর জন্মের পথ উন্মুক্ত হয়ে যাওয়া‌। এক্ষেত্রে জরায়ুর সারভিক্সের মুখ সময়ের আগেই খুলে যায়। ফলে ভ্রুণ নীচের দিকে নেমে আসতে থাকে। এমনটা হলে চিকিৎসককে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই শিশুর ডেলিভারি করতে হয়।
  • প্রিএকল্যাম্পসিয়া (Preeclampsia): প্রিএকল্যাম্পসিয়া মা ও সন্তান দু’জনের জন্যই সমান বিপজ্জনক। অ্যাজমার চিকিৎসা ঠিক সময়ে না-করানো হলে এই সমস্যার আশঙ্কা বেড়ে যায়। এক্ষেত্রে মায়ের বমিবমি ভাবের সঙ্গে মাথা ব্যথা, ওজন বেড়ে যাওয়া , রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি সমস্যাগুলো দেখা দিতে শুরু করে।
    প্রিএকল্যাম্পসিয়া হলে ভ্রুণের যেমন ক্ষতি হতে পারে, তেমন মায়ের অবস্থাও আশঙ্কাজনক হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে সময়ের আগেই সন্তানের জন্ম দিতে হয়। এবং তার স্বাস্থ্য নিয়েও আশঙ্কা থেকে যায়। জন্মের সময় ওজনও কম থাকে। এছাড়াও অ্যাজমার কারণে প্রিএকল্যাম্পসিয়া হলে সন্তানের মধ্যেও অ্যাজমার লক্ষণগুলো ফুটে উঠতে থাকে। পাশাপাশি ছোট্ট সোনার শরীরে এক্সিমা ও অ্যালার্জিও দেখা দেয়।
  • শিশুর শারীরিক সমস্যা (Childhood Problem Of Baby): বিশেষজ্ঞদের মতে, জন্মের সময় শিশুর ওজন কমে যাওয়ার পিছনে অ্যাজমা অন্যতম কারণ হতে পারে। অ্যাজমার ফলে রক্তচাপ বাড়ে, যা শিশুর ওজন কমিয়ে দেয়, অথবা অ্যাজমার কারণে হওয়া প্রিএকল্যাম্পসিয়া ছোট্ট খুদের জীবনে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা ডেকে আনে।

অ্যাজমার ফলে কী হতে পারে তা বলতে বলতেই চিকিৎসক প্রস্মিতাকে কিছু ওষুধ লিখে দিচ্ছিলেন। ওষুধগুলো লিখে দেওয়ার পর বললেন, শুধু ওষুধ নয়, নজর রাখতে হবে আরও কয়েকটি বিষয়ে।

 

গর্ভকালীন শ্বাসকষ্টের চিকিৎসা (Managing Asthma in Pregnancy)

#1. ওষুধ (Medication): মা ও সন্তানের ভালো স্বাস্থ্যের কারণে অ্যাজমা তাড়াতাড়ি সারিয়ে তোলা প্রয়োজন। সে কারণে চিকিৎসকরা এই ক্ষেত্রে ওষুধ খাওয়ার পরামর্শ দেন। সব ওষুধেরই কিছু না কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে যা গর্ভাবস্থায় মায়ের ক্ষতি করতে পারে। তবে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সবচেয়ে কম রয়েছে, চিকিৎসকরা এমন ওষুধই খাওয়ার (Safe Asthma Inhalers During Pregnancy) পরামর্শ দেন।
#2. আবহাওয়া থেকে সাবধান (Be aware Of Weather): আবহাওয়ার ঘনঘন পরিবর্তনে অ্যাজমা আরও গুরুতর হয়ে উঠতে পারে। পরিবেশে হঠাৎ আর্দ্রতা বেড়ে গেলে বা হঠাৎ ঠান্ডা হঠাৎ গরমের মধ্যে তাপমাত্রার পরিবর্তন খুব তাড়াতাড়ি হয়। এই সময় শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে ঘরের বাইরে না-বেরনোই ভালো।
#3. ধুলোবালি (Dust): রাস্তার ধুলোবালি বা ঘরদোর পরিষ্কারের সময় ধুলোবালি নিঃশ্বাসের মধ্যে দিয়ে শ্বাসনালীতে ঢুকে পড়ে সংক্রমণ ঘটায়। যার ফলে অ্যাজমার সমস্যা দেখা দেয়। এছাড়াও এটি অ্যাজমাকে আরও গুরুতর করে তোলে। তাই প্রয়োজন না-থাকলে রাস্তাই না-বেরনোই নিরাপদ। বাড়িতে ধুলো ঝাড়ার কাজ নিজে না-করাই উচিত। একান্তই প্রয়োজন থাকলে নাক-মুখ ঢেকে তবেই তা করা উচিত।
#4. পোষ্যের লোম (Animal Hair): পোষ্যের লোমে থাকে নানা রকম ব্যাকটেরিয়া যা নিঃশ্বাসের মাধ্যমে ফুসফুসে গিয়ে অ্যাজমার সমস্যা ঘটায়। গর্ভাবস্থায় পোষ্য থেকে দূরে থাকাই ভালো। একান্তই ওকে আদর করতে হলে নাকে মুখে কিছু চাপা দেওয়া প্রয়োজন। পোষ্যের লোম পরিষ্কারের কাজ এই সময় না-করার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা।
#5. নেবুলাইজার (Nebulizer): নেবুলাইজার মেশিন থেকে তরল ওষুধ বায়ুর মাধ্যমে সরাসরি ফুসফুসে পৌঁছে যায়। এতে ওষুধটি তাড়াতাড়ি কাজ শুরু করে। অ্যাজমা কমাতে চিকিৎসকরা অনেক সময় নেবুলাইজার ব্যবহারের পরামর্শ দেন। তবে নেবুলাইজারে ব্যবহৃত ওষুধেও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকতে পারে। চিকিৎসকরা তাই অপেক্ষাকৃত নিরাপদ ওষুধই বেছে নেন।

প্রস্মিতাকে নিয়ে অভিজিৎ-এর চিন্তা বেড়ে গিয়েছিল। কারণ দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টার চলতে চলতেই ও অ্যাজমায় আক্রান্ত হল। তবে ওর সব চিন্তা দূর করে মাত্র একসপ্তাহেই কমে গেল অ্যাজমা। অভিজিৎ হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। ডেলিভারির সময়েও মা ও সন্তানের কোনও সমস্যা হয়নি। এখন সারাদিন ও ছোট্ট বাবাইয়ের ভালো নাম খুঁজতেই ব্যস্ত। ( How to Deal With Asthma During Pregnancy)

 

আরও পড়ুন: গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিসের প্রভাব ও কীভাবে সুস্থ রাখবেন নিজেকে, জেনে নিন বিশদে!

 

একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার  হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

 

 

null

null