ঘরোয়া ভাবেই সামাল দিন ছোট্ট সোনার অ্যালার্জির সমস্যা; উপায় এখানে!

ঘরোয়া ভাবেই সামাল দিন ছোট্ট সোনার অ্যালার্জির সমস্যা; উপায় এখানে!

দু’বছরের গুবলাইকে নিয়ে রিনিতা গিয়েছিল শপিং মলে। উপলক্ষ্য ওর জন্য শীতের জামাকাপড় কেনা। জামাকাপড় কেনার পর বাড়ি ফেরার পথেই বিপত্তি। ক্যাব না-পাওয়ায় গুবলাইকে নিয়ে বাসে উঠতে হল রিনিতাকে। বাসে ওঠার কিছুক্ষণ পর থেকেই গুবলাইয়ের প্রচন্ড হাঁচি! প্রথমে রিনিতা গুরুত্ব না-দিলেও পরে বুঝতে পারে, গুবলাইয়ের কোনও সমস্যা হচ্ছে। হাঁচতে হাঁচতে ছোট্ট গুবলাইয়ের নাকমুখ লাল! (Allergies in Babies & Toddlers Types, Diagnosis, Home Remedies)

ব্যাপারটার গুরুত্ব বুঝতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসককে ফোন। বাস থেকে নেমে চিকিৎসকের চেম্বারে যেতেই উনি গুবলাইকে বেশ কিছুক্ষণ পরীক্ষা করলেন। তারপর রিনিতাকে জিজ্ঞেস করলেন কখন থেকে এমনটা হচ্ছে ওর? সব শুনে চিকিৎসক বললেন গুবলাইয়ের ডাস্ট অ্যালার্জি/এলার্জি (Baby Allergies) রয়েছে। ডাস্ট অ্যালার্জি কথাটা আগেও রিনিতা বেশ কয়েকবার শুনেছে। তবে এ ব্যাপারে কিছুই সে জানে না। চিকিৎসকই ওকে অ্যালার্জির ব্যাপারে বিশদে বুঝিয়ে বললেন। (Allergies in Babies & Toddlers: Types, Diagnosis, Home Remedies)

 

অ্যালার্জি কাকে বলে? (What Is Allergy?): আমাদের আশেপাশে ছড়িয়ে থাকা খুব সাধারণ কিছু পদার্থ থেকেই অ্যালার্জির সমস্যা তৈরি হয়। সাধারণভাবে এই পদার্থগুলো মোটেই ক্ষতিকর নয়। তবে কারও কারও ক্ষেত্রে এগুলোই প্রচণ্ড সমস্যার সৃষ্টি করে।

একেক জনের একেক রকম পদার্থে অ্যালার্জি থাকে। অ্যালার্জির ক্ষেত্রে শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কোনও বিশেষ পদার্থের বিরুদ্ধে অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকে। চিকিৎসকের কথায়, ওই নির্দিষ্ট পদার্থটির বিরুদ্ধে শরীর স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি রক্ষণশীল হয়ে পড়ে। এমন কিছু পদার্থ রয়েছে যা থেকে অনেকেরই অ্যালার্জি হয়। যেমন, ধুলোবালি, ফুলের রেণু, পশুর লোম, বিশেষ কোনও খাবার যেমন ডিম, চিংড়ি, বেগুন ইত্যাদি। বিশেষজ্ঞদের কথায়, কিছু কিছু ওষুধ থেকেও অনেকের অ্যালার্জির সমস্যা দেখা দেয়।

অ্যালার্জেন (Allergen): ওই নির্দিষ্ট পদার্থে থাকা যে বিশেষ উপাদানটি থেকে খুদের শরীরে অ্যালার্জির সমস্যা দেখা দেয়, তাকে চিকিৎসশাস্ত্রে অ্যালার্জেন বলা হয়। অ্যালার্জেন আসলে এক প্রকৃতির অ্যান্টিজেন যা খুদের শরীরে ঢুকে ওর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে নষ্ট করে দেয়। এর কারণেই রোগপ্রতিরোধ শক্তি স্বাভাবিক আচরণ করে না।

 

অ্যালার্জি নির্দিষ্ট কোনও পদার্থ হয় না, তাই নানারকম পদার্থ থেকেই অ্যালার্জি হওয়া সম্ভব। বিশেষজ্ঞরা প্রকৃতি অনুযায়ী অ্যালার্জিকে তিন-চারটি ভাগে ভাগ করেন।

#1. খাবার থেকে অ্যালার্জি (Food Allergy): ছোট্ট খুদে মাত্র কয়েক মাস হল শক্ত খাবার খাওয়া শুরু করেছে।‌ তাই খাবার থেকে ছোট্ট সোনার অ্যালার্জি হওয়া স্বাভাবিক। এটা আগে থেকে বোঝার উপায়ও থাকে না। মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের অ্যালার্জি সাধারণত বেশি হয় বলে অনেকে মনে করেন। ডিম, গোরুর দুধ, বাদাম, আটা, মাছ যেমন চিংড়ি ইত্যাদি খাবার থেকে অনেক খুদেরই অ্যালার্জির সমস্যা হয়। (Food Allergies in Children)

#2. পোষ্য থেকে অ্যালার্জি (Pet Allergy): পোষ্যের লোম থেকে এই অ্যালার্জি ছড়ায়। পোষ্যের লোম কোনও কারণে খুদের নাকেমুখে ঢুকে গেলে তা থেকে ওর অ্যালার্জি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। এজন্যই চিকিৎসক পরামর্শ দেন, ছোট্ট সোনা একটু বড় না-হওয়া পর্যন্ত ওকে পোষ্যের সঙ্গে খেলতে দেওয়া উচিত নয়।

#3. পোকামাকড় থেকে অ্যালার্জি (Allergy From Insects): পোকামাকড়ের কামড় বা সংস্পর্শ থেকে খুদের অ্যালার্জির সমস্যা হতে পারে।‌ একেক জন মানুষের একেকটি পোকামাকড়ে অ্যালার্জি থাকে। পোকার রোঁয়া থেকেও একইভাবে অ্যালার্জি ছড়ায়। সাধারণত শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাই ছোটখাটো পোকার কামড় থেকে আমাদের রক্ষা করে। তবে এক্ষেত্রে রোগপ্রতিরোধ শক্তি অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করে। অনেক ক্ষেত্রে তা ঠিক মতো কাজও করে না। ফলে জীবনসংশয়ের মতো ঘটনাও ঘটে।

#4. উদ্ভিদ থেকে অ্যালার্জি (Allergy From Trees): গাছের বিভিন্ন অংশ যেমন পাতা ,ফুলের রেণু ইত্যাদিতে অনেকেরই অ্যালার্জির সমস্যা দেখা দেয়। উদ্ভিদ থেকে যে অ্যালার্জি হয়, তার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ফুলের রেণুই এর কারণ। হালকা ও সহজে বাতাসে ভেসে বেড়ায় এমন রেণু থেকেই খুদের অ্যালার্জি হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে।

 

আরও পড়ুন : জন্মের ১ সপ্তাহের মধ্যেই জন্ডিসে আক্রান্ত হতে পারে সদ্যোজাত শিশু; জেনে নিন কারণ ও প্রতিকার!

#5. ধুলোবালি থেকে অ্যালার্জি (Dust Allergy): খুদের ধুলোবালিতে অ্যালার্জি হওয়া স্বাভাবিক ঘটনা।‌ ধুলোর সূক্ষ্ম কণা ওর শ্বাসের মাধ্যমে শরীরের ভিতরে যায়। এই অ্যালার্জি থেকে খুদের ফুসফুসেও সমস্যা দেখা দিতে পারে।

 

প্রকৃতি অনুযায়ী অ্যালার্জির নানা ভাগ থাকলেও কিছু নির্দিষ্ট লক্ষণ সব ক্ষেত্রেই থাকে। চিকিৎসকরা এই লক্ষণগুলো থেকেই বুঝতে পারেন রোগীর অ্যালার্জি হয়েছে কি না (Baby Allergies: Symptoms)।

  • হাঁচি: অ্যালার্জির অন্যতম সাধারণ লক্ষণ হল হাঁচি। অ্যালার্জেন শরীরে ঢোকার কিছুক্ষণের মধ্যেই এই লক্ষণ দেখা দেয়। এই হাঁচি অনবরত চলতেই থাকে ও সহজে থামে না।
    নাক থেকে জল পড়া বা নাক বন্ধ হয়ে যাওয়া: অ্যালার্জেন ছোট্ট শরীরে প্রবেশ করার কিছুক্ষণের মধ্যেই ওর নাক থেকে জল পড়ার লক্ষণ দেখা যায় (Baby Seosonal Allergies)। তাছাড়াও সর্দি জমে নাক বন্ধ হয়ে যেতে পারে ছোট্ট খুদের।
  • র‍্যাশ হওয়া: অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়ায় খুদের কোমল ত্বক ভরে যেতে পারে র‍্যাশে (Baby Allergies Rash)।‌ এই র‍্যাশ শরীরের কোনও নির্দিষ্ট জায়গায় হয় না। বরং শরীরের যে কোনও অংশেই হতে পারে।
    হাত, পা মুখ ফুলে যাওয়া: অ্যালার্জেন শরীরের প্রবেশ করার পর রোগপ্রতিরোধ শক্তির অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। এর অন্যতম লক্ষণ হাত পা মুখ ফুলে যাওয়া। এতে ছোট্ট সোনার ত্বকের নানা অংশ গোল গোল চাকতি আকারে ফুলে উঠতে পারে।
  • শ্বাসকষ্ট: বিশেষজ্ঞদের কথায়, নিঃশ্বাসের মাধ্যমে অ্যালার্জেন খুদের শরীরে গেলে প্রথমেই ওর ফুসফুস আক্রান্ত হয়। এর প্রভাবে ছোট্ট সোনার প্রচন্ড শ্বাসকষ্টের সমস্যা দেখা দিতে পারে (Baby Nasal Allergies)।
  • ডায়রিয়া: কোনও বিশেষ খাবার থেকে অ্যালার্জি হলে খুদের ওর খাদ্যতন্ত্রে থাকা ব্যাকটেরিয়া ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এর থেকে ছোট্ট সোনার ডায়রিয়ার সমস্যা দেখা দিতে পারে।
  • বমি: খাবারের মাধ্যমে ছোট্ট সোনার শরীরে অ্যালার্জেন প্রবেশ করলে প্রথমেই তা ওর অপরিণত খাদ্যতন্ত্রের ক্ষতি করে। এর ফলে বমির লক্ষণ দেখা দিতে পারে। অল্প সময়ের ব্যবধানে বমি হতে থাকে এ ক্ষেত্রে।
  • খিঁচুনি: কিছু নির্দিষ্ট অ্যালার্জির ফলে খুদের খিঁচুনির লক্ষণও দেখা দিতে পারে। খুদের রোগপ্রতিরোধ শক্তি মোটেই একজন পরিণত মানুষের মতো হয় না। তাই অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়ার ফলে সহজেই ছোট্ট খুদে দুর্বল হয়ে পড়ে।
  • ঝিমুনি: বিশেষ কিছু পদার্থের ফলে হওয়া অ্যালার্জির প্রভাব যথেষ্ট বেশি হয়। অনেক সময় দেখা যায়, অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়া খুদের মস্তিষ্কেও প্রভাব ফেলছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এর থেকে খুদের ঝিমুনি ভাব আসতে পারে।

অ্যালার্জির লক্ষণগুলো শোনার পর রিনিতা জিজ্ঞেস করল, অ্যালার্জি থেকে খুদেকে সুরক্ষিত রাখার কোনও ঘরোয়া উপায় কি রয়েছে? চিকিৎসক তখন বেশ কয়েকটি ঘরোয়া সমাধানের কথা জানালেন (Natural Remedies for Children’s Allergies)।

  • ডাস্ট অ্যালার্জি হলে: এক্ষেত্রে সবচেয়ে পরিচিত উপায় হল খুদের নাকমুখ মাস্ক দিয়ে ঢেকে রাখা। মাস্কের সাহায্যে খুব সহজেই ধুলোবালি, ফুলের রেণু বা পোষ্যের লোম ইত্যাদি পদার্থগুলো খুব সহজেই এড়িয়ে চলা যায়। (Baby Allergies: Prevention & Treatment Tips)
  • ত্বকে অ্যালার্জি হলে: ত্বকে জ্বলুনি, চুলকানির অনুভূতি থাকলে কাজে আসতে পারে অ্যালোভেরা জেল। ফুসকুড়ি, র‍্যাশের মতো হলে ঠান্ডা জলে নরম কাপড় ভিজিয়ে জায়গাটি ঢেকে রাখুন। আরাম হবে বাচ্চার। স্নানের জলে বেকিং সোডা বা ওটমিল দিলেও নিরাময় হয় অনেক সময়। (Treating Skin Allergy Symptoms in Kids)
  • হাঁচি-কাশি হলে: গরম জলের ভাপ নেওয়াটা এসময়ে সবচেয়ে উপকারী হতে পারে। তবে সেটা একমাত্র একটু বড় বাচ্চার জন্য প্রযোজ্য।
  • পেট-খারাপ-পেটে ব্যথা হলে: কাঁচাকলা সেদ্ধ, অ্যাপেলসস, ভাত-টোস্ট এসব খাওয়ালে পেট ধরে আসে অনেকের। তবে সেই সাথে বাচ্চাকে অনেক পরিমাণ জলটাও খাওয়াতে হবে মনে করে।
  • অ্যালার্জি গুরুতর হলে: অনেক সময় অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া খুবই গুরুতর হয়ে ওঠে। তখন দেরি না-করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। এসব ক্ষেত্রে ঘরোয়া উপায় সাধারণত কার্যকরী হয় না।

চিকিৎসক গুবলাইয়ের অবস্থা দেখা বুঝতে পারেন অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়া ধীরে ধীরে কমে আসছে। তাই তিনি ওকে কোনও ওষুধ দেননি। চিকিৎসকের অনুমান মতো কিছুক্ষণের মধ্যেই গুবলাই ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে যায়। তবে রিনিতা চিকিৎসকের পরামর্শ মতো একটা ডায়েরি রাখাও শুরু করে। একই সঙ্গে গুবলাইয়ের জন্য মাস্ক কিনে নেয়।‌ এরপর থেকে বেরোনোর সময় মাস্ক ছিল মাস্ট। (Allergies in Babies & Toddlers Types, Diagnosis, Home Remedies)

 

আরও পড়ুন: ইউরিন ইনফেকশন হতে পারে ছোট্ট বাচ্চারও; আরাম দিতে কিছু ঘরোয়া পথ্য

 

একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার  হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

null

null